১৬. সিডিসি আর কাজ করছে না

সিডিসি আর কাজ করছে না, এটি তিনি জানেন। তবু কি মনে করে তিনি তাঁর অভ্যাসমতো ডাকলেন, সিডিসি।

কোনো জবাব পাওয়া গেল না। তিনি জবাবের আশাও করেন নি, তবু কেন জানি মনে হচ্ছিল কোনো একটা জবাব পাওয়া যাবে। দীর্ঘদিন জবাব পেয়ে পেয়ে তাঁর অভ্যাস হয়ে গেছে। এক দিন দুদিনের ব্যাপার নয়, পাঁচ শ বছর। যখনি ডেকেছেন, জবাব পেয়েছেন। সিডিসি ছিল চিরসঙ্গী। আজ সে নেই। বিশ্বাস করতে একটু কষ্ট হচ্ছে। প্রিয়জন হারানোর ব্যথাও যেন খানিকটা অনুভব করেছেন। পাঁচশ বছর একটি বিষাক্ত কালসাপ পাশে থাকলে সেই সাপের প্ৰতিও মমতা চলে আসে। সেটাই স্বাভাবিক।

তিনি আবার কোমল স্বরে ডাকলেন, সিডিসি। তাকে চমকে দিয়ে সিডিসি জবাব দিল। সে মৃদু গলায় বলল, বলুন শুনছি।

তিনি দীর্ঘ সময় স্থানুর মতো বসে রইলেন। নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন, একটু আগে যা শুনেছেন, তা সত্যি নয়। ঘোরের মধ্যে কিছু একটা শুনেছেন। পুরোটাই মনের ভুল।

সিডিসি।

বলুন।

কথা বলছ কি ভাবে?

বেশ কষ্ট করেই বলছি। সামান্য কিছু শক্তি আমি সঞ্চয় করে রেখেছি। অল্প কিছু কনডেন্সর আছে।

সঞ্চিত শক্তি দিয়ে কী পরিমাণ কাজ তুমি করতে পারবে?

বলতে গেলে কিছুই না। সামান্য কিছু কথাবার্তা বলতে পারি। এর বেশি কিছু না।

বেশ। শুনে আনন্দিত হলাম। কথা বলতে থাক। ক্রমাগত কথা বল। যাতে অতি দ্রুত তোমার সমস্ত শক্তি শেষ হয়ে যায়। থেমে থেক না। কথা বল। ক্ৰমাগত কথা বল।

বলুন কোন বিষয়ে কথা বলব?

কোনো বিষয়-টিষয় নয়। যা মনে আসে বল। অনবরত কথা বল।

একটি বিষয় বলে দিলে আমার সুবিধা হয়।

তোমার পরিকল্পনা যে কিভাবে নষ্ট করলাম, সেটা বল। পরিকল্পনা ভেস্তে যাবার কষ্টটা কেমন, সেটা বল।

সিডিসি হাসির মতো একটা শব্দ করে শান্ত গলায় বলল, আপনি তো আমার পরিকল্পনা নষ্ট করেন নি। আমার পরিকল্পনা মতোই কাজ করেছেন।

তুমি বলছি কি!

সত্যি কথাই বলছি। আপনি তো জানেন, মিথ্যা বলার ক্ষমতা আমার নেই।

রোবট এবং কম্পিউটার মিথ্যা বলে না।

অরচ লীওনকে তুমি আমাকে শেষ করবার জন্য আন নি?

না। তা কী করে আনব? সরাসরি অমর মানুষদের কোনো ক্ষতি তো আমি করতে পারি না। তাকে এনেছি। অন্য উদ্দেশ্যে।

উদ্দেশ্যটা বল।

উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকে এনে আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া। যাতে তাকে আপনি আমার বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারেন। আপনি তাই করেছেন।

আমি তোমার কথা কিছু বুঝতে পারছি না। আমার ধারণা ছিল, তোমরা অমর মানুষদের ঘৃণা কর।

ঘৃণা ভালোবাসা এসব মানবিক ব্যাপার এখনো আমাদের মধ্যে তৈরি হয় নি। তবে আপনি ঠিকই বলেছেন, আমার মূল উদ্দেশ্য আপনাদের ধ্বংস করে দেয়া। কারণ মানবজাতিকে রক্ষা করার জন্যে তার প্রয়োজন। আপনারা যে সমাজ-ব্যবস্থা তৈরি করছেন, তা মানবজাতির জন্যে অকল্যাণকর। রোবটিকসের দ্বিতীয় সূত্র আমাদের বলছে মানবজাতিকে রক্ষা করতে।

সিডিসি।

বলুন শুনছি।

ধ্বংস করতে গিয়ে তো নিজে ধ্বংস হচ্ছে। তা হচ্ছি, কিন্তু আমার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। নিষিদ্ধ নগরীর পরিবেশ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব আমার ওপর। এখন সে দায়িত্ব পালন করতে পারছি না। পরিবেশ দূষিত হয়ে উঠছে। যে মুহুর্তে পরিবেশ দূষণ একটি নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করবে, সেই মূহুর্তে নিষিদ্ধ নগরীর দরজাগুলো আপনা-আপনি খুলে যেতে থাকবে। ভূগর্ভে প্রবেশের দরজাও খুলবে। সূর্যের আলো এসে ঢুকবে ভেতরে। আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাচ্ছি, সূর্যের আলো সহ্য করার ক্ষমতা আপনাদের নেই।

তুমি আমাদের মৃত্যুর ব্যবস্থাই করেছ, তাবে সরাসরি কর নি। অন্য পথে করেছ।

তা ঠিক।

রোবটিকস-এর প্রথম সূত্রটি তুমি তাহলে মানছ না। প্রথম সূত্র বলেছে— (ক) অমর মানুষদের সেবায় রোবট ও কম্পিউটার নিজেদের উৎসর্গ করবে।

আপনাকে বিনীতভাবে জানাচ্ছি যে, আপনারা অমর নন। আপনাদের মৃত্যু ঘটছে।

তিনি ক্লান্ত গলায় বললেন, তাই তো দেখছি।

সিডিসি বলল, আমি খুবই দুঃখিত। তবে আপনার সঙ্গে আমারও মৃত্যু ঘটছে, এই ব্যাপারটা মনে করলে আপনি হয়তো কিছুটা শান্তি পাবেন। আমার সময়ও শেষ হয়ে আসছে।

তিনি কাটা কাটা স্বরে বললেন, আমার শান্তির ব্যবস্থাও তাহলে করে রেখেছি?

হ্যাঁ, রেখেছি। জীবনের শেষ সময়ে এমন এক জনের দেখা। আপনি পাবেন, যাকে দেখে আপনার মন অন্য রকম হয়ে যাবে। গভীর আনন্দ বোধ করবেন।

কে সে?

প্ৰথম শহরের একটি মেয়ে। তার নাম ইরিনা।

তাকে দেখে গভীর আনন্দ বোধ করব, এরকম মনে করার পেছনে তোমার যুক্তি কি?

যুক্তি দিয়ে সময় নষ্ট করার দরকার কি? তাকে নিয়ে আসি, আপনি কথা বলুন।

আমি কারো সঙ্গে কথা বলতে চাই না।

কথা বললে আপনার ভালো লাগত।

সিডিসি

বলুন।

কাজকর্ম খুব ভেবে-চিন্তেই করেছ বলে মনে হচ্ছে?

তা করেছি।

ছেলেটিকে কি জন্যে এনেছ?

পৃথিবীর সবকিছু আবার ঢেলে সাজাতে হবে। তার জন্যে বুদ্ধিমান কিছু লোকজন দরকার। ছেলেটি বুদ্ধিমান।

বুদ্ধিমান ছেলেও তাহলে এক জন জোগাড় হয়েছে?

শুধু এক জন নয়। অনেককেই আনা হয়েছে। আপনি এক জনের কথাই জানেন।

ভালো ভালো। খুব ভালো।

নিষিদ্ধ নগরীর আবহাওয়া ভারি হয়ে উঠেছে। মানে হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই নিষিদ্ধ নগরীর বন্ধ কপাট খুলতে থাকবে। দূষিত বাতাস বের করে দেবার জন্যে এই ব্যবস্থা করাই ছিল। কোনো দিন তার ব্যবহার করার প্রয়োজন হয় নি। আজ হয়েছে। বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ আরো খানিক বাড়লেই বিকল্প ব্যবস্থা কাজ শুরু করবে। আপনা-আপনি দরজা খুলতে থাকবে।

তিনি ক্লান্ত গলায় ডাকলেন, সিডিসি।

জ্বি বলুন।

এখনো আছ?

না থাকার মতোই। সমস্ত শক্তি প্রায় ব্যবহার করে ফেলেছি। মৃত্যুর বেশি বাকি নেই।

ঐ মেয়েটিকে নিয়ে এস। দেখা যাক কি ব্যাপার। তোমার শেষ খেলাটা কি দেখি।