১৬. জটিল অপারেশন

১৬.

দারুণ সাফল্যমণ্ডিত হল জটিল অপারেশন।

আমি কিন্তু অপারেশনের বিপক্ষে ছিলাম। অন্য কারুর উপর হলে কোনও আপত্তি ছিল না দুরূহ এক্সপেরিমেন্টে, কিন্তু আপনি একমেবাদ্বিতীয়ম, পজিট্রনিক ব্রেনের কোনও ক্ষতি হলে কেউ ক্ষমা করবে না আমাকে, নিজের কাছে অপরাধী হয়ে পড়তাম। অবশ্য এখনও কিছু গরমিল আছে পজিট্রনিক ব্রেন এবং নকল স্নায়ুতন্ত্রের গতিপথের মধ্যে, তবে কালক্রমে দূর হয়ে যাবে গরমিল, একে অন্যের পরিপূরক হয়ে উঠবে। তবে হ্যাঁ, দেহে কোনও মারাত্মক ব্যাধি হলে ব্রেনের ক্ষতি হতে পারে কিন্তু!

সে যখন হবে তখন দেখা যাবে, তবে প্রথম থেকেই আপনাদের উপর অখণ্ড বিশ্বাস ছিল, পারলে আপনারাই পারবেন, এককথায় অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন, বিশ্বাস করুন কৃতজ্ঞতা জানাবার কোনও ভাষা নেই আমার ডক্টর, এবার যাবার অনুমতি দিন, অনেক দিন হয়ে গেল বাড়িছাড়া আছি।

হ্যাঁ হ্যাঁ, বাড়ি যাবেন বইকী, এখন তো সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছেন, তবে হ্যাঁ, দশ আউন্স করে অলিভ অয়েল খাবেন পাঁচ দিন, নতুন অবস্থায় কম্বাশন চেম্বার পরিষ্কার রাখা বিশেষ প্রয়োজন, বাদবাকি সব পরিষ্কার করে লেখা আছে প্রেসক্রিপশনে, ভুলবেন না কিন্তু।

না, ভুলব না ডক্টর, তবে কী জানেন, শিল্পীর ক্যানভাসের মতো ব্যবহার করছি আমার দেহটা, দেহটার মধ্যে গড়ে তুলতে চাই, গড়ে তুলতে চাই

এক পরিপূর্ণ মানুষ! তা-ই না মি. অ্যান্ড্রু?

 ঠিক বলেছেন আপনি। দেখা যাক কোথায় পৌঁছতে পারি শেষ পর্যন্ত।

আমার একটা অনুরোধ আছে, সীমার বাইরে যাবার চেষ্টা না করাই ভালো, প্রচলিত ধ্যান-ধারণাকে নস্যাৎ করে প্রস্থেটিক নয়া নকশা রীতিমতো যুগান্তর এনেছে মানব সভ্যতায়, আবিষ্কারক হিসাবে আপনার স্বীকৃতি আজ জগৎজোড়া। তাই বলি, আর কেন? নাই-বা আর জুয়া খেললেন নিজের অমূল্য দেহ নিয়ে!

এর জবাব জানা আছে অ্যান্ড্রুর। কিন্তু কী হবে উত্তর দিয়ে, বাসনার মর্মদাহী জ্বালা যে অনুভব করেনি সে কেমন করে বুঝবে ওর মর্মবেদনা!

নানান সম্মানে ভূষিত অ্যান্ড্রু একাধিক পণ্ডিত সমিতি সাম্মানিক সভ্যপদে সম্মানিত করল ওকে। নিখিল বিশ্ব প্রস্থেটিক বিজ্ঞান সমিতির আজীবন সভাপতি অ্যান্ড্রু স্বয়ং। রোবো-বায়োলজির নতুন নাম এখন প্রস্থেটোলমি!

অ্যান্ড্রুর দেড়শো বছর জন্মজয়ন্তী পালন করা হল মহা সমারোহে। বিশাল ভোজসভার আয়োজন করল ইউ এস রোবটস, অ্যালভিন ম্যাগভেস্ক স্বয়ং উপস্থিত হলেন ভোজসভায়, চুরানব্বই বছর বয়সেও সতেজ কর্মচঞ্চল। মুহুর্মুহু রোবটের জয়ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠল সমস্ত ভোজসভা।

রোবট! রোবট! রোবট! মর্মদাহে অস্থির হয়ে উঠল অ্যান্ড্রু… মুখের গড়নে বহিঃপ্রকাশ হয় না কিছু। আপমানে থরথর করে কেঁপে উঠেছিল ঠোঁট দুটো মনের কথা বলার কেউ নেই। আজ বার বার করে ভেসে উঠল ছোট মামণির মূর্তি।

ছোট মামনির চিন্তা যেন অমৃতবারি সিঞ্চন করল সারা দেহে। রোবটের নির্মোক থেকে মুক্তি কি আসবে কোনওদিন? সঙ্গে সঙ্গে মানুষ হবার প্রতিজ্ঞায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল সমস্ত দেহমন।

.

১৭.

প্রস্থেটোলজির বিজয় অভিযান পৃথিবীর গণ্ডি ছাড়িয়ে চাঁদে গিয়ে পৌঁছাল অল্প সময়ে। ডাক পড়ল অ্যান্ড্রুর। বিশাল চাঁদের জনবসতি। চাঁদের অভ্যন্তরে একাধিক প্রকাণ্ড আধুনিক শহর।

স্বল্প মাধ্যাকর্ষণের জন্য সামান্য হেরফের হল প্রস্থেটিক নকশার। বিশিষ্ট প্রস্থেটোলজি বিশারদদের নিয়ে পুরো পাঁচ বছর কাজে ব্যস্ত রইল অ্যান্ড্রু। কাজের অবসরে যত্রতত্র ঘুরে বেড়াল সে মনের আনন্দে৷ দু-চোখে ওর শিশুসুলভ অদম্য বিস্ময় আর কৌতূহল। হুবহু মানুষের মতোই তিন আইনে তার অনুগত্য স্বীকার করল সমস্ত রোবটগোষ্ঠী।

কাজ শেষে চাঁদের বুক থেকে ফিরে এল অ্যান্ড্রু পৃথিবীতে। সটান চলে এল নিজের অফিসে। সম্মানে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল একজিকিউটিভ ডাইরেক্টর সাইমন ডিলং।

আসুন, আসুন। আপনি ফিরে আসবেন শুনেছিলাম, কিন্তু আজই যে আসবেন সেটা জানতে পারিনি।

ভুল শোনোনি কিছু, কথা তা-ই ছিল, হঠাৎ সবকিছু যেন দুর্বিষহ মনে হল। আসলে কী জানো সাইমন, কুড়িজন শ্রেষ্ঠ মানুষ-ডাক্তার নিয়ে গড়ে তুলেছিলাম আধুনিক প্রস্থেটিক গবেষণাগার। আমারই নির্দেশে নিঃশব্দে কাজ করেছে ওরা। চাঁদের রোবটরাও মানুষের মতো সম্মান দেখিয়েছে আমাকে। অথচ… অথচ একটা চিন্তাই পাগলা করে তুলছে।

কোন চিন্তার কথা বলছেন?

 জানো সাইমন, চিন্তা আমার একটা এত কাণ্ডের পরেও আমি কেন মানুষ হব না? মানুষ বলে স্বীকৃতি পাব না কেন? কেন? কেন?

বিপুল বিস্ময়ের ছায়া পড়ল সাইমনের দুচোখে। আন্ড্রয়েডের বড় বড় দু-চোখে অবিশ্বাস্য অস্থিরতা। উজ্জ্বলতার মশাল জ্বালিয়ে অসম্ভবের খোঁজে দিশাহারা।

স্যার, এইমাত্র তো বললেন রোবটরাও মানুষ হিসাবে সম্মান দিয়েছে। মানুষ ডাক্তাররাও বিনা প্রতিবাদে শুনেছে আপনার কথা, অর্থাৎ প্রকৃত অর্থে আপনি মানুষ!

কথা দিয়ে ভুলিয়ে কী লাভ সাইমন? প্রকৃত অর্থে মানুষ বলে গণ্য হলেও সত্যিই কি মানুষ হওয়া যায়? মানুষ মানুষই… মানুষের মতোই সত্যিকারের মানুষ হতে চাই আমি। আইনসঙ্গত সত্যিকারের মানুষ, ন্যায়সম্মত অধিকারবলে মানুষ!

আশ্চর্য! এ যে অসম্ভবের সাধনা! আপনার স্বপ্ন সার্থক হলে মানুষের আত্মঅহংকারে ঘা লাগবে। তার ফলে আসল কথা কী জানেন, যতদূর সম্ভব মানুষ হয়ে উঠলেও মানুষের মতোই এই কথাটাই বলবে সকলে। সত্যিকারের আসল মানুষ হওয়া সম্ভব নয় কিছুতেই!

কিন্তু কেন কেন কেন? কেন সম্ভব নয় সাইমন? মানুষের আকৃতি আমার, মানুষের সমতুল্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সব। প্রস্থেটিক যন্ত্রসম্বলিত মানুষের মতোই আমার দেহ, জ্ঞান-বিজ্ঞান শিল্প সাহিত্য মানবসভ্যতার সার্বিক অগ্রগতির পথে মূল্যবান পাথেয় জুগিয়েছি আমি, এর চেয়ে বেশি আর কী দিতে পারে কেউ?

এত উত্তেজিত হয়ে পড়বেন বুঝিনি সে কথা। ব্যাপার কী জানেন, একমাত্র বিশ্ব আইনসভাই আইন প্রণয়ন করে মানুষের স্বীকৃতি দিতে পারে আপনাকে। কিন্তু সেও প্রায়…

বিশ্ব আইনসভা? বেশ, আইনসভার সদস্য কে আছে বলো তো এখানে?

সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি কমিটির চেয়ারম্যানকে বললেও কাজ হবে স্যার।

.

১৮.

সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি কমিটির চেয়ারম্যান হলেন পূর্ব এশিয়ার এক ভদ্রমহিলা। নাম শ্ৰীমতী চী-লি সিং। মাঝবয়সী সুন্দরী না হলেও দেহ-যমুনায় জোয়ারের ঢল কানায় কানায় ভরপুর। পরনে স্বচ্ছ আলোকোজ্জ্বল আধুনিক পোশাক।

মানুষের সম্পূর্ণ অধিকার অর্জনের জন্য আপনার ঐকান্তিক প্রয়াসের প্রতি আমার পূর্ণ সহানুভূতি আছে মি. অ্যান্ড্রু। তবে কোনও বিশেষ অধিকার থেকে কি বঞ্চিত আপনি? তার জন্যই কি আপনার…

না না, বিশেষ কোনও অধিকার দাবি নেই আমার। আমার বক্তব্যেই আমার জীবন… সব স্বীকৃতি পেয়েও আমি মানুষ নই, রোবটমাত্র। অন্যান্য রোবটের মতো আমাকেও বিচ্ছিন্ন করা যাবে প্রয়োজনবোধে!

মানুষকে তো প্রাণ দিতে হয় সময় সময়।

প্রাণ দিতে হয় বটে, তবে সেটা আইনের মাধ্যমে, বিচার শেষে! অথচ আমাকে খুলে শেষ করতে বিচারের প্রয়োজন নেই কোনও। এ-ব্যাপারে সরকারি অধিকারবলে বলীয়ান কোনও মানুষের হুকুমই যথেষ্ট! যাক, এ তো গেল পার্থক্যের কথা, আসল কথা মানুষ হতে চাই। পূর্ণ স্বীকৃতি। দেড়শো বছর ধরে মানুষ হবার সাধনাই করে আসছি আমি।

শ্ৰীমতী চী-লির ভ্রমরকালো চোখের তারায় বেদনার আভাস।

মি. অ্যান্ড্রু, বিশ্ব আইনসভা সবকিছুই করতে পারে, পাথরের মূর্তিকেও আইন প্রণয়ন করে মানুষ বলে গণ্য করাতে পারে। কিন্তু আসল ব্যাপার কী জানেন, আইন সভার সদস্য সবাই মানুষ। মানুষের মনের গহনে এক সন্দেহ ভীতি রয়েছে রোবট সম্বন্ধে।

এখনও সন্দেহ, এখনও ভয়?

অবিশ্বাস্য বলে মনে হলেও এটাই বাস্তব সত্য। মানবিক গুণের বিকাশ ঘটেছে আপনার মধ্যে। পৃথিবীর মানুষই নানান সম্মানে ভূষিত করেছে আপনাকে। তা সত্ত্বেও বাজে নজির সৃষ্টির ভয়েই হয়তো পিছিয়ে যাবে আইনসভা।

নজির? কীসের নজির? আমিই একমাত্র স্বাধীন রোবট। অতীতেও আমার সমকক্ষ কেউই নেই। ভবিষ্যতেও আমার মতো হবে না কখনও।

কখনও–কথাটা সীমাহীন ভবিষ্যতের ইঙ্গিত করে। ভবিষ্যতের কথা অনুমান করা গেলেও জোর করে বলা উচিত হবে না কিছু। যা-ই হোক মি. অ্যান্ড্রু, ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে মানুষ বলে স্বীকৃতি দিতে পারি। আমার পূর্ণ সহানুভূতিও থাকবে আপনার উপর। তা সত্ত্বেও আইনসভা কী করবে, কী সিদ্ধান্ত নেবে, কিছুই বুঝতে পারছি না আমি।

কয়েক মিনিট চুপচাপ। গভীর চিন্তায় মগ্ন চেয়ারম্যান।

আরও একটা বিষয় ভাবার আছে মি. অ্যান্ড্রু৷ আপনার বিষয় নিয়ে ঝড় ওঠে আইনসভায়, তাহলে সমাজজীবনেও হয়তো ছড়িয়ে পড়বে সেই উত্তেজনা। গড়ে উঠবে এক বিজাতীয় মনোভাব। বিদ্বেষ আর ঘৃণা, তখন… তখন জনমতের চাপে আপনার দেহকে ধ্বংস করে ফেলাও বিচিত্র নয়। বৃহত্তর স্বার্থের জন্য ক্ষুদ্রতর স্বার্থ ত্যাগ বাঞ্ছনীয়। সেইজন্যই আর একবার ভেবে দেখুন মি. অ্যান্ড্রু!

এতদূর নিচে নামবে মানুষ! না না, এমন হতে পারে না কোনও মানুষ। মানুষের আদর্শেই তো গড়ে তুলেছি নিজেকে। মানুষকে ভালোবাসি, ভালোবাসি মানুষের আকাশের মতো হৃদয়কে। আকাশের বুকেও তো কালো মেঘ জমে, বজ্রের জন্ম দেয়, তাই বলে মেঘ আর বজ্র তো চিরন্তন সত্য নয়। সত্য নির্মল নীল আকাশ, অসীম শূন্যে উধাও। মানুষের মনও তা-ই। তাই অবিশ্বাস করতে পারি না মানুষকে। তা ছাড়াও আমার কথা ভুলে যাবে কী করে মানুষ? দীর্ঘ মানবজীবনের জন্য আমার প্রস্থেটোলজি এক অসম্ভবকে সম্ভব করেছে, সে কথাও কী ভুলে যাবে মানুষ? না না, মানুষ তা করবে না কখনওই।

এত বিশ্বাস আমাদের উপর! এত ভালোবাসেন মানুষকে! কিন্তু তবুও ভেবে দেখুন ভালো করে। ওরা যদি বলে প্রস্থেটোলজি আবিষ্কারের পেছনে রয়েছে আপনার ব্যাক্তিগত স্বার্থ অথবা মানুষকে রোবট করে তোলা বা রোবটকে মানুষ করে তোলার জন্য এটা এক হীন চক্রান্তমাত্র! একবার যদি প্রচার হয় এমন সম্ভাবনার কথা, তা হলে বিশাল আন্দোলন গড়ে উঠবে আপনার বিরুদ্ধে। সেই আন্দোলনের চাপে… না না, মি. অ্যান্ড্রু, যেমন আছেন তেমন থাকুন আপনি। এত বড় ঝুঁকি নেওয়া উচিত নয়। একটা কিছু হয়ে গেল…

না না না, ভয় পাই না কোনওকিছুকে। আর মানুষই যদি হতে না পারলাম তাহলে কী মূল্য আছে আমার জীবনের? অর্থহীন নিরর্থক বেঁচে থাকায় শুধু গ্লানি আর যন্ত্রণা। আচ্ছা, মানুষ হবার শেষ যুদ্ধে আপনার সমর্থন কি পেতে পারি আমি?

নিশ্চয়ই। যতখানি আমার পক্ষে সম্ভব। তবে আমার রাজনৈতিক জীবন বিপন্ন হলে তখন হয়তো ত্যাগ করতে হবে আপনাকে। বিশ্বাস করুন মি. অ্যান্ড্রু, আপনার অধিকার অর্জনের যুদ্ধে পাশে পাশে থাকব আমি।

অনেক, অনেক ধন্যবাদ। আশাতীত আশ্বাস আর প্রতিশ্রুতি পেলাম আপনার কাছে। মানুষ হবার সাধনায় যে কোনও চরম মূল্য দিতে প্রস্তুত। মানুষ! মানুষ হব আমি।

.

১৯.

না, সরাসরি লড়াই যুক্তিযুক্ত নয় বলে সিদ্ধান্ত নিল ফেইনগোল্ড মার্টিন কোম্পানি, অবশেষে অ্যান্ড্রুর পরামর্শে এক অভিনব কৌশলের আশ্রয় নিল ওরা।

ফেইনগোল্ড অ্যান্ড মার্টিন কোম্পানি নালিশ ঠুকে দিল কোর্টে। প্রস্থেটিক হার্ট বসানো এক ভদ্রলোকের প্রচুর দেনা ছিল সরকারের কাছে। আদালতে বলা হল যে যান্ত্রিক হার্ট বসানোর ফলে মানসিক সত্তা বিনষ্ট হয়ে গেছে মক্কেলের, সেইসঙ্গে বিনষ্ট হয়েছে মানুষ বলে গণ্য হবার সাংবিধানিক অধিকার। সুতরাং মানুষ বলে গণ্যই যদি না হন তা হলে সরকারের টাকা ফেরত দেবার আইনগত বাধ্যবাধকতাও রইল না আর।

যেমনটি আশা করা হয়েছিল হুবহু সেইরকম হল ফলাফল, পরাজয় ঘটল প্রতি পদক্ষেপে, পরাজয়ের গ্লানির বদলে আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠল অ্যান্ড্রু, আপিল করল বিশ্ব আদালতে। লক্ষ লক্ষ ডলারের খেলা চলল বহু বছর ধরে। সর্বস্ব পণ করে বসেছে অ্যান্ড্রু। বিশ্ব আদালতেও হারতে হবে নিপুণভাবে।

অবশেষে একদিন রায় বেরুল বিশ্ব আদালতের। চূড়ান্ত পরাজয়ের জন্য বিজয়োৎসবের আয়োজন করল সাইমন।

এই পরাজয়ে পরিষ্কার হয়ে গেছে দুটো বিষয়। প্রথমত, একাধিক বা বহু কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজিত হলেও মানুষের দেহ মানুষের দেহ বলেই পরিগণিত হবে। দ্বিতীয়ত, এই মামলা এবং আমাদের প্রচারের ফলে অনেক সম্প্রসারিত হয়েছে মনুষ্যত্বের ব্যাখ্যা। খুব শান্তভাবে বলল সাইমন ডিলং।

বুঝলাম, এর জন্য অনেক ধন্যবাদ তোমাকে, কিন্তু এখনও কি আইনসভা মানুষ বলে স্বীকার করবে না আমাকে? মানুষ বলে মানবে না আমাকে?

না স্যার, মানুষের ব্যাখ্যায় বিশ্ব আদালত কিন্তু অন্য কথা বলছে। বহু কোষের সমন্বয়ে গঠিত জটিল এক জৈব ব্রেনের উত্তরাধিকারী মানুষ, আর এই ব্রেনের উপস্থিতি মানুষকে মানুষ করে তুলেছে। আর আপনার আছে প্ল্যাটিনাম-ইরিডিয়ামে তৈরি পজিট্রনিক ব্রেন, সেইজন্যেই সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ মানুষের সমতুল্য হলেও মানুষ নন আপনি। বিজ্ঞানের উন্নতি হলেও মানুষের জৈব ব্রেনের অনুকরণ করা সম্ভব হয়নি এখনও।

তা হলে, এত করেও কি হেরে যাব আমি?

 না না, তা কেন হবে! এখনও তো আইনসভা রয়েছে, আইনসভার সদস্য শ্রীমতী চী লির সমর্থন পাব আমরা, এইসঙ্গে বেশ কয়েকজন সদস্যেরও সমর্থন পাব বলে আশা আছে, তবে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন পেলেও…

সাইমন, কী মনে হয় তোমার? সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন কি পাব আমরা?

 আমার সন্দেহ আছে স্যার, শেষপর্যন্ত জনগণের দ্বারস্থ হতে হবে আমাদের, জনসমর্থন লাভ করলে কী হবে বলতে পারব না, তবে একেবারে শেষ পর্যন্ত লড়তে হবে স্যার।

হ্যাঁ, শেষপর্যন্ত, সর্বস্ব পণ করে জুয়া খেলব সাইমন।

.

২০.

বেশ কিছু বছর কেটে গেল এর মধ্যে। শ্রীমতী চী-লির বয়সও বাড়ল অনেক। দুধসাদা মাথার চুল, কেমন যেন ভাটা পড়ে এসেছে সমস্ত দেহ জুড়ে। কালের প্রবাহে অনেক কাছে এসেছে দু-জনে, প্রগাঢ় হয়ে উঠেছে ঘনিষ্ঠতা।

অ্যান্ড্রু, অনেক দূর এগিয়েছি আমরা। সাধ্যাতীত চেষ্টা করেছি, শীতকালীন সভা শুরু হবার পরেই শেষ চেষ্টা করব আমরা।

যতই চেষ্টা কর-না কেন চী, আসল কথা হল ব্রেন। সবকিছু ঠেকেছে এখন ওইখানেই। অর্থাৎ জৈবকোষে তৈরি ব্রেন বনাম পজিট্রনস। আচ্ছা চী, কর্মক্ষমতার উপর নির্ভর করা যায় না কিছু বলা যায় না আই কিউ-ই আসল মনুষ্যত্বের মাপকাঠি?

তুমি কি ছেলেমানুষ হয়ে গেলে অ্যান্ড্রু! কিছুই হবে না এতে। আসল পার্থক্য তো অন্য বিষয়ে। তোমার ব্রেন মানুষের তৈরি, মানুষের ব্রেন প্রকৃতির। অভিব্যক্তির ধারায় পুষ্ট। এছাড়া তুমি অমর, মানুষ মরণশীল। কী জানো অ্যান্ড্রু, রোবট আর মানুষের মধ্যে যারা পার্থক্য দেখতে ভালোবাসে, এই পার্থক্যগুলোই হিমালয়ের মতো দুর্লঙ্ঘ তাদের কাছে।

যেমন করেই হোক এই পার্থক্য দূর করব চী, যেমন করেই হোক।

অ্যান্ড্রু… অ্যান্ড্রু, কী অবুঝ তুমি, কী জেদি! এখনও যুক্তিতর্ক দিয়ে বুঝতে চাইছ মানুষকে! সত্যি তোমার জন্য দুঃখ হয় অ্যান্ড্রু, ভীষণ কষ্ট হয় আমার। রাগ কোরো না, তোমার মধ্যেকার রোবটই গোঁয়ারের মতো তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে তোমাকে, আর তার ফলেই…

শেষে তুমিও বললে এমন কথা চী? আমার সম্বন্ধে, তোমারও এই ধারণা? আমার মধ্যেকার রোবটই… রোবট বলেই অমর… না না চী, যেমন করেই হোক… যেমন করেই হোক… উদ্ভ্রান্তের মতো দ্রুতপায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল অ্যান্ড্রু! যান্ত্রিক ব্রেনের মধ্যেও শুরু হয়ে গেছে মানসিক যন্ত্রণা।

যেমন করেই হোক… যেমন করেই হোক… যেমন করেই হোক… বহুকাল থেকে মনে হয়েছিল এমন পরিণতির কথা। মনে হয়েছিল কিন্তু বিশ্বাস হয়নি, মানুষের মনুষ্যত্বের উপর অপরিসীম বিশ্বাস আর ভালোবাসাই মানুষ হবার প্রেরণা জুগিয়েছে অ্যান্ড্রুকে! উপায় কী! উপায় কী? কোথায় পথ?

অবশেষে পথ পাওয়া গেল। উপায়ও হল। সার্জেনের দ্বারস্থ হল অ্যান্ড্রু, সবচেয়ে বড় রোবট-সার্জন।

নির্বিঘ্নে হয়ে গেল জটিল অপারেশন।

.

২১.

দুর্বল… ভীষণ দুর্বল… কেমন যেন অতল জলের তলায় ডুবছে… ক্রমেই আরও গভীরে। না না, এসব অনুমান কল্পনা… মিথ্যে মনকে সান্ত্বনা দিল অ্যান্ড্রু। বেশ কয়েকদিন কেটে গেল এইভাবে অসম্ভব মনের জোরে আরোগ্যলাভের পথে, দেওয়ালে হেলান দিয়ে বিছানার উপরে বসে থাকে সারাক্ষণ।

এই সপ্তাহে চূড়ান্ত ভোট, অ্যান্ড্রু। জনে জনে ধরে ধরে বলেছি, যত্ন করে বুঝিয়েছি, জানি না শেষরক্ষা হবে কি না। বিছানার পাশে বসতে বসতে বলল শ্রীমতী চী-লি।

চূড়ান্ত ভোট? ফলাফল কী হবে চী? অবুঝ শিশুর মতো প্রশ্ন করল অ্যান্ড্রু।

কী হবে সে তো অনুমান করা যায় অ্যান্ড্রু! পরাজয় ধরে নিয়েছি আমি, আমাদের চেষ্টার কোনও ত্রুটি করিনি।

যা হবার তোক চী, অনেক, অনেক করেছ তুমি, তোমরা সকলে, যাক, ভালো সময় ভোট হচ্ছে, এই সময়টাই প্রয়োজন ছিল আমার। এবার সত্যিকারের জুয়া খেলেছি চী, জীবন-জুয়া।

জুয়া? জীবন জুয়া? কী বলছ তুমি! কিছুই বুঝতে পারছি না অ্যান্ড্রু! উৎকণ্ঠিত সুরে প্রশ্ন করে শ্রীমতী চী-লি।

দুর্জ্ঞেয় এক মিষ্টি হাসিতে ভরে উঠল অ্যান্ড্রুর মুখ। পলকহীন বড় বড় চোখে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল জানালার বাইরে নির্মল আকাশের দিকে।

ইচ্ছে করেই বলিনি তোমাকে চী, কাউকে বলিনি, বললে বাধা দিতে তুমি, তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেতে পারতাম না কোনওমতে, যাক, এখন আর বলতে বাধা নেই, চী, ব্রেনই যদি একমাত্র বিবেচ্য বিষয় হয়, তা হলে অমরত্বের প্রশ্নও ওঠে সঙ্গে সঙ্গে, কারুর মাথাব্যাথা পড়েনি ব্রেন নিয়ে মাথা ঘামানোর, অর্থাৎ মানুষের ব্রেনের কোষের মৃত্যু হয়, মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী, এমনকী দেহের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বদলানো সম্ভব হলেও ব্রেন পালটানো অসম্ভব। অথচ দেখো, আমার পজিট্রনিক ব্রেন নির্ভুলভাবে কাজ করে চলেছে দু-শো বছর ধরে, আরও কত বছর চলবে কে জানে! এটাই হল আসল বাধা। মানুষ, মানবসমাজ অমর রোবটকে মানিয়ে নিতে পারে অনায়াসে, বিনা দ্বিধায়, কারণ, সে অমর হলেও রোবট। কিন্তু কোনও মানুষ যদি অমর হয় তা হলে তাকে মেনে নিতে পারে না মানবসমাজ, কারণ মানুষ নিজে তো অমর নয়, প্রচণ্ড আঘাত লাগে মানুষের আত্মশ্লাঘায়, হীন মনে হয় নিজেদের। একমাত্র এই কারণেই আমাকে মানুষ বলে স্বীকার করে নেয়নি মানবসমাজ সেইজন্যেই…।

সেইজন্যেই কী, কী বলতে চাইছ অ্যান্ড্রু?

বলছি, বলছি, সব বলছি, তোমাকে ছাড়া আর কাকেই বা বলব বলো? জানো চী, সেই আসল বাধাকে সরিয়ে দিয়েছি আমি, কয়েক যুগ আগে আমার দেহের জৈব স্নায়ুতন্ত্রের সঙ্গে সংযোজিত হয়েছিল আমার পজিট্রনিক ব্রেন। শুধু সামান্য পরিবর্তন ঘটিয়েছি এই অপারেশনে, স্নায়ুতন্ত্র আর ব্রেনের সংযোজনের মধ্যে পরিবর্তন ঘটিয়েছি এই অপারেশনে, স্নায়ুতন্ত্র আর ব্রেনের সংযোজনের মধ্যে পরিবর্তন ঘটেছে বেশ কিছু, আর এই পরিবর্তনের ফলেই, ধীরে ধীরে, খুব ধীরে ধীরে ব্রেনের উন্মুক্ত গতিপথ দিয়ে নিষ্কাশিত হয়ে যাবে আমার জীবনীশক্তি।

আকস্মিক আঘাতে বিমূঢ় হয়ে পড়ল শ্রীমতী চী-লি, পাথরের মতো আড়ষ্ট নিস্পন্দ, অব্যক্ত বেদনায় কেঁপে উঠল ঠোঁট দুটো, দু-চোখ বেয়ে নামল ভালোবাসার ঢল।

তুমি, তুমি মৃত্যুর সমস্ত আয়োজন সাঙ্গ করে ফেলেছ অ্যান্ড্রু। কেন? কেন এমন করলে অ্যান্ড্রু? কেন করলে? একবারও ভাবলে না আমার কথা?

চী, সব ভেবেছি, সারাজীবন ভেবেছি, দেহের মৃত্যু বড় না সারজীবনের আদর্শ স্বপ্ন কামনা? এ-দুটোর মধ্যে একটাকেই বাছতে হবে আমাকে, আদর্শের মৃত্যুর মূল্য দিয়ে অমর হতে চাই না আমি, আদর্শের মৃত্যুই তো প্রকৃত মৃত্যু, এই বোধ আসার সঙ্গে সঙ্গে তিন নম্বর আইন সহজ হয়ে গেল আমার কাছে।

আবেগে উত্তেজনায় অ্যান্ড্রুকে আঁকড়ে ধরল শ্রীমতী চী-লি। থরথর করে কাঁপল ওর সর্বাঙ্গ।

না না অ্যান্ড্রু, এ হয় না, হয় না, পালটে নাও, বন্ধ করো তোমার আত্মহত্যা…

আর হয় না চী, বেশি ক্ষতি হয়ে গেছে ব্রেনের, আর এক বছর মাত্র আমার আয়ু, হয়তো-বা দু-একদিন কমবেশি, হ্যাঁ হ্যাঁ, দু-শো বছরের জন্মজয়ন্তী দেখে যেতে পারব নিশ্চয়ই…

জন্মজয়ন্তী! কী কাজে লাগবে সে জয়ন্তী আন্ডু? কী কাজে লাগবে? আচ্ছা অ্যান্ড্রু, বলতে পার, বলতে পার কী করলে খুশি হবে সেদিন?

আমার আবার খুশি! বামন হয়ে চাঁদ ধারার বাসনা, দিতে পার, দিতে পার তোমরা মানুষের স্বীকৃতি? আর তা যদি না পার তা হলে চাই না, চাই না কিছু আর, শুধু তুমি আমার পাশে থেকো যাবার বেলায়।

শ্ৰীমতী চী-লির ডান হাতটা নিজের হাতের মধ্যে তুলে নিল অ্যান্ড্রু, জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত নির্বাক হয়ে বাঁধা পড়ল দু-হাতের বন্ধনে, পুষ্পাঞ্জলি হয়ে ঝরে পড়ল মুক্তোর মতো অশ্রুজল।

.

২২.

স্তম্ভিত সমস্ত বিশ্ব। অ্যান্ড্রুর স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ মনুষ্যত্বের নবজাগরণ ঘটাল দিকে দিকে। বহুকাল ধরে বিস্ময়কর অবদানেও যাদের চৈতন্য হয়নি আজ তারা মরিয়া হয়ে উঠল কিছু করার জন্য, শুধুমাত্র মানুষকে ভালোবেসে, মানুষ হবার দুর্নিবার আকর্ষণে মৃত্যুপথে পা বাড়িয়েছে অ্যান্ড্রু মনুষ্যত্বের জয়গানে।

মহোৎসবের দিন ঠিক হল বিশেষ উদ্দেশ্যপূরণের জন্য। দু-শো বছর জন্মজয়ন্তীর দিন। সেই উৎসবের সূচনায় মানবসভ্যতার ইতিহাসে বিস্ময়কর দলিল স্বাক্ষর করবেন বিশ্ব সভাপতি৷ আইনে পরিণত হবে সেই মুহূর্তে। পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তে একই যোগে দেখা যাবে মহোৎসব। বিশেষ প্রক্রিয়ায় উপগ্রহের মাধ্যমে চাঁদ আর মঙ্গলের উপনিবেশও সরাসরি পাঠানো হবে সমস্ত অনুষ্ঠানের ছবি।

চাকা লাগানো চেয়ারে নিয়ে আসা হল অ্যান্ড্রুকে। দু-পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারলেও চলার ক্ষমতা চলে গেছে বেশ কিছুদিন।

করতালি মুখরিত সভাগৃহে গমগম করে উঠল বিশ্ব সভাপতির পৌরুষদীপ্ত কণ্ঠ।

গত দু-শো বছর নিঃস্বার্থভাবে মানবসভ্যতার সেবা করে এসেছেন আপনি, শিল্প কলা বিজ্ঞান সর্বত্রই আপনার অবদান অনস্বীকার্য। আমাদের মধ্যে আপনাকে পেয়ে রীতিমতো গর্বিত আমরা। সমস্ত মানবসমাজ অশেষ ঋণে ঋণী আপনার কাছে। তাই আপনার দু-শো বছর জন্মজয়ন্তীর মূহূর্তে সমস্ত মানবসমাজের পক্ষ থেকে ঘোষণা করছি, মানুষ! দু-শো বছরের চিরন্তন মানুষ আপনি মি. অ্যান্ড্রু মার্টিন!

অবিস্মরণীয় সেই মুহূর্তে, এক অনির্বচনীয় স্বর্গীয় আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল অ্যান্ড্রুর মুখমণ্ডল। কাঁপা কাঁপা বলিষ্ঠ দুই হাত সে বাড়িয়ে দিল সভাপতির দিকে… সমস্ত মানবসমাজের উদ্দেশে।

.

২৩.

ক্রমেই ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে আসছে অ্যান্ড্রুর চিন্তাধারা। কেমন যেন আবছা আবছা চিন্তার ধারাবাহিকতা বিচ্ছিন্ন মাঝে মাঝে শয্যাশায়ী অ্যান্ড্রু নীলাকাশের মতো মেঘমুক্ত।

আজ সমাপ্তির পথে সংগ্রামী-জীবন। দেনা-পাওনার হিসাব-নিকাশে জীবন জুড়ে এসেছে প্রাপ্তির শান্তির ধারা… মানুষ! অ্যান্ড্রু আজ মানুষ। জীবনের প্রান্তে দাঁড়িয়ে চৈতন্যের শেষ বিন্দু দিয়ে অনুভূত হল মানুষ… মানুষ… মানুষ… দীর্ঘজীবনের রুক্ষ মরুভূমি শুধু কন্টকাকীর্ণ ক্যাকটাসে ভরা নয়, ক্যাকটাসের বুকে আছে স্বর্গীয় ফুলের দ্যোতনা, সৃষ্টির অনির্বচনীয় সুধারস। সেই চিন্তায় লীন হয়ে যেতে চায় অ্যান্ড্রুর অন্তিম সত্তা।

চিত্রার্পিতের মতো শয্যাপাশে বসে আছে শ্ৰীমতী চী-লি। ক্রমেই অস্পষ্ট হয়ে উঠছে চীর অস্তিত্ব। তিলধারণের স্থান নেই আজ ঘরে। মহাপ্রয়াণের যাত্রাপথে বুকচাপা নিস্তব্ধতা আজ বড় বেশি বাত্ময়। অ্যান্ড্রুর চোখে সবই যেন ছায়া ক্রমেই আবছা হয়ে আসে ছায়া-ছায়া শরীর সব। ধীরে ধীরে ডান হাত প্রসারিত করে দিল বাক্যহারা চী-র দিকে চী-র হাতে উত্তপ্ত স্পর্শ অনুরণিত হল অবসন্ন চৈতন্যে।

ক্রমেই অন্ধকার গাঢ় অন্ধকারে আবৃত হয়ে উঠছে চারপাশ… তমিস্রাঘন নিবিড় আঁধার অজস্র নক্ষত্র জেলার মধ্যে চলেছে অ্যান্ড্রু… মেঘের কোলে কোলে রংবেরঙের আলোর মেলা… চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা কুয়াশার, কালো গহ্বর আর রেডিয়ো জেটের হাতছানি… নিউট্রিনোর সমুদ্রে আদিগন্ত একাকার… শিশুর আনন্দে নেচে নেচে চলেছে অ্যান্ড্রু… ব্রহ্মাণ্ডের ওপারে হঠাৎ ভেসে ওঠে একটি মুখ… মহাযাত্রার পরমলগ্নে শুভ মাঙ্গলিকী… আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে অ্যান্ড্রুর অন্তিম মুহূর্ত… অসাড় ঠোঁট দুটো কেঁপে কেঁপে ওঠে। বারেবারে… সমস্ত সত্তা দিয়ে শেষবারের মতো গেয়ে ওঠে… মামণি… ছোট মামণি…মা… ম… ণি…

[আইজাক আসিমভের দ্য বাইসেন্টেনিয়াল ম্যান এর ভাবানুসরণে।
প্রথম প্রকাশ: ফ্যানট্যাসটিক, বার্ষিকী ১৯৮৮]