১৬. শূন্যের রাগিণী

ষোলো – শূন্যের রাগিণী

বৃষ্টির দিন। বিকেলের দিকে আকাশ কিছু ফরসা হয়েছে। রেল লাইনের ধারে নয়ানঝুলিতে জল জমেছে। চটান জায়গাটায় চৌহদ্দি নির্দেশকারী তারের বেড়া—খুঁটিগুলো ইংরিজি ‘এ’ হরফের গড়ন, মরচে যথেষ্ট ধরেছে, সারাদিনের বৃষ্টির জলে নিচেটা ডুবে রয়েছে সেগুলোর, এবং খুঁটিগুলোর ওপর কোথাও শালিক ফিঙে আর বক বসে রয়েছে। চাঁদঘড়ির রোগা ছেলেটা সেই জলে দৌড়াদৌড়ি করে পাখিগুলোকে বড্ড জ্বালাচ্ছে। জানলা দিয়ে গোরাংবাবু দেখছেন আর অকথ্য খিস্তিতে গাল দিচ্ছেন ছোঁড়াটাকে। তাই শুনে চাঁদঘড়ির বউ এসে শাসিয়ে গেল—’ছি ছি! ই কী বাত ভদ্দরলোকের মুখে! জেলমে এইগুলা শিখাইছে আপনাকে? ও দিদি, আপনি বলুন!’

জলে ভিজে ছপছপে ঘাসের ওপর দাঁড়িয়ে মিনিট তিনেক অনুযোগ করে বউটি চলে গেছে। স্বর্ণলতা আকাশ দেখতেই ব্যস্ত, চাপা গলায় বলেছে—’দেখছি। তুমি যাও। ঘাঁটালে আরও বলবে।’

গোরাংবাবুর কান থেকে তা এড়িয়ে যায়নি। আজকাল কিছু এড়ায় না এঁর। অমনি বলেছেন, ‘বলবে না ছেড়ে দেবে? রেলকোম্পানির চাকর বলে তার ব্যাটা যা খুশি করবে! পাখিগুলো দিনমান চরতে পায়নি, খিদেয় ধকাচ্ছে। এখন খাবার ধান্দায় বেরিয়েছে তো হারামজাদা গুয়োটা ওদের পেছনে লেগেছে!’

স্বর্ণ টের পেয়ে গেছে, বুড়ো ডাক্তার হয়তো পাগল হয়ে যাচ্ছেন! প্রথম প্রথম সে ধমক দিত, এখন আর দ্যায় না। রাগ করে পালিয়ে ডাউন সিগনালের কাছে বসে থাকবেন। খুঁজে সাধাসাধি করে আনা সে এক প্রকাণ্ড হাঙ্গামা। অবশ্য তার মনে পড়ে যায়, নিজে একসময়ে বাবার উপর রাগ হলে সেও ডিসট্যান্ট সিগনালের কাছে বেলতলায় গিয়ে দাঁড়াত। এখন সে রাগ করে না। বাবা যখন থেকে জেলে, তখন থেকেই সে এ ধরনের রাগ হারিয়েছে। এখন বাবা ফিরছেন। কিন্তু এ তো অন্য মানুষ।

বাবা যদি সত্যি পুরো পাগল হয়ে যান! এখন শুধু এই অস্বস্তি দিনরাত্রি। পাগলদের শেকলে বেঁধে রাখা সে দেখেছে। আর, রেললাইনের পাশে বাস—কখন হয়তো গিয়ে পড়বেন এঞ্জিনের সামনে, কী বীভৎস কাণ্ড না ঘটে যাবে!

অবশ্য জর্জ বলেছে, পাগলরা কখনও অ্যাকসিডেন্ট করে না।

জর্জ এখনও বাঘটা মারতে পারেনি। এদিকে বাঘটারও আর সাড়াশব্দ নেই কদিন থেকে। তাকে শেষবার দেখা গেছে দিনদুপুরে ডাবকইয়ের কাছে গভীর নয়ানজুলির ধারে ব্রিজটার তলায়। বৃষ্টি এসেছিল, তাই একদল রাখাল দৌড়ে এসে শুকনো ব্রিজের তলায় আশ্রয় নেয় এবং বাঘটাকে দিব্যি বসে থাকতে দেখে। আশ্চর্য, বাঘটা তক্ষুনি জায়গা ছেড়ে চলে যায় পশ্চিমের ছোট মাঠ পেরিয়ে জঙ্গলের দিকে। রাখালরা অবাক হয়েছে। মোটামোটা ফোঁটা পড়ছিল। বাজ ডাকছিল! তার মধ্যে রোদ্দুরও ছিল খানিকটা। এইরকম বৃষ্টি হলে ওরা সুর ধরে বলে—

রোদের মধ্যে পানি ঝরে

খ্যাঁকশেয়ালরা বিহা করে।

…তখন খেকশিয়ালদের বিয়ের লগ্ন। বাঘটা আস্তে আস্তে এগোল। আলগুলো বেশ উঁচু। পেরোবার সময় ওকে একটুও গতর ঘামাতে হল, মনে হয়নি তাদের। রাখালরা সায়েবকে বলেছে, ‘ও সায়েব, হেঁদুদের ঠাকুর দেখেছ—বাঘের ওপর বসে থাকে? এ বাঘ সেই বাঘ।’

জুহা মৌলবির কানে গেলে ছোঁড়াগুলোকে সাত হাত নাক ঘষটাতে হত। বন্য প্রাণীর মধ্যে ঈশ্বরারোপ হিন্দুত্বের লক্ষণ না? এই শয়তানগুলোর রক্তে এখনও আদিম হিন্দুর প্রেত বিরাজ করছে। তা নাহলে এলাকার মুসলমানেরাও অস্পষ্টভাবে বিশ্বাস করে, এই বাঘটা আসলে একজন ‘ঠাকুর’—অর্থাৎ ঈশ্বরের প্রতীক! কোনো এক নির্জন দুপুরে নাকি গুটিকয় মুসলিম বউঝি জঙ্গলের মধ্যে যে জটাবাবার সুপ্রাচীন থান রয়েছে, সেখানে বাঘটার উদ্দেশ্যে মানত দিয়ে এসেছে! কারণ তাদের ছেলেমেয়েরা গোরুছাগল চরাতে যায় ‘বাবার’ এলাকায়। জুহা মৌলবি বলেছেন, তাঁর প্রথম জেহাদ এইসব কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। তাবৎ জড় ও মনুষ্যেতর প্রাণীতে ঈশ্বরত্ত্ব আরোপ একান্তভাবে হিন্দুয়ানি। অপিচ, এতদ্দেশীয় মোছলেম ভ্রাতৃবর্গ এবং তাঁদের অগোচরে কারও কারও পুত্রকন্যাবধূমাতা ঔরৎকুল অনুরূপ বিশ্বাসে উদ্ভট কাজকর্ম করে থাকেন। তবে এসবের জন্যে মোছলেমকুলকলঙ্ক হারামজাদা ইয়াকুব সাধুরাই দায়ী। ইয়াকুব পালিয়েছে, কিন্তু তার জটিবুটিশেকড়বাকড়ের প্রভাব আস্ত রেখে গেছে।

অবশ্য এসব হচ্ছে তন্ত্র বিশ্বাসের ধারাবাহিক সংক্রমণ। হবে না? জুহা মৌলবির ভাষ্য: এই কর্ণসুবর্ণ ছিল বৌদ্ধদের মস্ত ঘাঁটি। হীনযান সম্প্রদায় ছিল, তেমনি ছিল, মহাযানীরা। এদেরই লোকায়ত রূপ সিদ্ধাই তান্ত্রিকতা। ডাকিনী যোগিনী প্রেত ইত্যাদি ভাবকল্পগুলোর মধ্যে এদের ছিল বাস। এলাকার গ্রামে গ্রামে এদের সংগুপ্ত ঐতিহ্য তুমি লক্ষ্য করবে। গোকর্ণের পাশের গ্রাম বিজয়নগর—অধিবাসীরা মুসলিম। অথচ ওরা সবাই গুণিন ও তান্ত্রিক। কালীপুজোর অমাবস্যার রাত্রে ওরা নিশিপান করে, তন্ত্রসাধনার গুহ্য আচার পালন করে। দ্রাবিড় সংস্কারের সঙ্গে আর্য সংস্কার, তার সঙ্গে মঙ্গোলিয় সংস্কার তারপরে জুটল সেমিটিক মুসলিম সংস্কার। নাও, বোঝো ঠ্যালা। সংস্কারের সে এক হযবরল—এই জটিল জাল ছিঁড়ে আদমপুত্রদের মুক্তিদানই জুহাসাহেবের ঐকান্তিক ব্রত। বস্তুত ফরাজি আন্দোলনের পটভূমিকায় বাহ্যরূপ ব্রিটিশবিরোধিতা, কিন্তু মূল উদ্দেশ্য ভারতীয় মুসলিমদের আত্মাকে শোধন করা —হিন্দুত্বের প্রবাব থেকে মুক্ত করা। ইত্যাদি, ইত্যাদি।

এই গোরাং ডাক্তার একদা তাঁকে বলেছিলেন, ‘ওহে মৌলবি, উপনিষদের তত্ত্ব তোমার ওই ভোঁতা মাথায় ঢুকবে না—পাদরি সাইমনেরও ঢুকবে না। তোমরা সেমিতি। তোমাদের ধর্মের পূর্বপুরুষ আব্রাহাম বুঝতেন। তিনি ছিলেন আসলে প্রকৃতির উপাসক। নেচার ছিল তাঁর ঈশ্বর। তাঁর সঙ্গে আমাদের ঋষিদের চিন্তার মিল আছে আগাগোড়া। জড়ে—অজড়ে সর্বময় ব্রহ্মের অস্তিত্ব তোমাদের সুফিরাও বিশ্বাস করতেন। মৌলবিভায়া, তোমার দৃষ্টি স্থূল—তোমার মগজে মোটা বুদ্ধি। এই কাঠের টুকরোর মধ্যেও ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে। শুধু দেখতে শিখতে হয়। আর ভাই জুহাসায়েব, তুমি নাকি রবিঠাকুরের ভক্ত—তুমি নাকি তাঁর কবিতায় ইসলামি বিশ্বাস খুঁজে পাও। হ্যাঁ রবিঠাকুর ব্রাহ্ম, মূর্তিপুজোর বিরোধী ব্রাহ্মণ। তাই তোমরা মনে মনে বড্ড খুশি এঁর প্রতি। কিন্তু আসলে তিনিও এই কাঠির মধ্যে ঈশ্বরের লীলা দেখেন। আব্রাহাম বা এব্রাহিম থেকে সোজা লাইন টেনে দাও, রবিঠাকুরে এসে পৌঁছবে। তুমি শালা একটা গাড়োল হে!’

তাই শুনে সেবার জুহা মৌলবির এত রাগ হয়েছিল যে বেশ কিছুদিন ওমুখো হননি। কতবার এমন হয়েছে। তবে লোকটা মানুষ হিসেবে ভালো। বন্ধুতা ইত্যাদি কিছু মানসিক শ্রেষ্ঠ গুণাবলিতে তাঁর প্রগাঢ় বিশ্বাস আছে। জেল থেকে গোরাংবাবু ফিরে এলে অন্তত একবার করে আসেন! গতিক বুঝে গেছেন—তাই তর্কের ধারকাছ ঘেঁষেন না। দশপনেরো মিনিট বসে কুশল প্রশ্ন করেই কেটে পড়েন। গোরাংবাবু কিন্তু অনর্গল কথা বলেন। অসংলগ্ন, উদ্ভট সব কথা। তিনি মৌলবিকে দেখে খুবই খুশি হন সত্যি, কিন্তু চলে গেলে একনাগাড়ে অকথ্য গালাগালি দেন। এবং যাবার সময় মৌলবি আড়ালে স্বর্ণকে বলে যান, ‘তিনপাহাড়ি বলে একটা জায়গা আছে বিহারে—পূর্ণিয়া জেলায়। ওখানে উন্মাদরোগের হাসপাতাল করেছে মিশনারিরা। চেষ্টা করে দেখতে পারো, মা।’

কী মারাত্মক পরামর্শ! সুধাময় তিনপাহাড়ি স্টেশনে রয়েছে। সে এখন স্টেশন মাস্টার। স্বর্ণ যাবে? সুধাময় তার সুখ, নাকি তার দুঃখ, এ মীমাংসা আজও হয়নি। এই ঠোঁটে তার ঠোঁটের ধর্ষণের স্মৃতি রয়েছে। মাঝে মাঝে আয়নায় নিজের ঠোঁট দুটো দেখে স্বর্ণ। বিচলিত হয়। কেন অমন হয়েছিল—কেন?

তিনপাহাড়ি! শব্দটা ওই আকস্মিক প্রধর্ষক চুম্বনের এত প্রধান অনুষঙ্গ যে গা জ্বলে যায় ঘৃণায়, আবার মৃদুভাবে এই বোধ আনে যে তাকে একজন পুরুষ চুম্বন করেছিল, তাই সে জীবনের কোনো গূঢ় ক্ষেত্রে বিজয়িনী হয়ে রইল।

হায়, সুধাময় যদি জর্জ হ্যারিসন হত—কিংবা জর্জ হ্যারিসন হত সুধাময়! স্বর্ণ কী বিপদেই না পড়ত।…

‘মিস রয়!’

কে? বর্ষাতিতে শরীর মুড়ে জর্জ বেরিয়েছে। হাতে বন্দুক। শান্টিং লাইটের ওপর পা ফেলে হাঁটতে হাঁটতে ডেকেছে—’মিস রয়!’

নতুন এ এস এম এসে গেছে আরেক বাঙালিবাবু। বয়সে প্রৌঢ়—এখনও আলাপ হয়নি। তাই জর্জ ফের দুবেলা বেরোতে পারছে বাঘের তল্লাসে। আকাশ ফরসা হয়ে গেল। আজ আর বৃষ্টি হবে না বোঝা যাচ্ছে। জর্জের কাঁধে ব্যাগ আর একগুচ্ছের রশারশি। মাচান বাঁধবার সরঞ্জাম। ‘হ্যালো মিস রয়!’ সকৌতুকে হাত দোলাচ্ছে সে।

স্বর্ণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছিল। গোবরহাটি যাবে মতিবায়েনের বাড়ি। রোজ একবার করে না গিয়ে থাকতে পারছে না। খুব ভোরে যায়, এক ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসে। বাঁকী নদীতে ঘোড়াটার হাঁটু অব্দি জল বইছে কদিন থেকে। আজ সারাদিন বৃষ্টি হল। উত্তরের বিশাল বিল ‘তেলকার জলা’ থেকে জল নামলে বাঁকীর বুক ভরে যাবে নির্ঘাৎ। তবু একবার যেতে হবে। ছেলেটার প্রতি কি সে বেশি মনযোগী হয়ে পড়েছে ক্রমশ? ছেলেটা তার নিছক জেদের বিষয়, নাকি স্নেহ মমতা? স্বর্ণ বুঝতে পারে না। শুধু সবিস্ময়ে এবং শিহরনসহ লক্ষ্য করে, সে ক্রমশ গভীরভাবে আসক্ত।

স্বর্ণ বারান্দা থেকে নেমে বলে—’বাঘ?’

‘ইউ আর ড্যাম রাইট।’…জর্জ হাহা করে হাসে।

আর সেই সময় গোরাং ডাক্তার ঘর থেকে বেরিয়ে বলেন, ‘বাঘ, না কচু! শুধু বড়ফট্টাই! দেখছ কখনও বাঘ? রয়েল বেঙ্গল টাইগার—সাবধান! ফাদার—মাদার বলতে দেবে না!’

‘হ্যাল্লো ডাক্তারবাবু! কেমন আছেন?’ …জর্জ এগিয়ে আসে।

‘আমি যাই থাকি, তোমার কী হে সাহেব? খবরদার, কখনো আমার মেয়েকে অমন অভদ্রভাবে ডাকবে না। গোরু, না ছাগল যে দূর থেকে অমন করে ডাকবে?’

স্বর্ণ বলে, ‘বাবা! ঘরে যাও!’

‘নেভার! কভি নেহী!’ গোরাংবাবু মুঠো শূন্যে তুলে বলেন। …’শী ইজ এ হিন্দু উইডো। তার সম্মান আছে মি. হ্যারিসন!’

জর্জ সটান তারের বেড়া টপকে কাছে এসে গম্ভীর মুখে বলে, ‘আমি আপনার কন্যাকে বহট, সম্মান করে, ডাকটার বাবু। শী ওয়াজ মাই টিচার।’

‘জর্জ! তুমি যেখানে যাচ্ছ যাও তো!’ স্বর্ণ বাবার হাত ধরে টানে। …’ঘরে চলো।’

হাত ছাড়িয়ে নিয়ে গোরাংবাবু বলেন, ‘যাচ্ছি! জেলখানায় ছিলুম বলে সবাই আমার মেয়েকে যা খুশি করছ তোমরা। এখন এসো দেখি—কাম অন! টাচ হার—গায়ে হাত দাও!’

স্বর্ণ অস্ফুট চিৎকার করে—’বাবা!’

জর্জ আরও গোমড়া হয়ে বলে, ‘কেহ মিস রয়কে কিছু করে নাই। দ্যাটস এ ন্যাসটি থিং, এভরিবডি এনজয়েড—গসিপস!’

‘যাও, যাও! বন্দুক দেখে ভয় পায় না গৌরাঙ্গ রায়! সুধাময় আমাকে বলে গেছে, তুমি স্বর্ণর ওপর জবরদস্তি করতে গিয়েছিলে। ইয়েস! ইউ ট্রায়েড টু অ্যাটাক আপন হার টেস্টিটি!’

অমনি স্বর্ণ চকিতে বুদ্ধিশূন্যভাবে গোরাংডাক্তারের গায়ে সজোরে ধাক্কা দিয়ে বসল। আর্তনাদময় গর্জন করে গলায়—’ঘরে যাও, ঘরে যাও বলছি!’ গোরাংবাবু ভিজে ঘাসে পড়ে গেলেন। তখন স্বর্ণ তার হাত ধরে টানতে টানতে বারান্দার কাছে নিয়ে গেল। হাঁফাতে হাঁফাতে ঠেলে বারান্দায় তুলল। তারপর ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা টেনে শেকল তুলে দিল।

দরজায় পিঠ রেখে সে লাল চোখে জর্জের দিকে তাকাল। ভিতরে গোরাংবাবুর কোনো সাড়াশব্দ নেই।

জর্জ একটু হাসে। …’ডোন্ট টেক ইট সিরিয়াসলি! এ গসিপ!’ তারপর আস্তে আস্তে চলে যায়। লাইনে পৌঁছে একবার এদিকে ঘুরে বাঁহাতটা নাড়ে—অর্থাৎ ‘কিছু মনে করোনা—টেক ইট ইজি। সহজভাবে নাও’….

তার একটু পরেই স্বর্ণ চৈতকের পিঠে চেপে বেরিয়ে পড়ে। গোরাংবাবু যা ছিলেন, তাই—শুয়ে পত্রিকা পড়ছেন। স্বর্ণর ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে—তারপর ভারী কষ্ট হয়। বাবাকে ধাক্কা মারল। কোথায় চলে যাচ্ছে সে দিনে দিনে।

রাস্তায় কাদা। ঘোড়াটার চলতে কষ্ট হচ্ছে। কাঁচা রাস্তা—সামান্য বৃষ্টিতেই কাদা হয়। তবে এলাকার মাটির একটা গুণ আছে, খুব তাড়াতাড়ি রস শুষে নিতে পারে। বাঁকী নদীতে জল কিছু বেড়েছে। পেরোতে সময় লাগল। ঘোড়ার তলপেট ছুঁল ঘোলা স্রোত। স্যাডল থেকে পা তুলেছিল স্বর্ণ। পরনে ঘিয়ে রঙের ব্রিচেস—মাথায় শোলার হালকা টুপি, গলায় স্টেথিসকোপ, লেডি ডাক্তার কলে চলেছে।

তারপর রাস্তার মাটি বেশ শক্ত খটমটে। বৃষ্টি হয়েছে বোঝা যায় না। উঁচু হয়ে উঠেছে ক্রমশ গোবরহাটির দিকে। দিঘির পাড় দেখে পাহাড় মনে হয়। চারদিকে ধ্বংসস্তূপ—খুচখাচ ঝোপঝাড়, শেয়াকুল নাটা বৈঁচি কোঙা কেয়া, নিমগাছ বটগাছ, নির্জন শিবমন্দির—একসময় বৌদ্ধদের জমজমাট আখড়া ছিল। গাছতলায় ছড়ানো শিলাগুলোতে সেই চিহ্ন রয়েছে। দিঘির পাড়ে ওঠা গেল না—বড় পিছল। নিচে দিয়ে কুপথে এগোল ঘোড়া। সামনেই বায়েন পাড়া। শেষ সূর্যের গাঢ় গোলাপি রোদ পড়েছে গাছপালায়। বায়েনপাড়ায় কার বাড়ি ঢোল আর সানাই বাজছে। মহড়া চলেছে অভ্যাসমতো। তাড়ি খেয়ে দাওয়ায় ওরা বসেছে। রেওয়াজ চলছে সানাইতে—পূরবীর।

এই নিরক্ষর গরিব ছোটলোকরাও পূরবী রাগিণী বাজাতে পারে! ঢোলে বিলম্বিত লয়ের সূক্ষ্ম গভীর ছন্দকে শব্দের প্রতীকে সাজাতে পারে! বেপথু গলায় ফোগলা মুখে কোনো বুড়ো দুহাত প্রসারিত করে দোলাচ্ছে এবং বলছে—ধা—কট্টে—ধে— ধিন…ধা—আ—ধা—আ—ধিন—কট্টে—তেরেকেধে—ধা—ধি—ই—ন—ধি—ই—ন…..

মতি বায়েনের বউ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। দৌড়ে আসে স্বর্ণকে দেখে! —’দিদি, ও ডাক্তোর দিদি! বিষম খবর—খারাপ খবর। মিন্সে সেই বেরিয়েছে দুপুরবেলা বিষ্টি মাথায়! এখনও ফেরেনি! আমি ভাবছি কী করে মুখ দেখাব আপনাকে দিদি গো!’…আচমকা হু হু করে কেঁদে ওঠে সে!

স্বর্ণ রুদ্ধশ্বাসে বলে, ‘কী হয়েছে বায়েনবউ?’

‘ছেলেটা পালিয়েছে। দুপুরবেলা বিষ্টি পড়ছিল—আমি উনুন ধরাব বলে আগুন আনতে গেলাম নুটোদের বাড়ি, মিন্সে যেয়েছিল বাবুদের আখড়ায়, ইদিকে ছেলে আমার একলা ছিল। এসে দেখি, ঘরে নাই। তা—খোঁজ খোঁজ! দিঘির উদিক কটা ছোঁড়া গোরু চরাচ্ছিল—বললে, তোমাদের ভাগ্নে হুই মাঠ বাগে ভিজতে ভিজতে যাচ্ছিল দেখলাম! তক্ষুনি তো চলে গেল সেবাগে। আর দুজনেরই পাত্তা নাই ডাকতোরদিদি। এই আমি কেবল ঘরবার হচ্ছি তখন হতে—না নাওয়া, না খাওয়া!’

‘কমলকে খবর দাওনি?’

‘দিয়েছি। সে বললে—ছেড়ে দাও। সময় হলে ফিরবে।’

‘কোন মাঠে দেখেছে বললে?’

‘পুবমাঠে—হেজলের (হিজল বিলের) দিকে।’

স্বর্ণ ঘোড়া ঘোরায়। আস্তে আস্তে চলে আসে। দিঘির শেষপ্রান্তে এসে ঢালু হতে থাকা বিস্তীর্ণ প্রান্তরের দিকে তাকায়। রোদ মুছে ধূসর ছায়া নেমেছে। কোথায় হারিয়ে গেল ছেলেটা? তার দুচোখ জলে ভরে আসে। কিছুতে নিজেকে সামলাতে পারে না সে। ও আমার কে? বারবার মনেমনে উচ্চারণ করে। আর ধীরে হেঁটে আসে গৃহাভিমুখী শান্ত চৈতক। দিন শেষে এক অপারশূন্যতায় বিলম্বিত সেই পূরবীর লয় কেন্দ্র করে ঘোড়াটার পায়ের শব্দ মৃদু বাজে, ধা—কট্টে—ধে—ধিন….ধা—আ—ধি—ই—ইন— ধা—আ….