তোমার নাম মীরজুমলা? কিরীটীই প্রশ্ন করে।
জী
দেশ কোথায়?
ঢাকা জিলা।
বাঙালী তুমি?
হ্যাঁ।
তুমি আর শশী এখানে সাত বছর কাজ করছ, তাই না?
শশী বলেছে বুঝি?
যেই বলুক, কথাটা সত্যি কিনা?
একটু ইতস্তত করে মীরজুমলা বললে, হ্যাঁ।
তবে একটু আগে ও কথা বললে কেন মীলজুমলা?
আজ্ঞে মানে লোক বড় মিথ্যাবাদী কিনা তাই—
হুঁ, আচ্ছা আজ রাত্রে এখানে অশোক রায় এসেছিলেন?
হ্যাঁ।
মিস সেনের আগে না পরে?
কয়েক মিনিট পরেই বোধ হয়।
তারপর অশোক রায় কখন চলে যান জান কিছু?
না। দেখিনি।
অশোক রায় ও মিত্রা সেনকে তুমি কোথায় দেখ?
মিস সেন এসেই নীচে বাগানে চলে যান, আমি তখন হলঘরে। যাবার সময় বলে যান আমাকে, অশোকবাবু এলে তাঁকে বাগানে পাঠিয়ে দেবার জন্য।
অশোক রায় এলে তুমি বলেছিলে তাঁকে সে কথা?
হ্যাঁ। বলেছি বৈকি।
তুমিই তো এখানে সকলকে ড্রিঙ্ক সরবরাহ কর মীরজুমলা?
হ্যাঁ।
মিত্রা সেন ড্রিঙ্ক করতেন?
না।
কখনো ড্রিঙ্ক করেননি?
না।
অশোক রায়?
করতেন মধ্যে মধ্যে।
মহারানী?
করতেন প্রত্যহ।
বিশাখা চৌধুরী?
প্রত্যহ করতেন।
আজ ওঁরা কেউ ড্রিঙ্ক করেছিলেন?
বিশাখা চৌধুরী ও মহারানী করেছেন।
তুমি দেখেছিলে আজ মহারানী ও বিশাখা চৌধুরীকে আসতে?
মহারানীকে দেখেছি, কিন্তু বিশাখা চৌধুরীকে দেখিনি।
কেন? তুমি তখন কোথায় ছিলে?
বারে।
আচ্ছা আপাতত তুমি যেতে পার। রঞ্জনবাবুকে এ ঘরে পাঠিয়ে দাও।
যে আজ্ঞে।
মীরজুমলা চলে গেল।
মীরজুমলা ঘর থেকে বের হয়ে যেতেই কিরীটী লাহিড়ীর দিকে তাকিয়ে বললে, লাহিড়ী সাহেব, প্রত্যেককে আমি আমার যা জিজ্ঞাসা করবার জিজ্ঞাসা করছি বলে আপনার কাউকে বিশেষ কিছু জিজ্ঞাস্য থাকলে কিন্তু চুপ করে থাকবেন না।
না, না—আপনিই জিজ্ঞাসা করুন। আমিও সঙ্গে সঙ্গে নোট করে যাচ্ছি প্রত্যেকের জবানবন্দি। সেরকম কিছু জিজ্ঞাস্য থাকলে নিশ্চয় জিজ্ঞাসা করব। কিন্তু আপনি যেখানে জিজ্ঞাসা করছেন সেখানে কোন প্রশ্ন তোলার কোনরকম প্রয়োজন থাকতে পারে বলে তো
আমার মনে হয় না। মৃদু হেসে কথাটা শেষ করেন লাহিড়ী।
তাই বলে সব দায়িত্বটা আমার ঘাড়ে চাপাবেন নাকি?
এতবড় সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে নাকি! হাসতে হাসতে জবাব দেন লাহিড়ী আবার।
আসুন রঞ্জনবাবু!
ঠিক সেই মুহূর্তে ঘরে যে ব্যক্তি প্রবেশ করলেন তাঁকে আহ্বান জানাল কিরীটী।
রোগাটে চেহারার ভদ্রলোক, দৈর্ঘ্যে পাঁচ ফুট দু-তিন ইঞ্চির বেশী হবে না। পরিধানে দামী স্যুট। বেশভূষা ও চেহারার মধ্যে একট সযত্নরক্ষিত পরিচ্ছন্নতা। বয়স চল্লিশের কোঠা প্রায় পার হতে চলেছে বলেই মনে হয়৷
মাঝখানে সিঁথি করে চুল ব্যাকব্রাশ করা। ছোট কপাল, চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় দৃষ্টি বেশ তীক্ষ্ণ ও সজাগ। নাকটা একটু চাপা।
রঞ্জন রক্ষিত ঘরে ঢুকেই বললে, হলঘরে ওঁরা সব অস্থির হয়ে উঠেছেন। কতক্ষণ আর তাঁদের এভাবে আপনারা আটকে রাখতে চান, ওঁরা জানতে চাইছেন।
জবাব দিল কিরীটীই, সুব্রত, ওঘরে গিয়ে বলে আয় যাঁদের সঙ্গে কথা হয়ে গিয়েছে তাঁরা আপাতত যেতে পারেন বটে যে যার বাড়ি কিন্তু পুলিশ কর্তৃপক্ষের বিনানুমতিতে আপাতত তাঁরা কেউ কলকাতা ছেড়ে যেতে পারবেন না। কি বলেন লাহিড়ী সাহেব?
হ্যাঁ, তাই বলে আসুন সুব্রতবাবু। আর অসুবিধা না হলে প্রত্রেকের বাড়ির ঠিকানাটা নিয়ে নেবেন ওঁরা যাবার আগে।
বললাম, প্রত্যেকের ঠিকানা তো প্রেসিডেন্টের খাতা থেকেই পাওয়া যেতে পারে!
তবে তো কথাই নেই, they can go now। যেতে পারেন তাঁরা।
আমি ঘর থেকে বের হয়ে পাশের হলঘরে গিয়ে ঢুকলাম কিরীটী তথা লাহিড়ী সাহেবের নির্দেশটা জানিয়ে দেবার জন্য।
ঘরের মধ্যে ছত্রাকার ভাবে বৈকালী সঙ্ঘের মেম্বাররা সকলে এদিক-ওদিক বসে ফিসফিস করে কি যেন সব আলোচনা করছিলেন পরস্পর নিজেদের মধ্যে, আমাকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখেই অকস্মাৎ তাঁদের আলোচনার গুঞ্জনটার মধ্যে যেন একটা ছেদ পড়ল।বুঝলাম পরস্পরের মধ্যে আলোচনারত প্রত্যেকেরই মনটা পড়েছিল এক নম্বর দরজার দিকেই। যুগপৎ অনেকগুলো চোখের সপ্রশ্ন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যেন এসে সর্বাঙ্গে ছুঁচের মত বিদ্ধ হল।
আমি গম্ভীর হয়ে মৃদুকণ্ঠে রজত লাহিড়ী তথা কিরীটীর নির্দেশটা জানিয়ে দিয়েই সকলের মুখের উপর দিয়েই দ্রুত দৃষ্টি একবার বুলিয়ে নিলাম।
আমার কথার কেউ কোন জবাব না দিলেও, অনেকের মুখেই যে একটা স্বস্তির ভাব ফুটে উঠল সেটা আমার দৃষ্টিতে এড়াল না।
নিঃশব্দে যেমন আমি হলঘরে প্রবেশ করেছিলাম তেমনিই নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হয়ে এসে পূর্বোক্ত বার-রুমে ঢুকলাম।