রিশান আর সানি ছোট একটা ঘরে বসে আছে। ঘরটিতে একটা বৈচিত্র্যহীন বেঞ্চ এবং উপর থেকে আসা কর্কশ এক ধরনের তীব্র আলো ছাড়া আর কিছু নেই। সানি চারদিকে একবার তাকিয়ে বলল, আমাদেরকে এখনো কেন এখানে আটকে রেখেছে?
আমাদেরকে এখানে আটকে রাখে নি, এখানে আমাদের জীবাণুমুক্ত করছে।
কিন্তু অন্য দুজন তো চলে গেল।
হ্যাঁ তারা তো আমাদের মতো গ্রুনি কলোনিতে যায় নি। তাদের জীবাণুমুক্ত করা সহজ। আমাদের দুজনের অনেক সময় নেবে।
ও। সানি খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে বলল, কিন্তু চুপচাপ বসে থাকতে তো ভালো লাগে না। কিছু তো দেখতেও পারি না
এই তো আর কিছুক্ষণ, তারপর আমরা মূল মহাকাশযানে চলে যাব, সেখানে অনেক কিছু দেখতে পাবে। এই যে গ্ৰহটাতে এতদিন তুমি ছিলে সেটা কেমন তাও দেখবে!
সানি একটা ছোট নিশ্বাস ফেলল, কিছু বলল না। রিশান তাকে নিজের কাছে টেনে এনে বলল, মন খারাপ লাগছে সানি?
সানি কোনো কথা বলল না। রিশান তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, এই তো আর কয়েকদিনের মাঝে আমরা পৃথিবীতে রওনা দেব–সেখানে পৌঁছে দেখবে তোমার কত ভালো লাগবে। সেখানে তোমার আর কোনোদিন মহাকাশচারীর পোশাক পরে বের হতে হবে না। বাতাস ঝকঝকে পরিষ্কার, তুমি বুক ভরে নিশ্বাস নেবে। আকাশ হবে গাঢ় নীল, মাঝে মাঝে সেখানে থাকবে সাদা মেঘ। কখনো কখনো সেখানে বিদ্যুৎ চমকে চমকে উঠবে, তারপর বৃষ্টি প্রু হবে!
বৃষ্টি?
হ্যাঁ বৃষ্টি! আকাশ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি নেমে আসবে।
সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি।
তখন তুমি ইচ্ছে করলে আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পার, দেখবে বৃষ্টির পানি এসে তোমাকে ভিজিয়ে দেবে!
সত্যি?
হ্যা সত্যি। এই গ্রহে যেরকম কোনো পানি নেই, তুমি প্রত্যেক ফোঁটা পানি বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে রাখ–পৃথিবী সেরকম নয়। পৃথিবীর প্রায় বেশিরভাগই পানি!
কী মজা!
হ্যাঁ–খুব মজা। রিশান হেসে বলল, তারপর তুমি যখন তোমাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যাবে, দেখবে তোমার বয়সী ছেলেমেয়ে! তাদের মাঝে কেউ কেউ তোমার প্রাণের বন্ধু হয়ে যাবে–তোমার মনে হবে তোমার সেই বন্ধুদের ছাড়া তুমি কেমন করে একা একা ছিলে এতদিন!
কিন্তু, কিন্তু
কিন্তু কী?
আমি তো কখনো পৃথিবীতে থাকি নি–আমি তো জানি না কী করতে হয়, কী বলতে হয়—
সেটা নিয়ে তুমি কিছু ভেবো না! তারা যখন জানবে তুমি ভিন্ন গ্রহ থেকে এসেছ দেখবে কেমন অবাক হয়ে যাবে!
সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি।
রিশান এক ধরনের মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে এই শিশুটির দিকে তাকিয়ে রইল। রহস্যের খোঁজে সে গ্রহ থেকে গ্রহে, মহাকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ভয়ঙ্কর সব অভিযানে জীবনের বড় অংশ কাটিয়ে এসেছে; ছোট একটা শিশুর অর্থহীন কৌতূহলের মাঝে যে এত বড় বিষয়, এত অপূর্ব রহস্য লুকিয়ে থাকতে পারে সে কল্পনাও করে নি।
রিশান আর সানি যখন ছোট আলোকিত ঘরটিতে বসে থেকে–থেকে ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেল তখন হঠাৎ একটা সবুজ আলো জ্বলে ওঠে এবং প্রায় সাথে সাথেই ঘরঘর শব্দ করে দরজা খুলে যায়। দরজার অন্য পাশে হান এবং বিটি দাঁড়িয়ে আছে। হান একটু এগিয়ে এসে সানির সামনে দাঁড়িয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, সম্মানিত সানি! আমাদের মহাকাশযানে তোমাকে সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।
সানি একটু অবাক হয়ে হানের দিকে তাকাল, ঠিক কী বলবে বুঝতে পারল না। বিটি একটু এগিয়ে এসে সানির দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এস আমার সাথে। তোমাকে আমাদের মহাকাশযানটি দেখাই।
সানি একটু ইতস্তত করে বলল, কী আছে মহাকাশযানে?
কত কী আছে, তুমি কোনটা দেখতে চাও সেটা তোমার ইচ্ছে। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কুৰু ইঞ্জিন আছে। কৃত্রিম মহাকর্ষ নিয়ন্ত্রণকক্ষ আছে, তুমি ইচ্ছে করলে সেখানে গিয়ে মহাকর্ষ বল অদৃশ্য করে দিতে পারবে, তখন তুমি শূন্যে ভেসে বেড়াবে!
সত্যি?
হ্যাঁ। আমাদের কাছে ইরিত্রা লেজার আছে, সেটা দিয়ে তুমি ইচ্ছে করলে তোমার গ্রহের বায়ুমণ্ডলটিতে একটা আলোর খেলা শুরু করে দিতে পার। আমাদের মূল তথ্যকেন্দ্রে অসংখ্য তথ্য আছে, চোখ বুলিয়ে দেখতে পার! কৃত্রিম অনুভূতি–ঘরে কৃত্রিম অনুভূতি অনুভব করতে পার! আরো এতসব জিনিস আছে যে বলে শেষ করতে পারব না। চল আমার সাথে
সানির মুখে হাসি ফুটে ওঠে। সে বিটির হাত ধরে বলল, চল।
রিশান এবং হান বিটির হাত ধরে সানির ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে, তাদের পিছনে দরজাটি ঘরঘর করে বন্ধ হয়ে যাবার সাথে সাথে দুজনেরই মুখ শক্ত হয়ে যায়। হান কঠোর মুখে রিশানের দিকে তাকিয়ে বলল, এখন কী করবে তুমি?
কী করব?
হ্যাঁ। তুমি নিজে নিজে খুব বড় বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছ রিশান। তার বেশিরভাগই নীতিমালার বাইরে। শুধু নীতিমালার বাইরে নয়, নীতিমালার বিরুদ্ধে।
বিশান একটা নিশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, আমার কিছু করার ছিল না। একটা বুদ্ধিমান প্রাণীকে আমি ধ্বংস হতে দিতে পারি না।
সেটা নিয়ে দীর্ঘদিন আলোচনা করা যাবে রিশান, এখন সেটা থাক। এখন বল তুমি কী করতে চাও।
আমি পৃথিবীতে ফিরে যেতে চাই।
পৃথিবীতে ফিরে গেলে মহাকাশ কাউন্সিলে তোমার বিচার হবে রিশান। সে বিচারের রায় কী হবে আমি তোমাকে এখনই বলে দিতে পারি, শুনতে চাও?
না। আমি নিজেও জানি সেই রায়। কিন্তু আমি পৃথিবীতেই ফিরে যেতে চাই।
হান রিশানের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি জান রিশান আমাদের এই মুহূর্তে পৃথিবীতে ফিরে যাবার প্রয়োজন নেই। আসল উদ্দেশ্য যাই থাকুক না কেন, আমাদের পাঠানো হয়েছে পৃথিবীর মানুষের বাসোপযোগী একটা গ্রহ খুঁজে বের করার জন্যে। আমরা সে জন্যে আরো এক–দুই শতাব্দী ঘুরে বেড়াতে পারি। তারপর যখন পৃথিবীতে ফিরে যাব, পৃথিবীর সবকিছু পাল্টে যাবে, হয়তো তোমাকে মহাকাশ কাউন্সিলের সামনে দাঁড়াতে হবে না, হয়তো
না। রিশান মাথা নাড়ল, আমি পৃথিবীতেই ফিরে যেতে চাই। পৃথিবী পাল্টে যাবার আগে আমি যেতে চাই।
কেন?
রিশান একটু ইতস্তত করে বলল, সানিকে আমি আমার পরিচিত পৃথিবীতে নিতে চাই হান। যে পৃথিবীতে গাছ আছে, নদী আছে, নীল আকাশে মেঘ আছে, মানুষের ভিতরে ভালবাসা আছে। দুশ বছর পর পৃথিবীতে কী হবে আমি জানি না আমি আমি সেই ঝুঁকি নিতে পারি না।
হান রিশানের কাছে এসে তার কাঁধে হাত রেখে বলল, আমি বুঝতে পারছি রিশান। আমরা পৃথিবীতেই ফিরে যাব!
রিশান নিচু গলায় বলল, বেঁচে থাকাটাই বড় কথা নয়। কিন্তু যতদিন বেঁচে থাকব সেই বেঁচে থাকাটার যেন একটা অর্থ থাকে।
হান হেসে বলল, অর্থ থাকবে রিশান। নিশ্চয়ই অর্থ থাকবে।
পৃথিবীতে ফিরে যাবার আগে প্রস্তুতি নিতে কয়েকদিন কেটে গেল। এই সময়টাতে সানি নিডিয়ার সাথে ইরিত্রা লেজার দিয়ে গ্রহটির বায়ুমণ্ডলে আলোর খেলা করে কাটাল। ঘুমোতে যাবার আগে বিটির সাথে কৃত্রিম মহাকাশ নিয়ন্ত্রণকক্ষে ভেসে বেড়ানোটি মোটামুটিভাবে একটি নিয়মিত খেলা হয়ে দাঁড়াল। হান তাকে নিয়ে বসত কুরু ইঞ্জিনের সামনে। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ইঞ্জিনটি সম্পূর্ণ বিনা কারণে তার সমস্ত শক্তি ব্যয় করে গর্জন করানোর ঘোরতর বেআইনি কাজটি সবাই উপভোগ করতে শুরু করল শুধুমাত্র সানির বিস্ময়াভিভূত মুখটি দেখে! রিশান তাকে নিয়ে বসত তথ্যকেন্দ্রে, মানুষের বিশাল জ্ঞানভাণ্ডার তার সামনে সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে বিকশিত করে দিয়ে সে সানির চোখের দিকে তাকিয়ে থাকত। স্বল্পভাষী ষুনকেও সবাই আবিষ্কার করল কৃত্রিম অনুভূতি–ঘরে, দীর্ঘ সময় সানিকে নিয়ে সে সেখানে বসে তার সাথে মানুষের বিচিত্র অনুভূতিকে নিয়ে খেলা করত।
যেদিন দীর্ঘ যাত্রার জন্যে সবাইকে শীতলঘরে গিয়ে ঘুমোতে হল, কোনো একটি বিচিত্র কারণে সবার ভিতরে এক ধরনের বিষণ্ণতা নেমে এল। ঠিক কী কারণ কারো জানা নেই কিন্তু সবার মনে হতে লাগল চমৎকার একটি স্বপ্ন শেষ হয়ে আসছে।