দেবতা ও অসুর
ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যে লক্ষ্য করা যায় যে, যজ্ঞ অনুষ্ঠান করেই দেবতারা দেবত্ব অর্জন করেছিলেন, এবং তাদের বিজয়লাভের মূল কারণও যজ্ঞ। সংহিতা পর্যায়ে কিন্তু ধারণা ছিল ভিন্ন ধরনের; সেখানে দেবতারা তাদের মহত্তর শৌর্য ও বীরত্বের দ্বারাই বিজয় অর্জন করেছেন। শতপথে কথিত হয়েছে যে, ছন্দের মধ্যে দিয়ে দেবতারা স্বৰ্গলাভ করেছিলেন; কিন্তু সংহিতায় স্বৰ্গই তাদের চিরন্তন আবাস, কোনও কিছুর সাহায্যে তা অর্জন করতে হয় নি। সংহিতার দেবতাদের নূতনভাবে শ্রেণীবিভক্ত করে পুনর্বিন্যাসের একটি প্রবণতা আমরা ব্রাহ্মণ সাহিত্যে লক্ষ্য করি। একটি দেবসঙ্ঘরূপে বিশ্বেদেবাঃ-র উত্থান এমনই একটি দৃষ্টান্ত যার মধ্যে আমরা কিছু কিছু গণদেবতার ব্যক্তি পরিচয়ের ক্ষয়ের নিদর্শন পাই। অনুষ্ঠান বিশেষজ্ঞদের মধ্যে দেবতা শব্দের প্রাচীন বিশেষণগুলিতে পৃথক ব্যক্তিত্ব আরোপের যে প্রবণতা দেখা গিয়েছিল, তারই ফলে দেবতাদের সংখ্যা বহুগুণ বৃদ্ধি পায় এবং নুতনভাবে শ্রেণীবিন্যাসের প্রয়োজন অনিবাৰ্য হয়ে পড়ে। আবার বহু অনুষ্ঠানই দেবকাহিনীর মধ্যে দিয়ে প্রবর্তিত হয়েছে, যেখানে কোনও নির্দিষ্ট দেবতার মধ্যে প্রথম পর্যায়ে কোনও গুণ বা শক্তি বা অনুষ্ঠানের অভাব পরিলক্ষিত হয়। অন্যান্য দেবতারা নিজস্ব শক্তিতে কিংবা প্ৰজাপতির নির্দেশে কোনও অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সেই গুণ যুক্ত করেন বা অভাব পূরণ করেন। এ ধরনের কাহিনী সংহিতায় প্রতিফলিত স্বয়ং-সম্পূর্ণ ও সর্বশক্তিমান দেবতার সম্পর্কে ধারণাকে সফলভাবে খণ্ডন করেছে; তাদের পূর্বতন গীেরব বহুলাংশে নিম্প্রভ হয়ে গেছে। যজ্ঞানুষ্ঠানের সময় কখনও কখনও যজমান ভাবগতভাবে নিজেকে কোনো না কোনো দেবতার সঙ্গে একাত্ম করে নিয়েছেন। সোমযাগে একটি নির্দিষ্ট সময়ে যজমান ইন্দ্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন। বস্তুত, দেবতা ও মানুষের মধ্যবতী আধ্যাত্মিক ব্যবধান হ্রাস করার জন্য এটা একটি বিশেষ পদ্ধতি। তবে, সর্বাধিক শক্তিশালী যে বিবৃতির দ্বারা দেবতার শ্রেষ্ঠত্ব, অসামান্যতা ও গৌরব সার্থকভাবে হ্রাস পেয়েছে, তা আমরা শতপথ ব্ৰাহ্মণে (১১ : ২ : ৩ : ৬) পাই : “দেবতারা একদা মরণশীল ছিলেন; ‘ব্ৰহ্মত্ব’ লাভ করে তাঁরা অমর হয়ে উঠলেন।” একদিক দিয়ে এটা দেবতার গৌরবকে সর্বাধিক ক্ষুন্ন করেছে, কেননা দেখা যাচ্ছে যে, তারা স্বভাবত অমর নন; ব্রহ্মের অলৌকিক শক্তির সাহায্যে তারা অমরতা অর্জন করেছিলেন। আবার ‘ব্ৰহ্ম’ বা ঐন্দ্ৰজালিক শক্তি পুরোহিতদের ভাবমূর্তির পক্ষে বিশেষভাবে অনুভূত অভাববোধকে প্রকট করে তুলেছিল। ঐ উক্তিতে পুরোহিতরা দেবতাদের সঙ্গে একই আধ্যাত্মিক উচ্চভূমিতে প্রতিষ্ঠিত। পুরোহিতদের উন্নতমােনা প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই দেবতাদের স্বাধীনতা ও সর্বশক্তিমত্তার অবনমন ঘটেছে। যদি ব্ৰহ্মা ব্যতীত দেবতারা নিজেরাই তুচ্ছ মরণশীল মানুষের সমতুল্য হয়ে পড়েন, তাহলে যে জনগোষ্ঠীতে পুরোহিতদের মধ্যে ব্ৰহ্মশক্তির আধ্যাত্মিক সঞ্চয় পরিস্ফুট-তারও ভবিষ্যৎ যথার্থ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। দেবতারাও যেহেতু সত্যরূপ ব্ৰতপালন করেন। শতপথ [ ১৪ : ১ : ১ : ৩৩ ] তাই তারা সন্ন্যাস ও ব্রতের দ্বারা ঋষিদের আদি প্রত্নরূপে পরিণত হন। অলৌকিক ও নৈতিক শক্তির শ্ৰেষ্ঠত্বই তাদের বিশেষ গৌরবের হেতু। বিশাল ও জটিল রাজ্যের বা সাম্রাজ্যের শাসকরূপে শক্তিশালী রাজাদের সম্পর্কে জনসাধারণের যে অভিজ্ঞতা গড়ে উঠেছিল, সম্ভবত তারই নিগৃঢ় প্রবর্তনায় একেশ্বরবাদের জন্ম। ব্রাহ্মণ সাহিত্যের যুগে ভারতবর্ষের সামাজিক পরিস্থিতি যে বাস্তব ভিত্তিভূমি রচনা করেছিল, তারই প্রভাবে সার্বভৌম একেশ্বর রূপে প্ৰজাপতির উত্থান। উপনিষদের পূর্ণ বিকশিত অদ্বৈতবাদের অব্যবহিত পূর্বে প্রায়-চুড়ান্ত ধর্মতাত্ত্বিক স্তর-রূপে একে গ্রহণকরা যেতে পারে। যদিও আমরা ব্ৰাহ্মণ গ্রন্থগুলিতে একেশ্বরবাদের কথা শুনি, মোটামুটিভাবে প্রচলিত ধর্মীয় বাতাবরণ তখনও বহুদেববাদী থাকলেও বহুদেববাদ ততদিনে বহুলাংশে হৃতগৌরব ও দুর্বল হয়ে পড়েছিল, এবং একেশ্বরবাদী প্রবণতা দ্রুত প্রভাবে বিস্তার করেছিল। প্ৰজাপতি এমন একজন বিমূর্ত-দেবতাররূপে ক্রম শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলেন যে, প্রত্নকথা ও আনুষ্ঠানিক রহস্যবাদী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরমেশ্বরের পক্ষে উপযুক্ত গুণাবলী যার উপর আরোপিত হচ্ছিল। শুভ ও অশুভের বিশ্বব্যাপ্ত সংঘাতরূপে দেবতা ও অসুরদের সংগ্রামকে স্পষ্টভাবে উপস্থাপিত করার প্রবণতা অবেস্তা গ্ৰছেও পাওয়া যায়-সেখানে আহুরমজদা ও আত্মামৈনুর মধ্যে নিরস্তর প্রতিস্পর্ধিতা পরিস্ফুট হয়েছে। ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলিতে দেবতা ও অসুররা ছিল প্ৰধান ভূমিকায়, লক্ষণীয় যে, উভয়েই প্ৰজাপতির সন্তান। বিশেষভাবে লক্ষণীয় এই যে, অসুরেরা সংখ্যায় অধিক, তাদের তুলনায় দেবতারা বয়ঃকনিষ্ঠ। ঋগ্বেদের মতো দেবতারা তত শক্তিশালী বীর নন, যাদের পরাক্রমের কাছে অসুররা পর্যুদস্ত। অসুর অর্থাৎ প্ৰাগাৰ্যরা পরাজিত হলেও ভারতবর্ষের আদিম অধিবাসীরূপে তারা ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যে বয়োজ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বলে চিত্রিত। তাকে বারংবার অসুরদের কাছে দেবতাদের পরাজয়বরণের কাহিনীর উপস্থাপন ঋগ্বেদের চিত্রের বিরোধী এবং ব্রাহ্মণ-প্রতিফলিত এই নূতনতত্ত্বের প্রকৃত কারণ সম্পর্কে কোনো নিশ্চিন্ত সিদ্ধান্তে আসা যায় না। দেবতাদের মহিমা ক্রমশ খর্ব হওয়ার ফলে অন্য কোনো উপাদান দায়ী, এই সিদ্ধান্ত মাত্র আংশিকভাবেই সত্য, প্রকৃতপক্ষে নূতন আধ্যাত্মিক শক্তির উৎসরূপে বিষ্ণু বা প্ৰজাপতির সঙ্গে একাত্মীভূতরূপে যজ্ঞের উপস্থাপনার ফলেই চিরাগত দেবতারা নিম্প্রভ হয়ে পড়েছিলেন। ঋগ্বেদে বিষ্ণু প্ৰাচীন, গৌণ দেবতা হলেও ব্রাহ্মণ সাহিত্য তার মহিমা এমন সতর্কভাবে গড়ে তোলা হয়েছে যে, শেষ পর্যন্ত তিনি যজ্ঞের সঙ্গে একান্ম হয়ে পড়েছেন।
প্ৰজাপতি যেহেতু যজ্ঞের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়েছিলেন, তাই ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যে তার ভূমিকাকে একটু অন্যভাবে বিচার করা যেতে পারে; প্রায়ই বলা হয়েছে যে, সৃষ্টির পরে প্রজাপতি যখন ক্লান্ত, তখনও কোনো নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেবতারা তাকে নুতনভাবে উজ্জীবিত করে তুলেছিলেন। সুতরাং যজ্ঞ স্বয়ং স্রষ্টা ও রক্ষাকর্তা প্ৰজাপতিরকেও নুতন জীবন দান করতে সমর্থ। তার গৌরব ও তাৎপর্য যেহেতু দ্রুত বেড়ে যাচ্ছিল এবং অন্যান্য দেবতারা সমানুপাতিকভাবে নিজেদের মাহাত্ম্য হারিয়ে ক্রমশ হীনপ্রভ হয়ে পড়ছিলেন, তাই একদিক থেকে সমগ্র দেব্সঙ্ঘে একেশ্বরবাদের দিকে অপ্রতিহত গতিতে অগ্রসর হচ্ছিল। কিন্তু ব্ৰাহ্মণযুগের ধর্ম যেহেতু মূলত যজ্ঞামূলক তাই যেখানে বহুদেবতার উদ্দেশে আহুতি অর্পিত হয়–সচেতনভাবে কোনো একেশ্বরবাদী প্রবণতা ঘনীভূত হয়ে ওঠেনি। যজ্ঞমূলক ধর্মের প্রয়োজনে ধর্মতাত্তিকগণ অসংখ্য দেবকাহিনীতে প্ৰজাপতির ভাবমূর্তিকে এমনভাবে মহিমান্বিত করে তুলেছিলেন যে, অন্যান্য দেবতারা তারই মহিমা ও করুণায় আশ্রিত হয়ে রইলেন। সংহিতা সাহিত্যে যেহেতু এরকম কোনো দেবতার সন্ধান পাওয়া যায় না, অন্তিম পর্যায়ের রচনায় অর্থাৎ ঋগ্বেদের দশম মণ্ডল ও অথর্ববেদে প্রাপ্ত ব্ৰহ্মা, বৃহস্পতি, ব্ৰহ্মণস্পতি, হিরণ্যগৰ্ভ, পুরুষ, আত্মা, স্কম্ভ বা কালের দেবতাকে তাই পুনর্বিন্যস্ত করে একজন সর্বোত্তম পরাৎপর দেবতার ভাবমূর্তি নির্মাণ করা হয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত তিনিই যুগের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় তত্ত্ব অর্থাৎ যজ্ঞের দেবরূপ হয়ে উঠলেন। ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যে প্ৰজাপতি সর্বজ্যেষ্ঠ দেবতাররূপে বর্ষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠেছিলেন—এই বর্ষ কৃষিজীবী সমাজে কালগত একটি সম্পূর্ণ এককের প্রতিনিধি।
সময় সম্পর্কে ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যের ধারণা কতকটা জটিল–এর মধ্যে একধরনের স্ববিরোধিতা রয়েছে, যার প্রাথমিক আভাস সংহিতা সাহিত্যে উষা-সূক্তগুলিতে পাওয়া গিয়েছিল। সেখানে উষা স্বয়ং নিত্যনবীনা অথচ মানুষের জরার সে-ই হেতু, যেহেতু প্রতি প্ৰত্যুষে মানুষের পরমায়ু একদিন করে কমে যায়। ব্রাহ্মণসাহিত্যে প্রজাপতি যে একই সঙ্গে খণ্ডকাল ও অনন্তকালের প্রতিভূ হয়ে উঠেছেন, তাতেই তার সর্বোত্তম মহিমা প্ৰমাণিত। কালের বিভিন্ন মাত্রা সম্পর্কে এই সচেতনতার ফলে জীবন ও মৃত্যু সম্পর্কে নূতন চিন্তাধারার সৃষ্টি হ’ল। স্থায়িভাবে নির্দিষ্ট কৃষিজীবীর মনস্তত্ব স্থায়িত্ববোধের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে সম্পূক্ত। সম্পদ সঞ্চিত হবার সঙ্গে সঙ্গে উত্তরাধিকারীদের জন্য সেই সম্পদ সংরক্ষণ করার একটি নূতন আগ্রহ দেখা গেল। জ্যোতির্বিদ্যা, বিশেষত নক্ষত্রমণ্ডলী সম্পর্কে নূতন উৎসাহ, সেই যুগের একটি বিশিষ্ট চরিত্র লক্ষণ, কারণ তৎকালীন মানুষ নিরবচ্ছিন্নতা ও চিরস্থায়িতা সম্পর্কে আগ্রহী ছিল বলেই নক্ষত্রমণ্ডলী তাদের কাছে স্থায়িত্বের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। এসব অতিজাগতিক উপাদানের বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে নিজের নশ্বরতাকে মানুষ যেন নতুনভাবে উপলব্ধি করল। একদিকে মানুষের জরা এবং মৃত্যু এবং অন্যপ্রান্তে দিন ও রাত্রির আবর্তনের হেতুরূপ সূর্যকে পর্যবেক্ষণ করে তৎকালীন মানুষ সূর্যকে জরা ও মৃত্যুর প্রেরয়িতারূপে গ্ৰহণ করেছিল। বর্ষ হয়ে উঠল। সময়ের প্রথম সসীম ও সম্পূর্ণ একক, একই সঙ্গে আবর্তনশীল ঋতুচক্র ও বর্ষ যেহেতু চিরবহমান কালের দ্যোতক-তার মধ্যে বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের অবিনাশী রূপও আভাসিত হ’ল। এই প্রসঙ্গে মানুষের নিজস্ব মৃত্যুবোধও তীক্ষতির অভিব্যক্তি লাভ করল।