জটায়ু নামেতে পক্ষী গরুড়-নন্দন।
দূর হৈতে শুনিল সে সীতার ক্রন্দন।।
আকাশে উঠিয়া পক্ষী চতুর্দ্দিকে চায়।
দেখিল, রাবণ রাজা সীতা লয়ে যায়।।
ত্রিভুবনে যত বীর পক্ষীর গোচর।
দেখিয়া চিনিল পক্ষী রাজা লঙ্কেশ্বর।।
দুই পাখা পসারিয়া আগুলিল বাট।
রাবণেরে গালি দিয়া মারে পাখসাট।।
ডাক দিয়া বলে পক্ষী, শুন নিশাচর।
আপনা না জানিস্, তুই পাপী দুরাচার।।
কোন্ দোষে হরিলি রে রামের সুন্দরী।
রঘুনাথ নাহি হিংসে তোর লঙ্কাপুরী।।
সূর্পণখা গিয়াছিল রমণের সাধে।
নাক কাণ কাটে তার সেই অপরাধে।।
দশরথ রাজা বড় ধর্ম্মেতে তৎপর।
পুত্রবধূ হরিলি, তাঁহার নাহি ডর।।
কি কব হয়েছি বৃদ্ধ, ঠোঁট হৈল ভোঁতা।
নতুবা ফলের মত ছিঁড়িতাম মাথা।।
পাখসাট মারে পক্ষী, আর দেয় গালি।
রাবণের সঙ্গে যুদ্ধ করে মহাবলী।।
আকাশে উঠিয়া দেখে, রাম বহুদূর।
আঁচড়ে কামড়ে তার রথ কৈল চূর।।
আকাশে উঠিয়া পক্ষী ছোঁ দিয়া সে পড়ে।
রাবণের পৃষ্ঠ-মাংস থাকে থাকে ফাড়ে।।
ছিঁড়িল ঠোঁটের ঘায় সারথির মুণ্ড।
রথধ্বজ ভাঙ্গিয়া করিল খণ্ড খণ্ড।।
অতি ব্যস্ত দশানন জ্বলে ক্রোধানলে।
রথ হৈতে সীতারে রাখিল ভূমিতলে।।
ভূমে রাখি সীতারে সে উঠিল আকাশে।
সম্বরেন বস্ত্র সীতা পলায়ন আশে।।
পলাইতে চান সীতা, নাহি পান পথ।
চতুর্দ্দিকে মহাবন বেষ্টিত পর্ব্বত।।
ভয়েতে কান্দেন সীতা করিয়া ব্যগ্রতা।
অন্তরীক্ষে হাহাকার করেন দেবতা।।
যুঝে পক্ষিরাজ, কিন্তু অন্তরেতে ত্রাস।
বৃক্ষডালে বৈসে তার ঘন বহে শ্বাস।।
বলে টুটা পক্ষিরাজে দেখিয়া রাবণ।
মায়া করি রথখান করিল সাজন।।
আরবার রাবণ সীতারে তোলে রথে।
চলিল সে মহাবলী পূর্ণ মনোরথে।।
আরবার জটায়ু সাহসে করি ভর।
মহাযুদ্ধ করে পক্ষী অতি ঘোরতর।।
রাবণ বলিল পক্ষী শুনহ বচন।
পর লাগি প্রাণ কেন দেহ অকারণ।।
অতঃপর পক্ষিরাজ নিজ প্রাণ রক্ষ।
যাবৎ তোমার আমি কাটি দুই পক্ষ।।
দুই জনে ঘোর রবে হৈল গালাগালি।
দুই জনে যুদ্ধ করে, দোঁহে মহাবলী।।
অঙ্কুশ না মানে মত্ত মাতঙ্গ যেমন।
কেহ কারে করিতে নারিল নিবারণ।।
রাবণের মুকুট সে রত্নেতে নির্ম্মাণ।
ঠোঁট দিয়া পক্ষী তাহা করে খান খান।।
পূর্ব্বপুণ্যে রাবণের রহে দশ মাথা।
শিবের প্রসাদে তাহা না হয় অন্যথা।।
কিন্তু কেশ ছিঁড়িয়া করিল খণ্ড খণ্ড।
নিষ্কেশ হইল রাবণের দশ মুণ্ড।।
পক্ষী-যুদ্ধে তাহার হইল অপমান।
ধরিয়াছে সীতারে, কেমনে ছাড়ে বাণ।।
আরবার সীতারে রাখিল ভূমিতলে।
রথশুদ্ধ রাবণ উঠিল নভঃস্থলে।।
বত্রিশ হাজার বাণ রাবণ এড়িল।
সর্ব্বাঙ্গে ফুটিয়া পক্ষী কাতর হইল।।
দুর্জ্জয় রাবণ রাজা ত্রিভুবন জিনে।
কি করিতে পারে তারে পক্ষীর পরাণে।।
রামের অপেক্ষা করি রহে পক্ষীবর।
প্রাণপণে যুঝিল সাহসে করি ভর।।
রাবণ দেখিল, পক্ষী বলে নাহি টুটে।
অর্দ্ধচন্দ্র বাণে তার দুই পাখা কাটে।।
ভূমিতে পড়িয়া পক্ষী করে ছটফট।
আসিয়া কহেন সীতা পক্ষীর নিকট।।
আমা লাগি শ্বশুর হারালেন জীবন।
রাবণের হাতে আছে আমার মরণ।।
আমার হইল জন্ম রাবণ কারণ।
আর না পাইব শ্রীরামের দরশন।।
যাবৎ না দেখা পান শ্রীরাম লক্ষ্মণ।
তাবৎ কহিবে তুমি মম বিবরণ।।
প্রভুরে দেখহ যদি বনের ভিতর।
বলিহ তোমার সীতা নিল লঙ্কেশ্বর।।
সাগরের পারে ঘর বৈসে লঙ্কাপুরী।
অন্তরীক্ষে লয়ে গেল তোমার সুন্দরী।।
জটায়ু বলেন, সীতা নাহি মোর হাত।
যত যুদ্ধ করিলাম, দেখিলে সাক্ষাৎ।।
আমার বচন শুন, না কর ক্রন্দন।
তোমারে উদ্ধারিবেন শ্রীরাম লক্ষ্মণ।।
উভয়ের কথা শুনি দশানন হাসে।
রথ দেখি জানকী কাঁপেন মহাত্রাসে।।
পুনর্ব্বার সীতারে তুলিল রথোপরে।
সীতার বিলাপ শুনি পাষাণ বিদরে।।
অসার ভাবিয়া সীতা নাহি পান কূল।
অতিকৃশা দীনবেশা কান্দিয়া আকুল।।
সীতার বিলাপ কত লিখিবে লেখনী।
গরুড়ের মুখে যেন পড়িল সাপিনী।।
সীতা যত গালি দেন, রাবণ না শুনে।
রথে চড়ি বায়ুবেগে উঠিল গগনে।।
রাবণ পক্ষীর যুদ্ধে হৈল লণ্ডভণ্ড।
কি জানি আসিয়া রাম কাটিবেন মুণ্ড।।
এই ভয়ে রাবণ পলায় ঊর্দ্ধশ্বাসে।
তার সহ যাইতে না পারিল বাতাসে।।