১৭০তম অধ্যায়
সঙ্কুলযুদ্ধে কৌরবপরাজয়
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! ঐ সময় মহাবল সুবলনন্দন নকুলকে সৈন্যসংহারে প্রবৃত্ত দেখিয়া তাঁহার সমীপে গমনপূর্ব্বক ‘থাক থাক’ বলিয়া আস্ফালন করিতে লাগিলেন। তখন সেই বদ্ধবৈর মহাবীরদ্বয় পরস্পরকে সংহার করিবার মানসে শরাসন আকর্ণ আকর্ষণপূর্ব্বক পরস্পরের প্রতি অনবরত শরনিকর বর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলেন। মহাবীর নকুল যেরূপ শরপ্রয়োগ করিলেন, শকুনিও স্বীয় শিক্ষাবল প্রদর্শনপূর্ব্বক তদ্রূপ শরজাল বিস্তার করিতে লাগিলেন। তখন সেই বীরদ্বয় শরনিকরে সমাচ্ছন্নকলেবর হইয়া কণ্টকাকীর্ণ শল্লকী ও শাল্মলী বৃক্ষদ্বয়ের ন্যায় শোভা ধারণ করিলেন। তাঁহাদের বর্ম্ম শরনিকরে ছিন্নভিন্ন ও কলেবর রুধিরধারায় সমাকুল হওয়াতে তাঁহাদিগকে বিচিত্র কল্পবৃক্ষ ও বিকশিত কিংশুকপাদপদ্বয়ের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। তৎপরে তাঁহারা লোচনযুগল বিস্তারপূর্ব্বক রোষানলে পরস্পরকে দগ্ধ করিয়াই যেন কুটিলভাবে পরস্পরের প্রতি দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন।
“অনন্তর মহাবীর সুবলতনয় একান্ত ক্রোধাবিষ্ট হইয়া হাস্যমুখে নিশিতকর্ণিদ্বারা নকুলের হৃদয় বিদ্ধ করিলেন। মহাবীর নকুল তন্নিক্ষিপ্ত কর্ণি-অস্ত্রে গাঢ়তর বিদ্ধ হইয়া রথমধ্যে বিষন্ন ও মোহাবিষ্ট হইলেন। শকুনি সেই প্রবল বৈরী নকুলকে তদবস্থ অবলোকন করিয়া বর্ষাকালীন জলদের ন্যায় গভীর গর্জ্জন করিতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে মাদ্ৰীতনয় সংজ্ঞালাভপুর্ব্বক ব্যাদিতবদন কৃতান্তের ন্যায় পুনরায় শকুনির প্রতি ধাবমান হইলেন এবং ক্রোধভরে তাঁহাকে ষষ্টিশরে বিদ্ধ করিয়া শতনারাচে তাঁহার বক্ষঃস্থল ভেদ করিলেন; তৎপরে তাঁহার সশর শরাসনের মুষ্টিদেশ দুইখণ্ডে ছেদনপূর্ব্বক সত্বর ধ্বজদণ্ড খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলেন; অনন্তর পীত নিশিত একমাত্র শরে তাঁহার উরুদ্বয় ভেদ করিয়া সপক্ষ শ্যেনের ন্যায় তাঁহাকে তৎক্ষণাৎ রথমধ্যে নিপাতিত করিলেন। তখন সুবলতনয় নকুলনিক্ষিপ্ত শরে গাঢ়তর বিদ্ধ হইয়া, নায়ক যেমন কামিনীকে আলিঙ্গন করে, তদ্রূপ ধ্বজষষ্ঠি আলিঙ্গণপূর্ব্বক রথমধ্যে অবস্থান করিতে লাগিলেন। তাঁহার সারথি তাঁহাকে সংজ্ঞাহীন ও রথমধ্যে নিপতিত নিরীক্ষণ করিয়া সেনামুখ হইতে অবিলম্বে অপসারিত করিল। তদ্দর্শনে অনুচরগণসমবেত পাণ্ডবেরা পরমাহ্লাদে চীৎকার করিতে লাগিলেন।
“হে মহারাজ! মহাবীর নকুল এইরূপে শকুনিকে পরাজিত করিয়া সারথিকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে সূত! তুমি এক্ষণে আমাকে দ্রোণসৈন্যাভিমুখে সমানীত কর।’ সারথি তাঁহার আজ্ঞাপ্রাপ্ত হইবামাত্র দ্রোণাভিমুখে অশ্বচালন করিতে লাগিল। এদিকে কৃপাচার্য্য মহাবল শিখণ্ডীকে দ্রোণাভিমুখে আগমন করিতে দেখিয়া পরমযত্নসহকারে মহাবেগে যুদ্ধার্থ তাহার সম্মুখীন হইলেন। শিখণ্ডী কৃপকে দ্রোণের সাহায্যার্থ-দ্রুতবেগে আগমন করিতে দেখিয়া হাস্যমুখে নয়বাণে তাঁহাকে বিদ্ধ করিলেন। তখন আপনার পুত্রগণের প্রিয়কারী কৃপাচার্য্য শিখণ্ডীকে প্রথমতঃ পাঁচশরে বিদ্ধ করিয়া পুনরায় বিংশতিশরে বিদ্ধ করিলেন। পূর্ব্বে শম্বরাসুর ও সুররাজ ইন্দ্রের যেরূপ যুদ্ধ হইয়াছিল, এক্ষণে সেই বীরদ্বয়ের তদ্রূপ ঘোরতর যুদ্ধ হইতে লাগিল। তাঁহারা বর্ষাকালীন জলদের ন্যায় নভোমণ্ডল শরবৃষ্টিদ্বারা সমাচ্ছন্ন করিয়া ফেলিলেন। হে মহারাজ! তখন সেই যুদ্ধ পূর্ব্বাপেক্ষা অধিকতর ভয়ানক হইয়া উঠিল। যোদ্ধাদিগের সেই ভয়জনক ঘোররজনী কালরাত্রির ন্যায় বোধ হইতে লাগিল।
“অনন্তর মহাবীর শিখণ্ডী অর্দ্ধচন্দ্রবাণে কৃপাচার্য্যের শরাসন ছেদন করিয়া শণিত শর বিস্তার করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। তখন কৃপাচার্য্য ক্রোধাবিষ্ট হইয়া তাঁহার প্রতি রুদণ্ড, অকুণ্ঠিতা, কর্ম্মারপরিমার্জিত এক ভয়ঙ্কর শক্তি নিক্ষেপ করিলেন। মহাবীর শিখণ্ডী সেই আচার্য্যনিক্ষিপ্ত শক্তি আগমন করিতে দেখিয়া দশশরে খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। তখন কৃপাচাৰ্য্য সত্বর অন্য শরাসন গ্রহণ করিয়া শাণিত শরনিকর বর্ষণপূর্ব্বক শিখণ্ডীকে সমাচ্ছন্ন করিলেন। শিখণ্ডী সেই আচার্য্যনির্মুক্ত শরজালপ্রভাবে অবসন্ন হইয়া রথমধ্যে অবস্থান করিতে লাগিলেন। মহাবীর কৃপাচার্য্য তাঁহাকে অবসন্ন নিরীক্ষণ করিয়া তাঁহার বিনাশবাসনায় অনবরত শরবৃষ্টি করিতে লাগিলেন। পাঞ্চাল ও সোমকগণ দ্রুপদতনয়কে একান্ত অবসন্ন ও সমরে বিমুখ অবলোকন করিয়া সাহায্যার্থ তাঁহাকে পরিবেষ্টন করিলেন। তখন আপনার আত্মজগণও বহুল বলসমভিব্যাহারে কৃপাচার্য্যকে বেষ্টন করিতে লাগিলেন। অনন্তর উভয়পক্ষে পুনরায় ঘোরতর সংগ্রাম আরম্ভ হইল। পরস্পর সম্মুখীন রথীগণের মেঘগর্জ্জনসদৃশ তুমুল শব্দ হইতে লাগিল। অশ্বারোহী ও গজারোহিগণ পরস্পরের বিনাশে প্রবৃত্ত হওয়াতে সংগ্রামস্থল অতি দারুণ হইয়া উঠিল। ধাবমান পদাতিগণের পদশব্দে মেদিনী ভয়কম্পিত কামিনীর ন্যায় কম্পিত হইতে লাগিল। যেমন বায়সেরা শলভসমুদয় আক্রমণ করে, তদ্রূপ দ্রুতগামী রখে সমারূঢ় রথীগণ রথীদিগকে, মত্তমাতঙ্গগণ মাতঙ্গদিগকে, রোষিত অশ্বারোহিগণ অশ্বারোহিদিগকে ও পদাতিগণ পদাতিদিগকে আক্রমণ করিতে আরম্ভ করিল। সেই রাত্রিযোগে সৈন্যগণের মহাবেগে গমন, পলায়ন ও প্রত্যাগমননিবন্ধন সমরাঙ্গনে তুমুল শব্দ সমুত্থিত হইল। রথ, হস্তী ও অশ্বগণের উপরিস্থিত প্রদীপসকল অম্বরস্থলিত মহোল্কাসমুদয়ের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। সেই অন্ধতমসাবৃত রজনী প্রদীপপ্রভাবে প্রদীপ্ত হইয়া দিবসের ন্যায় শোভমান হইল। দিবাকর যেমন জগদ্ব্যাপ্ত গাঢ় তিমির বিনষ্ট করিয়া থাকেন, তদ্রূপ সেই প্রজ্বলিত প্রদীপসকল সমরভূমির ঘোরান্ধকার নিরাকৃত করিয়া ভূমণ্ডল ও দিঙ্মণ্ডল আলোকময় করিল। সেই আলোকপ্রভাবে বীরগণের শস্ত্র, বৰ্ম ও মণিসমুদয়ের প্রভাজাল তিরোহিত হইল। হে মহারাজ! সেই ঘোরতর যুদ্ধে যোধগণ আত্মপরিজ্ঞানবিমূঢ় হইতে লাগিলেন। তখন মোহবশতঃ পিতা পুত্রকে, পুত্র পিতাকে, মিত্র মিত্রকে, মাতুল ভাগিনেয়কে, ভাগিনেয় মাতুলকে এবং আত্মীয় আত্মীয়গণকে বিনাশ করাতে সংগ্রাম শৃঙ্খলাশূন্য ও ভীরুগণের ভয়াবহ হইয়া উঠিল।”