১৬. দিন দুই আর কিরীটী কোথাও বেরই হলো না

দিন দুই আর কিরীটী কোথাও বেরই হলো না। মিত্রানীর হত্যারহস্যটা যেন ক্রমশ জট পাকিয়ে পাকিয়ে জটিল হতে জটিলতর হয়ে উঠছে। সূত্রগুলো কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

ফোন এলে পর্যন্ত কিরীটী ফোন ধরে না। ফোনে কেউ ডাকলেও সাড়া দেয় না।

সারাদিন প্রচণ্ড গরমের পর কিছুক্ষণ আগে হঠাৎ ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে কয়েক ফোঁটা। বৃষ্টি হওয়ায় প্রখর তাপ-দাহ কিছুটা কমেছে।

কৃষ্ণা একটা সোফার ওপরে বসে একটা বই পড়ছে আর কিরীটী সোফার গায়ে হেলান দিয়ে সামনের ছোট টেবিলটার ওপর পা দুটো তুলে দিয়ে চোখ বুজে পড়ে আছে।

বই পড়লেও কৃষার মনটা বইয়ের পাতার মধ্যে ঠিক ছিল না——সে মধ্যে মধ্যে চোখ তুলে স্বামীর দিকে তাকাচ্ছিল।

বুঝতে পারছিল কৃষ, মিত্রানীর মৃত্যুরহস্যের কোন সমাধানে কিরীটী পৌঁছতে পারেনি—তাই তার ঐ নিঃশব্দতা। বাইরের চেহারাটা যতই শান্ত হোক, ভিতরে ভিতরে তার একটা অস্থির আলোড়ন চলেছে।

চা খাবে? কৃষ্ণা স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললে।

চা!

হ্যাঁ, চা করে আনি—

নিয়ে এসো!

কৃষ্ণা একপাশে বইটা রেখে ঘর থেকে বের হয়ে যেতেই একটু পরে সুব্রত এসে ঘরে ঢুকল দরজা ঠেলে।

সুব্রতকে ঘরে ঢুকতে দেখে কিরীটী ওর দিকে তাকাল চোখ তুলে—আচ্ছা সুব্রত।

কি?

মিত্রানী সেদিন অকস্মাৎ আক্রান্ত হবার পর নিশ্চয়ই চিৎকার করে উঠেছিল–

সেটাই তো স্বাভাবিক মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শেষ প্রতিরোধ যেমন মানুষ করে তেমনি শেষ একটা ভয়ার্ত চিৎকারও সে করে ওঠে।

তাহলে—

কি তাহলে?

কাজল বোস নিশ্চয়ই সে চিৎকার শুনেছিল—

কাজল বোস!

হ্যাঁ, সে যে ঠিক সেই মুহূর্তে মিত্রানী ও আক্রান্তকারীর আশেপাশেই ছিল সে ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ—আর তার প্রমাণ হচ্ছে কাজলেরই ভাঙা চুড়ির কয়েকটি টুকরো মৃতদেহের অনতিদূরে, যেগুলো সুশীল নন্দী পরের দিন কুড়িয়ে পেয়েছেন। কাজল বোস আমাদের কাছে সে কথা চেপে গিয়েছে কিন্তু কেন? হোয়াট ইজ হার মোটিভ বিহাইন্ড? কি উদ্দেশ্যে?

হয়ত হত্যার ব্যাপারে জড়িয়ে যাবার ভয়ে সে মুখ খোলেনি—

হতে পারে—তবে এও হতে পারে–সে কাউকে শিল্ড করবার চেষ্টা করছে।

তোমার তাই মনে হয়?

অনুমান—অনুমান মাত্র আমার—

অসম্ভব নয় হয়তো, কিন্তু সে কে। কাকে সে আড়াল করার চেষ্টা করছে–

কাজল বোসের একমাত্র ইন্টারেস্ট সুহাস মিত্র তার প্রেমাস্পদ—কিন্তু ঐখানেই। আমার যোগফলটা মিলছে না সুব্রত

কিন্তু সুহাসই যদি হত্যা করে থাকে মিত্রানীকে—একটা বলিষ্ঠ অ্যাথলেট মানুষ

ঠিক, ঠিক। কিন্তু সে সত্যিই ভালবাসতো মিত্রানীকে। যোগফলটা ঐখানেই বিয়োগফলে দাঁড়াচ্ছে। দুইয়ের সঙ্গে দুই যোগ হয়ে চার হচ্ছে না—দুই থেকে বাদ গিয়ে

শূন্য দাঁড়াচ্ছে। না—ঠিক মিলছে না।

সুব্রত বললে, তবে আর কে হতে পারে?

কেন, বিদ্যুৎ সরকার—

বিদ্যুৎ সরকার–

হ্যাঁ, তুই ভেবে দেখ—বিদ্যুৎ সরকারই সুহাসকে প্রথম আবিষ্কার করেছিল। এবং সুহাস যেখানে গাছের ডাল চাপা পড়েছিল তারই কাছাকাছি মিত্রানীর মৃতদেহটা আবিষ্কৃত হয়—আর বিদ্যুৎই সেটা দেখতে পায় প্রথম। একমাত্র ঐ বিদ্যুৎ সরকারেরই যোগাযোগ ছিল মিত্রানীর সঙ্গে–

কিন্তু তাকে তো তুই প্রথম থেকেই বাদ দিয়েছিস—

কিরীটী বললে, দিয়েছি ঠিকই কিন্তু যুক্তিরও সেটাই শেষ কথা নয়—হতেও পারে না তা।

কৃষ্ণা ঐ সময় দুকাপ চা নিয়ে এসে ঘরে ঢুকল। সুব্রতর দিকে তাকিয়ে বললে, কখন এলে?

এই–

কিরীটী ও সুব্রতর দিকে দুকাপ চা এগিয়ে দিল কৃষ্ণা।

তুমি খাবে না? সুব্রত শুধায় ওর মুখের দিকে তাকিয়ে।

তোমার জুতোর শব্দ আমি পেয়েছিলাম, কৃষ্ণা হাসতে হাসতে বললে, আর এক কাপ তৈরী করেছি, তোমরা শুরু কর, আমারটা আমি নিয়ে আসছি—

কিছুক্ষণ পরে, তখনো চায়ের কাপ কারো নিঃশেষ হয়নি–

সুব্রত এক সময় বললে, তোর কথায় মনে হচ্ছে কিরীটী, সুহাস মিত্র আর কাজল বোস মিত্রানীর হত্যারহস্যের মধ্যে বেশ জটিলভাবে জড়িয়ে আছে—যেহেতু ওরা দুর্ঘটনাটা যখন ঘটে তখন খুবই কাছাকাছি ছিল—

শুধু তাই নয় সুব্রত।

তবে—

সুহাসকে মিত্রানী যেমন ভালবাসত, সুহাসও তেমনি ভালবাসত মিত্রানীকে। সেদিক থেকে একমাত্র সুহাসের প্রতি কিছুটা যে সন্দেহ জাগে না তা নয় কিন্তু মজা হচ্ছে কেউ কাউকে সে কথাটা ঘুণাক্ষরেও জানতে দেয়নি কিন্তু কেন? পরস্পরকে পরস্পরের ভালবাসা জানাবার সত্যিই কি কোথায়ও বাধা ছিল?

কৃষ্ণা বললে, হয়ত কোন তৃতীয় ব্যক্তি সজল চক্রবর্তীর মত মিত্রানীর দিক থেকে যেমন ছিল—সুহাসের দিক থেকেও তেমনি ছিল—

কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে কিরীটী কৃষ্ণার মুখের দিকে তাকাল, আশ্চর্য কৃষ্ণা, ঐ। কথাটা তো একবারও আমার মনে হয়নি—ঠিক—তৃতীয় ব্যক্তি—তৃতীয় ব্যক্তি…

সুব্রত বললে, মিত্রানীর ব্যাপারে না হয় সজল চক্রবর্তী ছিল কিন্তু সুহাসের বেলায় : কে ছিল তবে?

কৃষ্ণা শান্ত গলায় বললে, তোমার ঐ প্রশ্নের জবাব একমাত্র একজনই দিতে বোধ হয় পারে

কিরীটী মৃদুকণ্ঠে বললে, তুমি বোধ হয় সুহাসের কথা বলছে কৃষ্ণা!

হ্যাঁ—

জংলী এসে ঐ সময় ঘরে ঢুকল।

বাবু—

জংলীর দিকে তাকিয়ে কৃষ্ণা বললে, কে এসেছে?

সুহাসবাবু বলে এক ভদ্রলোক।

কৃষ্ণা হেসে কিরীটীর দিকে তাকিয়ে বললে, যাক-দেখো মেঘ না চাইতেই জল স্বয়ং এসে হাজির একেবারে তোমার দরজায়।

কিরীটী মৃদু হেসে বললে, এখন জলটা ভালো ভাবে বর্ষিত হলেই হয়। এই জংলী যা, বাবুকে এই ঘরে নিয়ে আয়—

কৃষ্ণা উঠে দাঁড়াল-সুব্রত, রাত্রে এখানে তুমি খেয়ে যাবে কিন্তু—

ঠিক আছে। সুব্রত জবাব দেয়।

কৃষ্ণা ঘর থেকে বের হয়ে যাবার একটু পরেই সুহাস মিত্র এসে কিরীটীর ঘরে ঢুকল।

আসুন সুহাসবাবু—একটু আগে আপনার কথাই ভাবছিলাম।

সুহাস মিত্র বসতে বসতে বললে, জানি কেন ভাবছিলেন।

জানেন? কথাটা বলে কিরীটী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সুহাস মিত্রের মুখের দিকে তাকাল!

হ্যাঁ—আমি সেদিন আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর বাড়িতে ফেরা অবধি একটি কথাই ভেবেছি—আপনার কাছে তো অজ্ঞাত কিছুই থাকবে না কিরীটীবাবু, পেটের কথা আপনি ঠিকই বের করবেন, তার চাইতে যা সেদিন বলতে পারিনি—ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হোক, সেটা আপনার কাছে প্রকাশ করে দেওয়াই ভাল। কিন্তু তাহলেও বলবো। কিরীটীবাবু, সত্যি কথা বলতে কি ব্যাপারটা এখনো আমার কাছে যেন খুব একটা তেমন স্পষ্ট নয়—হয়ত সেই ঝড়ের শব্দের মধ্যে ভুল শুনেছি—

আমার অনুমান আপনি সেদিন কিছু শুনে থাকলে ভুল শোনেননি ঠিকই শুনেছেন, বলুন এবারে ব্যাপারটা কি!

সুহাস মিত্র বলতে লাগল,ঝড় আর ধুলোর ঘূর্ণির অন্ধকারের মধ্যে প্রথমটা আচমকা এমন দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম যে, কোথায় কোন্ দিকে এগোচ্ছি বুঝতেই পারছিলাম না—তাছাড়া ঐ সময় আমার চোখ থেকে চশমাটা হঠাৎ হুমড়ি খেয়ে পড়ায় কোথায় ছিটকে পড়ে গিয়েছিল।

হুঁ, সেদিন আপনার সঙ্গে কথা বলার সময় আপনার চোখে চশমা দেখে সত্যিই একটু খটকা লেগেছিল এবং আপনার চশমার লেন্সের দিকে তাকিয়েই বুঝেছিলাম একটু যেন বেশীই মাইনাস পাওয়ারের চশমা আপনার—অথচ সুশীল নন্দীর রিপোর্টে আপনার চশমার কথা কিছুই ছিল না। ভেবেছিলাম হয়তো সেটা সুশীল নন্দীর আপনার বর্ণনায় একটা সাধারণ অমিশন মাত্র।

না—চশমা ছাড়াই আমি থানায় গিয়েছিলাম—যদিও দূরের সব কিছু দেখতে বেশ অসুবিধা হচ্ছিল।

চোখ কি আপনার অনেক দিন থেকেই খারাপ?

হ্যাঁ—ছোটবেলার একটা ইনজুরির জন্য বাঁ চোখের দৃষ্টিটা বরাবরই কিছুটা খারাপ ছিল—ডান চোখেও হায়ার সেকেন্ডারি দেবার আগে থাকতেই চোখের এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে দৃষ্টিশক্তির বিপর্যয় শুরু হয়—মানে দু চোখের দৃষ্টিই ক্ষীণ হয়ে আসে।

কি রোগ?

গ্র্যাজুয়াল অপটিক নার্ভ অ্যাট্রোফি—ডান চোখের দৃষ্টিবাহী স্নায়ু আমার ক্রমশ শুকিয়ে আসছে, সঙ্গে সঙ্গে বাঁ চোখটাও আরও দুর্বল হয়ে আসছে—অনেকেই জানত না সে কথাটা—বি. এ.-তে ভাল রেজাল্ট করা সত্ত্বেও যে আমি আই. এ. এস. দিই না এটাই ছিল তার মুখ্য কারণ, মেডিকেল ফিটনেস সার্টিফিকেট আমি পেতাম না। অবিশ্যি বন্ধুবান্ধবরা ধরে নিয়েছিল আমার আত্মবিশ্বাসের অভাব-ভীরুতা——কেউ বলেছে এসকেপিস্ট মেন্টালিটি—কাউকেই মুখ ফুটে আমি তবু বলতে পারিনি—আমার জীবনটাই ড়ুমড়—একদিন একটু একটু করে দুচোখের দৃষ্টির উপরে চিরঅন্ধকার নেমে আসবে—অন্ধকার—ছেদহীন অন্ধকার।

সুহাস মিত্রর গলাটা যেন শেষের দিকে রুদ্ধ হয়ে এলো।

সুহাস মিত্র একটু যেন থেমে বলতে লাগল আবার,ভগবানই যে আমার জীবনের অগ্রগতির পথে কাঁটা দিয়ে সব শেষ করে দিয়েছেন

আর কাউকে না বলেছিলেন না বলেছিলেন সুহাসবাবু, মিত্রানীকে কেন বললেন না কথাটা, কিরীটী শান্ত গলায় বললে।

কি হতো বলে কথাটা তাকে কিরীটীবাবু, কেবল দুঃখই দেওয়া হতো তাকে—মিত্রানী যে কি গভীর ভালবাসত আমায় আমি কি তা জানতাম না কিরীটীবাবু, জানতাম, আর জানতাম বলেই কখনো তার ডাকে সাড়া দিইনি ভেবেছি আমার নীরবতায় যদি ক্রমশ একটু একটু করে মনটা তার অন্যদিকে ঘুরে যায়—তাই যাক।

সুহাসবাবু, সত্যিকারের ভালবাসা কি অত সহজে ভিন্নমুখী হয়? হয় না—

আগে সে কথাটা একবারও মনে হয়নি—কিন্তু মিত্রানীর মৃত্যুর পর কেবলই কি মনে হচ্ছে জানেন?

কি?

সেদিন আমাকেই হয়ত যদি সে ধুলোর ঘূর্ণি ও ঝড়ের মধ্যে অন্ধকারে খুঁজতে খুঁজতে পাগলের মত না হয়ে উঠতো তবে হয়ত অমন করে আমার কাছে থেকেই মৃত্যুকে বরণ করতে হতো না—আমার সবচাইতে বড় দুঃখ কি জানেন কিরীটীবাবু, সে জানতেও পারেনি ঐ মুহূর্তে তার অত কাছে থেকেও চশমা হারিয়ে আমি একপ্রকার ব্লাইন্ড–অন্ধ—আমি নিরুপায়—

উত্তেজিত কণ্ঠে কিরীটী প্রশ্ন করে, তা হলে আপনি কারো গলা বা চিৎকার শুনেছিলেন!

শুনেছিলাম—

কার—কার গলা শুনেছিলেন-চিনতে পেরেছিলেন সে কার গলা?

হ্যাঁ—

কার গলা?

মিত্রানীর গলা—

কি? কি বলেছিল সে?

কে? কে—আঃ ছাড়ো-সুহাস-সুহাস—তারপরই গোঁ গোঁ অস্পষ্ট একটা চাপা শব্দ–কিছু দেখতে পাচ্ছি না তখন তবু মরীয়া হয়ে সামনে এগুবার চেষ্টা করে দুপাও এগোয়নি—একটা গাছের ডাল এসে মাথায় হঠাৎ হুড়মুড় করে পড়ল, আমি জ্ঞান হারালাম।

আর কারো গলা আপনি শোনেননি সুহাসবাবু? কিরীটী আবার শুধাল।