জরাসন্ধবধার্থ কৃষ্ণের অনুমোদন
কৃষ্ণ কহিলেন, “ভারতবংশে জাত ও কুন্তীর গর্ভে সম্ভূত ব্যক্তির যেরূপ বুদ্ধি হওয়া উচিত, মহানুভব অর্জ্জুনে তাহা সুস্পষ্ট লক্ষিত হইতেছে। যখন মৃত্যু দিবাভাগে কি রজনীযোগে হইবে, তাহার স্থির নাই এবং কোন ব্যক্তি যুদ্ধ না করাতে অমর হইয়াছে, ইহাও কখন শুনি নাই; অতএব বিধানানুসারে নীতিপূর্ব্বক শত্রুপক্ষ আক্রমণ করিয়া পরিতোষ লাভ করাই পুরুষের কাৰ্য্য। যে ব্যক্তি নয়শালী ও অপায়রহিত, শত্রুকে আক্রমণ করা তাহার কর্তব্য; যুদ্ধে একের উৎকর্ষ ও অন্যের অপকৰ্ষ অবশ্যই হয়, দুই জনের সাম্য কদাচ হয় না। আর যে ব্যক্তি নয়হীন ও উপায়বিহীন, সংগ্রামে অবশ্যই তাহার ক্ষয় হয়। কিন্তু উভয় পক্ষ সমপরাক্রমশালী হইলে কাহারও জয়লাভের সম্ভাবনা নাই। অতএব আমরা নীতিমাগানুসারে স্বীয় রন্ধ আবরণপূর্ব্বক শক্রকে রন্ধে আক্রমণ করিলে কি নিমিত্ত জয়লাভে কৃতকাৰ্য্য না হইব? বুদ্ধিমান নীতিজ্ঞেরা কহেন যে, যে শত্ৰু বহু সৈন্যের অধীশ্বর এবং বলবান্ তাহার সহিত যুদ্ধ করা অনুচিত, ইহা আমার অভিপ্রেত। আমরা গোপনে শত্রুগৃহে প্রবেশপূর্ব্বক তাহাকে আক্রমণ করিয়া আপনাদের কাৰ্য্য সাধন করিব। দুরাত্মা জরাসন্ধ সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হইয়া একাকী রাজলক্ষ্মী ভোগ করিতেছে; আমি তাহাকে নিধন করিতে লক্ষ্য করিয়াছি। যদিও আমরা সেই দুরাত্মাকে যুদ্ধে সংহার করিয়া তাহার অন্যান্য স্বপক্ষগণ কর্তৃক নিহত হই, তাহা হইলেও তৎকর্তৃক কারাগারে অবরুদ্ধ জ্ঞাতিগণের পরিত্রাণনিবন্ধন স্বৰ্গলাভ করিতে পারিব।”
যুধিষ্ঠিরের জরাসন্ধ জন্মপ্রশ্ন
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে কৃষ্ণ! জরাসন্ধ কে? তাহার বীৰ্য্য ও পরাক্রম কি প্রকার? যে দুরাত্মা তোমার অনিষ্টাচরণ করিয়াও প্ৰজ্বলিত হুতাশনস্পশী পতঙ্গের ন্যায় বিনষ্ট হয় নাই?”
শ্ৰীকৃষ্ণ কহিলেন, “হে রাজন! জরাসন্ধের যেরূপ বীৰ্য্য ও পরাক্রম এবং যে নিমিত্ত সে অনেকবার আমার বিপ্ৰিয়াচরণ করিলেও তাঁহাকে উপেক্ষা করিয়াছি, তৎসমুদয় শ্রবণ কর। পূর্ব্বে তিন অক্ষৌহিণীর অধীশ্বর, সমরদর্পিত, রূপবান, ধনসম্পন্ন, অতুলবলবিক্রমশালী, নিত্যদীক্ষিত, পুরন্দরসদৃশ, বৃহদ্রথনামা ভূপতি মগধদেশে আধিপত্য করিতেন। ঐ ভূপাল তেজে সূৰ্য্যের ন্যায়, ক্ষমায় পৃথিবীর ন্যায়, ক্ৰোধে কালান্তক যমের ন্যায় ও ঐশ্বৰ্য্যে কুবেরের ন্যায় ছিলেন। তাঁহার গুণগ্রাম সূৰ্য্যকিরণের ন্যায় মহীমণ্ডলে ব্যাপ্ত হইয়াছিল। ঐ মহাবল-পরাক্রান্ত ভূপতি কাশীরাজের দুই পরম রূপবতী যমজ কন্যার পাণিগ্রহণ করেন। রাজা ‘আমি তোমাদের উভয়ের প্রতি সমান অনুরক্ত থাকিব
বলিয়া সেই পত্নীদ্বয়ের নিকট গমন করিলেন। ভূপতি সেই আত্মানুরূপ প্ৰণয়িণীদ্বয়ের মধ্যবর্তী হইয়া করেণুদ্বয়-মধ্যবর্তী কবিরাজের ন্যায় এবং গঙ্গা ও যমুনার মধ্যবর্তী মূর্তিমান সাগরের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন; তিনি বিষয়ারসে নিমগ্ন হইয়া যৌবনকাল অতিবাহিত করিলেন; কিন্তু বংশকীর পুত্রের মুখাবলোকন করিতে পারিলেন না; পুত্ৰকামনায় হোম, যজ্ঞ প্রভৃতি বহুবিধ মঙ্গলকর্মের অনুষ্ঠান করিলেন, কিন্তু কিছুতেই পুত্ৰলাভ হইল না।
জরাসন্ধ জন্মবৃত্তান্ত
তিনি একদা শ্রবণ করিলেন, মহাত্মা কাক্ষীবান গৌতমের পুত্ৰ উদারস্বরূপ ভগবান চণ্ডকৌশিক তপস্যায় পরিশ্রান্ত হইয়া যদৃচ্ছাক্রমে আগমন করিয়া এক বৃক্ষমূলে অবস্থিতি করিতেছেন। তখন রাজা পত্নীদ্বয়সমভিব্যাহারে তাহার সমীপে সমুপস্থিত হইয়া বিবিধ রত্নপ্রদান দ্বারা তাহাকে পরিতুষ্ট করিলেন। সত্যধৃতি সত্যবাক ঋষিসত্তম চণ্ডকৌশিক ভক্তিভাবে বশীভূত হইয়া কহিলেন, “হে রাজেন্দ্র! আমি তোমার আস্থাদর্শনে পরম পরিতুষ্ট হইয়াছি, এক্ষণে বর প্রার্থনা কর।” তখন মহারাজ বৃহদ্ৰথ ভাৰ্য্যাদ্ধয়সমভিব্যাহারে মহর্ষিকে প্ৰণাম করিয়া বাষ্পাকুললোচনে গদগদ বচনে কহিলেন, “হে মহাত্মন! আমি নিঃসন্তান, নিতান্ত হতভাগ্য, রাজ্য পরিত্যাগপূর্ব্বক তপোবনে আগমন করিয়াছি। এখন আর আমার বির লইবার আবশ্যকতা কি?”
মহর্ষি, রাজা বৃহদ্রথের সেইরূপ কাতরোক্তি শ্রবণে অনুকম্পাপরবশ হইয়া সেই আম্রতলে উপবেশনপূর্ব্বক ধ্যান করিতে লাগিলেন। ঐ সময়ে অক্ষত এক সরস আম্রফল বৃক্ষ হইতে অকস্মাৎ তাহার ক্রোড়দেশে পতিত হইল। মহর্ষি পুত্রোৎপত্তির নিমিত্তভূত সেই পরামরমণীয় আম্রফলটি গ্রহণপূর্ব্বক কিয়ৎক্ষণ মনে মনে বিবেচনা করিয়া রাজাকে প্রদান করিলেন এবং কহিলেন, “মহারাজ! তুমি স্বভবনে গমন কর, তোমার মনোরথ পূর্ণ হইয়াছে; অচিরাৎ পুত্ৰমুখ অবলোকন করিবে।”
রাজা বৃহদ্ৰথ মহর্ষির বাক্যশ্রবণানন্তর তাহার পদবন্দনপূর্ব্বক পত্নীদ্বয় সমভিব্যাহারে স্বভবনে গমন করিলেন এবং শুভক্ষণে সেই আম্রফলটি দুই সহধর্মিণীকে ভোজন করিতে দিলেন। তাঁহারা সেই ফলটি দুই খণ্ডে বিভক্ত করিয়া পরস্পর এক এক খণ্ড ভক্ষণ করিলেন। ফল ভক্ষণানন্তর কাৰ্য্যের অবশ্যম্ভাবিতা ও মহর্ষির সত্যবাদিতার প্রভাবে তাহারা উভয়েই গর্ভবতী হইলেন। নৃপতি তদর্শনে যৎপরোনাস্তি পরিতুষ্ট হইলেন।
অনন্তর যথাকলে প্রসবসময় উপস্থিত হইলে মহিষীদ্বয় উভয়ে একচক্ষু, একবাহু, একচরণ, অৰ্দ্ধোদর, অৰ্দ্ধমুখ ও অৰ্দ্ধস্ফিচ্ [নিতম্ব-পাছা] বিশিষ্ট এক এক দেহাৰ্দ্ধমাত্র প্রসব করিলেন। রাজপত্নীরা সেই সজীব অৰ্দ্ধকলেবরদ্বয় দর্শনে ভয়ে কম্পিত্যকলেবর ও যৎপরোনাস্তি উদ্বিগ্ন হইয়া পরস্পর মন্ত্রণা করিয়া ধাত্রীদিগকে উহা পরিত্যাগ করিতে আদেশ করিলেন। ধাত্রীরা তাহদের নির্দেশানুসারে সেই সদ্যঃপ্রসূত অৰ্দ্ধকলেবরদ্বয় সুসংবৃত করিয়া অন্তঃপুর হইতে বহিৰ্গমনপূর্ব্বক এক চতুষ্পথে নিক্ষেপ করিয়া আসিল ।
অনন্তর মাংসশোণিতলোলুপ জরা-নাম্নী এক রাক্ষসী সেই অৰ্দ্ধকলেবরদ্বয় গ্রহণ করিল। ভবিতব্যতার কি অনির্ব্বচনীয় মহিমা! রাক্ষসী ঐ দুই দেহাৰ্দ্ধ সুবাহ্য [অনায়াসে বহিবার যোগ্য] করিবার নিমিত্ত যেমন সংযোজিত করিল, অমনি উহা একত্র হইয়া এক মহাবল পরাক্রান্ত কুমার হইল। নিশাচরী তদ্দর্শনে সাতিশয় বিস্ময়াপন্ন এবং সেই বজ্রতুল্য দৃঢ়কলেবর শিশুকে বহন করিতে অসমর্থ হইল। বালক বদনে তাম্রবর্ণ মুষ্টি [শৈশবোচিত মুখে অঙ্গুলী প্ৰদান—অঙ্গুলী চোষণ] প্রদানপূর্ব্বক সজল-জলধরের ন্যায় গভীরস্বরে ক্ৰন্দন করিতে লাগিল।
অন্তঃপুরবাসিগণ সেই আকস্মিক গভীর ক্ৰন্দনধ্বনি শ্রবণ করিয়া আস্তে-ব্যস্তে রাজার সহিত বহির্গত হইল। দুগ্ধপূর্ণ স্তনভারাবনতা পরিম্লানবদনা সেই দুই রাজমহিষীও পুত্ৰলোভে হতাশ হইয়া সহসা তথায় গমন করিলেন। রাক্ষসী রাজ্ঞীদ্বয়কে তদবস্থাপন্ন, রাজাকে পুত্ৰাভিলাষী ও বালককে সাতিশয় বলবান দেখিয়া চিন্তা করিল, আমি এই রাজার অধিকারে বাস করি; রাজা একান্ত সন্তানাভিলাষী, ইনি পরম ধার্মিক ও মহাত্মা, অতএব ইহার এই শিশু সন্তানটি বিনষ্ট করা নিতান্ত অনুচিত। মনে মনে এই প্রকার চিন্তা করিয়া মনুষ্য-কলেবর ধারণপূর্ব্বক সেই শিশুকে লইয়া রাজার সমীপে গমন করিয়া কহিল, “হে বৃহদ্রাথ! এই বালকটি তোমার পুত্র; আমি ইহাকে তোমায় প্রদান করিলাম, গ্রহণ করা। এ ব্রাহ্মণের বরপ্রভাবে তোমার পত্নীদ্বয়ের গর্ভে জন্মিয়াছে। ধাত্রীরা ইহাকে পরিত্যাগ করিয়া আসিয়াছিল। আমি ইহাকে রক্ষা করিয়াছি।” তখন রাজমহিষীদ্বয় আনন্দিতচিত্তে বালককে গ্ৰহণ করিয়া স্তনদুগ্ধ দ্বারা অভিষিক্ত করিলেন। রাজা পুত্রলাভে পরম পরিতুষ্ট হইয়া সেই সর্ব্বাঙ্গসুন্দরী মানুষীবেশধারিণী রাক্ষসীকে জিজ্ঞাসিলেন, “হে শুভে! তুমি আমাকে পুত্ৰ প্ৰদান করিলে, এক্ষণে পরিচয় প্রদান কর, তুমি কে? আমি তোমাকে দেবতার ন্যায় বোধ করিতেছি।”