সিন্ধুতলের কোষাগার
নটিলাস আমাদের যত স্বাচ্ছন্দ্যই দিক, তবু বন্দী তো। ফলে নেড ল্যাণ্ড যখন। পলায়নের পরিকল্পনা করলে, আমাকে রাজী হতেই হলো।
মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টায় ভূমধ্য সাগর অতিক্রম করে আমরা তখন অতলান্তিক মহাসাগরে এসে পড়েছি, ইস্পাহানের উপকূল ধরে আস্তে জলের তলা দিয়ে চলেছে নটিলাস। ঠিক হয়েছে রাত নটার সময় নটিলাস-এর নৌকোয় করে আমরা পালাবো।
এই কদিন ক্যাপ্টেনের সঙ্গে দেখা হয়নি। নটিলাস ছেড়ে যাবার আগে শেষবার সব ভালো করে দেখে যাবার ইচ্ছে হলো খুব। তাই রাত আটটার সময় আমি সন্তর্পণে ক্যাপ্টেন নেমোর ঘরের কাছে গিয়ে দাড়ালুম। ভিতর থেকে কোনো শব্দ আসছে না দেখে সাহস সঞ্চয় করে আস্তে একটু ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেলো।
তপস্বীর শাদাশিদে ঘরের মতো এই নিরাভরণ ঘরটিতে আমি আগেও গেছি। দেয়ালে নানা দেশের নেতাদের ছবি ঝুলছে; পোল্যাণ্ডের বীর নেতা কোসকিয়ুস্কো আয়ারল্যাণ্ডের ডানিয়েল ও কনেল, আমেরিকার জর্জ ওয়াশিংটন, আব্রাহাম লিঙ্কন আর জন ব্রাউন। এরা প্রত্যেকেই স্বদেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। ক্যাপ্টেন নেমোর রহস্যের সূত্র কি তবে এই ছবিগুলি? ইনিও কি দুর্ভাগা দেশের লাঞ্ছিত ও নিপীড়িত মানুষদের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন? কোন সে আত্মীয়তার বাঁধন, যা বোটৎসারিস, ও কনেল, আব্রাহাম লিঙ্কনের সঙ্গে তাঁকে একসূত্রে বেঁধে রেখেছে? আমেরিকার সাম্প্রতিক গৃহযুদ্ধের কোনো নায়ক ইনি? এই শতাব্দীর বৃহত্তম বিপ্লবের কোনো নেতা কি তিনি আসলে?
হঠাৎ এমন সময়ে ঢং-ঢং করে আটটা বাজলো ঘড়িতে। অমনি যেন আমি মুছ থেকে জেগে উঠলুম। মনে পড়লো যে এ-ঘরে আসলে ঢুকেছিলুম দিগদর্শিকা দেখে আমাদের গতিপথ নির্ধারণ করতে। তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে ধড়াচুড়ো পরে তৈরি হয়ে নিলুম আমি, নটিলাস-এরই দেয়া নাবিকের পোশাকে নিজেকে সজ্জিত করে নিলুম।
পালাবার মুহূর্ত যত এগিয়ে আসতে লাগলো আমার বুকের স্পন্দনও ততই যেন বেড়ে চললল। সমস্ত নটিলাস-এ কোনো সাড়া শব্দ নেই, কেবল একটা ইঞ্জিনের মৃদু গুঞ্জন ভেসে আসছে; আমার হৃৎপিণ্ডের স্পন্দনের সঙ্গে যন্ত্রের এই গুঞ্জন যেন মিশে যাচ্ছে। প্রতি মুহূর্তে আমার উৎকর্ণ অস্তিত্ব প্রতীক্ষা করতে লাগলো চ্যাঁচামেচি ও হট্টগোলের; এই বুঝি নেড ল্যাণ্ড পালাবার চেষ্টা করতে গিয়ে ধরা পড়ে যায়।
ন-টা বাজতে মাত্র কয়েক মিনিট বাকি, এমন সময় হঠাৎ যেন বুকের ভিতরটা ফাকা করে দিয়ে ইঞ্জিনের মৃদু গুঞ্জন মিলিয়ে গেলো। ছোট্ট ধাক্কা দেখে বুঝলুম নটিলাস আস্তে-আস্তে গভীর সমুদ্রে নেমে যাচ্ছে। তাহলে কি আমাদের পলায়নের পরিকল্পনা আর গোপন নেই?
এমন সময়ে ঘরের দরজা খুলে হাসিমুখে ভিতরে ঢুকলেন ক্যাপ্টেন নেমো। এই যে, প্রফেসর, আপনাকেই খুঁজছিলুম। ইস্পাহানের ইতিহাস আপনি জানেন তো?
এমন অবস্থায় কাউকে তার স্বদেশের ইতিহাসের কথাও জিগেস করলে সে কোনো উত্তর দিতে পারতো কিনা সন্দেহ।
আমাকে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নেমো আবার জিগেস করলেন, কী? জানেন নাকি?
যৎসামান্য, কোনো রকমে এই কথাটিই বলতে পারলুম শুধু।
ঠিক পণ্ডিতদের মতোই জবাব, বললেন ক্যাপ্টেন, পণ্ডিত বলে তারা কিছুই জানে না—বসুন, আপনাকে ইস্পাহানের ইতিহাসের একটা কাহিনী শোনাই।
ডিভানের উপর হেলান দিয়ে বসলেন ক্যাপ্টেন নেমো। তারপর গুনগুন করে বলতে শুরু করলেন ইস্পাহানের জাতীয় সংগ্রামের দীর্ঘ কাহিনী।
সত্যি দীর্ঘ কাহিনী শুনিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন নেমো। ইংরেজ ওলন্দাজ আর আলেমান জাতিপুঞ্জের সম্মিলিত শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্য রাজা চতুর্দশ লুই-এর নেতৃত্বে ফ্রান্স ইস্পাহানের সঙ্গে মৈত্রী রচনা করলে। কিন্তু যুদ্ধের জন্য যেবিপুল অর্থ চাই, তা কে জোগাবে। দক্ষিণ আমেরিকায় ইস্পাহানের তখন অঢেল ঐশ্বর্য। মায়া আর ইনকাদের সোনারুপোয় অনেক ইস্পাহানি জাহাজ বোঝাই করা হলো, আর তেইশটা ফরাশি যুদ্ধজাহাজ তাদের পাহারা দিয়ে নিয়ে চললো ক্যাডিজের দিকে। খবর পেয়ে ইংরেজ নৌবাহিনী ক্যাডিজ অবরোধ করে পথ আটকে বসে রইলো। ফলে বিপদ এড়াবার জন্য ফরাশি সেনাধ্যক্ষ আর ইস্পাহানি অধিনায়ক পরামর্শ করে সোনাভতি জাহাজ নিয়ে চললেন ভিগো উপসাগরে, কিন্তু কোনো কারণে জাহাজ থেকে মাল খালাশ করতে বড্ড দেরি করে ফেলেছিলেন তাঁরাসেই সুযোগে ইংরেজ বাহিনী এসে তাদের আক্রমণ করে বসলো। নীল জল লাল হয়ে গেলো সেই দারুণ যুদ্ধে, আর ফরাশি সেনাধ্যক্ষ যখন দেখলেন ইংরেজ বাহিনী সঙ্গে কিছুতেই এটে-৩ঠ যাবে না, তখন তার আদেশে গোলাবারুদ দিয়ে সোনারুপোভরা ইস্পাহানি জাহাজগুলো জলে ডুবিয়ে দেয়া হলো। এই অতুল ঐশ্বর্য শত্রুর হাতে পড়ার চেয়ে সলিল-সমাধি হওয়া ঢের ভালো।
সাল-তারিখ-সংবলিত এই মস্ত গল্প শেষ হলো, কিন্তু আমি ঠিক বুঝতে পারলুম না ক্যাপ্টেন নেমো হঠাৎ আমাকে এই কাহিনী শোনালেন কেন। তো কী! আমি জিগেস করলুম।
মঁসিয় আরোনা, ক্যাপ্টেন নেমো বললেন, নটিলাস এখন এই ভিগো উপসাগরেই নেমে পড়েছে।
ক্যাপ্টেন নেমো উঠে দাড়িয়ে একটি জানলার পাশে নিয়ে গেলেন আমাকে। জানলা দিয়ে দেখলুম ডুবুরির পোশাক পরে নাটলাস-এর মাল্লার বালি খুঁড়ে তোবড়ানো, ভাঙাচোরা, শ্যাওলা-পড়া বাক্স উদ্ধার করছে। অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে অজয় জাহাজের ধ্বংসাবশেষ। সেই ভাঙা বাক্সগুলো থেকে রাশিরাশি সোনারুপপার ডেলা, পুরোনো ইস্পাহানি মোহর ও মূল্যবান দীপ্ত পাথর ছড়িয়ে পড়লো সিন্ধুতলে, আর নটিলাস-এর মাল্লারা তা দিয়ে বোঝাই করতে লাগলো মস্ত সব সিন্দুক। সিন্ধুতলের বলরাশির উপর তারার মতো ঝিকিয়ে-ওঠা এই অকল্পনীয় ঐশ্বর্য দেখতে দেখতে সুব স্পষ্ট বুঝতে পারলুম আমি। শূন্য সিন্দুক আবার ভরে নেবার জন্যই ভিগো উপসাগরে এসেছে নটিলাস–ইনকাদের অতুল ঐশ্বর্যের অধীশ্বর এখন এই মানুষটিই।
হাসিমুখে আমার দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন ক্যাপ্টেন নেমো। এখন বুঝতে পারছেন ততা কেমন করে আমি ক্রোড়পতি হয়েছি?
বুঝলুম। কিন্তু এত ঐশ্বর্য, সব কিনা এমনিভাবে নষ্ট হচ্ছে–কোনো কাজেই লাগছে না?
বলতে-বলতেই বুঝতে পারলুম অজান্তে আমি ক্যাপ্টেন নেমোকে আঘাত করে বসেছি।
নষ্ট হচ্ছে? আহত বাঘের মতো রুষ্ট স্বরে বলে উঠলেন নেমো, আপনি কি ভাবছেন এত কষ্ট করে এই সম্পদ আমি উদ্ধার করছি নষ্ট করার জন্য, নিজের ভোগের জন্য? আমি যে এই ঐশ্বর্যের সদ্ব্যবহার করছি না, তা আপনাকে কে বললে? আপনি কি মনে করেন আমি খবরটুকুও রাখি না পৃথিবীর কোথায়, কোন কোন দেশে, মানুষ নিপীড়িত লাঞ্ছিত ও নিগৃহীত হচ্ছে? এটা কি কিছুতেই বোঝেন না যে–
হঠাৎ ক্যাপ্টেন নেমো থেমে গেলেন। বোধ হয় এত কথা তিনি বলতে চাননি। বোধ হয় এত উত্তেজিত না-হলে এ-সম্বন্ধে কোনো কথাই তিনি বলতেন না। কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছিলুম।
সমুদ্রের তলায় এই স্বাধীন নিঃসঙ্গ জীবন বেছে নেবার পিছনে যে কারণই থাক না কেন, ক্যাপ্টেন নেমো যে এখনো মানুষেরই সন্তান, এই তথ্য আমার অগোচর রইলো না। এখনো মানবজাতির দুঃখে ও লাঞ্ছনায় তাঁর বুক কাঁদে, এখনো অত্যাচারিত দীন জাতিদের উদ্দেশে আর অঢেল ঐশ্বর্য ব্যয় হয়। আর অমনি আমি বুঝতে পারলুম বিপ্লব-জ্বলা ক্রীট দ্বীপের পাশ দিয়ে যাবার সময় কাদের উদ্দেশে তিনি ওই সোনাভরা সিন্দুক পাঠিয়েছিলেন।