১৬.
পরেরদিন সকালে।
চায়ের কাপ হাতে করে সুব্রত গতরাত্রের কথাটাই ভাবছিল।
একটা নির্দিষ্ট পথ ধরে সে এ কদিন এগুচ্ছিল, কিন্তু কাল রাত্রে অতর্কিতে ভবেন্দ্রর সঙ্গে নাটকীয়ভাবে সাক্ষাৎ হয়ে যাবার পর সুব্রতর যেন কেন মনে হচ্ছে মহেন্দ্রনাথের হত্যার ব্যাপারটার মীমাংসায় পৌঁছবার জন্য ঘটনাগুলোকে যেভাবে মনে মনে সে এ কদিন ধরে সাজিয়ে নিচ্ছিল হঠাৎ যেন সে সব কিছু এলোমেলো হয়ে গিয়েছে।
মনে হচ্ছে, আবার বুঝি প্রথম থেকে ভাবতে হবে—নতুন করে শুরু করতে হবে।
একটা সিগারেট ধরালো সুব্রত।
কিন্তু কোথা থেকে কি ভাবে শুরু করা যায়?
হঠাৎ মনে পড়ল কিরীটীকে।
কিরীটীর পরামর্শ নিলে কেমন হয়? কথাটা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সুব্রত উঠে পড়ল। গায়ে জামা দিয়ে বের হয়ে পড়ল।
কিরীটীর ওখানে গিয়ে যখন পৌঁছল, কিরীটী তখন সবে প্রথম কাপ চা শেষ করে দ্বিতীয় কাপটা হাতে তুলেছে।
সামনে বসে কৃষ্ণা।
দিন দুই হল কিরীটীর ইনফ্লুয়েঞ্জা মত হয়েছে, কালও জ্বর ছিল, আর জ্বর নেই।
সুব্রতকে ঘরে ঢুকতে দেখ কিরীটী তার মুখের দিকে তাকাল।
সুব্রত এসে একটা সোফায় বসল নিঃশব্দে।
কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করে, চা দেবো?
দাও। মৃদুকণ্ঠে সুব্রত বলে।
কি রে, একটু যেন চিন্তিত মনে হচ্ছে! কিরীটী এইবার প্রশ্ন করে সুব্রতকে।
কৃষ্ণা চায়ের কাপটা এগিয়ে দিতে দিতে বলে, কদিন আসনি যে?
সে-কথার জবাব না দিয়ে সুব্রত মৃদুকণ্ঠে ডাকে কিরীটী—
উঁ!
একটা মার্ডার কেস নিয়ে গত কদিন ধরে হিমসিম খেয়ে আছি ভাই।
গত দশদিনের মধ্যে কই মনে তো পড়ে না, সংবাদপত্রে একটিমাত্র বিশেষ মৃত্যুর ব্যাপার ছাড়া আর কোন দুর্ঘটনার কথা পড়েছি! কিরীটী বলে।
না না রে, দুর্ঘটনার নয়-রীতিমত একটা মার্ডার কেস—
মার্ডার কেস?
হ্যাঁ।
কবে ঘটল?
গত ২৩ শে ডিসেম্বর শনিবার রাত্রে
তুই কি সেই আগড়পাড়ার রেল স্টেশনের কাছে কে একজন ধনী বিজনেসম্যান–
হ্যাঁ, আমি মহেন্দ্রনাথ রায়ের হত্যার কথাই বলছি।
কিরীটী চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলে, আমিও সংবাদপত্রে পড়েছি। পড়ে মনে হচ্ছিল সামথিং মিস্টিরিয়াস-তারপর শুনলাম আই জি-র কাছে ময়নাতদন্তে মৃতের মাথার মধ্যে নাকি বুলেট পাওয়া গিয়েছে!
হ্যাঁ, সমস্ত ব্যাপারটা শুনলে হয়ত তুই বুঝতে পারবি-হাউ ব্রট্যালি হি ওয়াজ মার্ডার্ড। মনে হচ্ছে অর্থের জন্যই লোকটিকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে।
সুব্রত একটানা কথাগুলো বলে যায়।
তোর ধারণা তাহলে ভদ্রলোককে সত্যি-সত্যিই নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে?
অন্তত আমার তো তাই ধারণা। ঘটনাটা তোকে খুলে বলি শোন। সব আগাগোড়া শুনলে হয়ত তুই বুঝতে পারবি।
সুব্রত অতঃপর সমস্ত ঘটনাটা গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত বলে যায়।
পাইপটায় অগ্নিসংযোগ করে পাইপটা টানতে টানতে কিরীটী আদ্যোপান্ত সমস্ত ঘটনাটা শুনে যায়।
সমস্ত কাহিনী শোনার পর কিরীটী কিছুক্ষণ চুপ করে যেন কি ভাবে।
তারপর মৃদুকণ্ঠে কেবল একটা শব্দই উচ্চারণ করে, হুঁ।
কিন্তু আরও কিছু যে ঘটনার মধ্যে ঈঙ্গিত দিচ্ছে ভায়া। কিরীটী আবার বলে একটু থেমে।
ইঙ্গিত? আরও কিছুর?
হুঁ।
কীসের ইঙ্গিত?
পঞ্চশরের ব্যাপার!
সে আবার কি?
কিরীটী মৃদু কণ্ঠে এবার বলে, ঐ কুন্তলা দেবী!
কুন্তলা দেবী?
হুঁ, তোর মনে যে ভাবে রেখাপাত করেছেন ভদ্রমহিলা—
রাবিশ! সুব্রত বলে ওঠে।
রাবিশ নয় বন্ধু—নামের দিকে তাকিয়ে দেখ ঐ রাবিশের তলাতেই মনিরত্ন লুকিয়ে আছে—
দেখ, তোর কাছে কোথায় এলাম একটা পরামর্শ নিতে, না তুই ইয়ার্কি শুরু করে দিলি-সুব্রতর কণ্ঠে একটা উষ্মর আভাস ফুটে ওঠে যেন।
কণ্ঠের তোর ঐ উম্মার সুর কিন্তু বন্ধু অন্য রাগ প্রকাশ করছে!
কৃষ্ণা হেসে ওঠে।
হাসছ কি, কিরীটী বলে স্ত্রীর দিকে চেয়ে, বরণডালা সাজাও! না সুব্রত, যাত্রা তোর এবারে সত্যি মাহেন্দ্ৰ ক্ষণেই হয়েছে মহেন্দ্রভবনে বলতেই হবে।
তাহলে তুই ইয়ার্কি কর, আমি চলি।
সুব্রত উঠে দাঁড়ায়।
আরে বোস্—আমিও তোর সঙ্গে একমত।
একমত।
হ্যাঁ, ভদ্রলোককে সত্যিসত্যিই গুলি করে হত্যা করে ব্যাপারটাকে একটা অ্যাক্সিডেন্টের রূপ দেবার চেষ্টা করা হয়েছে।
তুইও তাহলে তাই মনে করিস?
হ্যাঁ, তবে কতকগুলো, জিনিস তুমি এড়িয়ে গিয়েছ বন্ধু।
এড়িয়ে গিয়েছি?
হ্যাঁ।
কি?
প্রথম অর্থাৎ ১নং, ডাঃ নলিনী চৌধুরীর দুই বন্ধুকে লেখা ব্যাঙ্কে ডিপোজিট দেওয়া চিঠি দুটো।
কিন্তু–
ত্রিকোণাকার সেই পৃথক দুখণ্ড কাগজকে একত্রে জোড়া দাও, হয়ত কোন রহস্যের হদিস পাবে। তারপর ২নং–
কি?
একটি টাপরাইটিং –
ইপরাইটিং মেশিন।
হ্যাঁ, এই হত্যার ব্যাপারে বিশেষ ক্লু ঐ মেশিনটি, যেহেতু চিঠিটা টাইপ করা ছিল। তারপর ৩নং রিভালভারটি—সেটারও প্রয়োজন।
সেটা—
পেতে হবে। আর ঐ সঙ্গে ৪নং সুরেন্দ্রনাথের এই কদিনের মুভমেন্ট!
আর কিছু?
হ্যাঁ। ৫নং, ডাঃ চৌধুরীর কোন উইল ছিল কিনা।
আচ্ছা ঐ মিঃ গাঙ্গুলী সম্পর্কে তোর কি মনে হয় কিরীটী?
না, সে ভদ্রলোক খুন করেন নি—নির্দোষ।
আমারও তাই মনে হয়।
তবে—
কি?
গাঙ্গুলী সাহেবের উপর যে কোনও মুহূর্তে অতর্কিতে আঘাত আসাটা খুব একটা কিছু বিচিত্র নয় কিন্তু–
কেন?
তার কারণ ডাঃ চৌধুরীর চিঠির অর্ধেক তার নামে ছিল। ভাল কথা, ডাঃ চৌধুরীর সে চিঠির অংশটা মানে মিঃ গাঙ্গুলীর অংশটা তো তারই কাছে আছে, তাই না? কিরীটী কথাটা বলে সুব্রতর মুখের দিকে তাকায়।
হ্যাঁ। সঙ্গে দুটোর কপিই আছে-এই যে।
মিঃ গাঙ্গুলীর চিঠিটা ও মিঃ রায়ের চিঠির নকল যেটা মিঃ গাঙ্গুলীর কাছে পেয়েছিল সুব্রত দুটোই পকেট থেকে বের করে কিরীটীকে দেয়।
দেখি! কিরীটী কাগজ দুটো হাতে নিল।
দেখতে থাকে। তারপর নিঃশব্দে গম্ভীর মনোযোগের সঙ্গে কাগজ দুটো সামনে টেবিলের উপরে মেলে ধরে।
সুব্রত কিরীটীকে প্রশ্ন করে, কিছু বুঝতে পারছিস?
আপাতত পারছি না বটে, তবে–
তবে? এটা একেবারে অর্থহীন নয়। কিছুর ইঙ্গিতই দিচ্ছে যেন মনে হয়। আমাকে একটা দিন ভাবতে দে সুব্রত, কাল সন্ধ্যায় বরং আসিস একবার।
বেশ, আমি তাহলে এখন উঠি।
আয়। তবে যে পয়েন্টগুলো বললাম মনে রাখিস।
সুব্রত কোন কথা না বলে নিঃশব্দে মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
সুব্রতর গমনপথের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে মৃদুকণ্ঠে কিরীটী আবৃত্তি করে, পঞ্চশরে দগ্ধ করে করেছ একি সন্ন্যাসী–বিশ্বময় দিয়েছ তারে ছড়ায়ে—
.
হঠাৎ সেদিন বিকেলের দিকে অসময়ে আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামল। সেই সঙ্গে ঝড়ো হাওয়ার শনশনানি।
সুব্রত আর কোথাও বের হল না।
তাড়াতাড়ি আহার শেষ করে শয্যায় আশ্রয় নেয়। এবং ঘুমিয়ে পড়ে।
ঘুমটা ভেঙে গেল রাত বারোটা নাগাদ ক্রমাগত টেলিফোনের শব্দে।
ক্রিং ক্রিং—ক্রিং।
আঃ! বিরক্ত হয়ে সুব্রত লেপের তলা থেকে উঠে গিয়ে ফোন ধরে।
হ্যালো—
কে, মিঃ রায়? আমি মৃণাল সেন কথা বলছি।
কি ব্যাপার!
কিছুক্ষণ আগে আগরপাড়া থানা থেকে চ্যাটার্জী ফোন করেছে। মিঃ গাঙ্গুলীর সলিটারি কর্নারের উপরে যাকে ওয়াচ রাখতে বলা হয়েছিল সে খবর দিয়েছে চ্যাটার্জীকে–গাঙ্গুলী নাকি আত্মহত্যা করেছে।
সে কি!
হ্যাঁ। আমি যাব। আপনি যাবেন?
নিশ্চয়ই, আপনি আমায় তুলে নিয়ে যেতে পারবেন?
পারি।
তাহলে আসুন—আমি রেডি হয়ে নিচ্ছি।
তাহলে কিরীটীর গতকালের ভবিষ্যৎবাণী ফলে গেল!
ফোনটা রেখে দিল সুব্রত। বাইর তখনও বৃষ্টি ঝরছে। সুব্রতর মনে পড়ে ঐদিনের আগের দিন সন্ধ্যারাত্রের কিরীটীর কথাগুলো। কিরীটী বলছিল গাঙ্গুলী সাহেবের উপরেও যে কোন মুহূর্তে আঘাত আসাটা কিছু বিচিত্র নয়। কিন্তু! কথাটা যে সুব্রতর একেবারে মনে হয়নি তা নয়।
কিন্তু সেটা এত তাড়াতাড়ি ফলে গেল! তবে কি সত্যিসত্যিই ঐ চিঠির অঙ্কগুলোর মধ্যে কিছু আছে? এবং গাঙ্গুলী আত্মহত্যা করেনি, নিহত হয়েছে?
মিনিট পনেরোর মধ্যেই মৃণাল সেন পুলিস ভ্যান নিয়ে এসে গেল।
বাইরে তখনও সমানে ঝড়বৃষ্টির তাণ্ডব চলেছে। শিগগির কমবার কোন সম্ভাবনাই নেই। ওদের গাড়ি খালি রাস্তা ধরে বৃষ্টির মধ্যেই যথাসম্ভব স্পিডে আগরপাড়ার দিকে ছুটে চলে।
চলন্ত গাড়িতে বসেই একসময় মৃণাল সেনকে সুব্রত প্রশ্ন করে, কি ব্যাপার? চ্যাটার্জী। ফোনে আপনাকে কি বলেছেন?
সুব্রত প্রশ্নটা করে মৃণাল সেনের মুখের দিকে তাকাল।
মৃণাল সেনকে ফোনে যা জানিয়েছিলেন জলধর চাটুজ্যে–সংক্ষেপে সুব্রতকে সব কথা জানায় সে।
.
১৭.
সন্ধ্যা থেকে আগরপাড়াতেও জলঝড় শুরু হয়।
বিকালের দিকে একবার গাঙ্গুলীর পান্থনিবাসে গিয়েছিলেন, বোধ হয় কফি পান। করতে এবং জলঝড়ের সম্ভাবনা দেখে তাড়াতাড়ি ফিরে আসেন সলিটারিী কর্নারে কিছুক্ষণের মধ্যেই।
তার পরই ঝড়-বৃষ্টি শুরু।
রাজেশ বলে যে ছেলেটি ওয়াচ করছিল বাড়িটা-ঝড়বৃষ্টির জন্য তাড়াতাড়ি গিয়ে পান্থনিবাসে আশ্রয় নেয়। ঘণ্টা দুই পরে ঝড়বৃষ্টি একটু কমে। তখন সে আবার পান্থনিবাস থেকে বের হয়ে সলিটারি কর্নারের দিকে যায়।
বৃষ্টি তখন টিপ টিপ পড়ছে। বাড়ির কাছে গিয়ে দেখে বাড়িটা অন্ধকার।
প্রথমে রাজেশ ভেবেছিল, ঝড়-বৃষ্টির জন্যে বোধ হয় তাড়াতাড়ি মিঃ গাঙ্গুলী খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়েছেন।
কিন্তু তারপরই হঠাৎ নজরে পড়ে, বাড়ির সদর দরজাটা হা-হা করছে খোলা। হাওয়ায় খুলছে আর শব্দ করে বন্ধ হচ্ছে। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক এবং রাজেশকে যেন কেমন সন্দিগ্ধ করে তোলে।
সে এগিয়ে যায় খোলা দরজা দিয়ে, ভিতরে গিয়ে ঢোকে। কিন্তু বাড়ির মধ্যে ঢোকবার পর সেখানেও দেখে অন্ধকার। কারও কোন সাড়া-শব্দ নেই—যেন একটা পরিত্যক্ত হানাবাড়ি।
অবশেষে রাজেশ টর্চের আলোর সাহায্যে মিঃ গাঙ্গুলীর ঘরে গিয়ে পা দিয়েই থমকে দাঁড়ায়।
ঘরের এক কোণে একটা রাইটিং টেবিল। তার সামনে চেয়ারে বসে গাঙ্গুলী, তাঁর মাথাটা টেবিলের উপরে ন্যস্ত। বাঁ হাতটা টেবিলের উপরে বিস্তৃত এবং ডান হাতটা অসহায়ের মত ঝুলছে। সেই হাতের মুঠোর মধ্যে ধরা একটা রিভলবার।
টেবিলের কাচের উপরে রক্ত জমাট বেঁধে আছে অনেকটা জায়গা নিয়ে। সোফাতেও কিছু গড়িয়ে পড়েছে। কপালের মাঝামাঝি একটা বেশ বড় রক্তাক্ত ক্ষতচিহ্ন।
ঘরের সব জানালাগুলো বন্ধ। পিছনের বাগানের দিককার জানালাটা খোলা। আর ঘরের দরজাটাও খোলা।
সুব্রত জিজ্ঞাসা করে, মিঃ গাঙ্গুলীর চাকরটা কোথায় ছিল ঐ সময়? সে তখন ছিল না।
ছিল না মানে?
বাইরে গিয়েছিল এবং একটু পরেই ফিরে আসে। সে নাকি দুপুরের দিকে ছুটি নিয়ে কলকাতায় তার এক জ্ঞাতি ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল।
তাহলে বাড়িতে কেউ ছিল না ঐ সময়ে একমাত্র মিঃ গাঙ্গুলী ছাড়া?
না।
তারপরই একটু হেসে মৃণাল সেন বলে, তখন যদি মিঃ গাঙ্গুলীকে আপনি অ্যারেস্ট করতে দিতেন সুব্রতবাবু, তবে হয়ত এভাবে মিঃ গাঙ্গুলী আমাদের ফাকি দিতে পারতেন না। ধরা পড়বার ভয়েই শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করলেন হয়ত ভদ্রলোক।
মিঃ সেন—সুব্রত বলে, মহেন্দ্রনাথের হত্যাকারী উনি নন।
এখনও আপনি তাই বলছেন?
হ্যাঁ।
তবে কে?
আর যেই হোক, আপাতত বলতে পারি মিঃ গাঙ্গুলী নন।
মৃণাল সেন অতঃপর চুপ করে থাকে।
.
ওরা যখন আগরপাড়া থানায় এসে পৌঁছল রাত তখন সোয়া একটা।
বৃষ্টি থেমে গিয়েছে।
তবে হাওয়া একেবারে থামেনি। হাওয়া চলেছে।
জলধর চাটুজ্যে ছিলেন না, থানার ছোটবাবু সুশীল সোম ছিলেন।
তিনি বললেন, স্যার, আপনাদের বড়বাবু সোজা সলিটারি কর্নারে চলে যেতে বলেছেন।
ওরা তখনই আবার সলিটারি কর্নারের দিকে গাড়ি ছোটায়।
ওরা যখন সলিটারি কর্নারে গিয়ে পৌঁছল, জলধর চাটুজ্যে নানাভাবে তখনও মিঃ গাঙ্গুলীর ভৃত্যকে ক্রস করছিলেন।
লোকটা জবাব দিচ্ছে আর কাঁদতে কাঁদতে চোখের জল মুছছে।
মৃণাল সেনকে দেখতে পেয়ে জলধর চাটুজ্যে বলেন, এ নিশ্চয় আমার মনে হয় মিথ্যে বলছে, সেন সাহেব। ও ঝড়জলের আগেই ফিরে এসেছে।
সুব্রত একবার লোকটার দিকে তাকিয়ে যে ঘরে মৃতদেহ ছিল সেই ঘরে গিয়ে ঢুকল।
.
সত্যিই করুণ দৃশ্য।
টেবিলের সামনেই নিচে মেঝেতে একটা বই পড়ে আছে। একটা নামকরা ইংরেজী উপন্যাস। সেই উপন্যাসের মলাটের উপরেও কয়েকটা রক্তের ফোঁটা জমাট বেঁধে আছে।
মৃণাল সেন বলে, মনে হচ্ছে ও ক্লিয়ার কেস অফ সুইসাইড। বোধ হয় পড়তে পড়তে এসময় ডিসিশন নেন, তারপরই রিভলবারটা বের করে নিজের মাথায় গুলি করেছেন।
সুব্রত মৃদুকণ্ঠে বলে, একটু যেন অস্বাভাবিক মনে হয় ব্যাপারটা মিঃ সেন!
কি?
পড়তে পড়তে হঠাৎ সুইসাইড করা। তাছাড়া সে রকম হলে বইটা মাটিতে না পড়ে হয়ত টেবিলের উপরেই থাকত!
তারপই হঠাৎ মেঝের দিকে তাকিয়ে সুব্রত বলে, সারা ঘরময় এত পোড়া কাগজ কেন বলুন তো?
সত্যিই তো ঘরময় পোড়া কাগজ!
সুব্রত তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে এদিকে ওদিকে তাকাতে তাকাতে দেখতে পেল, ঘরের কোণে কি যেন পোড়ানো হয়েছে। তার সুস্পষ্ট চিহ্নও রয়েছে।
এগিয়ে গেল সুব্রত সেদিকে।
কিছু আধপোড়া কাগজও তখনও সেখানে পড়ে আছে।
কৌতূহলভরে সুব্রত আধপোড়া কাগজগুলো তুলে নিল।
বিক্ষিপ্তভাবে চোখে পড়ল কতকগুলো অঙ্ক, সেই পোড়া কাগজের বুকে-১৫, ২১, ২০, ১৩ ইত্যাদি।
হঠাৎ মনে পড়ে সুব্রতর। অঙ্কগুলো তার পরিচিত।
ভাবতে গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে সেই চিঠি দুটোর কথা। ডাঃ চৌধুরীর লেখা দুই বন্ধুকে দুখানা চিঠি।
কিরীটী বলেছিল সেদিন একটা কথা, একেবারে অর্থহীন নয়—কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে যেন মনে হয়!
তবে কি মিঃ গাঙ্গুলী মরার আগে ঐ অঙ্কগুলো থেকে কোন কিছুর ইঙ্গিত পেয়েছিলেন?
রহস্য যেন ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।
আবার মনে হয় সুব্রতর, মৃণাল সেন যা বলেছে তাও তো হতে পারে, হয়ত মিঃ গাঙ্গুলী আত্মহত্যাই করেছেন। কিন্তু পরক্ষণেই আবার মনে হয়, আত্মহত্যাই বা হঠাৎ তিনি করতে যাবেন কেন? তিনি তো মিঃ রায়ের হত্যাকারী নন? তবে?
আরও কতকগুলো প্রশ্ন ঐ সঙ্গে মনের মধ্যে জাগে। বইটা মাটিতে কেন? পোড়া কাগজগুলো কীসের ইঙ্গিত দিচ্ছে? ঘরের দরজাটা ও সদর দরজাটা খোলা ছিল কেন? ঘরটা অন্ধকার ছিল কেন?
আরও কিছুক্ষণ পরে মৃতদেহ ময়না তদন্তের জন্যে পাঠাবার ব্যবস্থা করে এবং সলিটারি কর্নারে পুলিস প্রহরা রেখে মৃণাল ও সুব্রত ফিরে এল।
মিঃ গাঙ্গুলীর ভৃত্যকে আরেস্ট করা হল।
.
গৃহে ফিরে প্রথমেই সুব্রত কিরীটীকে ফোন করল।
কি খবর? কিরীটী শুধায়।
সলিটারি কর্নারের ব্যাপারটা সুব্রত বললে।
কি মনে হয় তোর কিরীটী, আত্মহত্যা?
না, আত্মহত্যা নয়।
আমারও তাই মনে হয়েছে। আর একটা মার্ডার!
তোর অনুমান মিথ্যা নয় বলেই মনে হয় সুব্রত।
.
পরের দিনই ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাওয়া গেল।
পুলিস সার্জেন ডাঃ মজুমদার রিপোর্ট দিয়েছেন, মৃণাল সেন রিপোর্টটা নিয়ে এসেছেন। মৃত গাঙ্গুলীর ব্রেনের মধ্যে বুলেট পাওয়া গিয়েছে।
বুলেট! সুব্রত বলে।
হ্যাঁ, দেখুন। পকেট থেকে একটা বুলেট বার করে দেয় মৃণাল সেন।
সুব্রত দেখল একই ধরনের বুলেট।
মিঃ সেন! সুব্রত ডাকে।
বলুন?
মৃণাল সেন তাকাল সুব্রতর মুখের দিকে।
মৃতদেহের হাতের মুঠোর মধ্যে ধরা যে রিভলবারটা পাওয়া গিয়েছিল সেটা কোথায়?
লালবাজারে আছে।
চলুন, সেটা নিয়ে একবার মেজর সিনহার ওখানে যাওয়া যাক।
বেশ তো, চলুন।
দুজনে উঠে পড়ে। সোজা দুজনে লালবাজারে যায়।
সেখান থেকে রিভলবারটা নিয়ে মেজর সিনহার গৃহে যায়।
.
মেজর ওদের দেখে বলেন, কি ব্যাপার? সুব্রতবাবু, উনি—
ইন্সপেক্টার মৃণাল সেন। আপনাকে আবার একটু বিরক্ত করতে এলাম।
কি ব্যাপার!
সেই বুলেটটার কথা আপনার মনে আছে, মেজর?
আছে বৈকি! রিভলবারটা ট্রেস করতে বলেছিলাম, পাওয়া গেল?
হ্যাঁ।
পাওয়া গেছে?
সুব্রত তখন রিভলবার ও দ্বিতীয় বুলেটটা বের করে মেজরের হাতে দিয়ে বলে দেখুন তো মেজর এ দুটো পরীক্ষা করে!
মেজর সিনহা প্রথমে বুলেটটা পরীক্ষা করলেন-তারপর রিভলবারটা।
হুঁ এ তো দেখছি ৩৮ ওয়েবলি রিভলবার। আর এখন বুঝতে পারছি—
কি?
কেন-কেন-হোয়াই–বুলেটটার গায়ে দাগ পড়েছিল!
কেন? রিভলবারের ব্যারেলের ভিতরটা কোন কারণে ড্যামেজড হয়েছে।
ড্যামেজড।
হ্যাঁ, মনে হয় অ্যাসিড বা ঐ জাতীয় কোন কিছুর অ্যাকশনে ড্যামেজ হয়ে গিয়েছে, তাইতেই এই রিভলবার থেকে নিক্ষিপ্ত বুলেটের গায়ে অমন খাঁজ কেটে গিয়েছে।
তার মানে, মেজর আপনি বলতে চান—দিস ইজ দি রিভলবার
হ্যাঁ, সুব্রতবাবু। আমার স্থির ধারণা, এই রিভলভার থেকেই ঐ দুটো বুলেট ছোড়া হয়েছে।
ধন্যবাদ মেজর। আমি নিশ্চিন্ত হলাম।
সুব্রত বললে। তারপর মৃণাল সেনের মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, চলুন মিঃ সেন, ওঠা যাক। মে
জরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দুজনে বাইরে এসে গাড়িতে উঠে বসে।
মিঃ সেন! সুব্রত ডাকে।
বলুন।
আপনাকে একটা কাজ করতে হবে।
কি?
আজই বেরিলিতে ভবেন্দ্র রায়ের ইউনিটে একটা জরুরি তার পাঠান। ঐ রিভলবারের নম্বরটা দিয়ে ৫৬৩৭৭৯ সুবেদার মেজর ভবেন্দ্র রায়ের যে রিভলবারটা হারিয়েছে সেটারও ঐ নম্বর কিনা এবং ভবেন্দ্ৰ ইউনিটে ফিরে গিয়েছে কিনা খবর নিন।
নিশ্চয়ই-আজই পাঠাব।
দুদিনের মধ্যেই তারের জবাব এল।
যে রিভলবারটা ভবেন্দ্রর কাছ থেকে খোয়া গিয়েছে তার নম্বর ঐ একই অর্থাৎ ৫৬৩৭৭৯ এবং ওয়েবলি ৩৮ রিভলবার।
আর জানালেন ভবেন্দ্ৰ ইউনিটে ফিরে গিয়েছে গতকালই। সে এখন ওপন অ্যারেস্ট আছে। কোর্ট অফ এনকোয়ারি শীঘ্রই বসবে।
মিঃ সেন প্রশ্ন করে, তবে কি ঐ ভবেন্দ্ৰই, সুব্রতবাবু–
কি?
তার বাপকে হত্যা করেছে?
না। সুব্রত মৃদু হাসল।
না—তবে কে?
দু-একদিনের মধ্যেই আশা করি জানতে পারবেন।
আমি তাহলে এবারে উঠি।
আসুন।
মৃণাল সেন অতঃপর বিদায় নিল।
.
সুব্রত বলেছিল, হত্যাকারী কে দু-একদিনের মধ্যেই জানা যাবে কিন্তু তার প্রয়োজন হল না।
ঐদিনই রাত্রে ঘটনাটা ঘটল। সুব্রত একাকী তার ঘরের মধ্যে বসে একটা রহস্য উপন্যাস পড়ছিল।
সন্ধ্যার সময় অনেকক্ষণ ধরে কিরীটীর সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে। অনেক আলোচনা হয়েছে।
সবশেষে কিরীটী বলেছে, অঙ্কগুলোর রহস্য বোধ হয় সভ করতে পেরেছি।
সুব্রত শুধিয়েছিল, কি রহস্য?
কিরীটী জবাব দিয়েছে, আর দুটো দিন ভাবতে চাই। তারপর—
সুব্রতবাবু!
কে? সুব্রত চমকে সামনের দিকে তাকায়।
এ কি, আপনি! এত রাত্রে, কি ব্যাপার। আসুন আসুন, দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে কেন, ভিতরে আসুন।
সুব্রত সাদর আহ্বান জানায়।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কুন্তলা। কখন সে এসে দাঁড়িয়েছে সুব্রত টেরই পায়নি।
গায়ে একটা দামী কাশ্মীরী শাল। শালটা মাথায় ঘোমটার মত করে তুলে দেওয়া। কুন্তলা এসে ঘরে ঢুকল।
বসুন।
কুন্তলা সামনের খালি চেয়ারটার উপরে বসে।
ছোড়দাকে আপনি বাঁচান সুব্রতবাবু—কথাটা বলতে বলতে দুহাতের মধ্যে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলে কুন্তলা।
.
১৮.
কুন্তলা কাঁদছে। সুব্রত ঘটনার আকস্মিকতায় নিজেকে যেন অত্যন্ত বিব্রত বোধ করে। কি বলবে কি করবে বুঝে উঠতে পারে না।
কেবল মৃদুকণ্ঠে কুন্তলাকে অনুরোধ জানায়, কুন্তলা দেবী, আমাকে সব কথা খুলে বলুন।
কুন্তলা কোন জবাব দেয় না, কাঁদতেই থাকে ফুলে ফুলে।
প্লীজ বলুন।
ধীরে ধীরে কুন্তলা এবার মুখ তুলল।
তার চিবুক ও গণ্ড অশ্রুতে প্লাবিত। দুচোখের কোণে তখনও টলমল করে অশ্রু।
সুব্রতবাবু!
বলুন।
ছোড়দা–ছোড়দা সেদিন আপনাকে মিথ্যা কথা বলেছিল।
আমি তা জানি কুন্তলা দেবী। শান্তকণ্ঠে সুব্রত জবাব দেয়।
জানেন?
জানি বৈকি। আর এও জানি গত ২৩শে ডিসেম্বর আপনার ভাই সমস্ত দিন সিঁথিতে তার যে বন্ধুর বাড়িতে উঠেছিলেন সেখানে ছিলেন না—এবং তিনি যে আমাকে বলেছিলেন সে-রাত্রে ঐ সময় সিনেমাতে গিয়েছিলেন তাও মিথ্যা।
মিথ্যা!
হ্যাঁ, মিথ্যা বলেছিলেন তিনি। এবং যতক্ষণ না তিনি বলছেন ২৩শে ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত কোথায় ছিলেন ততক্ষণ তার উপর থেকে পুলিসের সন্দেহটা কিছুতেই যাবে না। বিশেষ করে যখন জানা গিয়েছে তারই রিভলবারে আপনার বাবা ও মিঃ গাঙ্গুলী উভয়েরই মৃত্যু হয়েছে।
হ্যাঁ, ইন্সপেক্টার আমাদের বাড়িতে সন্ধ্যায় গিয়েছিলেন, তিনিও তা বলে এলেন। কিন্তু আমি আপনাকে বলছি সুব্রতবাবু, ছোড়দার চরিত্রে যত দোষই থাক, সে জুয়া খেলে, বেহিসাবী, অসংযমী—কিন্তু সে বাবাকে হত্যা করেনি। তার মনটা এত সফ্ট, এত কোমল–
কিন্তু পুলিস তো মনের খবর নিয়ে কাজ করে না কুন্তলা দেবী, আর করবেও না। তারা ফ্যাক্ট নিয়ে সব বিচার করে।
সন্ধ্যা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত ছোড়দা কোথায় ছিল জানি না। কিন্তু—
কি বলুন, থামলেন কেন?
বোধ করি তখন সাড়ে এগারোটা হবে, ছোড়দা আমার কাছে এসেছিল সে রাত্রে গড়িয়াহাটার বাড়িতে—সে সময় পরনে ছিল তার মিলিটারি ইউনিফর্ম! মাথার চুল এলোমেলো। চোখ দুটো জবা ফুলের মত লাল। কেমন যেন অস্বাভাবিক চেহারা।
তারপর?
আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম কোথা থেকে আসছে সে? এত রাত্রে বেরিলি থেকে নাকি?
আচ্ছা, সদর দিয়ে সে-রাত্রে বাড়িতে ঢুকেছিল কি?
না, পিছনের পাঁচিল টপকে।
তারপর?
সে বলল, না, বেরিলি থেকে সে আট-দশদিন হল এসেছে। ছুটি নিয়ে এসেছে।
বলেছিল ছুটি নিয়ে এসেছে?
হ্যাঁ, বলেছিল। আরও বলেছিল চাকরি করতে আর ভাল লাগছে না।
তারপর?
আমি তখন জিজ্ঞাসা করেছিলাম কেন বাড়িতে ওঠেনি? তাতে বলেছিল—
কি?
বাড়িতে আর সে কোন দিনও আসবে না। বাবা নাকি তাকে বাড়িতে আসতে নিষেধ করে দিয়েছিল। কিন্তু সেদিন আপনি চলে আসবার পর বললে, সে আমার কাছে মিথ্যে বলেছিল। ছুটি নিয়ে আসেনি। পালিয়ে এসেছে।
আর—আর কিছু আপনার ছোড়দা আপনাকে বলেনি?
না।
কিন্তু আমি জানি—
কি?
কিছু সে আমার কাছে গোপন করেছে। কিন্তু যাই সে গোপন করে থাকুক না কেন, বাবাকে সে হত্যা করেনি আপনি বিশ্বাস করুন সুব্রতবাবু।
সুব্রত চুপ করে কি যেন ভাবে।
কুন্তলা আবার বলে, ছোড়দাকে আপনি বাঁচান সুব্রতবাবু!
আপনি অধীর হবেন না, শান্ত হোন।
কিন্তু আগে আপনি বলুন, ছোড়দাকে আপনি বাঁচাবেন?
ঢং করে রাত্রি সাড়ে বারোটা ঘোষণা করল ঐ সময়।
রাত অনেক হয়েছে—চলুন, উঠুন-বাড়ি যান এবার। সুব্রত বলে।
কুন্তলা উঠে দাঁড়ায়। কীসে এসেছেন? সুব্রত শুধায়।
ট্যাক্শিতে।
ছি ছি, এত রাত্রে এই যুদ্ধের সময় একা একা ট্যাকশিতে এসেছেন! খুব অন্যায় করেছেন—চলুন, আমি আপনার সঙ্গে যাব।
না, না—আমি একাই যেতে পারব। আপনাকে কষ্ট করতে হবে না।
কষ্ট নয়—আপনাকে এত রাত্রে একা একা আমি ছেড়ে দিতে পারি না। সুরেনের ভাইঝি আপনি, তাছাড়া এসময় এত রাত্রে ট্যাকশিও আপনি পাবেন না।
সুব্রত অতঃপর জামাটা গায়ে দিয়ে গাড়ির চাবিটা নিয়ে বললে, চলুন—
গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে গাড়ির দরজা খুলে সুব্রত কুন্তলাকে ডাকে, আসুন উঠুন।
কুন্তলা গাড়িতে উঠে বসল।
জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ হলেও শহরে তখনও বেশ শীত। শীতের আকাশ—কিন্তু কুয়াশার লেশমাত্রও ছিল না, কৃষ্ণা-চতুর্দশীর চাদ আকাশে। ম্লান চাঁদের আলোয় যেন প্রকৃতি মূৰ্ছাতুরা। খাঁ খাঁ করছে রাস্তা।
সুব্রতর গাড়ি হ্যারিসন রোড দিয়ে শিয়ালদহ হয়ে সার্কুলার রোডে পড়ে। পাশেই একেবারে গা ঘেঁষে কুন্তলা। গাড়ির খোলা জানালাপথে হাওয়ায় কুন্তলার চুল উড়ছে। মৃদু একটা ল্যাভেন্ডারের গন্ধ নাকে আসে।
এ পথ যদি না ফুরাত! সুব্রতর মনে হয়, যদি অন্তহীন এ পথ হত! আর এমনি করে কুন্তলা তার পাশে থাকত।
ছি, এসব কি ভাবছে সে! মাথা তার খারাপ হয়ে গেল নাকি!
কুন্তলা দেবী!
বলুন?
আপনি কিন্তু খুব অন্যায় করেছেন।
অন্যায় করেছি! কুন্তলা ফিরে তাকায় পার্শ্বে উপবিষ্ট সুব্রতর মুখের দিকে।
হ্যাঁ, করেছেন! কতটুকু বা আমার সঙ্গে আপনার পরিচয়, বলুন তো? হুট করে। এত রাত্রে আমার ওখানে চলে এসেছেন–
আমি জানতাম।
কি?
আপনার কাছে যেতে কারোরই কোন ভয়ের কারণ থাকতে পারে না।
জানতেন?
হুঁ।
কি করে জানলেন?
পুরুষকে চিনতে কোন মেয়েরই ভুল হয় না। কিন্তু আপনার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে।
অনুরোধ!
হ্যাঁ, কাকামণির বন্ধু আপনি-আমাকে আপনি বলবেন না আর—
কিন্তু—
‘তুমি’ বলবেন।
বেশ। একটু থেমে আবার সুব্রত বলে, একটা কথা বলব?
কি?
সেদিন অমন করে হঠাৎ রাত্রে তোমার ঘরে গিয়ে ঢুকেছিলাম বলে তুমি আমার ওপরে খুব রেগে গিয়েছিলে, না?
হ্যাঁ।
আমার তো ভয়ই হয়েছিল, এখুনি বুঝি দারোয়ান ডেকে বাড়ি থেকে আমাকে বের করে দেবে।
কুন্তলা চুপ করে থাকে।
কিন্তু এখন আর রাগটা নেই তো?
কুন্তলা কোন জবাব দেয় না।
সে রাত্রে কুন্তলাকে তাদের গড়িয়াহাটার বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে গেল সুব্রত।
.
১৯.
অপঘাতে মৃত্যু হলেও নিয়মমাফিক মহেন্দ্রনাথের শ্রাদ্ধ-শান্তি চুকে গেল।
কুন্তলাই শ্রাদ্ধ করল।
সুব্রত সেদিন গিয়েছিল কুন্তলার নিমন্ত্রণে তাদের গড়িয়াহাটার বাড়িতে।
তারপর আরও কয়েকটা দিন কেটে গেল। মহেন্দ্রনাথের হত্যার ব্যাপারটা যেন। কেমন চাপা পড়ে গিয়েছিল।
ইতিমধ্যে আরও দুদিন সুব্রত কুন্তলাদের ওখানে গিয়েছিল। কুন্তলার সঙ্গে বসে বসে গল্প করেছে।
বেরিলিতে ভবেন্দ্রর কোর্ট অফ এনকোয়ারি চলছে—শেষ হয়নি।
সেদিন সন্ধ্যায় কুন্তলা তার শোবার ঘরে বসে একটা উলের বুননি নিয়ে আত্মমগ্ন ছিল। হঠাৎ পায়ের শব্দে মুখ তুলে দেখে দাঁড়িয়ে সামনেই তার নীরেন।
কুন্তলা!
তুমি!
হ্যাঁ। নীরেন ঘরে ঢুকে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল।
কুন্তলা, আমি কিন্তু আজ একটা বিশেষ কথা জানাবার জন্যই এসেছি।
কুন্তলা তাকাল নীরেনের মুখের দিকে।
বুঝতে পারছ বোধ হয়, যে ব্যাপারে তোমাকে দুদিন আগে একটা চিঠি দিয়েছি–এবং সে চিঠিটার জবাব তুমি এখনও দাওনি–
কুন্তলা তথাপি চুপ করেই থাকে, হাতের বুননটা নিয়েই যেন সে ব্যস্ত।
চিঠিটা তুমি আমার পেয়েছ নিশ্চয়ই?
পেয়েছি।
জবাব দাওনি!
না। তারপই একটু থেমে কুন্তলা বলে, আমাকে তুমি ক্ষমা করো।
ক্ষমা করব–কীসের জন্যে? কি ব্যাপার বল তো?..
কুন্তলা নীরেনের মুখের দিকে তাকাল, চোখ তুলে বললে, আমার পক্ষে তোমার প্রস্তাব মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।
সম্ভব নয়?
নীরেন ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
না। শান্ত গলায় আবার জবাব দেয় কুন্তলা।
তা হঠাৎ এই মতের পরিবর্তন?
নীরেনের গলার স্বরটা যেন বেশ একটু কঠিন মনে হয়।
পরিবর্তন!
আছাড়া আর কি! এতদিন তো মতই ছিল—হঠাৎ সুব্রতবাবুর আবির্ভাবে—
নীরনবাবু!
তুমি মনে কর কুন্তলা দেবী, একমাত্র এ দুনিয়ায় তুমিই চালাক আর আমরা বোকা–ঘাস খাই! সুব্রতবাবুর সঙ্গে যে ঢলাঢলি শুরু হয়েছে ইদানীং–
নীরেনবাবু, ভদ্রভাবে একজন ভদ্রলোকের সম্পর্কে কথা বললেই আমি খুশি হব।
ভদ্রলোক—তাই না! হঠাৎ ফাঁকতালে বাপের সম্পত্তি পেয়ে মাথাটা বিগড়ে গিয়েছে!
নীরেনবাবু!
চোখ রাঙাচ্ছ কাকে কুন্তলা দেবী?
যান-যান এখান থেকে বলছি—
কুন্তলা তখন উঠে দাঁড়িয়েছে, তার সর্বাঙ্গ থরথর করে কাঁপছে।
যাচ্ছি। তবে মনে রেখো কুন্তলা দেবী, এত সহজে নীরেন সান্যাল অপমানকে হজম করে নেয় না।
বের হয়ে যান—বের হয়ে যান এ ঘর থেকে! হঠাৎ যেন সব কিছু ভুলে চিৎকার করে উঠে কুন্তলা।
চিয়ারিও মাই হনি বাঞ্চ! আই অ্যাম গোয়িং নাউ, বাট ইউ উইল হিয়ার মি এগেন-হেয়েন আই ওয়ান্ট ইউ। আপাতত বিদায়–
নীরেন সেন কথাগুলো বলে ঘর থেকে বের হয়ে যায়-আর ঠিক তার পরমুহূর্তেই সুব্রত এসে ঘরে প্রবেশ করে।
কুন্তলা!
কুন্তলা দুহাতে মুখ ঢেকে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করছিল, সুব্রতর ডাকে যেন ভেঙে পড়ে। চেয়ারটার উপরে বসে পড়ে। ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকে।
সুব্রত কুন্তলার মাথায় একটা হাত রাখে, কি হয়েছে কুন্তলা?
কুন্তলা জবাব দেয় না, কাঁদতেই থাকে।
.
ঐ দিনই রাত্রে।
কিরীটীর বাড়িতে-সুব্রত আর কিরীটী কথা বলছিল।
আসলে কিরীটীই বলছিল, সুব্রত শুনছিল।
তাহলে তুমি বলছ মিঃ গাঙ্গুলীকেও হত্যা করা হয়েছে।
হ্যাঁ, সুব্রত। তাকেও একই হত্যাকারী, যে মহেন্দ্রনাথকে হত্যা করেছিল, সেই-ই হত্যা করেছে। তারপর যেমন মহেন্দ্রনাথের ব্যাপারটা অ্যাক্সিডেন্ট বা সুইসাইড বলে প্রমাণ করবার চেষ্টা করেছিল, এক্ষেত্রেও মিঃ গাঙ্গুলীর হাতের মুঠোর মধ্যে রিভলবারটা গুজে দিয়ে সেই চেষ্টাই করেছে খুনী।
কিন্তু কেন-গাঙ্গুলীকে হত্যা করল কেন সে? সুব্রত প্রশ্ন করে।
ঠিক একই কারণে। অর্থাৎ যে কারণে মহেন্দ্রনাথকে সে হত্যা করেছে।
কি-কি সে কারণ?
এখনও বুঝতে পারনি!
না।
ডাঃ নলিনী চৌধুরীর ঐ চিঠি।
মানে সেই সাংকেতিক চিঠি!
হ্যাঁ, সেই চিঠিই হল কাল। চিঠিই ডেকে এনেছে নৃশংস মৃত্যু।
কিন্তু কি করে, তবে কি–
তাই-এবং আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয় তো সম্ভবত মহেন্দ্রনাথ চিঠির সাংকেতিক পাঠ প্রথম উদ্ধার করতে পেরেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাকে প্রথম আঘাত হানে হত্যাকারী। তারপর মিঃ গাঙ্গুলী—তিনিও হয়ত শেষ পর্যন্ত তার বন্ধুর ঐ সাংকেতিক চিঠির রহস্য উদ্ঘাটন করতে পেরেছিলেন, আর সে-কথা হত্যাকারী জানতে পারায় সঙ্গে সঙ্গে মহেন্দ্রনাথের মতই পথের কাঁটা হিসাবে পথ থেকে তাকেও সরিয়ে দিতে দেরি করেনি। তাকেও পৃথিবী থেকে যেতে হল।
তাহলে তুই নিশ্চয়ই জানতে পেরেছিস—
হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি হত্যাকারী কে এবং–
কিরীটীর কথা শেষ হল না—ঘরের ফোনটা হঠাৎ ঐ সময় ক্রিং ক্রিং করে বেজে উঠল।
কিরীটীই এগিয়ে গিয়ে রিসিভারটা তোলে, কে—আছে হ্যাঁ ধরুন। সুব্রত তোর ফোন–
কে?
তোর হবু খুড়শ্বশুর সুরেন্দ্রনাথ।
সুরেন।
হ্যাঁ, দেখ, বোধ হয় জামাইকে নিমন্ত্রণ জানাতে চায়!
কিরীটীর ঠাট্টায় কান না দিয়ে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে ফোনটা ধরে, কি খবর সুরেন?
কুন্তলা কি তোমার ওখানে গিয়েছে?
কুন্তলা আমার এখানে! কই না তো। কিন্তু কি ব্যাপার বল তো?
সন্ধ্যার মুখে একটা গাড়ি আসে তোমার একটা চিঠি নিয়ে—কুন্তলার নামে।
কুন্তলার নামে চিঠি! কি বলছ তুমি সুরেন?
হ্যাঁ, আর সেই চিঠি পেয়েই তো কুন্তলা চলে গিয়ছে। এত রাত হচ্ছে, ফিরছে না দেখে তোমার বাড়িতে ফোন করে জানলাম তুমি এখানে!
কিরীটী সুব্রতর কথা বলা শুনেই বুঝেছিল কিছু একটা গোলমাল ঘটেছে। তাড়াতাড়ি সে সুব্রতর পাশে এসে দাঁড়ায়। জিজ্ঞাসা করে, কি বলছে সুরেন?
বুঝলাম না ঠিক—
মনে হল যেন তোকে কুন্তলার কথা কি জিজ্ঞাসা করছিল?
হ্যাঁ, জিজ্ঞাসা করছিল কুন্তলা আমার এখানে এসেছে কিনা। কে বলে একটা চিঠি নিয়ে–
চিঠি! কীসের চিঠি? কার চিঠি?
সুব্রত সংক্ষেপে তখন সব কথা খুলে বলে কিরীটীকে।
কিরীটী সব শুনে বলে, এইরকম একটা কিছু তোর কথা শুনে আমি অনুমান করেছিলাম। তুই এখুনি মৃণাল সেনকে ফোন কর, কয়েকজন আর্মড পুলিস নিয়ে যেন সে প্রস্তুত থাকে। আমরা এখুনি আসছি।
সুব্রত কিরীটীর নির্দেশমত তখুনি থানায় মৃণাল সেনকে ফোন করে দিল।
কিরীটী আর একটা মুহূর্তও দেরি করে না, তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে নেয়।
চল শিগগির—
গাড়ি লালবাজারের দিকে ছুটে চলেছে।
সুব্রতই গাড়ি চালাছিল। কিরীটী পাশে বসে।
কিরীটী বলছিল, খুনী কে-তাকে তুই তো অনেক আগেই ধরতে পারতিস যদি একবার ভাল করে ভেবে দেখতিস, ডাঃ চৌধুরীর যে উইলের কথাটা তোকে বলছিলাম –সেই উইলের কথাটা–
ডাঃ চৌধুরীর উইল।
হ্যাঁ। মনে করে দেখ, সে উইলে কি লেখা আছে এবং উইলের কথা কে কে জানত?
কিন্তু–
ঐখানেই তুই আলো দেখতে পেতিস বর্তমান রহস্যের!
আমি গতকালই সে উইলের কথা জানতে পেরেছি, কারণ তাঁর সেই উকিল বন্ধু, যিনি উইল তৈরি করেছিলেন তার মৃত্যুর মাত্র দুদিন আগে, তিনি কলকাতায় ছিলেন না। তারপরই তো তোকে জানাই।
ঐ উইলই হচ্ছে কাল।
কিন্তু সে উইলে কি আছে?
এখন সে কথা থাক। লালবাজার পৌঁছে গেছি আমরা। সর্বাগ্রে তোর কুন্তলা উদ্ধার, তারপর অন্য কথা।
.
মৃণাল সেন ফোনে নির্দেশ পেয়েই প্রস্তুত হয়ে ছিল।
কিরীটী বলে, মিঃ সেন, আপনি আমাদের গাড়িতে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ুন, পুলিশ ভ্যান আমাদের ফলো করবে।
মৃণাল সেন সুব্রতর গাড়িতে উঠে পড়ে।
সুব্রত এবার শুধায়, কোথায় যাব?
শ্রীরামপুর।
শ্রীরামপুরে!
সুব্রত কেমন যেন বোকার মতই প্রশ্নটা করে কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।
হ্যাঁ, খুব জোরে চালা।
সুব্রত গাড়ি ছেড়ে দেয়।
.
ধীরে ধীরে কুন্তলার জ্ঞান ফিরে এল একসময়।
নিঃশঙ্ক চিত্তেই গাড়িতে এসে উঠে বসেছিল কুন্তলা।
সুব্রতর হাতের লেখা সে কখনও দেখেনি ইতিপূর্বে এবং চিনতও না। তাই সুব্রতরই লেখা ভেবে নিশ্চিন্ত বিশ্বাসে সে এসে গাড়িতে উঠে বসেছিল চিঠিটা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই।
একবারও তার কথাটা মনে হয়নি, সুব্রতর তো বাড়িতেই ফোন ছিল! সুব্রত তাকে ফোন করে জানাতে পারত কথাটা!
আর তেমন যদি প্রয়োজন হবে তো সুব্রত চিঠি দিয়ে পাঠাবে কেন? সে নিজেও তো আসতে পারত ওর ওখানে?
আর সেটাই তো ছিল স্বাভাবিক।
কিন্তু অতি বড় বিচক্ষণ ব্যক্তিও মাঝে মাঝে এমন হাস্যকর ভুল করে ঘটনাচক্রে। কুন্তলাকেও বোধ হয় তাই তেমন দোষ দেওয়া যায় না।
পরে সুব্রত যখন কুন্তলাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, তুমি এত বড় ভুল করেছিলে কি করে কুন্তলা?
কি জানি কেন—বোধ হয়–
কি?
তুমি ডেকেছ তাই কোন কিছুই আর মনে হয়নি সে-সময়।
কিন্তু আমরা যদি আর একটু দেরি করতাম বা কোন কারণে দেরি হত।
কি আর হত!
কিছু হত না বুঝি?
না।
সত্যি-সত্যি বলছ?
কুন্তলা মুখটা ফিরিয়ে নিয়েছিল অতঃপর।
.
২০.
কুন্তলা জ্ঞান ফিরে আসবার পর দেখল একটা ঘরে শয্যার উপর শুয়ে আছে।
কেমন করে কীভাবে সে এখানে এল কিছুই যেন প্রথমটায় মনে পড়ে না।
প্রথমটায় সব অস্পষ্ট, ধোঁয়াটে—কিছুই চিন্তা করতে পারে না।
তারপর মনে পড়ে, গাড়ির মধ্যে যে দ্বিতীয় ব্যক্তি অন্ধকারে বসেছিল এবং যাকে সে দেখতে পায়নি তাড়াহুড়ায়, সে যেন তাকে গাড়িতে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই অন্ধকারে অকস্মাৎ জাপটে ধরে তার নাকের ও মুখের ওপরে কি একটা চেপে ধরেছিল-সঙ্গে সঙ্গে যেন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কুন্তলার।
একটা উগ্র মিষ্টি গন্ধে সব যেন সঙ্গে সঙ্গে কেমন গুলিয়ে গিয়েছিল। তলিয়ে গিয়েছিল ও, হারিয়ে গিয়েছিল ও-চেতনা অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল।
অনেক-অনেক দূর থেকে যেন ঝাপসা অস্পষ্ট কার গলা শোনা যায়।
কে যেন কাকে বলছে, কি হল ঠাকুরমশাই, তাড়াতাড়ি করুন! ভামিনী, এই ভামিনী–
কি?
দেখ জ্ঞান ফিরল কিনা!
দরজা খোলার শব্দ।
চোখ মেলে তাকায় কুন্তলা। ঘরের মধ্যে স্বল্পশক্তির একটা আলো জ্বলছে। আলোটা তবু যেন চোখে লাগে ওর।
কে এসে যেন পাশে দাঁড়াল।
দিদিমণি-অ দিদিমণি?
কর্কশ মেয়েলী গলায় কে যেন ডাকে কুন্তলাকে।
উঁ!
কি গো, ঘুম ভাঙল?
পূর্বের সেই কর্কশ নারী-কণ্ঠস্বর।
আমি কোথায়? ক্ষীণকণ্ঠে প্রশ্ন করে কুন্তলা।
কোনমতে আস্তে আস্তে শয্যার উপরে উঠে বসে কুন্তলা। মাথাটা যেন তখন ঝিমঝিম করছে!
এই যে জ্ঞান ফিরেছে!
কে?
কেন, চিনতে পারছ না?
নীরেনবাবু?
হ্যাঁ। যাক, চিনেছ তাহলে!
আমি কোথায়?
আমার বাড়িতে।
আপনার বাড়ি।
হ্যাঁ।
এর মানে কি নীরেনবাবু?
মানে তো অত্যন্ত সহজ।
নীরেনবাবু।
হ্যাঁ, যখন আমার কথায় সম্মত হলে না বুঝলাম সুব্রত তোমার মাথাটা রীতিমতই বিগড়ে দিয়েছে-সোজা আঙুলে ঘি গলবে না, তাই অন্য উপায়ে তোমাকে এখানে ধরে নিয়ে আসতে বাধ্য হলাম।
তাহলে এসব আপনারই কীর্তি!
উপায় কি?
কিন্তু জানতে পারি কি, এভাবে কৌশলে আমাকে ধরে নিয়ে এসে কি লাভ হবে আপনার?
লাভ? তা আছে বৈকি। নচেৎ এত ঝামেলা পোহাব কেন?
শুনুন নীরেনবাবু, ভাল চান তো আমার যাবার ব্যবস্থা করুন!
যাবে বৈকি। তবে অন্য কোথাও নয়—আমারই সঙ্গে আমারই ঘরে।
আপনার ঘরে!
হ্যাঁ। শোন, আমার একটা প্রস্তাব আছে—
প্রস্তাব?
হ্যাঁ। আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।
বিয়ে!
হ্যাঁ।
কুন্তলা ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। দরজার দিকে এগিয়ে যায়।
ওদিকে যাচ্ছ কোথায়? নীরেন বলে, দরজা বন্ধ!
দরজা খুলে দিন নীরেনবাবু!
দেখ কুন্তলা, আমি তোমার সঙ্গে কোনরকম খারাপ ব্যবহার করতে চাই না। ধর্মত আইনসঙ্গতভাবে তোমাকে বিয়ে করতেই চাইছি—আর তাতে যদি তুমি না রাজী হও, তাহলে—
তাহলে? কুন্তলা গ্রীবা বেঁকিয়ে তাকাল নীরেনের দিকে।
তাহলে আজ রাত্রে জোর করে তোমাকে—
ইউ স্কাউন্ডেল!
স্কাউন্ড্রেলই বল আর যাই বল সুন্দরী, সুব্রতর আশা ছাড়! যা বলছি এখনও শোন–ট্রাই টু রিজন, রাশন্যাল–
আবার চাপা গর্জন করে ওঠে ঘৃণায় কুন্তলা, ইতর নীচ!
তার সর্বাঙ্গ তখন থরথর করে আক্রোশে উত্তেজনায় কাঁপছে।
শোন, আমার প্রস্তাবে যদি রাজী না হও তো জেনো আমি যা একটু আগে বলেছি তাও করব না। কেবল তোমার নারীত্বের—সতীত্বের দম্ভকে চূর্ণ করে ছেড়া জুতোর মতই রাস্তায় ফেলে দেবো। আই শ্যাল থ্রো ইউ ইন দি ডাস্ট!
নীরেনের কথা শেষ হল না, হঠাৎ কে যেন ঘরের দরজাটায় বার-দুই ধাক্কা দিল।
কে-কে এল দেখ তো ভামিনী! ঠাকুরমশাই বোধ হয়!
ভামিনী এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই হুঁড়মুড় করে প্রথমে কিরীটী, তার পশ্চাতে সুব্রত, মৃণাল সেন ও দুজন কনেস্টবল ঘরে এসে ঢুকে পড়ে।
মৃণাল সেনের হাতে উদ্যত পিস্তল, ডাঃ সান্যাল, হ্যান্ডস আপ! উই আর আন্ডার অ্যারেস্ট!
কে? ও আই সি-ইন্সপেক্টর! শান্ত গলায় নীরেন সান্যাল বলে, কি চান? হোয়াই ইউ হ্যাভ কাম হিয়ার?
তেওয়ারী হাতকড়া লাগাও!
দাঁড়ান, ইনসপেক্টর। আমি জানতে চাই এসবের অর্থ কি?
এখনও অর্থটা তাহলে পরিষ্কার হচ্ছে না। কিন্তু অর্থটা পরিষ্কার করতে হলে আপনার অপরাধের ফিরিস্তি দিতে হয়। সেটাও তো একটা নয়—আর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েও তা সম্ভব নয়।
কুন্তলা ও ঘটনার আকস্মিকতায় হঠাৎ যেন থমকে গিয়েছিল। হঠাৎ সে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে সুব্রতকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে অজ্ঞান হয়ে যায়।
সুব্রত তাড়াতাড়ি কুন্তলাকে বুকে জড়িয়ে ধরে।
কিরীটী বলে, ওকে পাশের ঘরে নিয়ে হ্যাঁ, সুব্রত।
মৃণাল কিন্তু ডাঃ সান্যালের দিকেই স্থির দৃষ্টিতে তখনও তাকিয়ে আছে।
তাহলে শেষ থেকেই শুরু করি—তোমার বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ, কুন্তলা দেবীকে কিডন্যাপ–
কিডন্যাপ। কুন্তলাকে? কোন্ দুঃখে? সে নিজেই এসেছে।
ও, উনি নিজেই এসেছেন!
হ্যাঁ,। জিজ্ঞেস করলেই ওকে জানতে পারবেন সত্য-মিথ্যা।
নীরেনবাবু, আই মাস্ট প্রেজ ইওর নার্ভ! কিরীটী এবারে বলে ওঠে, কিন্তু ওতে করে শেষরক্ষা হবে না। জেল নয়—ফাঁসির দড়ি আপনাকে গলায় নিতেই হবে জানবেন।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ। দু-দুটো হত্যা ও একটা কিডন্যাপ—
মশায় কি নেশা করেছেন?
নেশাই বটে, তবে মারাত্মক নেশা। মিঃ সেন, অ্যারেস্ট করুন।
মৃণাল সেন বলে, তেওয়ারী!
কিন্তু তেওয়ারী এগোবার আগেই আচমকা নীরেন সান্যাল পকেট থেকে কি একটা বের করে চট করে মুখে পুরে দেয় এবং ব্যাপারটা কেউ কিছু বোঝবার আগেই নীরেনের দেহটা সশব্দে মেঝেতে পড়ে যায়।
বার দুই আক্ষেপ-তারপরই সব স্থির।
ঘটনার আকস্মিকতায় ঘরের মধ্যে সবাই যেন বিমূঢ় হতবাক।
কিরীটী বলে, হ্যাঁ, মিঃ সেন। হি ইজ দি ম্যান—যে মহেন্দ্রনাথ ও মনীন্দ্র গাঙ্গুলীকে হত্যা করেছে!