উপন্যাস
গল্প
নাটিকা

১৬. শেষ পর্যন্ত কুট্টিমামা

শেষ পর্যন্ত কুট্টিমামা

ভালুকে বাংলা বলে! এমন পরিস্কার ভাষায়।

আমার মাথার চুলগুলো খাড়া হতে যাচ্ছিল, কিন্তু জলে কাদায় মাখামাখি বলে খাড়া হতে পারল না। তার বদলে সারা গায়ে যেন পিঁপড়ে সুড়সুড় করতে লাগল, কানের ভেতর কুটুং কুটুং করে আওয়াজ হতে লাগল। অজ্ঞান হব নাকি? উঁহু কিছুতেই না! বারে বারে অজ্ঞান হওয়ার কোনও মানে হয় না—ভারি বিচ্ছিরি লাগে।

ঠিক এই সময় পেছন থেকে হাবুল বিকট গলায় চেঁচিয়ে উঠল : পলা—পলাইয়া আয় প্যালা—তরে ভাল্লুকে খাইব।

ভাল্লুকে খাইব শুনেই আমি উল্লুকের মতো একটা লাফ দিয়েছি। আর ভালুকটা অমনি করেছে কী–তার চাইতেও জোরে লাফ দিয়ে এসে ক্যাঁক করে আমার ঘাড়টা চেপে ধরেছে।

আমি কাঁউ কাঁউ করে বললুম, গেছি—গেছি–

আর ভালুক ভেংচি কেটে বললে, গেছি–গেছি! যাবি আর কোথায়? কথা নেই, বার্তা নেই–গেলেই হল!

আরে রামঃ—এ যে ক্যাবলা! একটা ধুমসো কম্বল গায়ে!

–ক্যাবলা–তুই!

—আমি ছাড়া আর কে? পটলডাঙার শ্রীমান্ ক্যাবলা মিত্তির–অর্থাৎ শ্রীযুক্ত কুশলকুমার মিত্র। দাঁড়া–সব বলছি। তার আগে ডিমটা খেয়ে নিই–বলে ডিমটা ভেঙে পট করে মুখে ঢেলে দিলে।

কী যে ভীষণ রাগ হল সে আর কী বলব! ভালুক সেজে ঠাট্টা তার ওপর আবার এত কষ্টের ডিম বেশ আমেজ করে খেয়ে নেওয়া! তাকিয়ে দেখি আমার হাতে একটাও ডিম নেই—সব মাটিতে পড়ে একেবারে অঁড়ো। সেই যে লাফটা মেরেছিলুম—তাতেই ওগুলোর বারোটা বেজে গেছে।

এদিকে মজাসে ডিমটা খেয়ে ক্যাবলা গান জুড়ে দিয়েছে; হাটি ডাটি স্যাটু অন্ এ ওয়াল—

আমি ক্যাবলার কাঁধ ধরে একটা ঝাঁকুনি দিলুম। বললুম, রাখ তোের হাটি-ডাটি! কোন্ চুলোয় ছিলি সারাদিন? একটা মোটা ধুমসো কম্বল গায়ে চড়িয়ে এসে এসব ফাজলামো করবারই বা মানে কী?

ক্যাবলা বললে, আরে বলছি, বলছি—হড়বড়াতা কেঁউ? লেকিন হাবুল কিধর ভাগা?

তাই তো হাবুল সেন কোথায় গেল? এই তো গাছতলায় শুয়ে নাক ডাকাচ্ছিল। তারপর আমাকে ডেকে বললে, পালা–পালা। কিন্তু পালিয়েছে দেখছি নিজেই। কোথায় পালাল?

দুজনে মিলে চেঁচিয়ে ডাক ছাড়লুম : ওরে হাবলা রে ওরে হাবুল সেন রে—

হঠাৎ ওপর থেকে আওয়াজ এল : এই যে আমি এইখানে উঠেছি–

তাকিয়ে দেখি, ন্যাড়া-মুড়ো কেমন একটা গাছের ডালে উঠে হাবুল ঘুঘুর মতো বসে আছে।

ক্যাবলা বললে, উঠেছিস, বেশ করেছিস। নেমে আয় এখন। উতাররা।

—নামতে তো পারতাছি না। তখন বেশ তড়াং কইর‍্যা তো উইঠ্যা বসলাম। অখন দেখি লামন যায় না। কী ফ্যাচাঙে পইর্যা গেছি ক দেখি? এইদিকে আবার লাসায় কামড়াইয়া গা ছুইল্যা দিতে আছে!

আমি বললুম, লাসায় কামড়ে তোকে তিব্বতে পাঠাচ্ছে।

হাবুল খ্যাঁচখেঁচিয়ে বললে, ফালাইয়া রাখ তর মস্করা। অখন আমি ক্যামন কইর‍্যা? বড় ল্যাঠায় পড়ছি তো!

ক্যাবলা বললে, লাফ দে।

–ঠ্যাং ভাঙব!

–তা হলে ডাল ধরে ঝুলে পড়। আমরা তোর পা ধরে টানি।

—ফালাইয়া দিবি না তো চালকুমড়ার মতন?

-আরে নানা!

—তাই করি! অখন যা থাকে কপালে—

বলেই হাবুল ডাল ধরে নীচে ঝুলে পড়ল। আমি আর ক্যাবলা তক্ষুনি ওপরে লাফিয়ে উঠে হাবুলের দুপা ধরে হেঁইয়ো বলে এক হ্যাঁচকা টান।

–সারছে—সারছে–কম্মো সারছে–বলতে বলতে হাবুল আমাদের ঘাড়ে পড়ল। তারপরে তিনজনেই একসঙ্গে গড়িয়ে গেলুম। আমার নাকটায় বেশ লাগল কিন্তু কী আর করা—বন্ধুর জন্যে সকলকেই এক-আধটু কষ্ট সইতে হয়।

উঠে হাত-পা ঝেড়ে তিনজনে গোল হয়ে বসলুম। আমার গল্প শুনে ক্যাবলা তো হেসেই অস্থির।

–খুব যে হাসছিস? যদি বাঘের গর্তে গিয়ে পড়তিস, টের পেতিস তা হলে!

–বাঘের পাল্লায় আমিও পড়িনি বলতে চাস?

—তুইও?

হাবুল মাথা নেড়ে বললে, পড়বই তো। বাবাকে পড়ব। ক্যাবল আমি না। আমার কুষ্ঠীতে লেখা আছে; ব্যাঘ্রে আমারে কক্ষনো ভোজন করব না।

আমি ধমকে বললুম, চুপ কর হাবলা তোর কুষ্ঠীর গল্প বন্ধ কর। তোর কী হয়েছিল রে ক্যাবলা?

–হবে আবার কী! হাতির পায়ের দাগ ধরে ধরে আমি তো এগোচ্ছি। এমন সময় হঠাৎ কানে এল ধুড়ুম করে এক বন্দুকের আওয়াজ।

–হ, আওয়াজটা আমিও পাইছিলাম—হাবুল জানিয়ে দিলে।

—অঃ, থাম না হাবলা! বলে যা ক্যাবলা—

ক্যাবলা বলে চলল, তারপরেই দেখি বনের মধ্যে দিয়ে একটা বাঘ পাঁই-পাঁই করে দৌড়ে আসছে। দেখে আমার চোখ একেবারে চড়াং করে চাঁদিতে উঠে গেল। আমিও বাপ বাপ করে দৌড় একেবারে মোটরটার কাছে চলে গেলাম। তারপর মোটরের কাচ-টাচ বন্ধ করে চুপ করে অনেকক্ষণ বসে রইলুম।

—সেই বাঘটাই বোধহয় আমার গর্তে গিয়ে পড়েছিল–আমি বললুম।

–হতে পারে, ক্যাবলা বললে; খুব সম্ভব সেটাই। যাই হোক, আমি তো মোটরের মধ্যে বসে আছি। ঘণ্টা-দুই পরে নেমে টেনিদার খোঁজে বেরুব–এমন সময়, ওরে বাবা!

–কী কী?—আমি আর হাবুল সেন একসঙ্গে জানতে চাইলুম।

–কী আর?—ভীমরুলের চাক। একেবারে বোঁ-বোঁ করে ছুটে আসছে।

আমি বললুম, হুঁ–আমার ঢিল খেয়ে।

ক্যাবলা দাঁত খিঁচিয়ে বললে, উ তো ম্যয় সমঝ লিয়া! তোর মতো গর্দভ ছাড়া এমন ভালো কাজ আর কে করবে! দৌড়ে আবার গিয়ে মোটরে উঠলুম। ঠায় বসে থাকো আর-এক ঘণ্টা। তারপর দেখি, ড্রাইভারের সিটের পাশে কম্বল রয়েছে একটা। বুদ্ধি করে সেটা গায়ে জড়িয়ে নেমে এলুম ভীমরুল যদি ফের তেড়ে আসে, তা হলে কাজে লাগবে। অনেকক্ষণ এদিকে ওদিকে খুঁজে শেষে আবিষ্কার করলুম, শ্রীমান প্যালারাম বনমুরগির ডিম হাতাচ্ছেন। তারপর–

আমি ব্যাজার হয়ে বললুম, তারপর আর বলতে হবে না–সব জানি। তুই তো তবু একটা ডিম খেলি আর আমার হাত থেকে পড়ে সবগুলো গেল। ইস–এমন খিদে পেয়েছে যে এখন তোকে ধরে আমার কামড়াতে ইচ্ছে হচ্ছে!

ক্যাবলা বললে, এই খবদার, কামড়াসনি। আমার জলাতঙ্ক হবে।

–জলাতঙ্ক হবে মানে? আমি কি খ্যাপা কুকুর নাকি?

হাবুল বললে,–কইব কেডা?

আমি হাবুলকে চড় মাতে যাচ্ছিলুম, ক্যাবলা বাধা দিলে। বললে, বন্ধুগণ, এখন আত্মকলহের সময় নয়। মনে রেখো, আমাদের লিডার টেনিদা হাতির পিঠে চড়ে উধাও হয়েছে। তাকে এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

—সে কি আর আছে? হাতিতে তারে মাইর‍্যা ফ্যালাইছে! বলেই হাবলা হঠাৎ কেঁদে ফেলল; ওরে টেনিদা রে—তুমি মইরা গেলা নাকি রে?

শুনেই আমারও বুকের ভেতর গুরগুর করে উঠল। আমিও আর কান্না চাপতে পারলুম না।

–টেনিদা, ও টেনিদা–তুমি কোথায় গেলে গো—

এমন যে শক্ত, বেপরোয়া ক্যাবলা–তারও নাক দিয়ে ফোঁসফোঁস করে গোটাকয়েক আওয়াজ বেরুল। তারপর আরশোলার মতো খুব করুণ মুখ করে সেও ড়ুকরে কেঁদে উঠতে যাচ্ছে, এমন সময় পেছন থেকে কে যেন বললে, আরে—আরে–এই তো তিনজন বসে আছে!

চমকে তাকিয়ে দেখি, কুট্টিমামা, শিকারি আর বাহাদুর।

আমরা আর থাকতে পারলাম না। তিনজনে একসঙ্গে হাহাকার করে উঠলুম : কুট্টিমামা গো, টেনিদা আর নেই।

কুট্টিমামার মুখ একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

–সে কি! কী হয়েছে তার?

হাবুল তারস্বরে ড়ুকরে উঠে বলল, তারে বুনা হাতিতে নিয়া গেছে কুট্টিমামা তারে নিয়া গিয়া অ্যাঁক্কেবারে মাইর‍্যা ফ্যালাইছে!

কুট্টিমামার হাত থেকে বন্দুকটা ধপাৎ করে মাটিতে পড়ে গেল।