জো কোনো কথা বলেনি। প্রবল হাতে সে ভীষণ আঁকুনি দিলে কেনেডিকে। এক হাতে বন্দুকের ট্রিগার চেপে অন্য হাতে জো-কে বাধা দেয়ার চেষ্টা করলেন কেনেডি। আর এই প্রচণ্ড টানা-হেঁচড়ার মধ্যে গুলিটা সশব্দে শূন্যের দিকে বেরিয়ে গেলো। শুন্যে মরুভূমির বুকে কোনো প্রতিধ্বনি না-তুলেই বাজ ফাটার আওয়াজ করে শব্দটা মুহূর্তে মিলিয়ে গেলো, কিন্তু সেই আওয়াজেই ফার্গুসনের সংবিৎ ফিরে এলো হঠাৎ। দাঁড়িয়ে উঠে তিনি দু-হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠলেন : ঐ-যে! ঐ-যে! ঐ দ্যাখো!
আচমকা এই চীৎকার শুনে জো আর কেনেডি ধস্তাধস্তি থামিয়ে দিয়ে দিগন্তের দিকে ফিরে তাকালেন। আকাশ-বাতাস আচ্ছন্ন করে প্রবল এক ঝড় এগিয়ে আসছে। ভীষণবেগে-পাহাড়-উঁচু হয়ে এগিয়ে আসছে মস্ত এক বালির স্তম্ভ, যেন হঠাৎ নিস্তরঙ্গ কোনো সমুদ্রের সব জলরাশি ফুলে-ফেঁপে ফুশে উঠে এগিয়ে আসছে পাহাড়ের দিকে।
ফার্গুসন সোল্লাসে চেঁচিয়ে উঠলেন, সাইমুম!
সাইমুম! অর্থ না-বুঝেই বিড়বিড় করে কথাটার পুনরাবৃত্তি করলে জো।
ভালোই হলো! অসহায় ক্ষোভে ভরে গেলেন কেনেডি, মৃত্যুর হাত থেকে আর ত্রাণ নেই! ভালোই তো-আত্মহত্যার চেষ্টা করতে হবে না আর।
সাইমুম একধরনের লু—আরব মরুভূমির যে উত্তপ্ত শুষ্ক ধূলিময় ঝোড়ো বাতাস শ্বাস রোধ করে উদ্দাম বয়ে যায়, তাকেই এই নামে ডাকা হয়। তার ভীষণতা স্বচক্ষে না-দেখলে বোঝা যায় না। কাজেই কেনেডির ক্ষোভ অসংগত নয়। কিন্তু ফাণ্ডসন অন্য কথা বললেন, না, ডিক, আর আমাদের ভয় নেই, এবারকার মতো আমরা বোধহয় বেঁচে গিয়েছি। এই বলে তিনি দ্রুত হাতে দোলনা থেকে বালি সরিয়ে দিতে লাগলেন। দেখাদেখি কেনেডি আর জো-ও তা-ই করলে, তারপর তিনজনে দোলনায় উঠে বসলেন ঝড় তখন কাছে এগিয়ে এসেছে। উঠে বসতে-না বসতেই ঝোড়ো হাওয়ায় তৎক্ষণাৎ আকাশের দিকে উঠে গেলো বেলুন, আর প্রচণ্ড সেই সাইমুম তার প্রবল ধাক্কায় তীরবেগে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে চললো।
ঝড় থামলো বেলা তিনটেয়। যেমন আচমকা সে এসেছিলো, তেমনি অকস্মাৎ সে চলে গেলো, যাবার আগে স্মৃতিচিহ্ন হিশেবে নিচে রেখে গেলো মস্ত এক বালির পাহাড়। আকাশ আবার পরিষ্কার হয়ে গেছে, আবার নিশ্চল হয়ে আকাশে থরথর করে কাপছে ভিক্টরিয়া। আর, সেই মুহূর্তে, অদূরে দেখা গেলো মস্ত একঝাড় খেজুর গাছ, মনোরম এক মরূদ্যান রচনা করে তারা দাঁড়িয়ে আছে।
জল! জল! এ-যে নিচে জল! চেঁচিয়ে বলে উঠলেন ফার্গুসন। বেলুনের ভালভ খুলে দিতে হু-হু করে সব গ্যাস বেরিয়ে গেলো, দ্রুত নিচে নেমে এলো ভিক্টরিয়া। এই চার ঘণ্টায় ঝড় তাদের আড়াইশো মাইল তাড়িয়ে নিয়ে এসেছে।
সাবধান কিন্তু! সঙ্গে বন্দুক নিয়ে যেয়ো। ফার্গুসন হুঁশিয়ারি শোনালেন।
কেনেডি আর জো চট করে লাফিয়ে নিচে নামলেন, ছুটে গেলেন কুয়োর কাছে। ধাপ বেয়ে-বেয়ে নিচে নেমে আকণ্ঠ জল পান করতে লাগলেন। আঃ, কী আরাম। স্নিগ্ধ একটি সুষমায় দু-জনের সারা শরীর ভরে গেলো। ঈশ্বর করুণাময়, শেষ পর্যন্ত তিনিই তাদের পিপাসাকাতর নিষ্ঠুর মৃত্যু থেকে বাঁচালেন।
আঁজলার পর আঁজলা জল পান করতে লাগলেন কেনেডি, পাগলের মতো।
জো বারণ করলে : একসঙ্গে অত জল খাবেন না, খারাপ হবে। তাছাড়া তাড়াতাড়ি করুন-মিস্টার ফার্গুসনের জন্যেও তো জল নিয়ে যেতে হবে।
বন্ধুর নাম শুনে কেনেডির সংবিৎ ফিরে এলো। বোতল ভর্তি করে জল নিয়ে ফিরতে যাবেন, এমন সময় কুয়োর মুখটায় হঠাৎ সূর্যালোক আড়াল করে দিলো যেন কে।
এ-কী! আমরা যে আটকা পড়ে গেলাম।
কী সর্বনাশ! সিংহ দেখছি! চীৎকার করে উঠলো জো।
সিংহ নয়, সিংহী, কেনেডি বললেন, দাঁড়াও মজা দেখাচ্ছি। মুহূর্তে লক্ষ্য স্থির করে তিনি বন্দুকের ট্রিগারে চাপ দিলেন। ভীষণ আওয়াজে কুয়োর ভেতরটা ভরে গিয়ে তাদের বধির করে দিলে, আর তারপরেই, কানে তালা লাগিয়ে বিকট আর্তনাদ করে সিংহটা গড়িয়ে কুয়োয় পড়ে গেলো। আর তারই প্রচণ্ড হ্যাচকা আঘাতে টাল সামলাতে না-পেরে হুড়মুড় করে পড়ে গেলো জো। ঠিক এমন সময় অতর্কিত আবার একটি গুলির শব্দ শোনা গেলো। দেখা গেলো, ফার্গুসন এসে দাঁড়িয়েছেন ওপরে, তখনও তার বন্দুক থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে।
কেনেডি তাড়াতাড়ি উঠে এসে ফার্গুসনকে জলের বোতল দিলেন। কোনো কথা–বলে তৎক্ষণাৎ ফার্গুসন সব জল ঢকঢক করে গলায় ঢেলে দিলেন।