না, গোপীনাথের ভিতরে কোনও আগুনই জ্বলল না, মেয়েটি কিছু ছলাকলা শুরু করতেই গোপীনাথ হঠাৎ খুব ঠান্ডা গলায় বলল, ক্ষান্ত হও, বৃথা পরিশ্রম কোরো না।
মেয়েটা থমকে গিয়ে বলল, কেন? আমি যথেষ্ট আকর্ষক নই?
নিশ্চয়ই, তবু ক্ষান্ত হও, আমি পরিশ্রান্ত, উদ্বিগ্ন এবং খানিকটা ভীত একজন মানুষ। এখন কোনও সুন্দরী মহিলার ঘনিষ্ঠ সাহচর্য আমি উপভোগ করতে পারছি না।
মেয়েটা একটু হেসে বলল, মানুষ তো ওসব কাটানোর জন্যই মেয়েদের চায়। গোপীনাথ মেয়েটার দিকে চেয়ে বলল, তুমি কি জানো সেক্সের মধ্যে কতটা শরীর আর কতটা মন?
মেয়েটা বলল, সেক্স তো শরীর মাত্র।
গোপীনাথ মাথা নেড়ে বলল, সকলের কাছে নয়। আমার কাছে সেক্স-এর অর্ধেক মন আর অর্ধেক শরীর।
তুমি বোধহয় জ্ঞানী লোক।
না, তবে আমি একজন মনোযোগী ছাত্র।
তুমি কী চাও বলো তো!
আপাতত আমি তোমার সঙ্গে বসে কফি খেতে খেতে একটু কথা বলতে চাই।
মেয়েটা মুখোমুখি সোফায় বসে বলল, তবে তাই হোক।
গোপীনাথ ইন্টারকমে কফির অর্ডার দিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। এই হোটেলের রুম সার্ভিস খুবই ভাল, ঠিক সাত মিনিটের মাথায় একজন বেয়ারা এসে কফির ট্রে নামিয়ে রেখে চলে গেল।
কফি খেতে খেতে মেয়েটা বলল, কী কথা বলতে চাও?
প্রথমে জানতে চাই তোমার নাম কী?
আমার নাম জিনা।
তুমি কি কল গার্ল? খানিকটা তাই। তবে আমি চাকরিও করি।
পুরুষদের খুশি করে বেড়াতে কি পছন্দ করো?
মেয়েটার মধ্যে হঠাৎ যেন সব চঞ্চলতা থেমে গেছে। কফির কাপটা ঠোঁটের কাছে ধরে একটু ভেবে বলল, তুমি আমাকে নীতি উপদেশ দেবে না তো!
না, ওসব আমার আসে না।
খুব ভাল। কারণ ওসব আমি মানি না। যা খুশি করি।
সবাই আজকাল তাই করে। আজকালকার মানুষ কিছু মানার ধার ধারে না।
আমরা একটা ছোট্ট জীবন পেয়েছি আর চারদিকের এই পৃথিবী, জীবনটা যতদূর পারি ভরে নেওয়াই তো ভাল।
ঠিক কথা। জীবনটা যদি ভরে নেওয়া যায় তা হলে আপত্তি কীসের? আমি জানতে চাই তুমি কি এই হোটেলেই চাকরি করো?
হ্যাঁ।
কী চাকরি?
স্ট্রিপ ড্যান্স।
দাতা কে জানো?
মেয়েটা ভ্রু কুঁচকে বলল, দাতা! দাতা আবার কে?
একজন ভারতীয়, আমার মতোই।
না, আমি লুইজির বান্ধবী।
লুইজি কি এই হোটেলের মালিক?
ওর কাকা মালিক।
লুইজির বোনকে চেনো?
চিনি, কেন বলো তো!
না, আমি একটা প্যাটার্ন বুনবার চেষ্টা করছি।
কীসের প্যাটার্ন?
নানা ঘটনাবলির।
কীরকম ঘটনা?
একে বেশি কিছু বলে লাভ নেই, জানে গোপীনাথ, তবু কাউকে তার কিছু বলতে ইচ্ছে করছিল। সে বলল, তুমি কি সাহসী মেয়ে?
তাই তো জানি।
তা হলে তোমাকে বলা যায়। শুনবে?
শুনব।
গোপীনাথ একটু ভেবে তার কাহিনিটা ছাঁটকাট করে বেশ সংক্ষেপে বলল। তারপর জিজ্ঞেস করল, আমি যাদের হেপাজতে রয়েছি তারা কেমন লোক তা কি তুমি জানো জিনা?
জিনা কফির শূন্য কাপটা ট্রে-তে রেখে বলল, এক কথায় এ প্রশ্নের জবাব হয় না। তবে লুইজি ভাল ছেলে। ওর কাকা হোটেল চালায় বলে গুন্ডা বদমাশ এবং সন্দেহজনক লোকদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। তবু বলতেই হবে এমপ্লয়ার হিসেবে লোকটা তেমন খারাপ নয়।
আমি লুসিলের কথা জানতে চাই।
লুসিল! না তার কথা আমি তেমন কিছু জানি না। লুইজির কাছে শুনেছি তার বোন লুসিল প্যারিসে থাকে।
এই হোটেলে কোনও মাফিয়া বা গুন্ডার দলের নজর আছে কি না জানো?
তারা তো সব জায়গাতেই আছে।
আমি একটু স্পেসিফিক হতে চাইছিলাম।
মেয়েটি মাথা নেড়ে বলল, এই হোটেলে সন্ধ্যায় আমাকে কয়েক ঘণ্টা কাটাতে হয়। কত লোক আসে! নাচঘর তখন অন্ধকার থাকে।
ঠিক কথা, তুমি আমাকে অনেক কথাই বলেছ। আলাপ করে খুশিই হলাম।
তার মানে তুমি কি আমাকে এখন চলে যেতে বলছ?
তা নয়। তবে আমার যেটুকু জানার ছিল জেনেছি।
শোনো পণ্ডিত মানুষ, তোমার মুখখানা আমার খারাপ লাগছে না। তুমি সেক্সি না হতে পারো, কিন্তু বর্বর নও।
ধন্যবাদ।
আমার কথা শেষ হয়নি।
তা হলে বলো।
আমি মাফিয়া এবং গুন্ডা বদমাশদের ঘেন্না করি।
খুব ভাল।
তুমি যে একটা বিপদের মধ্যে রয়েছ তা আমি বিশ্বাস করছি। তোমার মুখে উদ্বেগটা প্রকাশ পাচ্ছে।
গোপীনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি মিথ্যে কথা সহজে বলি না।
শোনো, তোমাকে আমি সাহায্য করতে চাই।
কীভাবে সাহায্য করবে?
মেয়েটা একটু ভেবে বলল, আমি তোমার নিরাপত্তার কোনও নিশ্চয়তা দিতে পারি না।
সেটা জানি।
তবু তোমাকে আমি এখান থেকে পালাতে সাহায্য করতে পারি। শুধু তাই নয়, আমাদের পরিবারে তুমি দু’-একদিন আশ্রয়ও পাবে। যদি ইচ্ছে করো।
তারপর?
তারপর তোমার যা ইচ্ছে।
গোপীনাথ একটু চুপ করে থেকে বলল, ভিকিজ মব বা মাফিয়াদের হাত খুবই লম্বা। তারা যেখানেই হোক আমার নাগাল পাবেই।
সেটা ঠিক কথা।
তবু আমি এই জোন থেকে বেরিয়ে পড়তে চাই।
কোথায় যাবে?
কলকাতায়।
তোমার কাছে ভাড়ার টাকা আছে?
না, তবে আমার কাছে চেকবই আছে। কিন্তু আমি টাকা তুলতে গেলেই ধরা পড়ে যেতে পারি।
টাকাটা যদি আমি তোমাকে ধার দিই?
ধন্যবাদ, কিন্তু ব্যাঙ্কে টাকা থাকতে ধার করার মানেই হয় না।
হয়। টাকাটা এখনই তোলার দরকার নেই। চেকটা তুমি আমাকে দিয়ো। তুমি নিরাপদে দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর আমি আমার ব্যাঙ্কের সাহায্যে টাকাটা তুলে নেব।
বাঃ। চমৎকার। আমাকে তোমার বিশ্বাস হচ্ছে তো?
হচ্ছে। আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই। এখন সবচেয়ে বেশি গুরুতর ব্যাপার হল, তোমাকে এই হোটেল থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া।
কীভাবে সেটা সম্ভব? আমি যতদূর জানি ভিকিজ মব-এর একজন এজেন্ট হল দাতা, অন্যজন লুসিল এবং হয়তো লুইজিও।
দাতাকে আমি চিনি না। তবে লুসিল এখন নিউ ইয়র্কে। লুইজি বার্সিলোনায়। দাতা সম্পর্কে খোঁজ নিতে হবে।
নাও।
কীরকম দেখতে সে?
লম্বাচওড়া এবং সুপুরুষ। চেহারায় একটা নিষ্ঠুরতা আছে। এবং খুবই বিস্ময়ের কথা, তোমাকে সেই আমার কাছে পাঠিয়েছে।
মেয়েটা অবাক হয়ে বলে, আমাকে তোমার কাছে আসতে বলেছে এই হোটেলের ম্যানেজার নিনো। সে ভারতীয় নয়, ইতালিয়ান।
তা হলেও পিছনে দাতা আছে।
মেয়েটা উঠে পড়ল, বলল, ভেবো না, আমি খোঁজ নিয়ে আসছি। তুমি তৈরি থেকো। এই হোটেলের ফায়ার এসকেপ দিয়ে নামলে পিছনে একটা সরু গলি পাবে। আমার গাড়িটা ছোট, থ্যাবড়া আর লাল রঙের। ফিয়াট। যদি রাস্তা পরিষ্কার থাকে তা হলে আধঘণ্টা বাদে আমি গাড়ি নিয়ে গলিতে অপেক্ষা করব।
গোপীনাথ সামান্য উদ্বেগের গলায় বলল, তোমার এতে কোনও বিপদ নেই তো!
না। তোমার সঙ্গে আমার দু’ঘণ্টা থাকার কথা। দু’ঘণ্টা পার হয়েছে। এখন চলে গেলে কারও সন্দেহ হওয়ার কিছু নেই। হলেও ভয় পেয়ো না। আমি যেখানে থাকি সেটা রোমের একটা ঘিঞ্জি পাড়া। বাইরের লোক ঢুকে সুবিধে করতে পারবে না, আমরা জোট বেঁধে থাকি।
জিনা বেরিয়ে যাওয়ার পর খুব দ্রুত গোপীনাথ পোশাক পরে নিল। কফির ট্রে দরজার বাইরে রেখে ডোন্ট ডিস্টার্ব সাইন টাঙাল দরজায়। পাসপোর্ট এবং প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে বাতি নিবিয়ে পেছনের ফায়ার এসকেপের কাছে এসে দাঁড়াল।
আধঘণ্টা সময় যে কতটা সময় তার কোনও ঠিক নেই। এক-এক পরিস্থিতিতে আধঘন্টা পাঁচ মিনিটের মতো আচরণ করে, এক-এক সময় পাঁচ ঘণ্টার মতো, এখন পাঁচ ঘণ্টার মতো লাগছে।
একজন অচেনা মেয়ের কাছে নিজেকে এতটা সমর্পণ করে কি বোকামি করছে না গোপীনাথ? এটা হয়তো এদেরই তৈরি করা ফাঁদ! গোপীনাথের এখানে তবু একটু নিরাপত্তা ছিল, এরপর কী হবে কে জানে! তবে তার তো জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ। বেশি আর কী-ই বা হতে পারে?
ফায়ার এসকেপটা লাথি মেরে খুলে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল গোপীনাথ।
গলির মুখে কিছুক্ষণ দাঁড়াতে হল তাকে। তারপর ডানপ্রান্ত দিয়ে একটা আলো নেবানো ছোট্ট গাড়ি মুখ ঢোকাল গলিতে। স্ট্রিট লাইটের আলোয় লাল রংটা বোঝা গেল।
সামনে এসে গাড়িটা দাঁড়াতেই দরজা খুলে জিনা বলল, উঠে পড়ো, কেউ এখন হোটেলে নেই।
গোপীনাথ উঠে পড়ে বলল, দাতা কোথায়?
খোঁজ নিয়ে জানলাম, যে একটা জরুরি টেলিফোন পেয়ে একটু আগেই বেরিয়ে গেছে।
গোপীনাথ ব্যাগটা পিছনের সিটে রেখে সামনের সিটে জিনার পাশে উঠে বসল। জিনা গাড়ি ছাড়ল।
.
আর ঠিক এসময়ে গোপীনাথের হোটেলের ঘরের দরজাটা কেউ লাথি মেরে খুলে ফেলল। ঘরে ঢুকল দু’জন। তাদের একজন বেনভেনুটি, অন্যজন বাসিলোঁ, দু’জনের হাতেই পিস্তল। চারদিক দেখে নিয়ে বাসিলোঁ বলল, বেনভেনুটি, আমাদের কপাল নিতান্তই খারাপ দেখছি।
বেনভেনুটি বাথরুমে উঁকি মেরে দেখছিল। বলল, কপাল খারাপ বললে তো হবে না বাসিলোঁ, লোকটাকে খুঁজে পাওয়া না গেলে আমাদের কী হবে তা ভেবে দেখেছ?
দেখেছি, কিন্তু ভাবতে চাই না।
আর এসবের জন্য দায়ী তুমি বাসিলোঁ। মেয়েছেলে দেখলেই তুমি এমন চঞ্চল হয়ে ওঠো যে, কাণ্ডজ্ঞান থাকে না, মেয়েটার সঙ্গে খুনসুটি করতে না গেলে সেদিন চিড়িয়া উড়ে যেতে পারত না।
ভুল বেনভেনুটি, তোমার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। ওদের একটা পরিকল্পনা কার্যকর না হলে আর একটা হতই, আমরা ওদের প্রথম কৌশলটারই শিকার হয়ে গিয়েছিলাম।
বেনভেনুটি ভ্রু কুঁচকে বলল, এখন কী করবে?
অন্য ঘরগুলো খুঁজে দেখব। হোটেলটা তছনছ করব।
দাঁড়াও। ফায়ার এসকেপটা দেখো।
কী দেখব?
ফায়ার এসকেপটা খোলা রয়েছে।
ঈশ্বর! বলে বাসিলোঁ এগিয়ে গেল। ফায়ার এসকেপ খুলে নীচের দিকে চেয়ে বলল, পরিশ্রম অনেকটাই বেঁচে গেল মনে হচ্ছে। হোটেলটা আর তছনছ করতে হবে না। আমাদের পাখি এদিক দিয়েই পালিয়েছে।
অথবা তাকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
একই কথা বেনভেনুটি। আমাদের গর্দান যূপকাষ্ঠেই রয়ে গেল। এসো বেনভেনুটি, তলাটা একটু ঘুরে দেখে আসি।
দু’জনে নীচে নামল। গলির মধ্যে পা রেখে বাতাস শুকে বাসিলোঁ বলল, বেনভেনুটি, পেট্রোলের গন্ধ পাচ্ছ? এই গলি দিয়ে সচরাচর গাড়ি চলাচল করে না। সুতরাং আমাদের পাখিটির জন্য কিছুক্ষণ আগেই এখানে গাড়ি ঢোকানোর ব্যবস্থা হয়েছিল। গলিটা সরু তাই নিশ্চয়ই কোনও ছোট গাড়ি।
তুমি পুলিশে চাকরি করলে পাকা ডিটেকটিভ হতে।
ডিটেকটিভরা বড্ড গরিব হয় বেনভেনুটি। তুমি নিশ্চয়ই চাও না, আমি দরিদ্রের জীবন যাপন করি।
কিন্তু শ্রীযুক্ত গোপীনাথ বসুকে খুঁজে বের না করতে পারলে আমাদের দুজনকেই হয়তো ভিক্ষে করতে হবে।
না বেনভেনুটি, না। দলে নতুন এসেছ, তাই জানোনা। ভিখিরি হয়েও যদি বেঁচে থাকতে পারো তো সেটা পরম সৌভাগ্য। লোকটা যদি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে তা হলে আমাদের দু’জনকেই গুলি করে টাইবারের জলে ফেলে দেওয়া হবে।
ঈশ্বর! তা হলে কিছু করো বাসিলোঁ।
হ্যাঁ। করতেই তো আসা। আপাতত চলল, ম্যানেজারকে আরও একটু কড়কানো যাক।
দু’জনেই ফিরে এল ফায়ার এসকেপ দিয়ে। আবার চারদিক দেখে নিল। তারপর নেমে এল একতলায়। যেখানে তাদের দলের আরও জনাপাঁচেক পেশাদার গুন্ডা ম্যানেজারের ঘরে এবং দরজায় পাহারা দিচ্ছে। রেস্টুরেন্টের দিক থেকে নাচগানের শব্দ এবং কিছু হল্লা আসছে।
ভীত ইতালিয়ান ম্যানেজার সাদা মুখে নিজের চেয়ারে বসে ছিল।
বাসিলোঁ মৃদু গলায় বলল, গোপীনাথ বোস তার ঘরে নেই।
আ-আমি জানি না।
না জানলে কি চলে? এত মাননীয় দামি একজন অতিথির খবর রাখো না, তুমি কেমন ম্যানেজার?
বিশ্বাস করো, তার এখন ঘরেই থাকার কথা। একটু আগে জিনা তাকে সেবা করতে গিয়েছিল। দু’ঘণ্টা ছিলও তার ঘরে। একটু আগেই জিনা নেমে এল।
জিনা কে?
স্ট্রিপটিজ করে।
বাঃ। তা হলে অতিথির জন্য আপ্যায়নের ব্যবস্থা ভালই ছিল।
হ্যাঁ, জিনা এসে বলল অতিথি ভাল আছে।
জিনা কি রোজ গোপীনাথের কাছে যেত?
না। আজই প্রথম।
অন্যান্য দিন কারা যেত?
কেউ না, উনি বোধহয় খুব একটা সেক্সি নন।
তা হলে আজ হঠাৎ জিনাকে দরকার হল কেন?
আ-আমি জানি না।
তা হলে কে জানে?
একজন লোক জিনাকে যেতে বলেছিল।
লোকটা কে?
আমি চিনি না। তবে তাকে দাতা বলে কেউ কেউ ডাকছিল।
বাসিলোঁর ভ্রু কুঁচকে গেল, দাতা! কোন দাতা?
তা জানি না।
রিভলভারটা ম্যানেজারের দিকে আলগোছে তুলে বাসিলোঁ বলল, ব্যাপারটা গুরুতর। বলো।
ম্যানেজার তোতলাতে তোতলাতে বলল, ভিকিজ মব-এর সর্দার।
ঈশ্বর! সে কোথায়?
এখানে নেই। একটু আগে বেরিয়ে গেছে।
মিথ্যে কথা।
বিশ্বাস করো। তবে সে বেশি দূর হয়তো যায়নি। আসবে।
আমরা অপেক্ষা করব। জিনার ঠিকানাটা দাও। তাড়াতাড়ি।
১৭.
কোনও মহিলাকে এত জোরে গাড়ি চালাতে আগে দেখেনি গোপীনাথ। বিশেষ করে রোমের কিছু অপ্রশস্ত রাস্তায়।
জিনা, তোমার সাহস আছে বটে, কিন্তু এটাই কি সাহস দেখানোর সময়?
জিনা একটা মোড় অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ফিরে গতি সামান্য কমাল। তারপর বলল, আমি বিপদের গন্ধ পাই।
সেটা কীরকম?
যখন গাড়িতে স্টার্ট দিচ্ছিলাম তখন হোটেলের চত্বরে তিনটে গাড়ি এসে থামল। একসঙ্গে প্রায় আট-দশজন লোক নেমে এল। তাদের মধ্যে একজন আমার গাড়িতে অত্যন্ত অভদ্রভাবে উঁকি দিয়েছিল।
কই, বলোনি তো?
তোমাকে ঘাবড়ে দিতে চাইনি।
ওরা কারা?
ওরা আর যাই হোক ভালমানুষ নয়। এদের একজনকে আমি চিনি। তার নাম বাসিলোঁ। অত্যন্ত ভয়ংকর লোক।
বাসিলোঁ?
নামটা শুনেছ?
আমি অনেকদিন রোমে বাস করছি। সুতরাং শুনতেই পারি। নামটা চেনা চেনা ঠেকছে।
একটা মাফিয়া দলের সর্দার গোছের। আমার সঙ্গে আলাপও হয়েছিল।
বন্ধুত্বও হয়েছিল কি?
জিনা ব্যথিত গলায় বলল, আমাদের যা জীবন তাতে কত কিছু হয়। না, লোকটা আমাকে ব্যবহার করেছিল বটে, কিন্তু বন্ধুত্ব হয়নি। শোনো গোপীনাথ, আমি গুন্ডা বদমাশদের একদম পছন্দ করি না।
হাঁ, কথাটা বোধহয় আগেও বলেছ।
আর সেইজন্যই অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে তোমাকে ওখান থেকে বের করে এনেছি।
গোপীনাথ সামান্য উদ্বেগের গলায় বলল, কিন্তু ওরা তো তোমার ঠিকানা জানে জিনা।
জানে। তবু আমার ঠিকানায় তুমি নিরাপদ। আমি যদি পাড়ার লোকদের বলে রাখি তবে তারা এমন ব্যবস্থা করবে, যাতে বাইরের কেউ ঢুকতে পারবে না। আমার পাড়াটায় আমারই নানা আত্মীয়স্বজনের বাস। আমরা খুবই আত্মীয়বৎসল।
জিনা ক্রমশ রোমের ঘিঞ্জি একটা এলাকায় ঢুকে পড়ছিল। সরু সরু গলি, বাচ্চারা খেলছে, বউ-ঝিরা গল্পসল্প করছে। রাস্তাটা যেন রাস্তা নয়, বৈঠকখানা। পথে ঝগড়াঝাটিও হচ্ছে কোথাও কোথাও।
জিনা যে পাড়ায় ঢুকল সেটা প্রায় দমবন্ধ করা একটা গলি। বহু পুরনো পাড়া, বাড়িগুলো যেন একটা আর-একটার ওপর ভর করে আছে।
নামো।
শোনো জিনা, তোমাদের বাড়িতে কি আমি অনভিপ্রেত লোক নই?
না। কারণ তুমি বিপন্ন। বিপন্ন মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে আমাদের পরিবারের সুনাম আছে।
গোপীনাথ নামল। জিনা গাড়িটা পথের পাশেই লক করে রেখে তাকে হাতে হাত ধরে নিয়ে চলল।
জিনাদের বাড়িটা আরও একটা গলির মধ্যে, যেখানে গাড়ি ঢুকবে না। বাড়িটা বেশ বড় এবং পুরনো। গলির পাথরে বাঁধানো রাস্তা থেকে সরাসরি বাড়ির সদর দরজায় উঠতে হয়, অনেকটা উত্তর কলকাতার গলিঘুজির মতোই।
দরজা খুলেছিল একজন বৃদ্ধা।
জিনা চাপা গলায় বলল, আমার পিসি। কথা বলার চেষ্টা কোরো না, বুড়ি কানে শোনে না।
তোমাদের কি যৌথ পরিবার?
না। আমরা মাত্রই কয়েকজন। ভাইরা বেশির ভাগই বিদেশে। আমি, মা, পিসি আর একজন কাকা।
তোমার বাবা?
বাবা নেই।
‘নেই’ কথাটার অনেক রকম মানে হয়। তবে গোপীনাথ আর বেশি জানতে চাইল না।
জিনা তাকে দোতলায় নিয়ে এল। একটা ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, এই ঘরটাই আপাতত তোমার গাড্ডা। আমি বেরোচ্ছি তোমার টিকিটের ব্যবস্থা করতে। ইতিমধ্যে আমার মা তোমার দেখাশোনা করবে। তোমার কি খিদে পেয়েছে?
না। আমি একটু চোখ বুজে পড়ে থাকতে চাই।
বেশ কথা। শুয়ে থাকো। ভয় নেই, কোনও বিপদ হবে না। আমি পাড়ায় বলে যাচ্ছি।
জিনা বেরিয়ে এল। গোপীনাথ জুতোজোড়া খুলে রেখে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। গভীর ক্লান্তি। অথচ ক্লান্তির কারণ নেই। গত দু’দিন সে কোনও পরিশ্রমের কাজই করেনি। তবে কি ভয় আর উদ্বেগই এই ক্লান্তির কারণ?
একটু বাদে দরজায় টোকা পড়ল। গোপীনাথ শক্ত হয়ে গেল হঠাৎ। চাপা গলায় বলল, ভিতরে আসুন।
খিটখিটে চেহারার এক বুড়ি ঢুকেই বলল, তুমি গোপীনাথ?
হ্যাঁ।
কী খাবে?
কিছু না।
কফি?
তারও দরকার নেই।
জিনা তোমার দেখাশোনা করতে বলে গেছে। আমি জিনার মা।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
তোমার কি খুব বিপদ?
হ্যাঁ।
চিন্তা কোরো না। এখানে কিছু হবে না। তুমি নিরাপদ।
আপনাকে ধন্যবাদ।
ঘুমোও।
বুড়ি চলে গেল।
গোপীনাথ উঠে ঘরের ছোট জানালাটা দিয়ে গলিটা একটু দেখল। ডাইনে গলির মুখটায় কয়েকটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।
কৌতূহলী গোপীনাথ গরাদহীন জানালা দিয়ে আরও একটু ঝুঁকে ছেলেগুলোকে দেখার চেষ্টা করতে যেতেই হঠাৎ বাড়ির নীচে আড়াল থেকে একটা অল্পবয়সি ছেলে বেরিয়ে তার দিকে চেয়ে ইতালিয়ান ভাষায় বলল, ভিতরে যাও। একদম জানালায় থেকো না। ওরা আসছে।
কারা আসছে?
মাফিয়ারা।
গোপীনাথ কেঁপে উঠল। বলল, কী করে জানলে?
আমাদের লোক চারদিকে আছে।
আমার জন্য তোমাদের যদি বিপদ হয়?
আমরা বিপদ পছন্দ করি। তুমি দয়া করে জানালা দিয়ে মুন্ডুটা বের কোরো না।
গোপীনাথ ছেলেটাকে ভাল করে দেখল। বছর কুড়ির বেশি বয়স নয়। রোগা লম্বা চেহারা।
গোপীনাথ বলল, আমার জানা দরকার ওরা আসলে কারা।
বাসিলোঁকে চেনো?
নাম শুনেছি। বা
সিলোঁ আর বেনভেনুটি। সঙ্গে ওদের আরও লোক আছে।
ওদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র আছে। পারবে না।
আগ্নেয়াস্ত্র আমাদেরও আছে। তার চেয়েও বড় কথা, এ পাড়ায় ঢুকবার আগে ওদের দু’বার ভাবতে হবে।
কেন বলো তো?
কারণ এখানে বাইরের লোক সুবিধে করতে পারে না।
গোপীনাথ ঘরের মধ্যে পিছিয়ে এল। এভাবে পালিয়ে থাকাটা তার কাপুরুষোচিত বলে মনে হচ্ছে।
কিন্তু বাসিলোঁ কে তা সে ঠিক বুঝতে পারছে না। নামটা সে কার কাছে শুনেছে। ওদের কে লাগাল তার পিছনে?
গোপীনাথ ফের বিছানায় এসে শুয়ে রইল।
কিছুক্ষণ বাদে হঠাৎ একটা দৌড়োদৌড়ির শব্দ পেল গোপীনাথ। একটা শিস দেওয়ার শব্দও। সে তাড়াতাড়ি উঠে জানালাটা ফাঁক করে চোখ রেখে দেখল, গলিটা ফাঁকা। মোড়ের ছেলেরাও কেউ নেই। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে গোপীনাথ দরজা খুলে প্যাসেজে বেরিয়ে এল। এদিক ওদিক চাইতেই বাঁদিকে সিঁড়িটা দেখতে পেল সে। সিঁড়ি বেয়ে সোজা ছাদে উঠে এল গোপীনাথ। ছাদ থেকে ঝুঁকে দেখল, গলি ছাড়িয়ে আর একটু দূরের রাস্তায় একটা গাড়ি দাঁড়ানো। দু’জন লোককে নিয়ে কয়েকটা ছেলে। উত্তপ্ত কিছু কথাবার্তা হচ্ছে। এখান থেকে শোনা গেল না।
গোপীনাথ তবু খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু সে ভুলেই গিয়েছিল যে, সে ভোলা ছাদে দাঁড়ানো। তাকে রাস্তা থেকে দেখা যাচ্ছে।
হঠাৎ দুম করে একটা শব্দ, আর শিস তুলে একটা তীব্র গতির বুলেট তার মাথার পাশ দিয়ে বেরিয়ে যেতেই কাণ্ডজ্ঞান ফিরে এল তার। সে বসে পড়ল এবং হামাগুড়ি দিয়ে চলে এল সিঁড়ির মুখে।
সিঁড়ি দিয়ে দ্রুতগতিতে নেমে দোতলার প্যাসেজে একটু দাঁড়াল সে। রাস্তার ও দুটো লোককে সে চেনে। এরাই আগের রুমিং হাউসটার করিডরে বসে তাকে পাহারা দিত। মারতে চাইলে তো তখনই মারতে পারত। গোপীনাথের বিশ্বাস ছিল, সাক্কি বা ভিকিজ মব কেউই তাকে মারতে চায় না। মেরে লাভ কী? বরং গোপীনাথ বেঁচে থাকলেই তাদের লাভ। কিন্তু আজ সে বিশ্বাস আর গোপীনাথের রইল না। বুঝতে পারছে তাকে খুন করার আদেশ দেওয়া হয়েছে।
রাস্তায় আরও দু’বার গুলির শব্দ হল। জিনা যে আশ্বাস দিয়েছিল তা কতটা নির্ভরযোগ্য কে জানে। পাড়ার ছেলেরা হয়তো প্রতিরোধ করার চেষ্টা করবে, কিন্তু প্রবল প্রতিপক্ষের সঙ্গে পারবে কি?
ঘরে এসে গোপীনাথ একটা চেয়ারে বসল। জানালার কাছে যেতে সাহস পেল না। একটু দূরে কোথাও আবার দুটো গুলির শব্দ হল। নীচের গলি দিয়ে একাধিক দৌড়পায়ের শব্দ এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে মিলিয়ে গেল।
তারপরই তাকে চমকে দিয়ে টেলিফোন বেজে উঠল ঘরের মধ্যেই। প্রথমটায় টেলিফোনটা খুঁজেই পেল না গোপীনাথ। তারপর পেল। দেয়ালে ঝোলানো সবুজ রঙের টেলিফোনটা জংলা ছাপের ওয়াল পেপারের সঙ্গে এমন মিশে গেছে যে বোঝা যাচ্ছিল না।
আমি জিনা।
উত্তেজিত গোপীনাথ বলল, জিনা, এখানে ভীষণ বিপদ। গুলি চলছে।
গুলি?
হ্যাঁ। আমি অল্পের জন্য বেঁচে গেছি। কিন্তু তোমার পাড়ার ছেলেদের কিছু হলে আমার লজ্জার সীমা থাকবে না।
জিনা শান্ত গলাতেই বলল, আমাদের এসব নিয়েই বাঁচতে হয়। তুমি ভেবো না।
না জিনা, আমি বেরিয়ে যাচ্ছি। এর চেয়ে মরা ভাল।
বীর হওয়ার চেষ্টা কোরো না। মন দিয়ে শোনো। আজ রাত বারোটা নাগাদ এয়ার ইন্ডিয়ার একটা ফ্লাইট রোম হয়ে দিল্লি যাবে। আমি তার একটা টিকিট জোগাড় করেছি।
ঈশ্বর! তুমি তো অসম্ভব সম্ভব করতে পারো।
আমার এক বন্ধু ট্রাভেল এজেন্ট। সে সাহায্য করেছে।
কিন্তু এয়ারপোর্টে যাব কী করে?
আমি তোমায় ঠিক বের করে আনব। অনেক গোপন পথ আছে। আমাদের পাড়াটা একটি পাক্কা গোলকধাঁধা।
জিনা, এ সময়ে তোমার পাড়ায় আসা বিপজ্জনক।
বিপদ কেটে যাবে। ভেবো না। অপেক্ষা করো।
জিনা লাইন কেটে দিল।
গোপীনাথ উঠে ঘরের মধ্যে একটু পায়চারি করল। তারপর গিয়ে জানালাটা ফাঁক করে গলিটা দেখল। সন্ধের আলোয় গলিটা ভুতুড়ে দেখাচ্ছে। কেউ কোথাও নেই।
গোপীনাথ মুন্ডু বের করে ভাল করে চারদিকটা দেখে নিল। মাফিয়ারা এত সহজে হাল ছাড়ার পাত্র কি?
দরজায় টোকা এবং জিনার মায়ের প্রবেশ, হাতে কফির কাপ।
একটু কফি খাও।
গোপীনাথ বলল, ধন্যবাদ। কফি না হলেও চলত।
তুমি নার্ভাস। কফি খেলে ভাল লাগবে। ওতে একটু ব্র্যান্ডি মেশানো আছে। খাও।
গোপীনাথ কফিতে চুমুক দিয়েই বুঝল, ভদ্রমহিলা জাতশিল্পী। ব্র্যান্ডি মেশানো কালো কফি কীভাবে করতে হয় তা দারুণ জানেন।
গোপীনাথ বলল, হ্যাঁ, আমি নার্ভাস। আমি আপনাদের খুব অসুবিধেয় ফেলেছি।
ভদ্রমহিলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, অসুবিধে কিছুই নয়। আমরা এরকম বিপদে প্রায়ই পড়ি। নিম্নবিত্ত ইতালিয়ানদের অবস্থা তুমি তো জানো না। আগে আমাদের কাছ থেকে তোলা আদায় করা হত। আন্তনিও সেসব বন্ধ করেছে।
আন্তনিও কে?
এ পাড়ার সে-ই মোড়ল। সে-ই সবাইকে এককাট্টা করে একটা বাহিনী গড়েছে। মাফিয়াবিরোধী গোষ্ঠী। হয়তো সে শেষ পর্যন্ত পেরে উঠবে না। কিন্তু একটু প্রতিরোধ তো হল। ইতালি শেষ হয়ে যাচ্ছে গুন্ডাবাজিতে।
জানি। আন্তনিওকে আমার নমস্কার জানাবেন।
আন্তনিও যদি সফল হয় তবে সারা রোমে এরকম প্রতিরোধ গড়ে উঠবে, দেখো।
তাই হোক।
আর আন্তনিও যদি মারা যায় তা হলে কী হবে বলা যায় না।
গোপীনাথ কফিটা শেষ করে বলল, উপায় থাকলে আমি আন্তনিওর দলে নাম লেখাতাম।
শুকনো মুখটা হাসিতে উদ্ভাসিত করে জিনার মা বলল, তোমাকে ধন্যবাদ। আন্তনিও শুনলে খুব খুশি হবে। জিনা কি তোমাকে ফোন করেছিল?
হ্যাঁ। আজ রাতেই আমি রোম ছাড়ছি। খু
ব ভাল। মাফিয়ারা লোক খুব খারাপ। যত তাড়াতাড়ি পালাতে পারো ততই ভাল।
একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
করো।
জিনা কেন স্ট্রিপটিজ করে?
ওটা ওর পেশা। খারাপ কী? আমাদের তো বাঁচতে হবে।
এটা তো খারাপ পেশা।
হয়তো তাই। বিশেষ করে এই এইডসের যুগে। তবে বেশিদিন নয়। জিনা হয়তো চাকরি পেয়ে যাবে।
জিনা ভাল মেয়ে। ওকে বলবেন স্ট্রিপটিজ মোটেই ভাল পেশা নয়।
বলব। তুমি যে ওর জন্য ভেবেছ তাতে খুশি হলাম।
নীচে ডোর বেল বাজল। উৎকর্ণ হল গোপীনাথ।
১৮.
জিনার পিসিই বোধহয় দরজা খুলল নীচের তলায়। একটি মেয়েলি কণ্ঠ কী যেন জিজ্ঞেস করল। তারপর একজোড়া লঘু পা উঠে এল ওপরে। একটু বাদে যে এসে ঘরে ঢুকল তাকে বালিকাই বলা যায়। পনেরো-ষোলো বছরের একটি ফুটফুটে মেয়ে। পরনে হালকা নীল রঙের পুলওভার, গরম কাপড়ের প্যান্ট, পায়ে ভারী রবার সোলের জুতো, মাথায় খুব রংদার একখানা রাশিয়ান কান-ঢাকা টুপি।
ঘরে ঢুকেই গোপীনাথের দিকে ডান হাতখানা বাড়িয়ে দিয়ে ইতালিয়ানে বলল, মারিয়া। আমি জিনার বন্ধু।
করমর্দন করে গোপীনাথ বলল, আমি গোপীনাথ।
জানি। জিনা তোমার হুবহু বর্ণনা আমাকে দিয়েছে।
জিনা কোথায়?
জিনা তোমার সঙ্গে এয়ারপোর্টে দেখা করবে। আমি এসেছি তোমাকে নিয়ে যেতে।
গোপীনাথ একটু অস্বস্তি বোধ করে বলল, তুমি! তোমার বয়স কম। তুমি কেন এসব বিপদের মধ্যে এলে?
মেয়েটি ভারী সুন্দর হাসি হেসে বলল, আমি বিপদ ভালবাসি।
গোপীনাথ তবু একটু কিন্তু কিন্তু করছিল। একবার জিনার মায়ের দিকে তাকাল।
জিনার মা তার শুকনো মুখে বললেন, ওকে অবিশ্বাস করার কিছু নেই। ও আন্তনিওর বোন।
আন্তনিওর বোন! তা হলে তো সত্যিই অবিশ্বাসের কিছু নেই। গোপীনাথ তৈরিই ছিল। উঠে পড়ে বলল, চলো।
আমি কিন্তু তোমাকে একটা মোটরবাইকে চাপিয়ে নিয়ে যাব। ভয় পাবে না তো?
না। ভয়ের কী আছে?
সবাই বলে আমি নাকি বড্ড জোরে চালাই।
রোমের রাস্তায় জোরে না চালানোই বুদ্ধির কাজ।
মারিয়া হাসল, জোরে না চালালে তোমাকে বের করে নিয়ে যাব কেমন করে? এ পাড়া থেকে বেরোবার মোট চারটে পথ আছে! চারটের মধ্যে তিনটে পথই ওরা বন্ধ করে দিয়েছে।
কীভাবে?
বন্ধ করেছে বলতে ওদের লোক তিনটে মোড়েই পাহারা দিচ্ছে। আন্তনিওর ভয়ে ভিতরে এসে হামলা করেনি। কিন্তু এ অবস্থা বেশিক্ষণ চলবে না। ওরা শেষ অবধি দল বাড়িয়ে ভিতরে ঢুকবে। তার আগেই তোমাকে বের করে নিয়ে যেতে হবে। তা ছাড়া সময়ও বেশি নেই।
চার নম্বর পথটা কি নিরাপদ।
মারিয়া ভ্রু কুঁচকে একটু ভাবল। তারপর বলল, তুমি দশ ফুট উঁচু থেকে লাফ দিতে পারবে?
অবাক হয়ে গোপীনাথ বলল, তার মানে?
চার নম্বর পথ বলতে কিছু নেই। কিন্তু একটা ছাদ ডিঙিয়ে ওপাশে পড়তে পারলে কোনও চিন্তা নেই। ও পাশে আমার মোটরবাইক রাখা আছে।
গোপীনাথ বলল, পারব।
তা হলে চলো। দেরি করলে পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠবে।
আমার জন্য তোমরা অনেক ঝুঁকি নিচ্ছ।
ঝুঁকি আবার কীসের? এসব আমাদের কাছে জলভাত। মাফিয়াতন্ত্রের বিরুদ্ধে আমাদের আরও বড় লড়াই করার আছে। চলো।
গোপীনাথ জিনার মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এল।
সিঁড়ি দিয়ে গোপীনাথের আগে আগে নামতে নামতে মারিয়া বলল, একটু দৌড়োতেও হবে। তুমি দৌড়োতে পারবে তো?
পারব। তবে গত এক সপ্তাহ আমি কোনও ব্যায়াম করিনি।
কিন্তু তোমার ফিগার তো ভাল। দেখতে বেশ শক্তপোক্ত।
হ্যাঁ। আমি সহজে কাবু হই না।
তা হলে পারবে।
রাস্তায় বেরিয়ে চারদিকটা দেখে নিয়ে মারিয়া বলল, গলির মুখে যে আড়াআড়ি রাস্তাটা দেখছ ওটাই দৌড়ে পার হতে হবে। কারণ ডানদিকে একটা প্রান্তে ওরা ওত পেতে আছে।
হ্যাঁ, ওদিক থেকেই ওরা আমাকে তাক করে গুলি চালিয়েছিল।
জানি। ওই রাস্তায় তোমার দিকে আবার গুলি চলতে পারে, যদি ওরা দেখতে পায়। তবে গলির মুখের বাতিগুলো আমরা নিবিয়ে দিয়েছি।
ওখানে তোমাদের পাহারা নেই?
মারিয়া মাথা নেড়ে বলল, আছে। তবে এটা একটা খোলা রাস্তা। বাইরের গাড়িটাড়ি যায়। কাজেই ওটা আমরা পুরোপুরি বন্ধ করতে পারিনি। করলে পুলিশ এসে ঝামেলা করবে, ট্রাফিক জ্যাম হবে।
বুঝেছি।
গলির মুখে এসে সাবধানে ডাইনে বাঁয়ে দেখে নিল মারিয়া। সামনের রাস্তায় খানিকটা সত্যিই অন্ধকার।
মারিয়া চাপা গলায় বলল, এবার আমাদের বাঁদিকে খানিকটা দৌড়ে যেতে হবে। ওই যে জলের কলটা দেখছ, ওর পিছনে ডানদিকের গলিতে ঢুকে যেতে হবে। তারপর নিশ্চিন্ত।
গোপীনাথ ব্যাগটা কাঁধের ওপর ফেলে বলল, চলো, আমি প্রস্তুত।
মারিয়া যত জোরে ছুটতে পারে তত জোরে গোপীনাথ পারে না। অন্তত এখন পারছে। দুশো মিটারের মতো পথ মারিয়া এক লহমায় পার হয়ে গেল। গোপীনাথ মাঝামাঝি পর্যন্ত যেতেই হাঁফাচ্ছিল। কে যেন সামনে থেকে চাপা গলায় বলল, জোরে জোরে দৌড়োও দেখতে পাবে।
জলের কলের কাছটায় পৌঁছেই গিয়েছিল গোপীনাথ। একেবারে শেষ সময়ে আচমকা দূর থেকে একটা গুলির শব্দ হল। কোথায় লাগল কে জানে, কিন্তু গোপীনাথ একটা ধাক্কা খেয়ে উপুড় হয়ে পড়ে গেল।
দু’জোড়া পা ছুটে এল। দু’জোড়া হাত তাকে ধরে প্রায় হিঁচড়ে গলির মধ্যে নিয়ে গিয়ে ফেলল।
মারিয়া উদ্বিগ্ন গলায় বলল, তোমার কোথায় লেগেছে?
গোপীনাথ উঠে দাঁড়িয়ে শরীরটাকে অনুভব করল। না, তার গায়ে গুলি লাগেনি। কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে সে বলল, সত্তবত ব্যাগে লেগেছে। অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না।
মারিয়া বলল, পরে দেখা যাবে। চলো, সময় নেই।
যে দুটি ছেলে তাকে টেনে এনেছিল, তাদের দুজনের হাতেই পিস্তল। একজন এসে বলল, দূর থেকে চালিয়েছে বলে বেঁচে গেছ, নইলে ব্যাগসুষ্ঠু তোমাকে ফুটো করে দিত।
মারিয়া গলির মধ্যে তাকে নিয়ে আরও প্রায় দুশো মিটার গেল। কানা গলি। দারুণ ঘিঞ্জি। গলির শেষ প্রান্তের কাছাকাছি মারিয়া তাকে নিয়ে একটা বাড়িতে ঢুকল। সরু সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে উঠে এল চার তলার ছাদে।
গোপীনাথ একটু হাঁফাচ্ছিল। ধকল কম যাচ্ছে না। ব্যায়াম নেই, তার ওপর উদ্বেগ ও অশান্তি তাকে খানিকটা কাহিল করে ফেলেছে।
মারিয়া ছাদের রেলিং-এর কাছে এসে বলল, ও পাশের ছাদটা মাত্র চার ফুট তফাতে। রেলিং-এ উঠে দাঁড়ালে অনায়াসে লাফিয়ে ওপাশে পড়া যায়। তুমি নার্ভাস নও তো?
গোপীনাথ বিবর্ণ মুখে হেসে বলল, আমার অন্য উপায় থাকলে এসব নিয়ে ভাবতাম। তবে এই লাফটা আমাদের প্রোগ্রামে তো ছিল না!
এটা ধর্তব্যের মধ্যে নয় বলে বলিনি।
মারিয়া রেলিং-এর ওপর উঠে দাঁড়াল। নীচে চারতলার ছাদ। কিন্তু সেটা গ্রাহ্য না করে বেড়ালের মতো একটা লাফ মেরে ও পাশের ছাদের রেলিং-এর ওপর চলে গেল। ছাদে নেমে হাত বাড়িয়ে বলল, তোমার ব্যাগটা দাও।
গোপীনাথ ব্যাগটা ওর হাতে চালান করে রেলিং-এর ওপর উঠল। উচ্চতার ভয় তার আছে, তবে এখন তার কাছে এগুলো কোনও ব্যাপার নয়। সে দাঁড়িয়ে একটু ঝুল খেল। তারপর খুব জোরে নিজেকে ছুঁড়ে দিল ওপাশে, এমনভাবে যাতে রেলিং-এ না থেমে ছাদে গিয়ে পড়া যায়। কিন্তু হিসেবের একটু ভুল হল গোপীনাথের। চমৎকার লাফটা দিলেও পা ভাল করে না গোটানোর ফলে পাশের ছাদের রেলিং-এ পা লেগে সে ও পাশের ছাদে গিয়ে পড়ল একেবারে কুমড়ো গড়াগড়ি খেয়ে।
মারিয়াই তাকে তুলে দাঁড় করাল, তোমার লাগেনি তো!
লেগেছে। ভালই চোট হয়েছে বাঁ হাঁটু আর বাঁ কনুইয়ে। শীতকাল বলে ব্যথাও হচ্ছে প্রচণ্ড। কিন্তু তা স্বীকার করে কী করে? সে বলল, না। তেমন কিছু নয়।
এসো, আমাদের সময় নেই।
মারিয়ার পিছু পিছু সে দোতলা অবধি নামল। বাড়িটা ফাঁকা এবং পোড়ো বলে মনে হচ্ছিল তার। জিজ্ঞেস করল, এটা কার বাড়ি?
এ বাড়িটা ভেঙে ফেলা হবে শিগগির। এসো।
তারা একটা ঝুল বারান্দার মতো জায়গায় এল। নীচে গলি।
নীচের দিকে চেয়ে গোপীনাথ আতঙ্কিত গলায় বলল, তুমি বলেছিলে দশ ফুট, কিন্তু এ তো দেখছি পনেরো ফুটের কম হবে না।
না, না, অত নয়। দশের জায়গায় বারো হতে পারে। পারবে না?
না পেরে উপায় কী?
শোনো। লাফ দেওয়ার সময় শরীরটাকে স্প্রিং-এর মতো করে নেবে। মাটিতে পড়েই পারলে গড়িয়ে নেবে একটু। তা হলে ইমপ্যাক্টটা টেরও পাবে না।
গোপীনাথ বলল, চেষ্টা করব।
আমি আগে নামছি।
মারিয়া রেলিংটা ডিঙিয়ে বিনা প্রস্তুতিতে লাফ দিল। অবিকল বেড়াল। পড়ল হাঁটু ভেঙে, পা আর হাতে চমৎকার ভর দিয়ে। এত অনায়াসে কাউকে এরকম নামতে দেখেনি গোপীনাথ। ব্যাগটা নীচে ফেলে সে-ও রেলিং ডিঙোল। তারপর নিজেকে ছেড়ে দিল ওপর থেকে। মারিয়ার নকল করেই নামল সে। কিন্তু গোঁড়ালি আর হাতের কবজি ঝিনঝিন করে উঠল লাফের ধাক্কায়। দাঁতে দাঁতে একটা জোর ঠোকাঠুকিও হল। তবু তেমন গুরুতর কিছুই ঘটল না।
মারিয়া তাকে ধরে গালে চকাস করে একটা চুমু খেয়ে বলল, তুমি দারুণ লোক। এসো, ওই আমার বাইক।
গোপীনাথ দেখল মোটরবাইকটা মোটেই মেয়েলি নয়। বেশ শক্তিশালী এবং বড়সড়। দুটো হেলমেট রাখা ছিল সিটের ওপর। মারিয়া তাকে একটা পরিয়ে নিজেও পরল।
শুরু থেকেই গোপীনাথ বুঝল মারিয়া বিপজ্জনক মেয়ে। গলিটা যে স্পিডে পার হল তাতে গোপীনাথের হাত-পা শিরশির করে উঠল।
একটু আস্তে চালাও মারিয়া। এত স্পিড, আমি হয়তো উড়ে যাব।
মারিয়া একটা ডানমুখী মোড় ফিরে স্পিড কমিয়ে বলল, এটা রোম, এখানে খুব স্পিডে কি চালানো যায়? আচ্ছা, তোমার সম্মানে আমি স্পিড কমাচ্ছি, কিন্তু মনে রেখো আমাদের হাতে সময় নেই।
দা ভিঞ্চি এয়ারপোর্ট পর্যন্ত মারিয়া বহুবার তার কথা ভঙ্গ করে মাঝে মাঝে এমন গতিতে চালাল যে গোপীনাথ মেয়েটাকে আঁকড়ে ধরে বসে থেকেও ভাবছিল বোধহয় বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে পিছনে। কিন্তু তারা পৌঁছোল অবিশ্বাস্য কম সময়ে।
নির্দিষ্ট টার্মিনালের বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল জিনা। মুখে একটু উদ্বেগ।
এসেছ? বাঁচা গেল।
গোপীনাথ একটা অদ্ভুত আবেগ বোধ করল মেয়েটার প্রতি। কিছুক্ষণ আগেই এই জিনা এসেছিল তাকে সঙ্গ দিতে। কিন্তু তার পরেই মেয়েটা নিল ত্রাতার ভূমিকা। জীবনটাই অদ্ভুত।
সে জিনার হাত আবেগে চেপে ধরে বলল, আমার জন্য তুমি এতটা করলে কেন?
জিনা একটু হাসল। বলল, সুযোগ পেলে পরে বলব।
আমি তোমার ঋণ কীভাবে শোধ করব বলল তো!
কেউ কারও কাছে ঋণী নয়। আমরা সবাই মানবতার জন্য যেটুকু পারি, করি।
জিনা, তুমি স্ট্রিপটিজ ছেড়ে দাও। তুমি তো সামান্য মেয়েমানুষ নও যে শরীর বেচে খাবে।
যাদের শরীর ছাড়া আর কিছু নেই তারা কী করবে বলো তো?
তোমার অনেক কিছু আছে জিনা। তুমি এক মহান নারী।
জিনা হাসল, এরকম কথা এর আগে আমাকে আর কেউ বলেনি। তুমিই প্রথম।
এটা তোষামোদ নয়। আমি আমার সত্যিকারের মনের কথা বললাম।
জানি। তোমার মুখ দেখে মনে হয় তুমি ধূর্ত নও। এই নাও তোমার টিকিট।
গোপীনাথ তার চেকবই বের করে সই করল। জিনার হাতে দিয়ে বলল, কিছু বেশি টাকা আছে, নিয়ো!
জিনা অবাক হয়ে বলল, কেন?
আমি চাই তুমি সাত দিন ছুটি নিয়ে কোথাও বেড়িয়ে এসো। এটা এক বন্ধুর প্রীতি উপহার।
জিনা চেকটা হাতে নিয়ে চোখ বড়বড় করে বলল, কিন্তু এ তো অনেক টাকা!
গোপীনাথ মাথা নেড়ে বলল, বেশি নয় জিনা, মোটেই বেশি নয়। তুমি তো জানো না মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা আগেও যখন মৃত্যুর মুখে বসে আছি তখন আমি উত্তরাধিকারী খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমার টাকা পয়সা, ভিলা, গাড়ি কাকে দিয়ে যাব বলো তো! পাঁচ ভূতে লুটে নিত সব। এখনও আমার উত্তরাধিকারী নেই। আমি যদি মারা যাই আমারটা ভোগ করার কেউ নেই।
তা বলে এত টাকা!
টাকার অঙ্কটা নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না। ওটা কিছু নয়।
জিনা তাকে হঠাৎ কাছে টেনে এনে গালে একটা পর একটার চুমু খেয়ে বলল, তোমাকে ধন্যবাদ।
গোপীনাথ আর একটা চেক তাড়াতাড়ি সই করে হাস্যমুখী মারিয়ার হাতে দিয়ে বলল, খুকি তোমাকে এটা দিচ্ছি কেন জানো? এটা ঘুষ। যত তাড়াতাড়ি পারো ওই মোটরবাইকটা ঝেড়ে ফেলে একটা গাড়ি কিনে নাও। দু’চাকা বড্ড বিপজ্জনক জিনিস।
চেকটার দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে একটা শিস দিল মারিয়া। বলল, আমি জীবনে একসঙ্গে এত টাকা দেখিনি।
লজ্জিত গোপীনাথ বলল, বন্ধুর সামান্য উপহার।
ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে গোপীনাথ ভিতরের দিকে পা বাড়িয়ে একবার ফিরে তাকাল। দুটি মেয়ে তার দিকে করুণ গম্ভীর মুখ করে চেয়ে আছে। গোপীনাথ মুখ ফিরিয়ে নিল। তার কান্না আসছে।
মধ্যরাত্রির এখনও একটু দেরি আছে। সে বিমানবন্দরের বিবিধ বিধি অতিক্রম করে একসময়ে লাউঞ্জে পৌঁছে গেল। ডিসপ্লে মনিটার দেখল, এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ রোম ছেড়ে যাবে।
গোপীনাথ একটা আরামদায়ক আসনে বসে গা ছেড়ে দিয়ে চোখ বুজল। গত কয়েক ঘণ্টায় তার ওপর দিয়ে উদ্বেগ ও অশান্তির যে ঝড় বয়ে গেছে তার ফলে সে গম্ভীরভাবে ক্লান্ত। ভীষণ ক্লান্ত।
কতক্ষণ কেটে গেছে কে জানে। গোপীনাথের একটু ঝিমুনিও এসেছিল।
হঠাৎ কানের কাছে কে যেন পরিষ্কার বাংলায় বলল, বাঃ, এই তো চাই। আপনি তা হলে এসে গেছেন।
গোপীনাথ চমকে উঠে যাকে তার পাশের সিটে দেখল তার মতো অপ্রত্যাশিত লোক হয় না। তার শরীর হিম হয়ে গেল। পাশে বসে দাতা।
চমকে গেলেন নাকি?
আপনি?
আরে ভয় পাচ্ছেন কেন, সব কিছুর পিছনেই তো আমি।
তার মানে?
জিনা তো আমারই লোক।
গোপীনাথ হাঁ হয়ে গেল।
১৯.
আকস্মিক সাক্ষাৎকারের ধাক্কাটা সামলাতে গোপীনাথের কিছুক্ষণ সময় লাগল। লোকটা বাঙালি বটে, কিন্তু ঘটনাচক্রে এই লোকটাই ভিকিজ মব-এর প্যারিস শাখার চাঁই, আর ভিকিজ মব যে তার পরম শত্রু সেটা আর সন্দেহের অবকাশ রাখে না।
গোপীনাথ তার অশান্ত হৃদযন্ত্রকে কিছুক্ষণ সময় দিল শান্ত হতে। তারপর স্তিমিত গলায় বলল, আপনারা কী চান বলুন তো?
দাতা একটু হেসে বলল, আমরা কী চাই তা তো আপনার অজানা নয়। আমার বন্ধু পল প্যারিসে আপনার সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করেছিল। এক্স টু থাউজ্যান্ড থ্রির সম্পূর্ণ কম্পিউটার প্রিন্ট আউট।
গোপীনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আপনি কি সায়েন্টিস্ট?
না। কিন্তু বন্ধু পল একজন ছোটখাটো বিজ্ঞানী। গোপীনাথ মাথা নেড়ে বলল, এক্স টু থাউজ্যান্ড থ্রি কত বড় প্রোজেক্ট তা আপনি জানেন। পলকে আমি বুঝিয়ে বলেছিলাম অত বড় একটা কাজের হাজারো দিকের হদিশ দেওয়া সহজ নয়। তা ছাড়া আমি সাক্কি ছেড়ে দিয়েছি, এখন তা আরও অসম্ভব। আপনি তো জানেন, সাক্কি আমাকে কীভাবে নজরবন্দি করে রেখেছিল। আপনি আমাকে উদ্ধার করেছিলেন।
হ্যাঁ। তারপর আরও অনেক ঘটনা ঘটে গেছে।
গোপীনাথ মাথা নেড়ে বলল, জিনা আপনার লোক অমি তা জানতাম না। জিনাকে আমার ভাল মেয়ে বলেই মনে হয়েছিল। কিন্তু ওখান থেকে আমাকে বের করে আনার নাটকটা করলেন কেন?
আপনি বেনভেনুটি আর বাসিলোঁকে চেনেন কি?
বাসিলোঁর নামটা শোনা।
হ্যাঁ, বেনভেনুটিও বিখ্যাত লোক। প্রাক্তন বক্সার। একটা মাফিয়া দলের নিচু দরের অপারেটর। নির্বোধ, কিন্তু ভয়ংকর। আপনার ওপর ওদের প্রতিশোধ নেওয়ার ছিল, কারণ রুমিং হাউস থেকে পালিয়ে এসে আপনি ওদের বিপদে ফেলেছিলেন।
তাই নাকি? আমি এত কিছু জানতাম না।
আপনি জিনার সঙ্গে পালিয়ে আসার মাত্র আধ ঘণ্টা আগে আমি খবর পাই যে, ওরা আসছে। জিনাকে সেইমতো সংকেত পাঠাই। জিনা আপনাকে নিয়ে পালিয়ে আসে।
জিনাকে কীভাবে সংকেত পাঠালেন? টেলিফোন তো বাজেনি।
দাতা হাসল, ইলেকট্রনিক্সের এই যুগে একজন বৈজ্ঞানিকের মুখে এই কথা? জিনার গলায় একটা সরু হার আছে, দেখেছেন? তার লকেটে….
গোপীনাথ মাথা নেড়ে বলল, বুঝেছি। এবার কী হবে?
দাতা মাথা নেড়ে বলল, কিছু হবে না। আপনাকে আমি নির্ভয়ে কলকাতা পর্যন্ত যেতে দিচ্ছি। কলকাতায় আপনি আপনার নিজস্ব ফ্ল্যাটে থাকবেন। কেউ বাধা দেবে না। সেইখানে বসে ঠান্ডা মাথায় আপনি এক্স টু থাউজ্যান্ড থ্রি-র ব্লু প্রিন্টটা তৈরি করবেন।
অসম্ভব!
জানি। আমরা আপনাকে সাহায্য করব। কিছু তথ্য আমরা আপনাকে দিচ্ছি। এগুলোকে লিঙ্ক আপ করা আপনার পক্ষে হয়তো সম্ভব। জিনিসটা একটা মারাত্মক পোর্টেবল ক্ষেপণাস্ত্র আমরা তার সবটুকু জানতে চাই। সবটুকু হলেও অনেকটাই আপনি জানাতে পারবেন।
কলকাতায় কি আমি নিরাপদ?
মৃদু একটু হেসে দাতা বলল, নিরাপত্তার গ্যারান্টি কে কাকে দিতে পারে বলুন তো?
আপনি পারেন। কারণ আপনার অর্গানাইজেশনই আমাকে হুমকি দিয়েছিল।
দাতা একটু চুপ করে রইল। তারপর বলল, আপনি বিজ্ঞানের মানুষ, নিজের কাজ নিয়ে থাকেন। পৃথিবীর অন্ধকার জগতের খবর রাখেন না। যদি রাখতেন তা হলে বুঝতেন, অপরাধের জগৎও কী বিপুল।
আপনি এই জগতে ঢুকলেন কেন?
সেটাও আমার কাজ। তবে আমার পা দু’নৌকায়। সেসব আপনি বুঝবেন না। বোঝার দরকারও নেই।
আন্তর্জাতিক একটা অপরাধ চক্রের চাঁই একজন বাঙালি, এ যে আমি ভাবতেই পারি না।
তা হলে ভাববার দরকার কী? ওসব না ভাবাই ভাল। বাঙালি একটা জাতিসূচক পরিচয় মাত্র। মানুষকে কত ভাবে বাঁচতে হয়।
দাতা তার পাশে রাখা একটা চামড়ার ব্যাগ খুলে একটা ফাইল বের করল। ফাইলটা তার হাতে দিয়ে বলল, এটা সঙ্গে রাখুন।
কী এটা?
এর মধ্যেই আপনার সাধের এক্স টু থাউজ্যান্ড থ্রি-র তথ্যগুলো আছে। সাজিয়ে নেওয়া আপনার কাজ।
আমার কলকাতার ফ্ল্যাটে কম্পিউটার নেই।
দাতা অবাক হয়ে বলল, কে বলল নেই?
আমিই বলছি। কলকাতায় খুব কম যাই, গেলেও বিশ্রাম নিই বলে কম্পিউটার রাখি না।
ওসব ভাববেন না। আপনার ফ্ল্যাটে গেলেই দেখতে পাবেন যে, সেখানে একটা কম্পিউটার বসানো রয়েছে।
গোপীনাথ হাঁ করে দাতার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, আপনি তো সাংঘাতিক লোক?
বিনীতভাবে দাতা বলল, নানা, আমি তেমন কিছুনই। আসলে আমাদের অর্গানাইজেশনের হাত খুব লম্বা। তারা সব পারে।
তা বটে।
আর-একটা কথা। সাক্কি কিন্তু জানে যে, আপনি রুমিং হাউস থেকে পালিয়েছেন। তারা এটাও অনুমান করবে যে, আপনি ইতালি ছাড়ার চেষ্টা করবেন।
গোপীনাথ তটস্থ হয়ে বলল, তাই নাকি?
সেটাই তো স্বাভাবিক।
গোপীনাথ মাথা নেড়ে বলল, তা বটে।
সুতরাং একটু সাবধান থাকবেন।
কীরকম সাবধান?
তা জানি না। সেটা নিজেই ঠিক করে নেবেন।
আপনি কি আমার সঙ্গে এই ফ্লাইটেই যাবেন?
মাথা নেড়ে দাতা বলল, না। আমি যাব অন্য জায়গায়, অন্য কাজে। আপনার ভয় নেই, ভিকিজ মব আপনার পিছু নেবে না। যতদিন আমাদের কথা শুনে চলবেন ততদিন নয়।
আর সাক্কি?
সাক্কি একটা কোম্পানি। তারা তো গুন্ডামি করে না। কিন্তু প্রয়োজন হলে পেশাদার গুন্ডা লাগায়। তাদের গতিবিধি সম্পর্কে আমার ধারণা নেই। আমি শুধু আপনাকে সতর্ক করতে পারি।
ধন্যবাদ।
লম্বা ও সুপুরুষ লোকটা উঠে দাঁড়াল। হাত বাড়িয়ে তার কাঁধে একটু চাপ দিয়ে বলল, চলি, এটা আমার টার্মিনাল নয়। আমার ফ্লাইট অন্য টার্মিনালে। কখনও দেখা হয়ে যাবে হয়তো।
গোপীনাথ কথা বলল না। শুধু হাতটা একবার তুলল।
লোকটা দ্রুত পদক্ষেপে লাউঞ্জ পেরিয়ে কোন দিকে যে চলে গেল তা বুঝতে পারল না গোপীনাথ। কিন্তু লোকটার গতিবিধি যে অবাধ তাতে সন্দেহ রইল না তার।
আরও আধ ঘণ্টা বাদে প্লেনে ওঠার নির্দেশ ফুটে উঠল মনিটরে। খুব ধীরে উঠল গোপীনাথ। এগোতে লাগল যন্ত্রের মতো। মাথায় চিন্তার ঝড়।
যখন সিকিউরিটির গাঁট পেরিয়ে প্লেনের ভিতরে ঢুকল তখনও তার গভীর অন্যমনস্কতা কাটেনি।
সাধারণত আইল সিট তার প্রিয়। আজ সে ইচ্ছে করেই আইল সিট নেয়নি। নিয়েছে জানালার ধার। প্লেনের পিছনে প্রায় টয়লেটের কাছাকাছি। পিছনে মাত্র দুটো রো।
অ্যাটাচি কেসটা পাশে নিয়েই বসল সে। ফাইলটা কোলের ওপর রেখে খুলল। কম্পিউটার প্রিন্ট আউট এবং মাইক্রো ফিমের অনেক কিছুই জোগাড় করেছে এরা। ফাইলটা বন্ধ করে অ্যাটাচি কেসটা খুলে ভিতরে ঢুকিয়ে দিল সে। কেসটা সিটে তার শরীর ঘেঁষে দাঁড় করিয়ে রেখে সে বসল।
গভীর রাত। প্লেনে অনেক ভারতীয় যাত্রী। বাংলা কথাবার্তাও শুনতে পাচ্ছে সে। কিন্তু তার ভারতীয়ত্ব অর্ধমৃত। দীর্ঘকাল বিদেশে বসবাসের ফলে বাঙালি বা ভারতীয় দেখলেই আজকাল আর হামলে পড়তে ইচ্ছে যায় না।
পাশের সিট দুটো খালি ছিল। একজোড়া স্বামী-স্ত্রী এসে বসল এবং গোপীনাথ খুব অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। কারণ দু’জনেই বাঙালি। মহিলাটি শাড়ি পরা, সিঁথিতে সিঁদুর। সে বাঙালি টের পেলেই আলাপ জমানোর চেষ্টা করবে।
গোপীনাথ ঘুমের ভান করে সিটে এলিয়ে রইল।
হঠাৎ শুনতে পেল মহিলাটি তার স্বামীকে খুব চাপা গলায় বলল, হ্যাগো, ভদ্রলোককে বললে জানালার পাশের সিটটা ছেড়ে দেবে না?
আরে নাঃ, ওসব বলতে গেলে রেগে যাবে হয়তো।
রাগবে কেন? ভালভাবে বললে ঠিক ছেড়ে দেবে। মুখ দেখে তো ভাল লোকই মনে হচ্ছে, বোধহয় বাঙালিই।
তোমার মাথা। জানালার পাশে বসেই বা কী দেখবে? বাইরের কিছু দেখা যায়?
আহা, আজ চাঁদ উঠেছে দেখোনি? জানালার পাশে বসে জ্যোৎস্না দেখব।
দেখতে হবে না। ঘুমিয়ে পড়ো। গত কুড়ি দিনে অনেক কিছু দেখেছ। জ্যোৎস্নাটা বাদ দাও।
অনেক কিছু না হাতি। প্যাকেজ টুরে কিছু কি দেখা যায়? লুভ্র মিউজিয়ামটায় মাত্র একদিন নিয়ে গেল। রোমও তো কিছু দেখা হল না।
আচ্ছা, পরে আবার আসা যাবে।
আর এসেছ! এবার আসতেই কত সাধাসাধি করতে হয়েছে।
ছেলেমেয়ে রেখে বিদেশ বেড়াতে আমার ভাল লাগে না বলেই আপত্তি ছিল।
ওরা এখন বড় হয়ে গেছে। অত চিন্তা করো কেন বলো তো পুরুষমানুষ হয়ে?
আমার মন তোমার মতো শক্ত নয়।
মহিলা বললেন, এরা কিন্তু আমাদের খুব খাওয়ার কষ্ট দিয়েছে। এরকম জানলে এদের সঙ্গে আসতামই না। খেতে গিয়েই তো টাকা সব ফুরিয়ে গেল, মার্কেটিং হলই না।
আর মার্কেটিং! ইউরোপে যা জিনিসের দাম? ওসব মার্কেটিং দেশে করলে দশ ভাগের এক ভাগ দামে পাওয়া যেত।
ওগো, ভদ্রলোক বোধহয় ঘুমোননি। হাঁটু নাড়ছেন। বলবে?
আরে না, প্লেনে যে যার সিট বেছে নেয়। বললে রেগে যাবে।
আমি বাজি ফেলতে পারি, ভদ্রলোক বাঙালি।
বাঙালিরা তো আরও প্রতিবাদী হয়।
ধ্যাত, তুমি কোনও কাজের নও।
গোপীনাথ আর পারল না। চোখ খুলে সোজা হয়ে বসে ভদ্রমহিলার দিকে চেয়ে বলল, আসুন, আপনি এই সিটে বসুন।
মহিলা জিভ কেটে হেসে ফেললেন, এ মা, আপনি আমার কথা শুনতে পেলেন নাকি?
না না, একদম শুনতে পাইনি। কিন্তু আকাশে আজ যে জ্যোৎস্নাটা উঠেছে সেটা মনে হল এক্সক্লুসিভলি মহিলাদের জন্যই। আসুন, লজ্জার কিছু নেই।
একটু ‘না না’ করে ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা জানালার দিকে সরে গেলেন। গোপীনাথ আইল সিটে বসল। ওপরের ক্যাবিনেটে অ্যাটাচি রাখতে ভরসা পাচ্ছে না। পাশেই রাখল।
ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি এনআরআই?
কী করে বুঝলেন?
বোঝা যায়।
হ্যাঁ, আমি এনআরআই-ই বটে।
আমার নাম গৌরাঙ্গ গাঙ্গুলি।
আমি গোপীনাথ বসু।
কোথায় থাকেন?
রোমে।
দু-চার কথা আলাপ জমে উঠছিল। কিন্তু এই আলাপটা খুব একটা চাইছিল না গোপীনাথ। তার চারদিকে নজর রাখা দরকার। সে আড়চোখে ভিতরটা দেখে নিয়েছে। সন্দেহজনক কিছু দেখতে পায়নি। সামনের দিকে কয়েকজন বিদেশি আছে বটে, কিন্তু তারা মাফিয়া কি না কে বলবে।
গৌরাঙ্গ কিছুক্ষণ কথা বলে ঘুমিয়ে পড়ল। কেবিন লাইটগুলো নিভে গেল একে একে। প্লেন ভেসে চলেছে আকাশের অনেক ওপর দিয়ে।
আজ রাতে গোপীনাথের ঘুম আসবে না। সে মাথাটা এলিয়ে রেখে চোখ বুজে রইল। সামনে অনিশ্চিত একটা সময়। সে নিজের পরিস্থিতি বুঝতে পারছে না।
ঘণ্টাখানেক বাদে হঠাৎ সে একটু চমকে উঠল। সামনের চারটে রো আগে একটা লম্বা লোক আধো অন্ধকারে হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। লোকটা বিদেশি। লোকটা পিছনের দিকে আসছে।
অ্যাটাচি কেসটা শক্ত করে চেপে ধরল গোপীনাথ। লোকটা তাকে পেরিয়ে টয়লেটের দিকে চলে গেল। একটু বাদে ফিরে গেল নিজের সিটে।
গোপীনাথ ভাবল, আমার কি রজ্জুতে সর্পভ্রম হচ্ছে?
ঘড়িতে যখন রাত তিনটে তখনই পূর্ব দিগন্তে সূর্যোদয় ঘটে গেল। প্লেনের ভিতরটা ঝলমল করে উঠল সকালের আলোয়।
গৌরাঙ্গ একটা হাই তুলে বলল, সকাল হয়ে গেল বুঝি?
হ্যাঁ। আমরা পুবদিকে যাচ্ছি তো, তাই।
বেশ মজার ব্যাপার। আচ্ছা, এরা ব্রেকফাস্ট কখন দেবে?
দেবে।
লোকটা টয়লেটে গেল। মহিলা অঘোরে ঘুমোচ্ছেন। এঁরা কষ্ট করে ইউরোপ ভ্রমণ করে এলেন প্যাকেজ ট্যুরে। এই টুরগুলো মধ্যবিত্ত বাজেটে বাঁধা থাকে বলে খানিকটা কষ্ট হয়।
গোপীনাথ খুব সন্তর্পণে চারদিকটা দেখল। টয়লেটে যাওয়া দরকার, কিন্তু অ্যাটাচি কেসটা কারও জিম্মায় না দিয়ে যায় কী করে? একটু অপেক্ষা করার পর গৌরাঙ্গ ফিরলে সে বিনীতভাবে বলল, দয়া করে অ্যাটাচি কেসটা একটু নজরে রাখবেন? আমি টয়লেট থেকে আসছি।
গৌরাঙ্গ অবাক হয়ে বলল, উড়ন্ত প্লেন থেকেও চুরিটুরি হয় নাকি?
গোপীনাথ একটু লজ্জা পেল। বাস্তবিক, প্রস্তাবটাই অবাস্তব। মৃদু হেসে বলল, কত কী হয়।
গৌরাঙ্গ বলল, আমার অবশ্য ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটের তেমন অভিজ্ঞতা নেই। ঠিক আছে, আপনি যান।
টয়লেট থেকে যখন ঘুরে এল গোপীনাথ তখন বারো-তেরো মিনিট কেটেছে। এসে দেখল, অ্যাটাচি নেই, গৌরাঙ্গ নেই। শুধু মহিলাটি ঘুমোচ্ছন।
আতঙ্কে খানিকক্ষণ স্ট্যাচু হয়ে রইল গোপীনাথ। তারপর ভদ্রমহিলাকে হাঁটুতে ঠেলা দিয়ে জাগিয়ে হিংস্র গলায় বলল, আপনার হাজব্যান্ড কোথায়?
মহিলা ভয় পেয়ে সোজা হয়ে বললেন, জানি না তো! আমি তো ঘুমোচ্ছিলাম।
সর্বনাশ! বলে গোপীনাথ সামনের দিকে দ্রুত পায়ে ছুটে গেল। উড়ন্ত প্লেন থেকে কেউ কখনও পালাতে পারেনি। সুতরাং লোকটাকে ধরা যাবেই।
ধরা গেল সহজেই। গৌরাঙ্গ গাঙ্গুলি খাবারের ঘরের সামনে প্যাসেজে দাঁড়িয়ে একজন এয়ার হোস্টেসের সঙ্গে গল্প করতে করতে কফি খাচ্ছে। গোপীনাথের অ্যাটাচি কেস তার ডান হাতে। গোপীনাথ গিয়ে তার হাত থেকে প্রায় ছিনিয়ে নিল সেটা।
লোকটা অবাক হয়ে বলল, ও আপনি? আমি ভাবলাম ছিনতাই হচ্ছে বুঝি। ভাবলাম, যখন দেখতে বলে গেছেন তখন অ্যাটাচি কেসটায় গুরুতর জিনিস আছে। তাই এটা নিয়েই কফি খেতে এসেছিলাম।
গোপীনাথ অপ্রস্তুতের একশেষ। মৃদু স্বরে বলল, আমাকে ক্ষমা করবেন।
২০.
গোপীনাথ বুঝতে পারছে পরিস্থিতির চাপে সে সম্পূর্ণ অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। নার্ভাস, নির্বোধ ও কাণ্ডজ্ঞানশূন্য। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ না আনতে পারলে সে হয়তো আরও বোকার মতো কাণ্ড করে ফেলবে। গৌরাঙ্গ গাঙ্গুলির হাত থেকে অ্যাটাচি কেসটা কেড়ে নিয়ে সে এমন একটা কাণ্ড করল যা আশেপাশের সকলের চোখে পড়েছে।
নিজের সিটে ফিরে এসে সে কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইল। মিসেস গাঙ্গুলির ঘুম সে এমন ভাবেই ভাঙিয়ে দিয়েছে যে ভদ্রমহিলা জড়সড় হয়ে বসে ভিতু ভিতু চোখে মাঝে মাঝে তাকে দেখছে। বড় লজ্জা করছে গোপীনাথের। ভদ্রমহিলার হাঁটু সে খিমচে দিয়েছিল।
গৌরাঙ্গ গাঙ্গুলি সিটে ফিরল আরও প্রায় দশ মিনিট পর। বউকে বলল, গুহবাবুর সঙ্গে দেখা করে এলাম। পরশু পাস্তা খেয়ে পেট খারাপ হয়েছিল। এখন ভাল আছেন।
বউ একটু গুম হয়ে আছে। শুধু বলল, ও।
এখনই বউটি ফিসফিস করে গৌরাঙ্গর কাছে এবং গৌরাঙ্গ ফিসফিস করে বউয়ের কাছে তার বিষয়ে বলবে। তখন গোপীনাথের ভাবমূর্তি যে এদের কাছে কী হবে তা ভাবতেই গোপীনাথের বড্ড লজ্জা হচ্ছে। ফিরে আসার পর গৌরাঙ্গ বা তার বউ তার সঙ্গে কথা বলছে না, এটাও অস্বস্তিকর। যদিও প্লেন থেকে নেমে যাওয়ার পর আর কারও সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে না, তবু একটা বিচ্ছিরি ঘটনার তেতো স্বাদ থেকে যাবে। গোপীনাথ তাই এদের সঙ্গে সম্পর্কটা সহজ করার উপায় ভাবতে লাগল।
হঠাৎ একজন তরুণী এয়ার হোস্টেস তাদের সামনে এসে মিসেস গাঙ্গুলিকে ইংরিজিতে জিজ্ঞেস করল, মিস্টার গোপীনাথ বসুর এই সিটে বসার কথা। তিনি কোথায়?
গাঙ্গুলির বউ থতমত খেয়ে গোপীনাথকে দেখিয়ে দিয়ে বাংলায় বলল, উনি এই সিটে ছিলেন।
এয়ার হোস্টেস নিচু হয়ে প্রায় তার কানে কানে বলল, ইউ আর ওয়ান্টেড অন দি ফোন স্যার। ইটস ইন্টারপোল!
ইন্টারপোল! গোপীনাথ তটস্থ হল। ইন্টারপোল তাকে চাইছে কেন?
এবার সে আর অ্যাটাচি কেসটা সঙ্গে নিল না, গৌরাঙ্গকে দেখতেও বলে গেল না। সেটা পড়ে থাকল তার সিটে। যাক, ওইটুকুই তার গৌরাঙ্গ আর তার বউয়ের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা।
টেলিফোনে নির্ভুল দাতার কণ্ঠস্বর, কেমন আছেন?
ভালই।
কোনও ঘটনা ঘটেনি তো!
না। আপনি কোথা থেকে ফোন করছেন?
প্যারিস। শুনুন, আপনার পিছনে দুটি ছায়া আছে।
তার মানে?
ইউ আর বিয়িং শ্যাডোড বাই টু অপারেটর্স।
তারা কারা?
সাক্কির ভাড়া করা মাফিয়ারা।
গোপীনাথ একটু চুপ করে থেকে বলল, কী করব বলুন তো!
সতর্ক থাকবেন।
সতর্কই আছি।
আমার অনুমান ওরা প্লেনের ভিতরে কিছু করবে না।
কোথায় করবে এবং কী করবে সেটাই জানা দরকার।
কিছুই বলা যায় না। আপনি যে তিমিরে আমিও সেই তিমিরে। আপনি ভয় পাননি তো?
যথেষ্ট নার্ভাস বোধ করছি। কারণ আমি তো বিপজ্জনক জীবন যাপন করি না। এসব অভিজ্ঞতা নতুন।
তা হলে অভিজ্ঞতাটা হোক। জীবনের এসব দিক সম্পর্কেও জ্ঞান থাকা দরকার।
তাই দেখছি।
এবার ভাল করে শুনুন। আমার কথা পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছেন তো! পাচ্ছি। আর ঘণ্টা দেড়েক বাদে আপনার প্লেন দিল্লিতে নামবে। নামবার সময় আপনি মোটেই তাড়াহুড়ো করবেন না। আপনার আগে অন্য সবাইকে নামতে দেবেন। প্রত্যেকটা লোককে ওয়াচ করার চেষ্টা করবেন।
ঠিক আছে। অ্যাটাচি কেসটা কখনও হাতছাড়া করবেন না। গোপীনাথ একটু শঙ্কিত গলায় বলল, কিন্তু এখন তো ওটা আমি সিটে রেখে এসেছি। সর্বনাশ। তা হলে! ওতে যা আছে সেগুলো তো কপি মাত্র। আপনার সঙ্গে তো আরও কপি আছে।
আছে আবার নেইও। ওতে এমন কিছু ইনফর্মেশন আছে যা হাতছাড়া হলে আমাদের হয়তো তেমন ক্ষতি হবে না, কিন্তু শত্রুপক্ষ বিরাট দাও মেরে দেবে।
আমি সিটে ফিরে যাচ্ছি। শুনুন। যে দু’জন অপারেটর আপনাকে ফলো করছে তাদের চোখে ধুলো দিতে হবে যেমন করেই হোক। কথাটা খেয়াল রাখবেন।
চেষ্টা করব। ফোন রেখে গোপীনাথ দ্রুত পায়ে নিজের জায়গায় ফিরে এল। অ্যাটাচি কেসটা রয়েছে জায়গামতোই। আছে গৌরাঙ্গ এবং তার বউও। তবে গৌরাঙ্গ তার দিকে কেমন যেন বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে।
সে বসার পর কিছুক্ষণ ফাঁক দিয়ে গৌরাঙ্গ গাঙ্গুলি হঠাৎ মোলায়েম গলায় জিজ্ঞেস করল, কিছু যদি মনে না করেন একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
নিশ্চয়ই। করুন না।
আপনার অ্যাটাচি কেসটায় কী আছে জানি না, কিন্তু আপনি কি কোনও বিপজ্জনক বা গোপনীয় জিনিস নিয়ে যাচ্ছেন? আপনি উঠে যাওয়ার পর একটা কালোমতো লোক ওদিক থেকে এসে অ্যাটাচিটা হাতে নিয়ে বলল, মিস্টার বোস এটা চাইছেন, নিয়ে যাচ্ছি।
বলেন কী?
ঠিকই বলছি। লোকটা খুব লম্বা, অন্তত ছ’ফুট দু’ইঞ্চি হবে। ব্ল্যাক।
আপনি কী করলেন?
আমি বললাম, না, অ্যাটাচিটা আপনি আমার হেফাজতে রেখে গেছেন। সুতরাং দরকার হলে আমি নিয়ে যাব।
আপনাকে ধন্যবাদ। লোকটা কী করল?
ইংরিজিতে বলল, আপনার নাকি খুবই দরকার অ্যাটাচিটা না হলেই নয়। একটু টানাহ্যাঁচড়াও করছিল।
তারপর?
গায়ের জোরে পারতাম না। কিন্তু হঠাৎ দু’জন এয়ার হোস্টেস এসে পড়ল। তারা লোকটাকে বলল নিজের জায়গায় চলে যেতে। লোকটা বিড়বিড় করে বোধহয় গালাগাল দিতে দিতেই চলে গেল সামনের দিকে।
লোকটা কোথায় বসেছে বলুন তো!
জানি না। সামনের কোথাও হবে।
আপনাকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেব! আপনার সঙ্গে আমি একটু অভদ্র ব্যবহারও করেছি। বিশেষ করে আপনার স্ত্রীর সঙ্গে। আপনারা দুজনেই আমাকে মাপ করে দেবেন। আমি একটা বিশেষ টেনশনের মধ্যে রয়েছি।
আরে তাতে কী হয়েছে? আমরাও বলাবলি করছিলাম যে আপনার একটা টেনশন চলছে।
সম্পর্কটা সহজ হওয়ায় একটা শ্বাস ফেলল গোপীনাথ। তারপর অ্যাটাচিটা খুলল।
গাঙ্গুলি পাশ থেকে আড়চোখে অ্যাটাচির অভ্যন্তরটা দেখে নিয়ে বলল, ইম্পর্ট্যান্ট পেপার্স।
হ্যাঁ।
কাগজপত্র ঠিক আছে দেখে ফাইলটা বন্ধ করে অ্যাটাচিটা ফের পাশে রাখল সে। ব্রেকফাস্ট আসছে। আর ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই দিল্লি।
ব্রেকফাস্টে মোটেই মন বসাতে পারছিল না সে। পাশের গাঙ্গুলিরা অবশ্য গোগ্রাসে খাচ্ছিল। খাওয়ারই কথা। ট্রাভেল এজেন্টদের সঙ্গে ইউরোপ ঘোরা মানেই খাওয়ার কষ্ট। গোপীনাথ যতদূর জানে ওরা ব্রেকফাস্ট ছাড়া মোটে আট-দশটা রাউন্ড মিল দেয়। সুতরাং ডিনার আর লাঞ্চ খেতে হয় নিজের পয়সায়, যেটা অধিকাংশ ভারতীয় ভ্রমণকারীই পেরে ওঠে না। ইউরোপে খাবারদাবারের দাম এঁদের পথে বসিয়ে দেয়।
বেশ ভাল ব্রেকফাস্ট খাওয়ায় তো এরা।
হ্যাঁ। ইচ্ছে করলে কোনও আইটেম আবার চাইতে পারেন।
গাঙ্গুলি তার বউয়ের দিকে চেয়ে বলল, তুমি কিছু নেবে?
না বাবা, অনেক খেয়েছি।
গাঙ্গুলি বলল, কলকাতায় যাবেন নাকি?
হ্যাঁ।
কোথায় থাকেন?
গোপীনাথ কথাটা চেপে গিয়ে বলল, দেশের সঙ্গে বহুকাল সম্পর্ক নেই। হোটেলেই থাকতে হবে।
গ্র্যান্ড নাকি?
দেখা যাক।
আপনারা যারা বিদেশে থাকেন তারা বেশ আছেন। অঢেল পয়সা। আমরা গ্র্যান্ডে এক রাত্রি কাটানোর কথাও ভাবতে পারি না।
হোটেলে থাকা কি ভাল?
টুকটুক এসব কথাবার্তায় সময় কেটে যাচ্ছিল। অবশেষে সিটবেল্ট বাঁধা ও সিগারেট নিবিয়ে দেওয়ার নির্দেশ ঘোষিত হল। তারপর অবতরণের সূচনা।
গোপীনাথ মনে মনে সংযত ও শক্ত হওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। সামনেই কি বিপদ?
প্লেন টার্মিনালের গায়ে যখন এসে ঠেকল তখন যাত্রীদের মধ্যে নামবার বেশ হুড়োহুড়ি। গাঙ্গুলিরাও ব্যস্তসমস্ত।
গৌরাঙ্গ বলল, নামবেন না? কলকাতার ফ্লাইট এখনই ছাড়বে। আজ ডিরেক্ট ফ্লাইট।
হা নামব। আপনারা এগোন, আমি যাচ্ছি।
গৌরাঙ্গ সস্ত্রীক আর অপেক্ষা করল না। ঘরমুখো বাঙালিকে ঠেকায় কার সাধ্য।
গোপীনাথ অপেক্ষা করল। প্লেনের পিছন দিকটা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছিল ক্রমশ। যখন সব লোক দরজার কাছ বরাবর চলে গেছে তখন হঠাৎ গোপীনাথের মনে হল কাজটা ঠিক হচ্ছে না। যদি কেউ বাথরুম টয়লেটে লুকিয়ে থেকে থাকে তবে এই তার সুযোগ। সে চট করে উঠে পড়ল এবং দ্রুত পায়ে এগোতে লাগল সামনের দিকে।
সিদ্ধান্তটা যে সে ঠিকই নিয়েছে সেটা বুঝতে পারল সঙ্গে সঙ্গেই। পিছনে একটা ক্লিক শব্দ শুনে চট করে পিছনে তাকিয়ে সে একটা লোককে দেখতে পেল। লোকটা মাঝারি উচ্চতার এক সাহেব। চওড়া কাঁধ এবং বিশাল স্বাস্থ্য। লোকটা তার দিকে চিতাবাঘের মতো ছুটে আসছিল।
গোপীনাথ জীবনে কখনও শারীরিক সংঘর্ষে যায়নি। আসলে যেতে হয়নি তাকে। কিন্তু এই পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে আত্মরক্ষার্থে তাকে ঘুরে দাঁড়াতে হল। ছুটে দরজা অবধি যাওয়ার সময় ছিল না। কেউ পিছু ফিরে দেখতও না কী হচ্ছে।
লোকটার হাতে একটা ছোরার মতো জিনিস। মারবে নাকি? লোকটা তার ওপর এসে পড়ার আগেই গোপীনাথ গিয়ে পড়ল লোকটার ওপর, হিংস্র আক্রোশ এবং সম্পূর্ণ কাণ্ডজ্ঞানরহিত হয়ে। কী করে লোককে মারতে হয় তা জানে না গোপীনাথ। তার সম্বল শুধু রাগ।
আর সেই রাগটাই পেশাদার মাফিয়া গুন্ডার বিরুদ্ধে আশ্চর্য সফল হয়ে গেল। গোপীনাথ লম্বা মানুষ, পায়ে একজোড়া ভারী ইতালিয়ান জুতো। সে তার লম্বা পায়ে লোকটাকে সরাসরি একটা জম্পেশ লাথি কষাল অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায়। লোকটা নিশ্চয়ই মারপিটের কৌশল জানে। বাগে পেলে গোপীনাথকে হালুয়া বানিয়ে দিতে পারে। কিন্তু গোপীনাথ যে উলটে আক্রমণ করবে এটা প্রত্যাশা করেনি বলেই লাথিটা খেয়ে গেল লোকটা এবং উলটে চিতপাত হয়ে পড়ে গেল দু’সারি আসনের মাঝখানে অপরিসর জায়গাটায়। পড়ার সময় সিটের হাতলে মাথাটা ঠুকেও গেল খুব জোরে।
গোপীনাথ দ্রুত দরজায় কাছে পৌঁছে গেল। শেষ চার-পাঁচজন যাত্রী বেরিয়ে যাচ্ছে। গোপীনাথ তাদের সঙ্গেই বেরিয়ে এল।
লাউঞ্জ পেরিয়ে কলকাতার প্লেন ধরার জন্য আর একটা লাউঞ্জে পৌঁছে গেল সে। কলকাতায় ফ্লাইটের ঘোষণা চলছে লাউড স্পিকারে।
গৌরাঙ্গ গাঙ্গুলি আর তার বউ মুষ্টিমেয় কলকাতা-যাত্রীদের মধ্যে বসা। গৌরাঙ্গ তাকে দেখে বলে উঠল, দেরি হল যে!
একটু কাজ ছিল।
আসুন মশাই, বসুন এখানে। মেলা জায়গা। কলকাতার যাত্রী তো দেখছি নেই-ই।
সাবালক হওয়ার পর জীবনে এই প্রথম আজ সে একটা শরীরী সংঘর্ষে গেল। আর লাথি খেয়ে একটা লোক এখনও ওই প্লেনের মেঝেয় পড়ে আছে। ঘটনাটা এখনও বিস্মিত ও উত্তেজিত রেখেছে তাকে। সে বসে রুমালে মুখ মুছল। তারপর উঠে গিয়ে কল থেকে জল খেয়ে এল। ধাতস্থ হতে একটু সময় লাগল তার।
গৌরাঙ্গ বলল, আপনাকে একটু রেস্টলেস লাগছে। শরীর ঠিক আছে তো?
আছে।
গৌরাঙ্গের বউ ওপাশ থেকে বলল, ওঁর কী সুন্দর ফিগার দেখছ না? শরীর খারাপ হবে কেন?
ফিগারের প্রশংসায় খুশি হওয়ার মতো অবস্থা এখন তার নয়। তবু ভদ্রতার হাসি হাসল সে।
গৌরাঙ্গ বলল, তা অবশ্য ঠিক। আপনার স্বাস্থ্যটা হিংসে করার মতোই। আপনি কী করেন বলুন তো?
চাকরি।
কোথায়?
রোমে।
বেশ আছেন। প্রাচীন শহর, কত কী দেখার আছে। আমাদের তো রোমটা দেখালই না। যাওয়ার সময় দু’দিন মাত্র ছিলাম। দু’দিনে আর কী দেখা যায় বলুন। ওই কলোসিয়ামটিয়াম যা একটু দেখাল। ফেরার সময় লন্ডন থেকে ছেড়ে দিল টিকিট দিয়ে।
আপনারা কি রোম থেকে ওঠেননি?
না মশাই, না। রোমে প্লেন আসতেই আমরা হ্যান্ডব্যাগট্যাগ নিয়ে টার্মিনালে গিয়ে উকিঝুঁকি মারলাম একটু।
তাই বলুন।
কলকাতার বিমানে ওঠার নির্দেশ ঘোষিত হল। গোপীনাথ চারদিকে নজর রাখছিল। না, লাথি খাওয়া লোকটাকে দেখা যাচ্ছে না।
বিশাল এয়ারবাসের অভ্যন্তরে যাত্রীসংখ্যা ত্রিশ-চল্লিশ জন হবে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসার পরও অভ্যন্তরটা হাঁ হাঁ করছিল।
গৌরাঙ্গদের পাশাপাশি সিট পড়েছিল তার। কিন্তু নির্দিষ্টসিটে বসার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। সুতরাং সে বসল গৌরাঙ্গদের পিছনের সারিতে জানালার ধারে।
প্লেন ছাড়তে কি একটু বেশি সময় নিচ্ছে? এখনও দরজা খোলা। কেউ কি উঠবে আরও?
গোপীনাথের বুকটা হঠাৎ কেঁপে উঠল। একটা দীর্ঘকায় লোক দরজা দিয়ে ঢুকেই সামনে একজিকিউটিভ ক্লাসের দিকে চলে গেল না! লোকটা তো কালোই মনে হল!
আরও কিছুক্ষণ দরজাটা খোলা রইল। একেবারে শেষ সময়ে গোপীনাথকে শিহরিত করে ঢুকল লাথি-খাওয়া লোকটা। গতি ধীর। একবার প্লেনের পিছন দিকে তাকাল। তারপর সামনের একজিকিউটিভ ক্লাসের দিকে এগিয়ে গেল।
গোপীনাথ একটু ঘাবড়ে গেল। ফের নিজেকে সংযত করে নিল। একটা লাথি তত দিতে পেরেছে। ভয় কী?