আপাত দৃষ্টিতে দেখলে এই স্মারকগুলিকে যতো বিস্ময়করই মনে হোক না কেন, ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যায় আস্থা নিয়ে অগ্রসর হলে আর তেমন বিস্ময়কর মনে হয় না। কেননা, ওই বৈদিক ধ্যানধারণার মতোই লোকায়তিক ও বামাচারী ধ্যানধারণাগুলিঈ সত্যিই অপৌরুষেয় নয়—সমাজ-বিকাশের একটি নির্দিষ্ট স্তরে মানুষের মাথায় এগুলি দেখা দিয়েছিলো। বামাচারের কথাই বিশেষ করে বলি। আধুনিক চোখে দেখলে মনে হয়, শুধুমাত্র বীভৎস কামবিকার। কিন্তু সমাজ-ব্যবস্থার ঠিক কোন পর্যায়ে এগুলির উৎস তা যদি খুঁজে পাওয়া সম্ভবপর হয় তাহলে আর এগুলিকে কামবিকার বা লাম্পট্য-ব্যবহার বলে মনে করবার কোনো অবকাশই থাকে না। কেননা, সমাজ-ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দেখতে বোঝা যায় এগুলি সেই সমাজের মানুষের কাছে শুধুই যে উদ্দেশ্যমূলক তাই নয়, বাঁচা-মরার সমস্যার সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। সমাজ-বিকাএর সেই পর্যায় থেকে এগুলিকে উপড়ে যদি আজকের সমাজে, কিংবা সমাজ-বিকাশের কোনো পরবর্তী পর্যায়ের আবহাওয়ায়, নিয়ে আসবার চেষ্টা করা হয় তাহলে অবশ্যই ওই আদিম-গুরুত্বের দিকটা মরে যাবে, মুছে যাবে—যা ছিলো উদ্দেশ্যমূলক তাই হয়ে দাঁড়াবে উদ্দেশ্য-বিরোধী কামবিকার। অর্থাৎ কিনা ধ্যানধারণাগুলি বিপরীতে পরিণত হবে। যেমনটা হয়েছে তন্ত্রশাস্ত্রের অধিকাংশ লিখিত পুঁথিপত্রের বেলায়। কিন্তু ওই বামাচারী ধ্যানধারণাগুলির উৎস সমাজ-বিকাশের যে-পর্যায়ে তা লেখার হরফ আবিষ্কার হবে আগেকার পর্যায়। তাই বামাচারকে বোঝবার জন্যে তন্ত্রশাস্ত্রের লিখিত পুঁথিপত্রগুলিকে একমাত্র সম্বল মনে করলে আধুনিক গবেষক ভুল করবেন।
আরো কথা আছে। সমাজ-বিকাশের সেই প্রাচীন পর্যায়টির কথা স্পষ্টভাবে মনে রাখলে বোঝা যায়, সে-অবস্থায় মানুষের মাথায় ভাববাদী বা অধ্যাত্মবাদী চিন্তাধারা জন্মাবার অবকাশই পায় নি। হয়তো, সেই স্তরের চিন্তাধারাকে কোনো রকম দার্শনিক সংজ্ঞা দিতে যাওয়া ভুল হবে। কেননা, এ-চেতনা বহুলাংশেই অস্ফুট ও অব্যক্ত। এই স্তরের চেতনায় বাস্তব প্রকৃতির বাস্তব নিয়মকানুন সম্বন্ধে মানুষের প্রকৃত জ্ঞান নেহাতই তুচ্ছ ও অকিঞ্চিৎ : জ্ঞানের ওই দৈন্য সে-অবসথায় মানুষের বাস্তব দৈন্যেরই অনুরূপ। সমান করুণ। তবুও, যেটা হলো আসলে জরুরী কথা, এ-অবস্থায় মানুষের চেতনায় ভাববাদী বা অধ্যাত্মবাদী চিন্তাধারার জন্মই সম্ভবপর হয় নি। মানুষ তখনো দেবতার পায়ে মাথা কুটতে শেখে নি, পরলোকতত্ত্বের আলেয়ায় ভুলে সংসারকে অসার মনে করবার অবকাশ পায় নি, অবসর পায় নি দুনিয়াটা মনগড়া কিনা তাই নিয়ে মাথা ঘামাবার। তাই যতো মূক, যতো অস্পষ্ট, যতো অব্যক্তই হোক না কেন,–সমাজ-বিকাশের এই স্তরে মানুষের চেতনাটা লোকায়তিকই, দেহাত্মবাদীই।
কিন্তু, সমাজ-বিকাশের এ-রকম কোনো পর্যায়ের কথা কি সত্যিই বাস্তব? এ-রকম কোনো পর্যায়ের কথা কি সত্যিই জানা গিয়েছে?
গিয়েছে। কেননা, পুরো পৃথিবীর বুক জুড়ে সমস্ত মানুষই সমান তালে উন্নত হতে পারে নি। আজো পৃথিবীর আনাচে-কানাচে নানা জায়গায় মানুষের দল আদিম দশাতেই পড়ে রয়েছে। এবং তাদের দিকে দেখলে বোঝা যায় তাদের মাথায় ঈশ্বরের ধারণা জন্মায় নি, তারা প্রার্থনা করতে শেখে নি,–এক কথায় তারা এখনো অধ্যাত্মবাদ ও ভাববাদী চিন্তাধারার পরিচয় পায় নি।
Religion is characterized by belief in God and the practice of prayer or sacrifice. The lowest savages known to us have no gods and know nothing of prayer or sacrifice. Similarly whenever we can penetrate the prehistory of civilized peoples we reach a level at which again there are no gods and no prayer of sacrifice.(৫৪)
ধর্মের লক্ষণ হইলো ঈশ্বরের বিশ্বাস এবং উপাসনা ও বলিদান-মূলক ক্রিয়াকাণ্ড। যে-সব মানবদলকে সবচেয়ে আদিম অবস্থায় থাকতে দেখা গিয়েছে তাদের কোনো ঈশ্বর নেই এবং তারা প্রার্থনা বা বলিদানের কথা কিছুই জানে না। তেমনি, সভ্য মানুষদের প্রাক্-ইতিহাস পর্যন্ত যখনই পৌঁছোনো যায় তখন আমরা এমন করে স্তরে পৌঁছুই যেখানে ঈশ্বর নেই, উপাসনা নেই, বলিদান নেই।
ভারতীয় ধ্যানধারণার ইতিহাসে যদি লোকায়তিক চেতনার উৎস সন্ধান করা যায় তাহলে শেষ পর্যন্ত সমাজ-বিকাশের একটি এই রকম স্তরেই গিয়ে পৌঁছতে হয়। তার সাক্ষী স্বয়ং সিদ্ধিদাতা গণেশ।
তার মানে নিশ্চয়ই এই নয় যে ভারতবর্ষের ইতিহাসে লোকায়তিক চিন্তাধারা চিরকালই ওই রকম মূক, অব্যক্ত ও অচেতন অবস্থায় পড়েছিলো। বস্তুত, ওই রকমই একটা অস্ফুট ও অচেতন দেহতত্ত্ব হিসাবে তার জন্ম হলেও ভারতীয় দর্শনের আলোচনায় দেখা যায়, কোনো একটা যুগে এই লোকায়তিক চেতনাই রীতিমতো সচেতন বস্তুবাদী দর্শনে পরিণত হয়। পুঁথি লেখা হয়েছিলো, ভাষ্য রচনা হয়েছিলো এবং তার সে-সব ভাঙাচোরা টুকরো আজো পাওয়া যাচ্ছে তা দেখে বোঝা যায় লোকায়তিকদের যুক্তিতর্ক একটা যুগে কী রকম শানানো-সবল হয়ে উঠেছিলো। কি করে যে তা সম্ভবপর হয়েছিলো তা আজো আমরা পুরোপুরি জানতে পারি নি। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস-সংক্রান্ত মৌলিক গবেষণা আজো অনেক বাকি আছে।
কিন্তু তার আগে, যে-প্রসঙ্গ থেকে এতো কথা উঠেছে সেটুকুর আলোচনা সেরে নেবার চেষ্টা করা যাক।
বৈদিক ঐতিহ্যের সঙ্গে লোকায়তিক ঐতিহ্যের তফাতটা উত্তর যুগে এতো প্রকট হওয়া সত্ত্বেও বৈদিক সাহিত্যের মধ্যে বামাচারী ও এমনকি লোকায়তিক চেতনার এত অজস্র স্মারক কি করে টেকে রয়েছে?
তার কারণ নিশ্চয়ই লোকায়তিক ধ্যানধারণাও যে-রকম আকাশ থেকে জন্মায় নি, উত্তর যুগের বৈদিক অধ্যাত্মবাদ ও ভাববাদী ধ্যানধারণাও সেই রকমই আকাশ থেকে জন্মায় নি। উভয়ের উৎসই হলো সমাজ-বিকাশের নির্দিষ্ট পর্যায়ের মধ্যে। এখন, সমাজ-বিকাশের যে-সব বিভিন্ন পর্যায় সেগুলির মধ্যে বাঁধাধরা সম্পর্ক আছে : কোন পর্যায় আগের এবং কোন পর্যায় পরের, শুধু এইটুকুই সুনির্দিষ্ট ও অপরিবর্তনীয় নয়, এমন কি কোনো দেশের কোনো মানুষই আগের পর্যায়কে লঙ্ঘন করে একেবারে পরের পর্যায়ে উঠে যেতে পারে নি। তার মানে, পশুর রাজ্যে পিছনে ফেলে এগিয়ে চলতে চলতে মানুষ যে শেষ পর্যন্ত সভ্যতার আওতায় এসে পৌঁছলো তা একটি নির্দিষ্ট পথ ধরে এগিয়েই, কয়েকটি নির্দিষ্ট ধাপ পেরিয়েই। এই দিক থেকে সব দেশের মানুষের অভিজ্ঞতাই মোটের উপর এক রকমের। তাই আজকের দিনেও পৃথিবীর পিছিয়ে-পড়া মানুষেরা যে-অবস্থায় পড়ে রয়েছে সেই দিকে চেয়ে দেখলে এগিয়ে-যাওয়া মানুষের দল তাদের বিস্মৃত অতীতটাকে খুঁজে পাবে। কেননা, এগিয়ে-যাওয়া মানুষেরাও এককালে ঠিক ওই রকমেই পিছিয়ে-পড়া পর্যায়ে ছিলো—সে-পর্যায় না পেরিয়ে একেবারে সরাসরি উন্নত পর্যায়ে উঠে আসা কোনো দেশের বা কোনো জাতের মানুষের পক্ষে সম্ভবপর হয় নি।
এ-কথা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করলেন লুইস্ হেনরি মর্গান। তার ‘প্রাচীন সমাজ’ নামের বই শুধুই যে বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডারে অমূল্য সম্পদ তাই নয়, যে-কোনো দেশের প্রাচীন পুঁথিপত্রের প্রকৃত তাৎপর্য-নির্ণয়ে অপরিহার্য হাতিয়ারও।
মানুষের ধ্যানধারণার সঙ্গে সমাজ-বিকাশের পর্যায়-বিশেষের অঙ্গাঙ্গি সম্পর্কের কথা এবং এই পর্যায়-পরস্পরায় অনিবার্য ধারাবাহিকতার কথা মনে রাখলে বৈদিক সাহিত্যে বামাচারী ও লোকায়তিক ধ্যানধারণার স্মারকগুলি দেখে খুব বেশি বিস্ময়ের অবকাশ থাকবে না। কেননা, সমাজ-বিকাশের যে-পর্যায়ে লোকায়তিক ও বামাচারী ধ্যানধারণার উৎস, বৈদিক মানুষেরাও এককালে তার মধ্যে দিয়েই অগ্রসর হয়েছিলেন এবং সে-পর্যায়কে পিছনে ফেলে এলেও তাঁদের সাহিত্য থেকে তার স্মৃতি সম্পূর্ণভাবে মুছে যায় নি। এই স্মৃতি হিসেবেই সে-পর্যায়ের ধ্যানধারণার অনেক চিহ্ন বৈদিক সাহিত্যে টেকে গিয়েছে। তার মানে, বৈদিক ঐতিহ্যের বাহকরা উত্তর যুগে যে-সব ধ্যানধারণাকে অমন ঘৃণার চোখে দেখতে শিখেছিলেন, এককালে তাঁদের নিজেদের মনেই—অর্থাৎ তাঁদেরই পূর্বপুরুষদের মনে—সেগুলি চরম সত্যের মর্যাদা পেতো।
——————–
৫৪. G. Thomson R 9.