১৬-১৮. হ্রবু-হে বিজয়ী বীর!

১৬. হ্রবুহে বিজয়ী বীর!

দিগ্বিজয়ী হ্রবু! তাহলে চেহারার এই মিলটাই আমার আবছাভাবে মনে পড়ছিলো। কয়েক বছর আগে এই অসাধারণ মানুষটির ছবি বেরিয়েছিলো আমেরিকার সব কাগজেই, তেরোই জুনের তারিখের তলায়, কেননা ঠিক তার আগের দিন হ্রবু (বা রবয়ু) ফিলাডেলফিয়ার ওয়েলডন ইনস্টিটিউটের সভায় আবির্ভূত হয়ে প্রচণ্ড শোরগোল তুলেছিলো–প্রায় হুলুস্থুলই-ফরাশি ঔপন্যাসিক মঁসিয় জুল ভেন পরে তাঁর ক্লিপার অভ দ্য ক্লাউড়স উপন্যাসে তার বিস্তৃত বিবরণ ছাপিয়েছিলেন।

তখন, যখন কাগজে-কাগজে ছবিটা বেরিয়েছিলো, আমি তার চেহারার চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্যগুলো লক্ষ্য করেছিলুম–একবার দেখে ভুলে-যাবার মতো চেহারা তার ছিলো না : প্রশস্ত বৃষস্কন্ধ, পৃষ্ঠদেশ প্রায় যেন একটা অসমান্তরাল বাহুবিশিষ্ট চতুর্ভুজের মতো, তার দীর্ঘতর দিকটা রচনা করেছে জ্যামিতিক স্কন্ধদেশ; হৃষ্টপুষ্ট দৃঢ় গ্রীবা; বিশাল বর্তুলাকার শিরোদেশ। একটু-কিছু হলেই তার চোখ দুটি ধকধক করে জ্বলে ওঠে, আর ঠিক তার ওপরেই আছে ভারি, চিরকুঞ্চিত ঝোঁপের মতো ভূযুগল, যা থেকে ছুরিত হয়ে পড়ে প্রচণ্ড শক্তির ইঙ্গিত। ছোটো-ছোটো খাড়া-খাড়া চুল, আলো পড়লে ধাতুর মতো ঝকঝক করে ওঠে। বিশাল বক্ষোদেশ যেন কামারের হাপরের মতো সবসময় উঠছে-নামছে; আর উরুদেশ, বাহুযুগল, করতল-সবই সেই সবল বিশাল দেহের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই তৈরি। অপেক্ষাকৃত সংকীর্ণ মাথাটিও তাই, নিখুঁত কামানো গাল পরিস্ফুট করে দিচ্ছে তার চোয়ালের সবল পেশীগুলো।

আর এই হলো হ্রবু, দিগ্বিজয়ী হ্রবু, এখন সে দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে, একটিমাত্র কথায় সে তার আত্মপরিচয় দিয়েছে, আমার দিকে নামটা ছুঁড়ে দিয়েছে যেন শাসানোর ভঙ্গিতে, তার এই অভেদ্য দুর্গের ভেতরে স্পর্ধায় গরীয়ান!

এখানে একটু সংক্ষেপে মনে করে নেয়া যাক সেই কাহন, যা কিছুদিন আগে দিগ্বিজয়ী হ্ৰবুর দিকে সারা জগতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলো, মঁসিয় জুল ভের্ন যার চমৎকার বিবরণ লিখেছেন তার ক্লিপার অভ দ্য ক্লাউড়সবইতে। ওয়েলডন ইনস্টিটিউট ছিলো বিমানবিদ্যায় সমর্পিতচিত্ত একটি ক্লাব, তার সভাপতি ছিলেন ফিলাডেলফিয়ার এক মান্যগণ্য মাতব্বর ব্যক্তি-আঙ্কল পুডেন্ট, আর সচিব ছিলেন মিস্টার ফিলিপ ইভাস। ইনস্টিটিউটের সদস্যরা ভেবেছিলো বায়ুর চাইতেই লঘুকোনো বিমানই আকাশে উড়তে পারবে; আর আঙ্কল পুডেণ্ট আর ফিল ইভানসের তত্ত্বাবধানে ইনস্টিটিউট তখন এক গ্যাস-দিয়ে-ফোলানো অতিকায় বেলুন বানাচ্ছিলো, তার নাম দেয়া হয়েছিলো গো অ্যাহেড।

একটি সভায় ক্লাবের সদস্যরা যখন তাদের এই বেলুন নির্মাণ করার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করছে, তখন হঠাৎ সেখানে এই অজ্ঞাতপরিচয়, উটকো, হবু এসে আবির্ভূত হয়, আর তাদের সব পরিকল্পনাকেই বিধিয়ে-বিধিয়ে টিটকিরি দিয়ে কথার তুবড়ি ছুটিয়ে দেয় : জোর দিয়ে বলে উড়াল শুধু তখনই সম্ভব হবে যখন বাতাসের চেয়েও ভারি কোনো বিমান বানানো যাবে–আর সে-যে কোনো মিথ্যে জল্পনা করে আকাশযানের বদলে আকাশকুসুম রচনা করছে না, তার প্রমাণই হলো সে নিজে ঠিক ঐরকম একটি বিমান বানিয়েছে, আর তার নাম সে দিয়েছে অ্যালবাট্রস।

এবার উলটে তার কথাতেই হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলো ওয়েলডন ইনস্টিটিউটের সদস্যরা-বিদ্রূপ করে তারা তখন তার নাম দিয়েছিলো দিগ্বিজয়ী হ্রবু। তারপর যে হুলুস্থুল কাণ্ড হয়েছিলো তার মধ্যে গর্জে উঠেছিলো–গুড়ুম! গুড়ুম!–অনেকগুলো রিভলবার, আর এই হৈ-চৈ এর মাঝখানে এই উটকো আগন্তুকটি অন্তর্ধান করেছিলো।

সেই একই রাত্তিরে সে জোর করে গুম করে নিয়েছিলো ওয়েলডন ইনস্টিটিউটের সভাপতি ও সচিবকে, রাগে-গরগর আঙ্কল প্রুডেন্ট ও ধিক্কারে-মুখর ফিল ইভাকে, আর তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে, জোর করেই, তাদের নিয়ে সে বেরিয়ে পড়েছিলো মহাশূন্যে, আকাশপথে, বিশ্বভ্রমণে, তার ঐ আশ্চর্য আকাশযান অ্যালবাট্রসে। সে চেয়েছিলো এইভাবেই সে–অর্থহীন কথাকাটাকাটির বদলে–তার তত্ত্বটিকে হাতে-কলমে–বা শূন্যে, হাওয়ায়–প্রমাণ করে দেবে। এই অ্যালবাট্রস আকাশযান ছিলো একশো ফিট লম্বা, হাওয়ায় তাকে ভাসিয়ে রাখতো সারি-সারি কতগুলো দিগন্তশায়ী স্কু, আর তাকে সামনে পেছনে চালিয়ে নিয়ে যেতো গলুইতে আর ল্যাজের দিকে সটান-দাঁড়-করানো কতগুলো উল্লম্ব স্ক্র। এই অ্যালবাট্রসে কর্মী ছিলো তার অন্তত আধডজন অনুচর–যারা ছিলো তাদের নেতা হুবুর একান্ত অনুগত ও বশম্বদ।

বিশ্বভ্রমণেই বেরিয়েছিলো তখন অ্যালবাট্রস, ঘুরে এসেছিলো গোটা বিশ্বই, ছয় মহাদেশই। শেষটায়, মরীয়া হয়ে, অ্যালবাট্রসকে বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করে, আঙ্কল পুডেন্ট আর ফিল ইভা পালিয়ে যান : তারা ভেবেছিলেন ঐ মারাত্মক বিস্ফোরণে অ্যালবাট্রস বুঝি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে–আর তার সমস্ত অনুচরকে নিয়ে হ্রবু তখন প্রচণ্ড বেগে আছড়ে পড়েছিলো প্রশান্ত মহাসাগরে।

আঙ্কল পুডেণ্ট আর ফিল ইভান্স তারপর ফিলাডেলফিয়ায় নিজেদের মহল্লায় ফিরে আসেন। এটুকু তারা জেনে এসেছিলেন প্রশান্ত মহাসাগরের কোনো অজ্ঞাত দ্বীপে–তারা তার নাম দিয়েছিলেন আইল্যাণ্ড এক্স-আলবাট্রসকে বানানো হয়েছিলো; কিন্তু এই দ্বীপটির অবস্থান যেহেতু সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ছিলো, কেউ-যে একদিন গিয়ে দ্বীপটা আবিষ্কার করবে, সেই সম্ভাবনা ছিলো সুদূরপরাহত। তাছাড়া তার খোঁজে বেরিয়ে-পড়ার কোনো দরকার ছিলো বলেও কারু মনে হয়নি, কেননা এই অনিচ্ছুক কয়েদিরা প্রতিহিংসার বশে হ্রবুকে সদলবলে নিধন করে এসেছেন বলেই ভেবেছিলেন।

তাই এই দুই ক্রোড়পতি, বাড়ি ফিরে এসে, পরম নিশ্চিন্ত মনে অতঃপর তাদের গো-অ্যাহেড বেলুনের নির্মাণেই আত্মনিয়োগ করেছিলেন; ভেবেছিলেন, এই বেলুনে করেই একদিন তারা সেই আকাশে উড়বেন, যে-আকাশপথে একদিন তাদের জোর করে নিয়ে গিয়েছিলো হুবু, আরো ভেবেছিলেন তাদের গো-অ্যাহেড-বাতাসের চেয়ে হালকা–অন্তত এই বাতাসের চেয়ে ভারি অ্যালবাট্রসের সমান না-হোক, উড়নবিদ্যায় তার চেয়ে মোটেই কম হবে না। তারা যদি একগুয়ের মতো ফের ঐ কাজে আত্মনিয়োগ না-করতেন, তাহলে তারা যথার্থ মার্কিনই বা হতেন কেমন করে?

পরের বছর, বিশে এপ্রিল, অবশেষে, গো-অ্যাহেড-এর নির্মাণ সম্পূর্ণ হলো, এবং ফিলাডেলফিয়ার ফেয়ারমাউন্ট পার্ক থেকে পুডেন্ট আর ইভাকে নিয়ে গো-অ্যাহেড আকাশে উড়লো। হাজার-হাজার দর্শকের মধ্যে আমিও সেদিন ছিলুম ঐ ফেয়ারমাউন্ট পার্কে। দেখেছিলুম, ঐ বিশাল বেলুন রাজহাঁসের মতো সাবলীল ছন্দে উঠে গেলো আকাশে, আর তার স্কুগুলোর সৌজন্যে এদিক-ওদিক-সবদিকেই বিস্ময়কর স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে ঘুরলো-ফিরলো। আর এমনি সময়েই আচমকা একটা চীৎকার উঠেছিলো দর্শকদের মধ্য থেকে : দূর আকাশের কোণায় ঠিক তখন দেখা দিয়েছিলো আরেকটি আকাশযান, আর বিস্ময়কর দ্রুতগতিতে সেটা ক্রমশ কাছে এসে পড়ছিলো। আরেকটা অ্যালবাট্রস –ফিনিক্স পাখির মতো সে ধ্বংস থেকে উঠে এসেছে, সম্ভবত আগেরটার চাইতেও উৎকর্ষে সে অনেক এগিয়ে গেছে। হ্র আর তার অনুচরেরা প্রশান্ত মহাসাগরে সলিল সমাধি থেকে বেঁচেছে–আর প্রতিশোধের স্পৃহায় জ্বলতে-জ্বলতে ফের তাদের ঐ আইল্যাণ্ড এক্স-এ এই দ্বিতীয় আকাশযানটি বানিয়ে নিয়েছে।

বিশাল, অতিকায় একটা শিকারি পাখির মতো অ্যালবাট্রস ছোঁ মেরে নেমে এসেছিলো গো-অ্যাহেড-এর ওপর। হুবু, প্রতিশোধ নেবার চাইতেও বেশি করে চেয়েছিলো সকলের চোখের সামনে হাতে-কলমে প্রমাণ করে দেবে বাতাসের চেয়েও ভারি আকাশযানের অপরিমেয় শ্রেষ্ঠত্ব। আঙ্কল পুডেন্ট আর ফিল ইভা আত্মরক্ষা করার জন্যে যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলেন। অ্যালবার্টসের মতো তাঁদের বেলুন গো-অ্যাহেড সোজা, খাড়া, সরাসরি ওপরে উঠে যেতে পারে না–এটা তারা জানতেন; তারা। চেয়েছিলেন তাদের বেলুন অ্যালবাট্রসের চাইতে অনেক হালকা বলে তারা বুঝি সহজেই তার চাইতেও অনেক ওপরে উঠে যেতে পারবেন। সমস্ত ভারি জিনিশ, যাবতীয় ব্যালাস্ট, তার গো-অ্যাহেড থেকে ফেলে দিয়েছিলেন, তরতর করে উঠে গিয়েছিলেন কুড়ি হাজার ফিট ওপরে। কিন্তু সমানে পাল্লা দিয়ে উঠেছিলো অ্যালবাট্রসও, গো-অ্যাহেডকে পেরিয়ে আরো ওপরে উঠে গিয়েছিলো, তারপর গো-অ্যাহেডকে ঘিরে পাক খেতে শুরু করে দিয়েছিলো, যেন উল্লাসে একটা নাচই সে জুড়ে দিয়েছে আকাশে।

হঠাৎ শোনা গিয়েছিলো এক বিস্ফোরণের আওয়াজ। বিশাল গ্যাসে-পোরা-থলে অর্থাৎ এই বেলুন গো-অ্যাহেড এত উঁচুতে উঠে যাবার ফলে গ্যাস বেরিয়ে গিয়ে একটা উৎকট আওয়াজ করে ফেটে যায়। দরদর করে গ্যাস বেরিয়ে গিয়ে বেলুনটা দ্রুতবেগে। নিচে নেমে আসতে থাকে–এই বুঝি প্রচণ্ডবেগে আছাড় খেলো!

তারপর, সারা বিশ্বকেই অবাক করে দিয়ে, অ্যালবাট্রস তীরবেগে নেমে এসেছিলো তার প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে, সর্বনাশটাকেই ত্বরান্বিত করে দিতে নয়, বরং তাদের উদ্ধার করবার জন্যে। হ্যাঁ, হবু, তার প্রতিহিংসার কথা ভুলে গিয়ে, পড়ে-যেতে-থাকা গো অ্যাহেড-এর গায়ে এসে ঠেকে, আর অর অনুচরেরা গো-অ্যাহেড থেকে অ্যালবাট্রস এ তুলে নেয় আঙ্কল পুডেণ্ট, ফিল ইভান্স আর তাদের সহযোগী বৈমানিকটিকে। তারপর বেলুনটি, এখন-একেবারেই-ফাঁকা, চুপসে গিয়ে ধসে পড়ে ফেয়ারমাউন্ট পার্কের গাছপালার ওপর।

দর্শকরা সবাই ভয়ে-বিস্ময়ে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলো! এখন হ্ৰবু তার কয়েদিদের আবার তার বাগে পেয়েছে, কীভাবে সে এখন এঁদের ওপর শোধ নেবে? এবার কি সে এঁদের চিরকালের মতো উড়িয়ে নিয়ে যাবে নীল শূন্যে?

অ্যালবাট্রস তখন সবেগে, অনবরত, নিচেই নেমে আসছিলো, যেন ফেয়ারমাউন্ট পার্কের ফাঁকায় নেমে পড়বে! কিন্তু সে যদি নাগালের মধ্যে এসে পড়ে, ক্ষিপ্ত দর্শকেরা কি তার ওপর হিংস্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়বে না, ক্ষিপ্ত হয়ে ছিঁড়ে ফেলবে না কি হ্রবুকে, আর তার এই চমকপ্রদ আবিষ্কারকে?

অ্যালবাট্রস মাটি থেকে যখন ছ-ফিট ওপরে, তখন হঠাৎ থমকে থেমে দাঁড়িয়েছিলো। আমার এখনও মনে পড়ে, কী-রকম ক্ষিপ্তভাবে লোকে তার ওপর হামলা চালাতে যাচ্ছিলো–আর ঠিক তখনই গমগম করে উঠেছিলো হ্ৰবুর গলা, সে-যে কী বলেছিলো তখন, আমি যেন এখনও তা হুবহু পুনরাবৃত্তি করে দিতে পারি :

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকগণ! মন দিয়ে শুনুন আপনারা। ওয়েলডন ইনস্টিটিউটের সভাপতি এবং সচিব এখন আবার আমার কবলে এসে পড়েছেন। তারা আমার যে-ক্ষতি করেছিলেন, যেভাবে আমাকে এবং আমার সঙ্গীদের বিস্ফোরণে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন, তাতে আমি যদি তাদের যাবজ্জীবন বন্দী করে রাখি তবে অন্যায় কিছুই করবে না, বরং সে হবে যথার্থ ন্যায়বিচারেরই দৃষ্টান্ত। কিন্তু অ্যালবাট্রস-এর সাফল্য দেখে তাদের এবং আপনাদের মধ্যেও যে-পরিমাণ ক্রোধ ও বিদ্বেষের সৃষ্টি হয়েছে, তাতে মনে হয় সাধারণ মানুষের আত্মা এখনও আকাশ বিজয়ের জন্যে প্রস্তুত নয়, বরং এই অসীম ক্ষমতাকে সে হয়তো মানুষের অকল্যাণেই কাজে লাগাবে। আঙ্কল পুডেন্ট, ফিল ইভানস, যান, আপনারা মুক্ত–আপনারা যেখানে-খুশি চলে যেতে পারেন!

বেলুন থেকে উদ্ধার-পাওয়া তিনজন মানুষই তখন অ্যালবাট্রস থেকে লাফিয়ে নিচে নেমে পড়েছিলেন। আকাশযান অমনি প্রায় তিরিশ ফিট উঁচুতে নাগালের বাইরে উঠে গিয়েছিলো, আর হবু ফের বলতে শুরু করেছিলো :

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকগণ! মানুষ আকাশকে জয় করেছে–কিন্তু এই ক্ষমতা উপযুক্ত সময় না-আসা পর্যন্ত আপনাদের হাতে তুলে দেয়া হবে না। আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি, সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি আমার আকাশযানের রহস্য। মানুষের কাছ থেকে অন্তরিক্ষবিজয়ের এই চাবিকাঠিটি কখনও হারিয়ে যাবে না, তবে যখন তারা শিখবে কী করে এই ক্ষমতার অপব্যবহার না-করতে হয়, শুধু তখনই এর তত্ত্ব ও তথ্যগুলো তাদের হাতে তুলে দেয়া হবে। বিদায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকগণ, আদিউ!

তারপর অ্যালবাট্রসতার বিশাল ক্রুগুলোর প্রচণ্ড ঘূর্ণনের ফলে আকাশে উঠে গিয়েছিলো, আর প্রতিহিংসা নেবার এই অপূর্ব রূপ দেখে মুগ্ধ মানুষের উল্লাসধ্বনির মধ্যে তীরবেগে। দূরে, দিগন্তে, মিলিয়ে চলে গিয়েছিলো।

এই শেষ দৃশ্যটা আমি বেশ কিছু খুঁটিনাটি সমেতই এখানে আমার পাঠকদের মনে করিয়ে দিতে চেয়েছি, কেননা তাতেই বোধহয় আমার সামনে এখন যে-দিগ্বিজয়ী বীর বু দাঁড়িয়ে আছে তার মনের অবস্থা কিছুটা উদঘাটিত করা যাবে। মানবজাতির প্রতি তার সে-রকম কোনো বিদ্বেষ বা বিরূপ মনোভাব নেই। সে এখনও অনাগত ভবিষ্যতের প্রতীক্ষাতেই আছে, যেদিন তার ধারণা মানুষ সত্যি-সত্যি এই বিস্ময়কর আবিষ্কারগুলোর যোগ্য হয়ে উঠবে। তবে এও সত্যি যে এর মধ্য দিয়ে নিজের প্রতিভার ওপর তার অগাধ আস্থাই প্রকাশ পাচ্ছে : যে-অতিমানুষিক শক্তি তার মধ্যে কাজ করে যাচ্ছে তার কথা যে সে শুধু সচেতনভাবে জানে তা-ই নয়, তা নিয়ে তার দুর্দান্ত অহমিকাতেও কোনো ঘাটতি নেই।

এটা মোটেই বিস্ময়কর নয় যে তার এই স্পর্ধা আর অহমিকাই নিজেকে সারা জগতের প্রভু বলে একদিন নিজের পরিচয় দিতে তাকে উসকে দিয়েছে-সেটাই সে জানিয়েছে তার খোলা চিঠিতে। নিশ্চয়ই কিছু-একটা হয়েছে এই অন্তর্বর্তী সময়ে, যেটা তাকে মানুষ সম্বন্ধে এতটা বিতৃষ্ণ করে তুলেছে। অ্যালবাট্রসের সেই শেষ প্রস্থানের পর অন্তর্বতীকালে কী হয়েছে সে-সম্বন্ধে আমি কেবল অনুমানই করতে পারি। এই পরাক্রান্ত উদ্ভাবক শুধু নিছক একটা আকাশযান তৈরি করেই ক্ষান্ত হয়নি। সে এমন একটা যন্ত্র বানাতে চেয়েছিলো যেটা জল-মাটি-আকাশ সবকিছুকেই যেন একসঙ্গে জয় করে নিতে পারে। হয়তো আইল্যাণ্ড এক্স-এর সংগোপন কারখানায় তার অনুগত অনুচরদের সাহায্যে সে এক-এক করে এই আশ্চর্য যানের বিভিন্ন অংশ তৈরি করেছে, যে যান একের ভেতরেই চার, যে অনায়াসে ভোজবাজির মতো রূপান্তরিত হতে পারে একধরনের যান থেকে অন্যধরনের যানে। তারপরে তার দ্বিতীয় অ্যালবাট্রস নিশ্চয়ই এইসব বিভিন্ন যন্ত্রাংশ বহন করে নিয়ে এসেছে গ্রেট আইরিতে, যেখানে সে সব আলাদা আলাদা টুকরোকে জুড়ে দিয়ে বানিয়ে তুলেছে এই বিভীষিকা, কেননা দূর প্রশান্ত মহাসাগরের কোনো অজ্ঞাত দ্বীপের চাইতে গ্রেট আইরি তার কাছে নিশ্চয়ই মনে হয়েছে অধিকতর সহজগম্য। অ্যালবাট্রস নিশ্চয়ই কালক্রমে একদিন ধ্বংস হয়ে গেছে–কোনো দুর্ঘটনায়, নয়তো-বা ইচ্ছে করেই হয়তো সেটার সে বিনাশ ঘটিয়েছে–এই আইরিতেই। তারপরেই আচমকা একদিন আবির্ভূত হয়েছে বিভীষিকা, মার্কিন মুলুকের জলে-ডাঙায় এক তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়ে তুলেছে। অ্যালবাট্রস থেকে বিভীষিকা-নামকরণের ভঙ্গির এই রূপান্তরের মধ্যেই হয়তো নিহিত রয়েছে তার মানসিক অস্থিরতা ও পরিবর্তনের ইঙ্গিত। তারপর তো আমি আগেই বলেছি, ঠিক নায়াগ্রা জলপ্রপাতের মুখটায় এসে, এই আশ্চর্য জলযান হঠাৎ কেমন করে বিশাল দুই ডানা মেলে দিয়ে আমাকে উড়িয়ে নিয়ে এসেছে সাধারণ মানুষের অনধিগম্য এই গ্রেট আইরিতে।

.

১৭. আইন মোতাবেক

এই রোমাঞ্চকর অ্যাডভেনচারের মূল প্রসঙ্গটা, তাহলে, কী? আমি কি তার কোনো পরিসমাপ্তি ঘটাতে পারি–এখনই, কিংবা পরে কোনোদিন? হ্রবুর হাতেই কি সমস্তকিছু নির্ভর করে নেই? আঙ্কল পুডেণ্ট আর ফিল ইভা একদিন প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপ থেকে যেভাবে পালিয়ে যাবার সুযোগ পেয়েছিলেন, সে-রকম কোনো সুযোগ আমি নিশ্চয়ই পাবো না–হবু নিশ্চয়ই দু-বার সেই একই ভুল করবে না। আমি শুধু অপেক্ষাই করতে পারি এখন। কে জানে এই প্রতীক্ষা কতটা দীর্ঘ, ও প্রলম্বিত, হবে!

এক-অর্থে, আমার কৌতূহল কিন্তু আংশিক চরিতার্থ হয়েছে। এখন আমি এটা অন্তত বুঝতে পেরেছি গ্রেট আইরিতে কী হয়েছিলো। এই রোমাঞ্চকর বৃত্তান্তের এতদূর অব্দি এসে আমি জানি ব্লু রিজ মাউন্টেনের আশপাশে লোকে কী দেখে এমন ভড়কে গিয়েছিলো। অন্তত এটা জানি যে এই অঞ্চলে কোনাদিনই অগ্ন্যুৎপাত বা ভূমিকম্পের ভয় ছিলো না–এখনও তার কোনো সম্ভাবনা নেই। পাহাড়ের পেটের মধ্যে কোনো অপার্থিব ভুতুড়ে শক্তি এসে কোনো নারকীয় নৃত্য জুড়ে দেয়নি। আলেঘেনির এই কোনাটায় কোনো জ্বালামুখ জেগে ওঠেনি অপ্রত্যাশিত ও আচম্বিত। গ্রেট আইরি নিছকই ছিলো দিগ্বিজয়ী হ্রবুর আশ্রয়। এই অনধিগম্য গোপন আশ্রয়েই সে জমিয়ে রাখতো তার রসদ বা যন্ত্রপাতির টুকরো। অ্যালবাট্রস-এ করে একদিন আকাশপথে বেরিয়েই নিশ্চয়ই সে আবিষ্কার করেছিলো এমন নিরাপদ আশ্রয়স্থল। প্রশান্ত মহাসাগরের সেই আইল্যাণ্ড এক্স-এর চাইতেও এই আশ্রয়কে তার নিশ্চয়ই অধিকতর সুরক্ষিত ও নিরাপদ মনে হয়েছিলো।

এইটুকুই শুধু জানি আমি; কিন্তু তার এই আশ্চর্য যান কীভাবে তৈরি, কোন ধাতুতে, কোন চালকশক্তিতে, কী তার নির্মাণতত্ত্ব-তার কতটুকুই বা আমি জানি? না-হয় ধরেই নিচ্ছি যে এই একের ভেতরে চার, এই বহুধার্থসাধক যান বিদ্যুতে চলে। কিন্তু আমরা তো আগেই জেনেছি যে অ্যালবাট্রসও তড়িৎশক্তিতে চলতো–আর এই তড়িৎপ্রবাহ সে কোনো অভিনব আশ্চর্য উপায়েই শুষে নিতে চারপাশের আবহমণ্ডল থেকে। কিন্তু কী সেই যান্ত্রিক সৃষ্টি, তার কোনো অনুপুঙ্খই তো আমার জানা নেই। আমাকে কখনোই ঐ এনজিনটা দেখতে দেয়া হয়নি; সন্দেহ নেই যে সেটা আমি কোনোদিনই দেখতে পাবো না–আমাকে দেখতে দেয়া হবে না।

আর আমার মুক্তি? এটা তো তর্কাতীত যে হ্রবু এখনও সকলের অগোচরেই থাকতে চাচ্ছে–সবার অচেনা। তার এই অভাবিত যানটিকে নিয়ে সে-যে কী করবে, তা আমি জানি না–তবে তার খোলা চিঠিটা যদি কোনো ইঙ্গিত হয়, তাহলে জগৎ তার কাছ থেকে কোনো মঙ্গলের বদলে শুধু অমঙ্গলই আশা করতে পারে। কিন্তু যেভাবে সে এতদিন লোকের চোখে ধুলো দিয়ে নিজের পরিচয় গোপন করে রেখেছে, তাতে এটাই মনে হয় যে নিকট-ভবিষ্যতে সে কারু কাছেই নিজের পরিচয় ফাস করে দিতে রাজি হবে না। এখন শুধু একজন-মাত্র লোকই পারে দ্য মাস্টার অভ দি ওয়ার্ল্ড আর দিগ্বিজয়ী বীর বুর পরিচয় ফাস করে দিতে–আর সে হলুম আমি, যে আমার ওপর ভার পড়েছে। তাকে গ্রেফতার করার। নিয়তির এমনই নির্মম পরিহাস যে আমি তাকে গ্রেফতার করার বদলে সে-ই এখন আমাকে বন্দী করে রেখেছে। অথচ আমার উচিত এক্ষুনি তার কাঁধে হাত রেখে বলা : ন্যায়বিচারের নামে, আইন মোতাবেক–

বাইরে থেকে কেউ কি কোনোদিন এখানে এসে আমায় উদ্ধার করে নিয়ে যাবে? উঁহু, তার কোনো সম্ভাবনাই নেই। ব্ল্যাক রক ক্রীকে কী হয়েছিলো, পুলিশ নিশ্চয়ই এতক্ষণে তার সব কথা জানে। সব কথা শুনে মিস্টার ওয়ার্ড নিশ্চয়ই এভাবে তার যুক্তির পইঠাগুলো সাজাবেন : বিভীষিকা যখন তার দড়িদড়ায় আমাকে জড়িয়ে ফেলে ক্রীক ছেড়ে ছুটে বেরিয়েছিলো, তখন হয় আমি ডুবে মরেছি (যদিও আমার মৃতদেহ কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি), আর নয়তো বন্দী হিশেবে আমাকে বিভীষিকায় তুলে নেয়া হয়েছে-এবং আমি, অকর্মণ্য ও অসমর্থ, অসহায় পড়ে আছি বিভীষিকারই কাপ্তেনের হাতে। প্রথম অনুমানটাই যদি সত্যি হয়, তাহলে ওয়াশিংটনের ফেডারেল পুলিশের চীফ ইনসপেক্টর জন স্ট্রকের নামের পাশে ঢ্যাঁড়া কেটে মৃত বলে ঘোষণা না-করে কোনো উপায় নেই। আর দ্বিতীয়টার বেলায়? আমার সহকর্মীরা কি কোনোদিনই আবার আমাকে ফিরে দেখতে পাবার আশা করতে পারবে? যে-দুটি ডেস্ট্রয়ার বিভীষিকার পেছন-পেছন নদী-নায়াগ্রা অব্দি তাড়া করে এসেছিলো, প্রপাতে পড়বার বিপদ দেখে একসময় তারা থেমে পড়েছিলো। তখন রাত নেমে আসছিলো, আঁধার ঘিরে ধরছিলো চারপাশ থেকে-ডেস্ট্রয়ারের ওপর থেকে তারা তখন কী ভেবেছিলো? যে, বিভীষিকা বুঝি প্রপাতের তীব্র স্রোতে আর ঘূর্ণিতে পাক খেতে-খেতে দুশো ফিট ওপর থেকে নিচে আছড়ে পড়েছে? রাতের আঁধারে কেউই নিশ্চয়ই দেখতে পায়নি যে বিভীষিকা তখন দু-ধারে পাখা মেলে দিয়ে হর্সশু ফলসের ওপর দিয়ে উড়ে গিয়েছে, শেষটায় উড়ে এসেছে পাহাড়ের ওপর দিয়ে এই গ্রেট আইরিতে!

আমি কি আমার কপালে কী আছে, সে নিয়ে বুকে এখন কোনো প্রশ্ন করবো? সে কি আমরা কথা কানে নেবে? শুধু নিজের নামটাই আমার দিকে মস্ত ঢেলার মতো ছুঁড়ে দিয়েই সে কি খুশমেজাজ হয়ে ওঠেনি? তার কি এটাই মনে হবে না যে তার নামটাই সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছে?

বেলা গড়িয়েই চললো, কিন্তু অবস্থার আর-কোনো তারতম্য হলো না। হবু আর তার স্যাঙাত্র অবিশ্রাম এনজিনটা নিয়ে কাজ করে চলেছে, বোঝাই যাচ্ছে তার একটা বড়ো-রকম মেরামতি দরকার। তারা নিশ্চয়ই চট করেই আবার বেরিয়ে পড়তে চাচ্ছে, নইলে এত তাড়া থাকতো না। আর, আমাকেও নিশ্চয়ই তারা সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। আমাকে যদি গ্রেট আইরির এই কোটরেই তারা বন্দী করে রেখে চলে যায়, তাহলেও আমার অনুযোগ করার কিছু থাকবে না। আর এখানে রেখে গেলে কিছুতেই আমি এখান থেকে পালাতে পারবো না–তবে রসদ যা থাকবে তাতে আমি হয়তো অনেকদিনই কাটিয়ে দিতে পারবো।

আমি শুধু সারাক্ষণ হ্রবুর মনটাকেই পড়বার চেষ্টা করছিলাম। কী আছে তার মনের মধ্যে? সারাক্ষণই সে যেন কোনো দুরন্ত উত্তেজনায় তেতে আছে। তার ঐ চিরজ্বলন্ত মগজের মধ্যে কোন আগুন এখন দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছে? ভবিষ্যতের জন্যে কী পরিকল্পনা সে আঁটছে তার ঐ নব-নব উন্মেষশালিনী প্রতিভার বশে? এবার সে কোন দিকে ফেরাবে উড্ডীন বিভীষিকার মুখ? সে কি একাই দাঁড়াবে সারা জগতের বিরুদ্ধে, যে-হুমকিটা সে দিয়েছে তার ঐ খোলা চিঠিতে, কোনো উন্মাদের যেটা আস্ফালন?

সেই প্রথম দিনের রাত্তিরে, আমি গ্রেট আইরির একটা খোঁদলের মধ্যে সেঁধিয়ে শুকনো ঘাসের বিছানায় শুয়েছিলুম। প্রতিদিনই আমার সামনে খাবার রেখে দিয়ে যাওয়া হতো। দোসরা ও তেসরা আগস্ট তিনজনেই মুখে টু শব্দটি না-করে সারাক্ষণ অবিরাম কাজ করে গেলো। যখন মনে হলো হ্ৰবুর সন্তোষ-মতো এনজিনগুলো সারাই হয়ে গেছে, সবাই মিলে তখন মালপত্তর ওঠাতে লাগলো বিভীষিকায়, মনে হচ্ছিলো কোনো দীর্ঘ ভ্রমণেই তারা বেরুবে এবার। হয়তো বিভীষিকা এবার দিকে-দিগন্তে যাবে, পেরিয়ে যাবে দূর-দূরান্তর, হয়তো আবার গিয়ে বু পৌঁছুতে চাচ্ছে প্রশান্ত মহাসাগরের ঐ আইল্যাণ্ড এক্স-এই!

মাঝে-মাঝে তাকে দেখতে পাই বিষম চিন্তামগ্ন, সে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে। আইরিতে; কিংঝ কখনও-কখনও সে তার দুই হাত তুলে বিষম স্পর্ধায় যেন ঈশ্বরকেই তার বিরুদ্ধে রণে-আহ্বান করে। তার এই দুরন্ত দম্ভ তাকে কি ক্রমশ উন্মত্ততার দিকেই টেনে নিয়ে যাচ্ছে না? এমন-এক উম্মত্ততা যেটা কারু সাধ্য নেই দমায়–এমনকী তার ঐ দুই অনুচরেরও না, কেননা তারাও যেন কোন-এক উত্তেজনায় সারাক্ষণ টগবগ করে ফুটছে! একসময় তার ছিলো শুধুমাত্র অ্যালবাট্রস, তখন সে শুধু আকাশকেই জয় করেছিলো; এখন সে জয় করেছে জল-মাটি-আকাশ–এই তিনকেই। এখন তার কাছে। যেন কোনো রুদ্ধ দুয়ার খুলে গিয়েছে, দিগন্ত পেরুনো কোনো সীমাহারা পথ–কোনো কিছু নেই, না ডাঙা, না জল, না আকাশ, সেই পথে কোনো দুর্লঙ্ঘ্য বাধার সৃষ্টি করতে পারে।

আর সেইজন্যেই ভবিষ্যতের গর্ভে সে-কোন অভাবিত আতঙ্ক লুকিয়ে আছে, ভেবে-ভেবে আমি ভয়েই কাটা হয়ে যাচ্ছিলুম। এই গ্রেট আইরি থেকে আমার পক্ষে কিছুতেই পালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, আমাকে তারা তাদের এই উম্মাদ অভিযানে টেনে নিয়ে যাবেই! আর বিভীষিকা যখন সীমাহারা মহাসাগর কিংবা দিগন্তহীন মহাকাশ পাড়ি দেবে, তখন কী করে পালাতে পারবো আমি? আমার একমাত্র সুযোগ শুধু তখনই আসবে, যখন সে ডাঙার ওপর দিয়ে পাড়ি দেবে–আর তাও যদি সে শ্লথমন্থর গতিতেই পাড়ি জমায়! এই সুদূর, দুর্বল আশাটিকেই শুধু খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরতে পারি। আমি!

গ্রেট আইরিতে এসেই, আমি হুবুর কাছ থেকে একটা সদুত্তর জানতে চাচ্ছিলুম–আমাকে নিয়ে সে কী করবে বলে ভেবেছে। সে তাতে কোনো সাড়াই দেয়নি, কোনো উচ্চবাচ্য না। এই শেষ দিনে আমি আরেকবার তার কাছে প্রশ্নটা তুললুম। বিকেলবেলায় আমি সেই সুড়ঙ্গটার মুখে গিয়ে দাঁড়ালুম যেখানে তারা একমনে কাজ করে যাচ্ছিলো। সুড়ঙ্গের মুখটায় দাঁড়িয়ে হবু কোনো কথা না-বলে নীরবে শুধু আমার আপাদমস্তক। একবার নিরীক্ষণ করলে। সে কি তাহলে আমাকে কিছু বলতে চাচ্ছে?

আমি তার কাছে এগিয়ে গেলুম, বললুম, কাপ্তেন হবু! আপনাকে আমি আগেই একটা প্রশ্ন জিগেস করেছিলুম-আপনি তার কোনোই উত্তর দেননি। আমি সেই একই প্রশ্ন আপনাকে আবার জিগেস করছি : আপনি আমাকে নিয়ে কী করতে চান?

মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি আমরা, দুজনের মধ্যে ব্যবধান দু-পাও হবে কি না সন্দেহ। বুকের ওপর দু-হাত ভঁজ-করা, সে তার জ্বলন্ত চক্ষু মেলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।–তার বিস্ফরিত চোখে সেই দীপ্ত দৃষ্টি দেখে আমি যেন একেবারে শিউরে উঠলুম। ভীত, সন্ত্রস্ত, আতঙ্কিত–তাতেও বোধহয় আমার বুকের কাঁপুনির বিবরণ সঠিক হয় না। এ-যে কোনো সুস্থ লোকের চাউনি নয়, এ-যে একেবারে পাগলের চোখ, বদ্ধ উম্মাদের চোখ!

আমি আবারও, একটু চ্যালেজের সুরেই, আবারও আমার প্রশ্নটা জিগেস করলুম। মুহূর্তের জন্যে মনে হলো হবু এবার বুঝি তার নীরবতা ভাঙবে।

কী করতে চান আপনি আমায় নিয়ে? আমাকে কি আপনি ছেড়ে দেবেন? না কি এখানে আমায় সারাজীবন আটকে রাখতে চান?

আবার দণ্ডমুণ্ডের এই মালিকের মন তখন নিশ্চয়ই অন্যকিছুতে আবিষ্ট হয়ে ছিলো–আমি যেন আচমকা তাকে তার সেই আবেশ থেকে এক হ্যাঁচকা টানে বার করে নিয়ে এসেছি। তারপরেই সে আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে অসীম স্পর্ধার সঙ্গে তার মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে ধরলে। যেন কোনো অপ্রতিরোধ্য শক্তিই তাকে বারেবারে এভাবে উর্ব আকাশে টেনে নিয়ে যেতে চাচ্ছে–সে যেন আর এই মাটিপৃথিবীরই মানুষ নয়, যেন তার নিয়তিই তাকে টেনে নিয়ে এসেছে এই অন্তরিক্ষে–যেন সে আকাশের মেঘেরই চিরবাসিন্দা। আমাকে সে কোনো উত্তরই দিলে না, মনেই হলো না যে সে আমার কথা কিছু বুঝতে পেরেছে। মোহাবিষ্টের মতো পা ফেলে সে আবার গিয়ে ঢুকলো ঐ সুড়ঙ্গের মধ্যে।

কতক্ষণ যে বিভীষিকা এখানে নিশ্চল পড়ে থাকবে, তা আমি জানি না। তবে তেসরা আগস্ট বিকেলবেলায় দেখতে পেলুম মেরামতির কাজ আর তার ওপর জিনিশপত্তর তোলার কাজ সাঙ্গ হয়েছে। এই যানের সমস্ত ভাড়ারই বোধহয় সুড়ঙ্গ থেকে রসদপত্র এনে ভর্তি করে দেয়া হয়েছে। তারপর তার দুজন সহকারীর একজন, যাকে মনে হলো হ্ৰবুর প্রধান সহকর্মী, যাকে এখন আমি চিনতে পারলুম অ্যালবাট্রসএর ফাস্ট মেট জন টারনার বলে, আরো-একটা কাজে লেগে পড়লো। তার সঙ্গীর সাহায্যে, সে ঐ মস্ত কোটরটার মাঝখানে নিয়ে এলো বাকি সমস্ত জিনিশপত্রই : খালি বাক্স, কাঠের টুকরোটাকরা, ছুতোরের সব সাজসরঞ্জাম, এমন-কতগুলো অদ্ভুত দেখতে কাঠ যা মনে হলো আগে ছিলো অ্যালবাট্রসএরই অংশ, যাকে হয়তো শেষ পর্যন্ত এই অভিনব এবং আরো শক্তিশালী যানের কাছেই আহুতি দেয়া হয়েছে। আর এই বিশাল স্কুপের তলায় পড়ে রইলো রাশি-রাশি শুকনো ঘাস। হঠাৎ মনে হলো, হবু বুঝি চিরকালের মতো তার এই আশ্রয় ছেড়ে চলে যেতে চাচ্ছে!

সত্যি-বলতে, এটা তো ঠিক যে সে মোটেই হাবা নয়। সে তো জানে যে এর মধ্যেই গ্রেট আইরির ওপর পুলিশের নজর পড়েছে–হয়তো শিগগিরই এই পাষাণপ্রাচীর ভেঙে ভেতরে ঢোকবার জন্যে নতুন করে তোড়জোড় শুরু হবে। হয়তো একদিন না-একদিন এ-সব চেষ্টা সফলও হবে–কেউ-একজন এসে হয়তো ঢুকবে ভেতরে, আর তার গোপন আড্ডা আর মোটেই গোপন থাকবে না! সে নিশ্চয়ই চাইবে পুলিশের লোক এসে কিছুতেই যেন তার কোনো চিহ্ন দেখতে না-পায়, কোনো সূত্রই যেন পড়ে না থাকে।

ব্লু রিজের শিখরের আড়ালে সূর্য ঢাকা পড়ে গেলো। এখন এসে শেষবেলাকার রোদ্দুর পড়েছে উত্তরপশ্চিমে, ব্ল্যাক ডোমের ওপর। হয়তো বিভীষিকা অপেক্ষা করে আছে কখন ঘন হয়ে রাতের আঁধার নেমে আসে, যখন সে তার নতুন অভিযান শুরু। করে দেবে। জগৎ তো এখনও জানে না যে এই স্বতশ্চল শকট এবং আশ্চর্য জলযান আবার একটা উড়োজাহাজও বটে। আজ অব্দি কেউই তাকে আকাশে দ্যাখেনি। দ্য মাস্টার অভ দি ওয়ার্ল্ড নিশ্চয়ই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তার চতুর্থ রূপান্তরের কথা গোপন রাখবে সহজে লোককে জানতে দেবে না যে তার এই যান আকাশেও উড়তে পারে!

ন-টা নাগাদ কোটরের মধ্যে নেমে এলো নিবিড় অন্ধকার। আকাশে একটাও তারা নেই। প্রখর পূর্বী হাওয়া তাড়িয়ে নিয়ে এসেছে ভারি-ভারি মেঘ, সারা আকাশ তাতে ঢাকা পড়ে গেছে। বিভীষিকা যদি এখন আকাশে ওড়ে, কেউই তাকে দেখতে পাবে না।

হঠাৎ তখন জন টারনার এসে কোটরের মাঝখানে ঐ পাকার জঞ্জালের তলায় শুকনো ঘাসের গায়ে আগুন ধরিয়ে দিলে। পুরো স্তূপটাই তক্ষুনি দপ করে জুলে উঠলো। নিবিড় ধোঁয়ার মাঝখান থেকে লকলক করে বেরিয়ে এলো লেলিহান শিখা, গ্রেট আইরির শিখরের ওপরেও গিয়ে যেন পৌঁছুলো সেই শিখা। আবারও নিশ্চয়ই মরগ্যানটন আর প্লেজেন্ট গার্ডেনের সাধারণ লোক বিশ্বাস করে বসবে যে জ্বালামুখ তার বিকট হা করে লোল জিহ্বা বার করে দিয়ে আকাশ চাটছে। তারা হয়তো ভাববে, এ বুঝি আগুনের পাহাড়েরই আরেকটা উৎকট কীর্তি।

সেই আগুনের কুণ্ডের দিকে তাকিয়ে রইলুম আমি। কানে আসছে দাউদাউ আগুনের ফোঁসফোঁস, কাঠ-ফেটে-যাওয়ার আওয়াজ, দুরন্ত পূর্বী হাওয়া যেন আরো অস্থির হয়ে উঠেছে। বিভীষিকার ডেক থেকে, হ্রবুও অনিবেমষ লোচনে তাকিয়ে আছে বহ্নিমান শিখার দিকে।

শিখার খ্যাপা রাগ যে-সব টুকরোটাকরা চারপাশে ছিটিয়ে দিচ্ছিলো, জন টারনার আর তার সঙ্গী আবার সেগুলো ঠেলেঠুলে ঢুকিয়ে দিচ্ছিলো আগুনের কুণ্ডের মাঝখানে। আস্তে-আস্তে আগুন সব খেয়ে শেষ করে দিলে, শিখা নুয়ে এলো নিচে, ছাইভস্মের কাছে, জ্বলন্ত অঙ্গারের ওপর দপদপ করলো খানিকক্ষণ। তারপর আবার সব স্তব্ধ আবার নিকষকালো রাত্রি, অবতামসী।

হঠাৎ কে যেন আমার হাত চেপে ধরলো। তাকিয়ে দেখি, টারনার। সে আমাকে টেনে নিয়ে চললো বিভীষিকার দিকে। কোনো প্রতিরোধ নিতান্তই অর্থহীন হতো। তাছাড়া এখানে একা পরিত্যক্ত, পড়ে-থাকার চাইতে অধম আর ভয়াল কী-ই বা হতে পারতো? এই জেলখানার দেয়াল ডিঙিয়ে আমি তো কোথাও যেতে পারবো না!

টারনারও আমার সঙ্গে-সঙ্গে বিভীষিকার ডেকে পা রাখলে। তার সঙ্গী গিয়ে দাঁড়িয়েছে টঙের ওপর, লুক-আউটে, দ্যাখন-কুঠুরির খোপে; টারনার সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলো এনজিন-ঘরে, ভেতরে বিজলি বাতি জ্বলছে, কিন্তু বাইরে তার লেশমাত্র স্ফুরণ নেই। হবু নিজে দাঁড়িয়ে আছে সারেঙের চাকায়, হালে, তার হাতের নাগালে আছে। রেগুলেটর, যাতে সে শুধু গতিই নয়, বিভীষিকা কোন দিকে যাবে, তার ওপরও নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে। আমাকে তারপরই ঠেলে থামিয়ে দেয়া হলো আমার ক্যাবিনটায়, মাথার ওপর আটকে দেয়া হলো হ্যাঁচওয়ের ঢাকনা। নায়াগ্রা থেকে বেরুবার সময় যেমন হয়েছিলো, আজও তাই, আমাকে বিভীষিকার উড়াল দেখতে দেয়া হবে না।

আমি যদিও বিভীষিকার ওপর কী হচ্ছে, তা দেখতে পাচ্ছি না, এনজিনের সব আওয়াজ কিন্তু শুনতে পাচ্ছি ধ্বকধ্বক! হঠাৎ যেন বিভীষিকা মাটি থেকে উঠে এলো বেশামাল, একটুক্ষণ, তারপরেই হাওয়ায় নিজেকে শামলে নিয়ে ভেসে চললো। নিচের টারবাইন তখন দুরন্ত গতিতে পাক খাচ্ছে, আর বিরাট ডানা দুটো যেন আকাশ হাড়াতে শুরু করে দিয়েছে!

এইভাবেই বিভীষিকা, হয়তো-বা চিরকালের জন্যেই, ছেড়ে এলো তার ঈগল পাখির বাসা, গ্রেট আইরি, হাওয়ায় ভেসে চললো, জলে যেমন করে ভেসে চলে কোনো জাহাজ। হ্ৰবু উড়াল দিয়েছে আলেঘেনির দু-পাল্লা শৈলশ্রেণীর ওপর–আর হয়তো সে কোনোদিনই এখানে ফিরবে না।

কিন্তু কোনদিক লক্ষ্য করে সে চলেছে? সে কি পেরিয়ে যাবে নর্থ ক্যারোলাইনার সমভূমি, হন্যে হয়ে খুঁজবে অ্যাটলান্টিক মহাসাগরকে? না কি সে ছুটতে শুরু করেছে। পশ্চিমে, প্রশান্ত মহাসাগরের উদ্দেশে? হয়তো চলেছে দক্ষিণে, মেহিকোর গাফের দিকে। দিন যখন আসবে, আমি কি তখন চিনতে পারবো কোথায় চলেছি, যদি আকাশ আর সমুদ্র একাকার হয়ে রচনা করে দেয় দিগন্ত?

ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে গেলো, আর একেকটা ঘণ্টা কী-যে দীর্ঘ ও প্রলম্বিত প্রহর বলে মনে হলো আমার! খ্যাপা সব অসংলগ্ন ভাবনা ভিড় করে আসছে আমার মনে। যেন আমি ঝেটিয়ে চলে যাচ্ছি আদিগন্ত কল্পনার জগতের ওপর দিয়ে–যে-দুরন্ত গতিতে বিভীষিকা এখন দুর্দাম ছুটেছে, তাতে এই অনিঃশেষ তমসায় কোথায় যে গিয়ে পৌঁছুবো, কে জানে! আমার মনে পড়ে গেলো, অ্যালবাট্রস-এর সেই অবিশ্বাস্য উড়ান–যার একটা বিস্তৃত বিবরণ ছাপিয়েছিলেন মঁসিয় জুল ভের্ন, ওয়েলডন ইনস্টিটিউটের সব নথিপত্তর ঘেঁটে। হ্ৰবু তার সেই প্রথম আকাশযান নিয়ে যা করেছিলো, এখন এই একের ভেতর চারকে নিয়ে তারও কত বেশি করে তাড়া করে যেতে পারবে অসম্ভবকে!

অবশেষে ঐ ছোট্ট ঘুলঘুলি দিয়ে দিনের প্রথম আলোর রশ্মি এসে ঢুকলো আমার ক্যাবিনে। এখন কি তবে আমায় ওপরে যেতে দেয়া হবে, ডেকের ওপর, যাতে নিজের চোখে সবকিছু দেখতে পারি, যেমন একদিন দেখেছিলাম লেক ইরির ওপর? আমি সিঁড়ি বেয়ে উঠে গিয়ে হ্যাঁচওয়ের ঢাকনাটা ঠেললুম, অমনি সেটা খুলে গেলো, আমি অর্ধেকটা উঠে এলুম ওপরে।

চারদিকেই শুধু আকাশ আর সমুদ্র। আমরা কোনো সমুদ্রের ওপর দিয়ে আকাশে উড়ে যাচ্ছি, সম্ভবত হাজার-বারোশো ফিট ওপর দিয়ে–অন্তত সব দেখেশুনে আমার তা-ই মনে হলো। হবুকে কোথাও দেখতে পেলুম না–সম্ভবত সে গিয়ে ঢুকেছে তার এনজিনঘরে। সারেঙের চাকায় দাঁড়িয়ে আছে টারনার, তার সঙ্গী আছে ঐ দ্যাখন-খোপে, লুকআউটে।

এবার আমি স্বচক্ষে দেখতে পেলুম বিশাল ডানাগুলোর ঝাঁপটানি, আগের বার উড়ালের সময় যা আমি দেখতে পাইনি। সূর্যের অবস্থান দেখে–যখন সে আস্তে-আস্তে দিগন্ত থেকে উঠে এলো–আমি বুঝতে পারলুম আমরা দক্ষিণ দিকে চলেছি। অর্থাৎ রাত্তিরে যদি বিভীষিকা তার নিশানা বদলে না-থাকে, তাহলে এখন আমাদের নিচে যে সীমাহারা জল ঢেউ তুলে যাচ্ছে, সেটা মেহিকোর উপসাগর।

তপ্ত একটা দিন ঘোষণা করে দিলে দিগন্তে ঝুলে-থাকা ভারি রাগি লাল মেঘ। আসন্ন ঝড়তুফানের এই লক্ষণ হ্রবুরও নজর এড়ায়নি, আটটা নাগাদ সে এসে টারনারকে ছুটি দিয়ে নিজেই দাঁড়ালে সারেঙের চাকায়। হয়তো অ্যালবাট্রস যে ভয়ংকর তুফানের পাল্লায় পড়ে ধ্বংস হতে বসেছিলো তার কথা ভেবে সে নিজেই এসে দাঁড়িয়েছে হালের কাছে। তবে অ্যালবাট্রস প্রকৃতির যে-দুর্দম শক্তির সঙ্গে যুঝতে পারেনি, এই দুর্দান্ত বিভীষিকা তাকে অনায়াসেই এড়িয়ে যেতে পারবে, কেননা সঙিন সময় এলে সে নেমে যেতে পারবে সমুদ্রে, সেখানেও ঝড় যদি তার ঝুঁটি ধরে নাড়াতে চায় তবে ডুবে যেতে পারবে অতলে, সমুদ্র যেখানে থাকে শান্ত, নিস্তরঙ্গ। তবে হবু হয়তো সব লক্ষণ পড়ে নিয়ে এটাই বুঝেছে যে কালকের আগে এই তুফান এখানে ফেটে পড়বে না। আর তা-ই হ্রবু আকাশ ছেড়ে জলে নেমে এলো না–উড়েই চললো বিভীষিকা, তারপর বেলা গড়িয়ে গিয়ে বিকেল হওয়ায় সে বিশ্রাম দিলে ঐ দুরন্ত ডানা দুটিকে, নেমে পড়লো জলের ওপর, আর সেখানে ফটফট করছে স্বচ্ছ অপরাহু, ঝড়ের কোনো পূর্বাভাসই সেখানে নেই । বিভীষিকা যেন কোনো সমুদ্রের পাখি, কোনো গাংচিল, কোনো অ্যালবাট্রস, যারা ঢেউয়ের ওপর অনায়াসেই বিশ্রাম করতে পারে, সাবলীল ছন্দে ভেসে যেতে পারে। তবে পাখির চাইতে বিভীষিকার সুবিধে বেশি–আর ধাতুর শরীর ককখনো ক্লান্ত হয়ে পড়বে না, অফুরান শক্তি পাবে তার বিদ্যুতের সঞ্চয়কোষ থেকে ।

আমাদের চারপাশে বিশাল সিন্ধু সম্পূর্ণ শূন্য পড়ে আছে। কোনো পালের চিহ্ন নেই কোথাও, কোথাও কোনো চোঙ দিয়ে ভলকে-ভলকে ধোঁয়া উঠছে না। অর্থাৎ, কেউ আমাদের দেখতে পায়নি, কেউ জানে না যে আমরা এখন গালফ অভ মেহিকো দিয়ে ভেসে যাচ্ছি, কোনো টেলিগ্রাম কাউকে আগে থেকে সে-খবর জানায়নি। বিভীষিকা তার নিজের ছন্দে অবিরাম এগিয়ে চলেছে–কোথাও কোনো বাধার মুখে তাকে পড়তে হয়নি। হ্ৰবুর মনে যে কী আছে, তা সে-ই জানে। আমরা যদি অবিশ্রাম এভাবে এগিয়ে চলি, দিক যদি না-পালটাই, তবে একসময় গিয়ে পৌঁছুবো ক্যারিবিয়নে, পশ্চিম ইনডিসে, অথবা তাকেও পেরিয়ে গিয়ে ভেনেসুয়েলায় বা কোলোম্বিয়ায়। তবে রাত যখন নামবে, তখন হয়তো আবার আমরা উঠে পড়বো আকাশে, যাতে গুয়াতেমালা আর নিকারাগুয়ার। পাহাড়ের বাধা পেরিয়ে যেতে পারি, সোজা ছুটে চলে যেতে পারি প্রশান্ত মহাসাগরে, সেই অজ্ঞাত আইল্যাণ্ড এক্স-এর দিকে।

সন্ধে এলো। সূর্য ডুবে গেলো দিগন্তে, রক্তের মতো রাঙা। বিভীষিকার আশপাশে সমুদ্রে লোহিত ছোপ চমকাচ্ছে–যেন রঙিন সব ফুলঝুরি, এমনভাবে ফেনিল ঢেউ ভেঙে পড়ছে পোতের পেছনে। সম্ভবত হ্রবু ভেবে থাকবে যে ছোটোখাটো একটা ঝড় উঠছে, আমাকে আবার আমার ক্যাবিনে পাঠিয়ে দিলে, আমরা মাথার ওপর আবার আটকে দেয়া হলো হ্যাঁচওয়ের ঢাকনা। পরের কয়েক মুহূর্ত এমন-সব আওয়াজ শুনতে পেলুম, যা থেকে বুঝতে পারলুম বিভীষিকা এবার জলের তলায় ডুবে যাচ্ছে। পাঁচ মিনিট পরেই সে অনায়াসেই সমুদ্রের গভীর দিয়ে শঙ্কাহীন চলে যেতে লাগলো।

আমি অবসাদে যেন ভেঙে পড়ছি তখন। কোনো শারীরিক শ্রমের জন্যে এই অবসাদ নয়, উত্তেজনা আর উদ্বেগই যেন আমাকে নিংড়ে আমার মধ্য থেকে সব শক্তি বার করে নিয়েছে। নিজের অজান্তেই কখন একসময় গভীর ঘুমে ঢলে পড়লুম, এবার কোনো ওষুধ দিয়ে কেউ আমার ঘুম পাড়ায়নি, অবসাদই এই ঘুমের কারণ। কতক্ষণ পরে যে ফের জেগে উঠেছি, জানি না, কিন্তু বিভীষিকা তখনও জলের ওপর ভেসে ওঠেনি–ডুবোজাহাজ সেজেই সে চলেছে তখনও।

বিভীষিকা জলের ওপর ভেসে উঠলো আরো-খানিকক্ষণ পরে, যখন ঘুলঘুলি দিয়ে ক্যাবিনে এসে পড়লো দিনের প্রথম আলোর ছটা। আর ভেসে উঠতেই সমুদ্র ছোট্ট খোলার মতো করে দোলাতে লাগলো বিভীষিকাকে সমুদ্রের ঢেউয়ের এই এক বিশ্রী স্বভাব, সবকিছু সে নাড়িয়ে দেয়।

আবারও ডেকের ওপর উঠে এলুম আমি, এসেই আমার প্রথম চিন্ত হলো আবহাওয়া সম্বন্ধে। উত্তরপশ্চিম থেকে ধেয়ে আসছে খ্যাপা হাওয়া, তুফান। ঘন কালো মেঘের মধ্যে চমকে-চমকে যাচ্ছে বিদ্যুতের যত সরীসৃপ। এরই মধ্যে দূর থেকে ভেসে আসছে বাজের শব্দ-গড়িয়ে যাচ্ছে ঢেউয়ের ওপর দিয়ে-গুম গুম গুম! আমি চমকে গেলুম-চমকে ঠিক নয়, ভয় পেয়ে গেলুম, এমন আচম্বিতে দ্রুত ছুটে এলো তুফান। এই ঝড়ের ঝাঁপটা সামলাতে গিয়ে কোনো পালের জাহাজ হয়তো তার পালগুলো গোটাবারও সময় পেতো না। যেমন দুর্দাম তার গতি, তেমনি ভয়াল–ভয়াল নয়, করাল! বাতাস এমনভাবে ফেটে পড়েছে যেন হাজার বৎসর সে অবরুদ্ধ ছিলো, এখন তার জেলখানা ভেঙে বেরিয়ে পড়েছে, এক-আধখানা নয়, যেন উনপঞ্চাশখানা পবনই! তারই সঙ্গে তাল রেখে উত্তাল সমুদ্র থেকে উঠেছে এক ভয়ংকর জলস্তম্ভ। ঢেউয়ের পর ঢেউ গর্জাচ্ছে, আছড়াচ্ছে, আর ফেনিল জল পাক খাচ্ছে বিভীষিকার চারপাশে। আমি যদি প্রাণপণে রেলিঙ আঁকড়ে না-থাকতুম, ঢেউ তবে আমাকে ঝেটিয়ে নিয়ে চলে যেতো।

এখন শুধু একটাই জিনিশ করার আছে–বিভীষিকাকে আবার ডুবোজাহাজে রূপান্তরিত করে জলের তলায় নিয়ে-যাওয়া। জলের একটু তলাতেই সে পেয়ে যাবে প্রশান্ত নিরাপত্তা-জলের ওপর সে কিছুতেই এই রাক্ষুসে প্রকৃতির সঙ্গে যুঝতে পারবে না। হ্রবু স্বয়ং দাঁড়িয়ে আছে ডেকে, আমি অপেক্ষা করছি এই বুঝি সে আমায় বলে নিচে চলে যেতে–কিন্তু কখনো আর সেই নির্দেশ এলো না। জলে ডুবে যাবার কোনো প্রস্তুতিও চোখে পড়লো না। আগের চেয়েও তীব্রভাবে জ্বলে উঠেছে তার চোখ, ভাবলেশহীন সে চেয়ে আছে ঝড়ের দিকে, যেন অসীম স্পর্ধায় সে তাকে অস্বীকার করতে চাচ্ছে, যেন সে নীরব মহাশব্দে এই কথাই বলে দিতে চাচ্ছে এই প্রকৃতিকে–সে মোটেই ডরায় না, মোটেই না!

আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা না-করে বিভীষিকার এখন ডুবোজাহাজ হিশেবে জলের তলায় চলে-যাওয়া উচিত। অথচ হ্রবুর যেন সে-বিষয়ে কোনো চেতনাই নেই। না, সে তেমনি অসীম ঔদ্ধত্যে, প্রচণ্ড স্পর্ধায় প্রকৃতির সব তাণ্ডবকেই তাচ্ছিল্য করতে চাচ্ছে। যেন সে সবকিছুর ঊর্ধ্বে, যেন সে কোনো মর্তমানুষ নয়!

তাকে এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একসময় আমারই কেমন আচ্ছন্ন লাগলো, মনে হলো সত্যি কি সে কোনো অতিমানব, কোনো অতিপ্রাকৃত জগৎ থেকে আচমকা বেরিয়ে এসেছে!

হঠাৎ তুফানের সমস্ত গর্জন ছাপিয়ে তার মুখ ফুটে এক চীৎকার বেরিয়ে এলো, আমি হ্রবু, দিগ্বিজয়ী হবু, দ্য মাস্টার অভ দি ওয়ার্ল্ড, কাউকে আমি মানি না!

সে হাত নেড়ে এমন-একটা ইঙ্গিত করলে, যা টারনার ও তার সহযোগী বিনাবাক্যব্যয়েই বুঝে ফেললে। দ্বিধাহীন তারা পালন করলে হ্রবুর নির্দেশ, যেন তারাও হবুর মতোই বুদ্ধিভ্রংশ। ছিটকে বেরিয়ে এলো ডানা দুটি, আর বিভীষিকা উঠে এলো ঝড়ের আকাশে, ঠিক যেমন সেদিন সে উঠে গিয়েছিলো নায়াগ্রার ওপর। কিন্তু সেদিন সে ঐ ভয়াল প্রপাতকে ফাঁকি দিতে পেরেছিলো, কিন্তু আজ–এই হারিকেনকে সে এড়াবে কেমন করে-ঝড়ের চোখ যেন আজ তারই ওপর এসে আক্রোশ ফলাচ্ছে!

উড়োজাহাজ সোজা উঠে এলো আকাশে, সরাসরি, পাশে চমকাচ্ছে হাজার বিদ্যুৎ, প্রচণ্ড নাদে ফেটে পড়ছে হাজারটা বজ্র-আর তারই মধ্যে অন্ধের মতো ছুটেছে বিভীষিকা, যেন প্রতি মুহূর্তেই আলিঙ্গন করতে চাচ্ছে অনিবার্য ধ্বংসকে।

হ্রবুর ভঙ্গিতে একফোঁটাও বদল নেই। এক হাত হালে, আরেক হাত রেগুলেটরে, দু-পাশে বিশাল দুটি ডানা অবিশ্রাম ঝাঁপটাচ্ছে নিজেদের, হবু সরাসরি যেন ঝড়ের চোখ লক্ষ্য করে চালিয়ে দিয়েছে বিভীষিকাকে, আর মেঘ থেকে মেঘে লাফিয়ে-লাফিয়ে ছুটে চলেছে বিদ্যুৎ, চারপাশেই।

যদি সে এই গগনচুল্লির মাঝখানে তার বিমান নিয়ে যেতে চায়–তবে তাকে এক্ষুনি ঠেকাতে হবে। তাকে বাধ্য করতে হবে নিচে নামতে, জলের তলার শান্ত আধারকেই খুঁজতে হবে তার এক্ষুনি-খুঁজতে নয়, তাকে দিয়ে খোঁজাতে হবে-নইলে কিছুতেই আর রেহাই নেই!

তারপর নিজের এই উত্তাল ভাবনার মধ্যে হঠাৎ আমার সমস্ত চৈতন্যই যেন কর্তব্যপরায়ণ হয়ে উঠলো। হ্যাঁ, এও একরকম উম্মত্ততা, কিন্তু তবু মরবার আগে আমাকেও শেষবার আমার দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে-যাকে আমার দেশের সরকার আইনকানুনের পরপারে কোনো সমাজবিরোধী বলে ঘোষণা করেছে, যে তার ভয়াল আবিষ্কার মারফৎ সারা জগতের নিরাপত্তাই বিপন্ন ও বিঘ্নিত করে তুলেছে, তাকে কি? গ্রেফতার করা আমার কর্তব্য নয়? আমার কি উচিত নয় তার কাঁধে হাত রেখে বলা, ওহে মানুষ! ন্যায়বিচারের কাছে আত্মসমর্পন করো! আমার নাম কি জন স্ট্রক নয়, ফেডারেল পুলিশের যে চীফ ইন্সপেক্টর? আমি ভুলেই গেলুম কোথাও আছি, এও ভুলে গেলাম যে এরা তিনজন আর আমি একা ফুঁসে-ওঠা এক সমুদ্রের ওপর বজ্রবিদ্যুতে সমাচ্ছন্ন এক আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছি! আমি লাফিয়ে গিয়ে পড়লুম হ্রবুর ওপর, ঝড়কে ছাপিয়ে চীৎকার করে উঠেছে আমার গলা :

হ্রবু, আইন মোতাবেক, বিচারের নামে আম–

অকস্মাৎ বিভীষিকা এমনভাবে কেঁপে উঠলো যেন সে বিদ্যুতের ছোবল খেয়েছে! তড়িতাহত! তার সারা কাঠামোটাই কেঁপে উঠেছে থর্থর, ঠিক তার তড়িৎকোষের ওপর এসে ভেঙে পড়েছে বজ্র, আর সেই আকাশযান যেন চৌচির হয়ে ভেঙে পড়ে যাচ্ছে। চার কোণায়।

ডানা দোমড়ানো, স্কু চুরমার, কাঠামোর মধ্যে কিলবিল করে ছুটে বেড়াচ্ছে কত যে বিদ্যুৎ, কত-যে ঝলসে-ওঠা সরীসৃপ, বিভীষিকাহাজার ফিট ওপর থেকে, লাট খেতে খেতে, ভেঙে পড়লো নিচের গর্জে-ওঠা সমুদ্রে!

.

১৮. বুড়ি দাসীর শেষ মন্তব্য

কত ঘণ্টা যে সংজ্ঞাহীন পড়ে থাকার পর আমার চেতনা যখন ফিরে এলো, তাকিয়ে দেখি আমি যে-ক্যাবিনে শুয়ে আছি তার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে একদল খালাশি–তারাই আমাকে বাঁচিয়েছে। আমার শিয়রের কাছে বসে কে-একজন আমায় প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে চলেছে, আর আস্তে-আস্তে যতই আমার ইন্দ্রিয়গুলো কাজ করতে শুরু করছে, ততই আমি তাকে বোঝাবার চেষ্টা করছি, কী হয়েছিলো।

সব, সব কথাই আমি তাকে খুলে বলেছি। হ্যাঁ, সবকিছু! আর আমার শ্রোতারা নিশ্চয়ই ভেবেছে যে নেহাৎই-বেচারা মানুষ আমি, আমার জ্ঞান ফিরেছে বটে অবশেষে, কিন্তু বুদ্ধিশুদ্ধি সব বুঝি লোপ পেয়েছে।

আমি রয়েছি মেহিকো উপসাগরে, অটোয়া স্টিমারের ওপর, সেটা চলেছে নিউ অর্লিন্সের দিকে। এই স্টিমার কোনোক্রমে এড়িয়েছিলো তুফানটা, ঠিক সেটা কেটে যাবার পরেই হাওয়া তাকে সমুদ্রের ওদিকটায় তাড়িয়ে নিয়ে এসেছিলো, আর জলের ওপর তারা দ্যাখে ভাঙা জাহাজের কাঠকুটো, যার একটাকে আঁকড়ে ধরে আমি–সংজ্ঞাহীন ভেসে যাচ্ছি।

এইভাবেই আবার আমি ফিরে এসেছি সাধারণ মানুষের মাঝখানে, আর বু দিগ্বিজয়ী হ্রবু-তার দুই সঙ্গীকে নিয়ে তার রোমাঞ্চকর অভিযান সাঙ্গ করেছে মেহিকো উপসাগরের জলে। চিরতরেই হারিয়ে গেছে দ্য মাস্টার অভ দি ওয়ার্ল্ড, বজ্রাঘাতে বিদীর্ণ, যার তুলকালাম প্রচণ্ডতার বিরুদ্ধে সে দাঁড়িয়েছিলো বেপরোয়া, প্রচণ্ড স্পর্ধায়। সে তার সঙ্গে নিয়ে গেছে তার এই আশ্চর্য আবিষ্কারের সমস্ত গোপন রহস্য।

পাঁচ দিন পরে অটোয়া দেখতে পেয়েছে লুইসিয়ানার তীর, আর দশই আগস্ট ভোরবেলায় পৌঁছেছে তার বন্দরে। আমার উদ্ধারকর্তাদের কাছ থেকে উষ্ণ সম্ভাষণে বিদায় জানিয়ে তক্ষুনি আমি চেপে বসেছি ওয়াশিংটনের ট্রেনে । মাঝখানে কয়েকদিন আমি স্বপ্নেও ভাবিনি যে আবার আমি এই শহর দেখতে পাবো। স্টেশনে নেমেই, আমি সোজা ছুটে গিয়েছি পুলিশের সদর দফতরে, সবচেয়ে আগে সব কথা খুলে বলতে চেয়েছি মিস্টার ওয়ার্ডকে, যিনি একদিন আমায় না-জেনেই পাঠিয়েছিলেবুর সন্ধানে।

মিস্টার ওয়ার্ডের ঘরের দরজা খুলে ঢোকবামাত্র আমাকে দেখে তার মুখচোখে পর পর যে-সব ভাব উঠেছিলো তা এইরকম : বিস্ময়, স্তম্ভিত হতবাক দশা, এবং হর্ষোল্লাস। আমার সঙ্গীদের কাছ থেকে তিনি যে-প্রতিবেদন পেয়েছিলেন, তাতে তিনি ধরেই নিয়েছিলেন যে লেক ইরির জলে আমার সলিলসমাধি হয়েছে–অন্যরকম কিছু ভাববার কোনো অবকাশই ঐ প্রতিবেদনের পরে ছিলো না।

তারপর আমি তাকে বিস্তারিতভাবে খুলে বলেছি সব কথা : লেক ইরির জলে আমি অদৃশ্য হয়ে যাবার পর কী-কী ঘটেছিলো : লেকের জলে সেই রুদ্ধশ্বাস অ্যাডভেনচার যখন ডেস্ট্রয়ারগুলো তাড়া করে এসেছিলো বিভীষিকাকে, নায়াগ্রার জল প্রপাতের ওপর থেকে একেবারে শেষ মুহূর্তে কীভাবে উড়াল দিয়েছিলো হ্ৰবুর আশ্চর্য যান, গ্রেট আইরির কোটরের ভেতর তার সাময়িক বিশ্রাম, আর সবশেষে মেহিকো উপসাগরের জলে প্রচণ্ড তুফানের মধ্যে তার ধ্বংসলীলা কীভাবে, কেমন করে, সম্পন্ন হয়েছিলো।

এই-প্রথম তিনি জানতে পেলেন কী আশ্চর্য যন্ত্র তৈরি করেছিলো হ্ৰবুর অসাধারণ প্রতিভা, একের ভেতরে চার, যে জল-মাটি-আকাশ সবকিছুকেই জয় করেছিলো।

সত্যি-বলতে, এমন আশ্চর্য ও পূর্ণাঙ্গ কোনো যন্ত্র যে বানাতে পারে, তারই পক্ষে দ্য মাস্টার অভ দি ওয়ার্ল্ড নাম নেয়া মানায়। যে-নামে হ্রবু এই খোলা চিঠি লিখেছিলো। এটা ঠিক যে হবু এবং তার যন্ত্র যদি এখনও থাকতো, তাহলে পৃথিবীতে সাধারণ মানুষের জীবন হয়তো স্বচ্ছন্দ ও নিরাপদ থাকতো না–তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সব ব্যবস্থাই হয়তো নিষ্ফল এবং অকেজো হতো। কিন্তু তবু আমি গর্বে ও স্পর্ধায় উদ্দীপ্ত এই মানুষটিকে যেভাবে প্রকৃতির সব তুলকালাম শক্তির বিরুদ্ধে যুঝতে দেখেছি, যেন সমানে-সমানেই এক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, তাতে আমি যেন পুরোপুরি বিহ্বল হয়ে পড়েছিলুম। আমি যে এই করাল তুফান থেকে প্রাণে বেঁচেছি, সেটাই যেন চূড়ান্ত অলৌকিক ঘটনা।

মিস্টার ওয়ার্ড ভেবেই পাচ্ছিলেন না আমার এই কাহনের কতটুকু তিনি বিশ্বাস করবেন। তাহলে, স্ট্রক, শেষটায় তিনি বলেছেন, তুমি শেষ অব্দি যে প্রাণে বেঁচে ফিরে এসেছে, সেটাই সবচেয়ে বড়ো কথা। দিগ্বিজয়ী বীর হুবুর পরেই তোমার নাম। এখন সবখানে ছড়িয়ে পড়বে–তুমি হবে এই মুহূর্তে দ্বিতীয় বিখ্যাত মানুষ। আশা করি তাতে তোমার মাথা দেমাকে ঘুরে যাবে না–বু যেভাবে জাক দেখাতে গিয়ে শেষটায় নিজের সর্বনাশ ঘটিয়ে বসেছে, আশা করি তোমার মধ্যে সে-রকম কোনো অহমিকার ভাব গজাবে না–

না, মিস্টার ওয়ার্ড, আমি তাকে আশ্বাস দিয়েছি, আমার মাথা মোটেই ঘুরে যাবে না। তবে এটাও তো মানবেন যে এর আগে আর-কোনো লোকই নিজের কৌতূহল চরিতার্থ করতে গিয়ে এমনভাবে জলেস্থলেআকাশে হুলুস্থুলতুলে ঘুরে বেড়ায়নি!

মানি, স্ট্রক মানি! আর, গ্রেট আইরির দুর্বোধ্য প্রহেলিকা, বিভীষিকার অমন আশ্চর্য সব রূপান্তর, তার এই ভয়ালভয়ংকর পরিণাম–সবই তুমি আবিষ্কার করেছে, নিজের চোখে দেখে এসেছে! তবে সবচেয়ে আপশোশের কথাই হলো এটাবুর সঙ্গে-সঙ্গেই তার সব গোপন কথাও হারিয়ে গেলো–ঐ যন্ত্রের রহস্য আর-কোনোদিনই আমাদের জানা হবে না!

সেদিনই খবরকাগজগুলোর সান্ধ্য সংস্করণে সাতকাহন করে বেরিয়েছে আমার এই রোমাঞ্চকর বৃত্তান্ত, কারু কল্পনারই সাধ্যি ছিলো না তার ওপর কোনো রং চড়ায়। মিস্টার ওয়ার্ড ঠিকই বলেছিলেন, সেদিন-হ্রবুর পরেই–আমিই ছিলুম সবচাইতে বিখ্যাত। মানুষ।

একটি কাগজ লিখেছে :

ইন্সপেক্টর স্ট্রকের সৌজন্যে আবারও আরেকবার প্রমাণ হলো যে মার্কিন পুলিশবাহিনীই এখনও সবার সেরা। অন্যদেশের পুলিশ হয়তো জলে-স্থলে অভিযান চালিয়ে কৃতকার্য হয়েছে, কিন্তু মার্কিন পুলিশ এবার দেখিয়েছে যে, শুধু জলে-স্থলেই নয়, দরকার হলে সে আকাশেও ঝাঁপ খেতে পারে।

অথচ, বিভীষিকার পেছনে ধাওয়া করে গিয়ে আমি যা-যা করেছি, এই শতাব্দীতে হয়তো তার চেয়েও দুর্ধর্ষ কাজ করবে গোয়েন্দাবাহিনী–হয়তো জলেস্থলেআকাশে দাপটের সঙ্গে ছুটে বেড়ানো তাদের নিত্যকর্ম হয়ে উঠবে।

এটা তো না-বললেও চলে আমি যখন লং স্ট্রিটে আমার বাড়িতে গিয়ে ঢুকেছিলুম, আমার বুড়ি দাসী আমাকে কীভাবে অভ্যর্থনা করেছিলো। যখন আমার ছায়ারূপ–তাই তো বোধহয় বলে ভূতকে, তাই না?-তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, মুহূর্তের জন্যে মনে হয়েছিলো সে বুঝি ধপ করে পড়ে গিয়ে হার্টফেল করে বসবে! বেচারা! তারপর আমার বৃত্তান্ত সব শুনে-টুনে সে বলেছে-তার চোখ থেকে অঝোরে দরদর করে জল ঝরছে তখন–ভগবানের অসীম দয়া ছাড়া এমন আশ্চর্যভাবে নিশ্চিত মরণ থেকে কেউ বাঁচে না।

এবার আপনিই বলুন, সে বলেছে, আমি ঠিক কথা বলেছিলাম কি না?

ঠিক বলেছো? কোন কথা?

বলিনি কি, গ্রেট আইরি হলো গিয়ে শয়তানের বাসা!

ধুর, কী-যে বলো! হ্রবু মোটেই কোনো শয়তান নয়?

তা হয়তো নয়, বুড়ি দাসীই শেষ কথাটি বলেছে, তবে শয়তান হবার সব যোগ্যতাই তার ছিলো।