[মান্দ্রাজে অবস্থানকালে স্বামীজী ‘চেন্নাপুরী অন্নদান-সমাজম্’ নামক এক দাতব্য ভাণ্ডারের সাংবৎসরিক অধিবেশনে সভাপতি হন। বিশেষভাবে ব্রাহ্মণজাতিকে ভিক্ষাদান-প্রথা ঠিক নহে—পূর্ববর্তী বক্তা এই মর্মে বলিলে স্বামীজী বলেনঃ]
এই প্রথার ভাল-মন্দ দুই দিকই আছে। ব্রাহ্মণগণই হিন্দুজাতির সমুদয় জ্ঞান ও চিন্তা-সম্পত্তির রক্ষক। যদি তাঁহাদিগকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলিয়া অন্নের সংস্থান করিতে হয়, তবে তাঁহাদিগের জ্ঞানচর্চার বিশেষ ব্যাঘাত হইবে ও সমগ্র হিন্দুজাতি তাহাতে ক্ষতিগ্রস্ত হইবে।
ভারতের অবিচারিত দান ও অন্যান্য জাতির বিধিবদ্ধ দান-প্রথার তুলনা করিয়া স্বামীজী বলিলেনঃ ভারতের দরিদ্র মুষ্টিভিক্ষা লইয়া সন্তোষ ও শান্তিতে জীবনযাপন করে, পাশ্চাত্যদেশের আইন দরিদ্রকে ‘গরীবখানায়’ (poorhouse) যাইতে বাধ্য করে; মানুষ কিন্তু খাদ্য অপেক্ষা স্বাধীনতা ভালবাসে, সুতরাং সে গরীবখানায় না গিয়া সমাজের শত্রু—চোর ডাকাত হইয়া দাঁড়ায়। ইহাদিগকে শাসনে রাখিবার জন্য আবার অতিরিক্ত পুলিস ও জেল প্রভৃতির বন্দোবস্ত করিতে সমাজকে অতিশয় বেগ পাইতে হয়। ‘সভ্যতা’ নামে পরিচিত ব্যাধি যতদিন সমাজ-শরীর অধিকার করিয়া থাকিবে, ততদিন দারিদ্র্য থাকিবেই, সুতরাং দরিদ্রকে সাহায্যদানেরও আবশ্যকতা থাকিবে। এখন হয় ভারতের মত নির্বিচারে দান করিতে হইবে, যাহার ফলে অন্ততঃ সন্ন্যাসিগণকে—তাঁহারা সকলে অকপট না হইলেও—আহার সংগ্রহ করিবার জন্য শাস্ত্রের দু-চারটি কথাও শিক্ষা করিতে বাধ্য করিয়াছে; অথবা পাশ্চাত্যজাতির মত বিধিবদ্ধভাবে দান করিতে হইবে, যাহার ফলে অতি ব্যয়সাধ্য দারিদ্র্য-দুঃখ-নিবারণ-প্রথার উৎপত্তি হইয়াছে এবং যে-আইন ভিক্ষুককে চোর-ডাকাতে পরিণত করিয়াছে। এই দুইটি ছাড়া পথ নাই। এখন কোন্ পথ অবলম্বনীয়, একটু ভাবিলেই বুঝা যাইবে।
মান্দ্রাজ হইতে স্বামীজী স্টীমারে কলিকাতা রওনা হন। খিদিরপুর হইতে স্পেশ্যাল ট্রেনে অতি প্রত্যূষে শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছিলেন। প্রায় বিশ সহস্র লোক ‘জয় ভগবান্ শ্রীরামকৃষ্ণকী জয়’ ‘স্বামী বিবেকানন্দকী জয়’ ধ্বনিতে স্বামীজীকে সংবর্ধনা করেন। যুবকগণ স্বামীজীর গাড়ির ঘোড়া খুলিয়া দিয়া নিজেরাই লইয়া যায়। পথে রিপন কলেজে অল্পক্ষণ থাকিয়া স্বামীজী বাগবাজারে রায় পশুপতিনাথ বসু বাহাদুরের ভবনে গুরুভ্রাতাদের সহিত মিলিত হন এবং আলমবাজার মঠে অবস্থান করেন। এক সপ্তাহ পরে কলিকাতায় বিরাট অভিনন্দন-সভা আহূত হয়; শ্রোতৃ-সংখ্যা ছিল প্রায় পাঁচ হাজার।