১৬শ অধ্যায় – শল্যসহ যুদ্ধে যুধিষ্ঠিরের দৃঢ়তা
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! ঐ সময় যুদ্ধদুৰ্ম্মদ অসংখ্য কৌরবসৈন্য মদ্ররাজকে অগ্রসর করিয়া মহাবেগে পাণ্ডবসৈন্যগণের প্রতি ধাবমান হইয়া ক্ষণকালমধ্যে একবারে তাঁহাদিগকে আলোড়িত ও বিদ্রাবিত করিল। মহাবীর বৃকোদর কৃষ্ণ ও অর্জুনের সমক্ষেই স্বীয় সৈন্যগণকে নিবারণ করিতে লাগিলেন, কিন্তু তাহারা কৌরবগণের শরে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া কোনক্রমেই সমরস্থলে অবস্থান করিতে সমর্থ হইল না। তখন মহাবীর ধনঞ্জয় ক্রোধাবিষ্ট হইয়া কৃতবর্ম্মা, কৃপাচাৰ্য্য ও তাঁহাদের অনুগামীদিগের উপর শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন। মহাত্মা সহদেব সৈন্যপরিবৃত শকুনির প্রতি শর নিক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিলেন। নকুল তাঁহার পার্শ্বে অবস্থান করিয়া মদ্ররাজকে অবলোকন করিতে লাগিলেন। দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র বহুসংখ্যক ভূপতির, পাঞ্চালনন্দন শিখণ্ডী অশ্বত্থামার, গদাপাণি ভীমসেন দুৰ্য্যোধনের ও কুন্তীতনয় যুধিষ্ঠির সৈন্যসমবেত মদ্ররাজের নিবারণে প্রবৃত্ত হইলেন।
“হে মহারাজ! এইরূপে উভয়পক্ষীয় বীরগণের ঘোরতর যুদ্ধ উপস্থিত হইলে মদ্ররাজের অসাধারণ কাৰ্য্যদর্শনে সকলেই চমৎকৃত হইল। তিনি একাকীই সমস্ত পাণ্ডবসৈন্যের সহিত যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। ঐ সময় যুধিষ্ঠিরসমীপে শল্যকে অবলোকন করিয়া বোধ হইল যেন, শশধরসমীপে শনিগ্রহ বিরাজিত হইতেছে। তখন, মহাবীর শল্য আশীবিষসদৃশ শরনিকরে যুধিষ্ঠিরকে নিপীড়িত করিয়া পুনরায় শরবর্ষণ করিয়া ভীমসেনের প্রতি ধাবমান হইলেন। তদ্দর্শনে কৌরব ও পাণ্ডব উভয়পক্ষীয় সৈন্যগণই মদ্ররাজকে ধন্যবাদ প্রদান করিতে লাগিল। পাণ্ডবসৈন্যেরা শল্যের শরে, নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া সমর পরিত্যাগপূর্ব্বক পলায়নে প্রবৃত্ত হইল। তখন মহারথ যুধিষ্ঠির রোষভরে ‘হয় জয়লাভ করিব, না হয় বিনষ্ট হইব’ এই স্থির করিয়া পুরুষকার অবলম্বনপূর্ব্বক মদ্ররাজকে নিপীড়িত করিতে লাগিলেন এবং স্বীয় ভ্রাতৃগণ ও বাসুদেবকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ প্রভৃতি যেসকল বীরগণ কৌরবদিগের নিমিত্ত সমরস্থলে পরাক্রম প্রকাশ করিয়াছিলেন, তাঁহারা সকলেই নিহত হইয়াছেন। তোমরাও উৎসাহ সহকারে স্ব স্ব অংশানুসারে তাঁহাদিগকে বিনষ্ট করিয়া পুরুষত্ব প্রকাশ করিয়াছ, এক্ষণে আমার অংশে একমাত্র মহারথ মদ্ৰাধিপতি অবশিষ্ট আছেন। আজ আমি ইঁহাকে পরাজিত করিতে উদ্যত হইয়াছি। এক্ষণে আমার যাহা অভিপ্রায়, তাহা তোমাদিগের নিকট ব্যক্ত করিতেছি, শ্রবণ কর। মহাবীর মাদ্রীতনয়দ্বয় আমার চক্র রক্ষা করিতেছে; সূররাজ পুরন্দরও এই সত্যপ্রতিজ্ঞ বীরদ্বয়কে সমরে পরাভূত করিতে সমর্থ নহেন। অতএব ইঁহারা আমার হিতার্থে ক্ষাত্রধর্মনুসারে মাতুলের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হউক। হে বীরগণ! আমি সত্য বলিতেছি, আজ জয় হউক, আর পরাজয়ই হউক, আমি ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্মানুসারে মাতুলের সহিত সমরে প্রবৃত্ত হইব, সন্দেহ নাই। তাঁহার ও আমার অস্ত্রশস্ত্র এবং অন্যান্য উপকরণসকল সমানই আছে। এক্ষণে রথযোগকগণ শাস্ত্রানুসারে আমার রথে সমুদয় উপকরণ সংস্থাপিত করুক। সাত্যকি দক্ষিণচক্র এবং ধৃষ্টদ্যুম্ন বামচক্র রক্ষা করুন। ধনঞ্জয় আমার পৃষ্ঠরক্ষায় নিযুক্ত হউক আর মহাধনুর ভীমসেন আমার অগ্রে অবস্থান করুক। তাহা হইলেই আমি মদ্ররাজ অপেক্ষা সমধিক বলশালী হইব। হে মহারাজ। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির এই কথা কহিলে তাহার হিতৈষী বীরগণ তাঁহার বাক্যানুসারে তাহা সম্পাদন করিলেন। তখন পাঞ্চাল, সোমক ও মৎস্যসৈন্যগণ সাতিশয় হর্ষযুক্ত হইল।
শল্য–যুধিষ্ঠির যুদ্ধে শল্যপরাজয়
“রাজা যুধিষ্ঠির এইরূপে প্রতিজ্ঞারূঢ় হইয়া মদ্ৰাধিপতি শল্যের প্রতি গমন করিতে লাগিলেন। পাঞ্চালগণ শঙ্খনিস্বন, ভেরীনিনাদ ও সিংহনাদ করিয়া ক্রোধভরে মদ্ররাজের প্রতি ধাবমান হইল। এ দিকে কৌরবগণ গজঘন্টাশব্দ, তূৰ্য্যধ্বনি, শঙ্খনাদ ও হর্ষজনিত কোলাহলে রণস্থল অনুনাদিত করিতে লাগিলেন। তখন আপনার আত্মজ রাজা দুর্য্যোধন ও মদ্ররাজ শল্য উদয় ও অস্তাচল যেমন মহামেঘসমূহকে প্রতিগ্রহ করে তদ্রূপ সেই পাণ্ডবগণকে প্রতিগ্ৰহ করিলেন। অনন্তর মহাবীর শল্য ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের প্রতি ইন্দ্রনির্মুক্ত বারিধারার ন্যায় অনবরত শুরধারা বর্ষণ করিতে লাগিলেন; কুরুরাজ দুর্য্যোধনও রুচির [উজ্জ্বল] শরাসন গ্রহণ ও বিবিধ অস্ত্রশিক্ষা প্রদর্শনপূর্ব্বক ক্ষিপ্তহস্তে নিরন্তর শরনিকর পরিত্যাগ করিতে আরম্ভ করিলেন। তৎকালে কেহই তাঁহার কোন রন্ধ্র প্রাপ্ত হইল না। অনন্তর মহাবলপরাক্রান্ত রাজা যুধিষ্ঠির ও মদ্ররাজ বিবিধ শরজালবিস্তারপূর্ব্বক আমিষলোপ শার্দূলদ্বয়ের ন্যায় পরস্পরকে ক্ষতবিক্ষত করিতে লাগিলেন। মহাবীর বৃকোদর, সমরদক্ষ দুৰ্য্যোধনের সহিত এবং ধৃষ্টদ্যুম্ন, সাত্যকি, নকুল ও সহদেব ইহারা শকুনি প্রভৃতি বীরগণের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন। তখন উভয়পক্ষে পুনরায় ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হইল। মহারাজ দুর্য্যোধন আনতপৰ্ব্ব শরদ্বারা ভীমসেনের সুবর্ণমণ্ডিত ধ্বজদণ্ড ছেদন করিলেন, ভীমসেনের সেই কিঙ্কিণীজালসমলঙ্কৃত রুচিরদর্শন ধ্বজ দুৰ্য্যোধনের শরে ছিন্ন হইয়া তাঁহার সমক্ষেই ভূতলে নিপতিত হইল। তৎপরে কুরুরাজ পুনরায় খরধার ক্ষুর নিক্ষেপূর্ব্বক বৃকোদরের করিশুণ্ডোপম কোদণ্ড ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তখন ভীমসেন শাসনবিহীন হইয়া বিক্রমপ্রকাশ পূর্ব্বক রথশক্তিদ্বারা দুৰ্য্যোধনের বক্ষঃস্থল ভেদ করিলেন। মহাবীর দুর্য্যোধন ভীমের সেই রথশক্তির আঘাতে তৎক্ষণাৎ বিমোহিত হইয়া রথোপরি নিষগ্ন হইলেন। মহাবীর বৃকোদর কুরুরাজকে মোহাবিষ্ট দেখিয়া সত্বর ক্ষুরপ্ৰদ্বারা তাঁহার সারথির মস্তক ছেদন করিয়া ফেলিলেন। দুৰ্য্যোধনের অশ্বগণ সারথিহীন হইয়া রথ লইয়া যদৃচ্ছাক্রমে ইতস্ততঃ ধাবমান হইল, তদ্দর্শনে সকলেই হাহাকার করিতে লাগিল। তখন মহাবীর অশ্বত্থামা, কৃপ ও কৃতবর্ম্মা রাজাকে রক্ষা করিবার নিমিত্ত ধাবমান হইলেন। ঐ সময় দুৰ্য্যোধনের অনুচরগণ সৈন্যগণকে নিতান্ত বিশৃঙ্খল দেখি যারপরনাই ভীত হইল। মহাবীর ধনঞ্জয় সেই অবসরে গাণ্ডীব শরাসন আকর্ষণপূর্ব্বক তাঁহাদিগকে বিনাশ করিতে লাগিলেন। ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির স্বয়ং মনোবেগগামী শ্বেতবর্ণ অশ্বগণকে সঞ্চালনপূর্ব্বক ক্রোধভরে মদ্ররাজের প্রতি ধাবমান হইলেন। তিনি মৃদুভাবাপন্ন ও জিতেন্দ্রিয় হইয়াও যে তকালে অতিশয় দারুণ কার্য্যের অনুষ্ঠান করিলেন, তদ্দর্শনে আমরা সকলেই বিস্মিত হইলাম। তিনি রোষভরে বিস্ফারিতলোচন ও কম্পিতকলেবর হইয়া সুনিশিত ভল্লদ্বারা অসংখ্য যোধগণকে সংহার করিতে লাগিলেন। ফলতঃ তৎকালে ধৰ্ম্মরাজ যে যে সৈন্যের অভিমুখে গমন করিলেন, তাঁহারা সকলেই তাঁহার শরনিকরে বিদীর্ণ হইয়া কুলিশবিদলিত অচলের ন্যায় নিপতিত হইল। তিনি একাকী হইয়াও বায়ু যেমন জলদজালকে ছিন্নভিন্ন করে, তদ্রূপ অশ্ব, সারথি ও ধ্বসম্পন্ন রথ ও রথীদিগকে ছিন্নভিন্ন করিলেন এবং রুদ্রদেব যেমন পশুদিগকে বিনাশ করিয়াছিলেন, তদ্রূপ অসংখ্য অশ্ব, অশ্বারোহী ও পদাতিগণকে নিপাতিত করিতে লাগিলেন। এইরূপে ধৰ্ম্মরাজ শরনিকর বর্ষণপূর্ব্বক রণস্থল শূন্য প্রায় করিয়া মদ্ররাজের প্রতি ধাবমান। হইলেন এবং তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া বারংবার “থাক থাক” বলিয়া আস্ফালন করিতে লাগিলেন। তৎকালে কৌরবপক্ষীয় বীরগণ যুধিষ্ঠিরের পরাক্রম নিরীক্ষণ করিয়া নিতান্ত ভীত হইয়াছিলেন।
“অনন্তর মদ্ররাজ শল্য দ্রুতবেগে ধৰ্ম্মরাজের অভিমুখে গমন করিলেন। তখন সেই বীরদ্বয় ক্রোধভরে শঙ্খধ্বনি করিয়া পরস্পরকে আহ্বান ও ভৎর্সনা করিয়া সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলেন; মহাবীর শল্য শরজালবর্ষণপূর্ব্বক যুধিষ্ঠিরকে নিপীড়িত করিতে লাগিলেন; ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরও মদ্ররাজের প্রতি শরনিকর পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। এইরূপে সেই বীরদ্বয় পরস্পরকে শরসমূহে সমাচ্ছন্ন করিলে তাঁহাদিগের উভয়েরই কলেবর হইতে অনবরত রুধিরধারা ক্ষরিত হওয়াতে তাঁহারা বসন্তকালীন কুসুমিত কিংশুকবৃক্ষদ্বয়ের ন্যায় সুশোভিত হইলেন। তৎকালে ‘আজ ধৰ্ম্মরাজ শল্যকে সংহার করিয়া বসুন্ধরা উপভোগ করিলেন, কি মহাবীর মদ্ররাজ যুধিষ্ঠিরকে বিনাশ করিয়া দুর্য্যোধনকে পৃথিবী প্রদান করিবেন,’ যোদ্ধারা ইহার কিছুই অবধারণ করিতে পারিলেন না।
“অনন্তর মহাবীর শল্য ধৰ্ম্মরাজের প্রতি এক শর নিক্ষেপ করিয়া খরধার ক্ষুরদ্বারা তাঁহার কার্ম্মুক ছেদন করিলেন; তখন ধৰ্ম্মরাজও সত্বর অন্য এক শরাসন গ্রহণ ও তিনশত শরে শল্যকে নিপীড়িনপূর্ব্বক ক্ষুরদ্বারা তাঁহার শরাসন ছেদন করিয়া ফেলিলেন এবং নতপৰ্ব্বশরনিকরে তাঁহার চারি অশ্ব বিনাশ করিয়া দুই শরে পার্ষ্ণি ও সারথির প্রাণসংহারপূর্ব্বক এক সুনিশিত সমুজ্জল ভল্লে মদ্ররাজের ধ্বজদণ্ড খণ্ড খণ্ড করিলেন। তদ্দর্শনে দুৰ্য্যোধনের সৈন্যগণ এককালে ছিন্নভিন্ন হইয়া পড়িল। ঐ সময় মহারথ অশ্বত্থামা মদ্ররাজকে তদবস্থাপন্ন অবলোকন করিয়া তাঁহাকে রক্ষা করিবার নিমিত্ত তাঁহার সমীপে সমুপস্থিত হইলেন এবং সত্বর তাঁহাকে স্বরথে আরোপিত করিয়া তথা হইতে গমন করিতে লাগিলেন। মদ্ররাজ দ্রোণপুত্রের রথারোহণে কিয়দ্দুর গমন করিয়া ধৰ্ম্মরাজকে সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে দেখি রথবেগ নিবারণপূর্ব্বক অবিলম্বে মেঘগম্ভীরনিস্বন, যন্ত্রোপকরণসম্পন্ন [যন্ত্রাদি উপকরণযুক্ত–ভারত-যুদ্ধে দুই প্রকারে রথ ব্যবহৃত হইত। প্রয়োজন মত অশ্বদ্বারা মৃত্তিকাপথে শকটের ন্যায় চালিত হইত; আবার আবশ্যক মত আকাশপথে যন্ত্রাদিযোগে বিমানবৎ পরিচালিত হইত। আজকালকার মেশিনগানের মত কলের কামানও হয়ত তাহাতে থাকিত], সুসজ্জিত অন্য এক রথে আরোহণ করিলেন।”