গোরানসাহেব বললেন, অদ্ভুত ব্যাপার! একাজটা কে করল?
অর্জুনও অবাক হয়েছিল। বলল, সাপের গর্তের মুখ বন্ধ করতে হলে সাহস থাকা দরকার। এখানে একমাত্র আপনি আর গোরক্ষনাথ সাপ সম্পর্কে সাহসী। কিন্তু আপনারা কেন এই কাজ করতে যাবেন? তা ছাড়া সন্ধের পরে কেউ তো বাংলোর বাইরে আসেনি।
গোরানসাহেব রেগে গেলেন, তুমি কি পাগল? আমি যদি নিজে এই কাজটি করি তা হলে জিজ্ঞেস করব কেন? না কি তুমি আমাকেও সন্দেহভাজনদের লিস্ট থেকে বাদ দিতে চাওনি? প্রশ্নটা করেই দূরে কিছু লক্ষ করে ফিসফিসে গলায় বললেন, সরে এসো অর্জুন, চটপট সরে এসো।
গোরানসাহেব তৃতীয় কবরটির দিকে দৌড়ে যেতে অর্জুন অনুসরণ করল। এবং খানিকটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে সে লক্ষ করতেই সাপটাকে দেখতে পেল। কাল সন্ধেবেলায় যে সাপটাকে তারা দেখেছিল, বোধ হয় সেটাই। খুব দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে স্টিভেনসনের কবরের দিকে। এখন আরও দীর্ঘ দেখাচ্ছে ওর চেহারা। কবরের পাশে এসে সাপটা থমকে দাঁড়াল। মুখ ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে কিছু খুঁজতে লাগল। পাশে কুঁজো হয়ে দাঁড়ানো গোরানসাহেবকে বলতে শুনল অর্জুন, ঢোকার গর্তটা খুঁজছে।
হঠাৎ ফোঁসফোঁস শব্দ প্রবল হল। সাপটা যে খুব রেগে গেছে, বোঝা যাচ্ছিল। আচমকা ফণা তুলে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। এত লম্বা, মোটা সাপকে কখনও ফণা তুলতে দ্যাখেনি অর্জুন। মুখ ফাঁক হওয়ায় সরু জিভ মাঝে-মাঝেই বেরিয়ে আসছে। সোজা হয়ে দাঁড়ানো ওর মাথা অর্জুনের উচ্চতার সমান হয়ে গিয়েছে। এই অবস্থায় ও যদি কাউকে আক্রমণ করে তা হলে আত্মরক্ষা করা অসম্ভব হবে।
হঠাৎ অর্জুন লক্ষ করল গোরানসাহেবের মুখের চেহারা বদলে যাচ্ছে। সাপ দেখলে ওঁর চোখমুখ যেরকম ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে, এখন সেই অবস্থা। অর্জুন শক্ত হাতে ওঁর হাত ধরল। সেটা ছাড়াতে চেষ্টা করলেন গোরানসাহেব, আমাকে যেতে দাও। ওকে আমার চাই। আমার সংগ্রহে ওর মাথাটাকে রাখব।
না। চাপা গলায় বলল অর্জুন, আপনি ওকে মারতে পারবেন না।
হঠাৎ সাপটা নিচু হতে লাগল। এবং প্রবল শক্তিতে ওর মুখ দিয়ে নরম মাটির ওপর আঘাত করল। এক-দুই-তিনবার। তারপরেই ওর শরীরটা তরতর করে ভেতরে ঢুকে যেতে লাগল। তাই দেখে গোরানসাহেব দৌড়লেন, কিন্তু তিনি গর্তটার কাছে পৌঁছনোর আগেই সাপের শরীর অদৃশ্য হয়ে গেল।
হতাশ হয়েও দমলেন না গোরানসাহেব, অতবড় শরীরটা এত দ্রুত ভেতরে ঢুকল কী করে? না অর্জুন, এই কবর খুঁড়তে হবে।
সেটা কি ঠিক হবে?
মানে?
ওখানে আর্নল্ড স্টিভেনসনের শরীরকে সমাধি দেওয়া হয়েছে। কবরটি খুঁড়লে তাঁকে অসম্মান জানানো হবে না? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
এত বছরে তাঁর শরীরটা নিশ্চয়ই মাটিতে মিশে গেছে। তা ছাড়া ওই সাপটা যদি তাঁর শরীরকে আস্তানা করে থাকে, তা হলে নিশ্চয়ই তাঁর আত্মা শান্তি পাচ্ছে না।
তখন কড়া রোদ। অথচ বেলা এগারোটা বাজে। গোরানসাহেব সবাইকে সতর্ক করে দিলেন সাপটার শক্তি সম্পর্কে। গোরক্ষনাথ তার তিনটে প্রাণীকে নিয়ে এল কবরের কাছে। বেচারারা ঘুমোচ্ছিল, ওখানে নিয়ে আসতেই প্রবল প্রতিবাদ শুরু করে দিল। কাক চেঁচাচ্ছে, শকুন পাখা ঝাপটে চলেছে, বেড়ালটা পিঠ উঁচু করে ফ্যাঁসফাঁস আওয়াজ তুলছে। গোরক্ষনাথ চটপট বলে উঠল, এই জায়গাটা মোটেই ভাল নয় বাবু।
কেন? জিজ্ঞেস করল অর্জুন।
এখানে তেনাদের কেউ নিশ্চয়ই আছেন। নইলে এরা এমন কাণ্ড করবে না। মেজর হাসলেন, তুমি অর্ধেক সাকসেসফুল গোরক্ষনাথ। এখানে প্রেতাত্মা আছে কিনা তা জানি না, তবে কবরে এককালে মৃত মানুষকে শোয়ানো হয়েছিল, এটা অন্তত তোমার প্রাণীরা জানিয়ে দিতে পেরেছে।
গোরক্ষনাথ কবরের কাছে খাঁচা নিয়ে গিয়ে শকুনটার দরজা খুলে দিল। দেখা গেল খোঁড়াতে-খোঁড়াতে পাখিটা বেরিয়ে এসে সাপের গর্তের মুখটায় চলে গেল। তারপর প্রবলবেগে গর্তের মুখ নখ দিয়ে আঁচড়াতে লাগল। গোরক্ষনাথ ওর পায়ে বাঁধা দড়ি টেনে কোনওমতে ফিরিয়ে আনতে পারল খাঁচায়। তারপর ওদের তিনজনকে রেখে দিয়ে এল দূরে। এবং সেখানে রাখার পর প্রাণী তিনটে একটু একটু করে শান্ত হয়ে গেল।
মেজর এবং গোরানসাহেব যেসব মালপত্র এনেছিলেন। তার ভেতর থেকে একটি শক্ত জাল বের করে আনা হয়েছে। মাটি খোঁড়ার জন্য বেলচা জাতীয় তিনটি স্টিলের যন্ত্র, লম্বা লাঠি আর এক বোতল অ্যাসিড। মেজর চাইছিলেন গর্তের ভেতরে বোতলটা উপুড় করে দিতে। তা হলে সাপটার আর বেঁচে থাকার কোনও সুযোগ থাকবে না। কিন্তু গোরানসাহেবের তাতে প্রবল আপত্তি। তিনি সাপটার মাথা আস্ত চান। অ্যাসিডে পুড়ে গেলে তাঁর কোনও কাজে লাগবে না।
অতএব গর্ত খুঁড়তে হবে এবং তার ফলে সাপটা নিশ্চয়ই আক্রমণ করবে। আর ওর রেগে যাওয়ার যে চেহারা অর্জুন দেখেছে তাতে স্পষ্ট, ওর মোকাবিলা করা। বেশ শক্ত হবে। গোরানসাহেব বললেন, তিনি তৈরি থাকবেন। সাপটা ফণা। তোলামাত্র তিনি তাকে জালবন্দি করবেন।
এই সময় বটা বলল, বাবু একটা কথা বলব?
অর্জুন তাকাল, শুনেছি শনি-মঙ্গলবার বাস্তুসাপ মারতে নেই। ওটা তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না, আর একটা রাত অপেক্ষা করলে হত না?
মেজর বললেন, যদিও ব্যাপারটা কুসংস্কার তবু আমার প্রস্তাবটা খারাপ লাগছে না। ছেলেবেলায় আমার মায়ের মুখে এমন কথা শুনেছি।
গোরানসাহেবকে ইংরেজিতে ব্যাপারটা বললেন মেজর।
গোরানসাহেব কাঁধ ঝাঁকালেন, দুহাজার সালে এসব কথার কোনও মানে আছে?
মেজর বললেন, নেই। তবে লোকাল মানুষের সেন্টিমেন্ট।
অর্জুনের দিকে তাকালেন গোরানসাহেব, তুমি কী বলো?
অর্জুনের চোখের সামনে রাগী সাপটার ফণা-তোলা শরীর ভেসে উঠল। ভয়ঙ্কর অথচ কী সুন্দর! আর একটা দিনরাতের সুযোগে ও যদি এখান থেকে পালিয়ে যায় তা হলে তো সমস্যার সমাধান হয়। এই যে ওরা এখানে জড়ো হয়ে কথাবার্তা বলছে, সাপটা নিশ্চয়ই নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবছে। আর সেকারণেই ও ওর এই আশ্রয় ত্যাগ করতে পারে। অর্জুন হেসে বলল, আজ আর কালের মধ্যে তো কোনও পার্থক্য আমি দেখতে পাচ্ছি না।
বেশ। তবে তাই হোক। গোরানসাহেব অবশ্য খুশি না হয়েই বললেন।
দুপুরটা কেটে গেল ঘুমিয়ে। বিকেলে আবার বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে কথাবার্তা। গোরানসাহেব বললেন, আমার বিশ্বাস, আর কোথাও খুঁজে বেড়াবার দরকার নেই। এখানেই সে আছে। আমরা আজকের রাতটা জেগে থাকব।
বটা ইতিমধ্যে বিষয়টা ভোনে গিয়েছে। সে দূরে দাঁড়িয়ে শুনছিল, বাবু, আমাকেও কি জাগতে হবে?
তার প্রশ্নের কেউ উত্তর দিল না।
মেজর জিজ্ঞেস করলেন, আমরা কি বাংলোর ভেতরে বসে লক্ষ করব, না বাইরে গিয়ে দাঁড়াব?
প্রথমে আমরা ভেতরে থাকব। রাত বাড়লে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা হবে। গোরানসাহেব গম্ভীর মুখে বললেন, আমি তখন থেকে লক্ষ করে যাচ্ছি, কিন্তু গতকাল যে সাপটাকে ওখান দিয়ে কবরের দিকে যেতে দেখেছি তাকে এখনও চোখে পড়ছে না। এর মানে ওটা ওর রুটিন নয়।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আজ যাকে দেখেছি সে কি গতকালেরটা নয়?
আমি ঠিক বুঝতে পারছি না অর্জুন। গোরানসাহেব বললেন।
সন্ধের সময় দেখা গেল আকাশে মেঘ জমছে আর জঙ্গলের গাছপাতা আচমকা স্থির হয়ে গেছে। একটা পাতাও নড়ছে না। মেজর বললেন, সর্বনাশ!
অর্জুন তাকাতে মেজর হিপ পকেট থেকে ছোট চ্যাপটা বস্তুটি বের করে ছিপি খুলে তরল পদার্থ গলায় ঢেলে বললেন, নাইনটিন এইট্টি ওয়ান। প্রায় কুড়ি বছর আগের কথা। ফিজিতে গিয়েছিলাম লাল ঝিনুক দেখতে। আহা, সমুদ্রের নীচে যখন ওরা পাশাপাশি থাকে তখন চোখ জুড়িয়ে যায়! তা একদিন জঙ্গলে ছিলাম। দুপুরবেলা। আচমকা সূর্যের আলো নিভিয়ে দিল বিশাল বিশাল মেঘ। অমনই গাছের পাতাগুলো ওইরকম স্থির হয়ে গেল। তারপরেই টের পেলাম পায়ের তলায় যেন হইচই শুরু হয়ে গেছে। অথচ আমার জুতোর তলায় শুধু মাটি। একটু এগিয়ে দেখলাম তিনটে গর্ত দিয়ে পিলপিল করে বড় বড় পিপড়ে পাগলের মতো বেরিয়ে আসছে। মাটির নীচে ওদের ছুটে চলার কম্পন আমার জুতো ভেদ করে। পায়ে পৌঁছেছিল। আমার সঙ্গী বলল, তাড়াতাড়ি ফিরে চলো। এখনই বৃষ্টি নামবে। আমরা টেন্টে পৌঁছবার এক মিনিট পরে যে বৃষ্টিটা নামল, তা থেমেছিল সাতদিন পরে। সমুদ্রের জল বেড়ে গিয়েছিল, সেই বৃষ্টিতে।
অর্জুন মুখ ফিরিয়ে নিল। তার মুখে হাসি দেখলে মেজর খুশি হবেন না।
বৃষ্টি নামল! তুমুল বৃষ্টি। অথচ সারাদিন মেঘ ছিল না। বৃষ্টি পড়ছে অথচ হাওয়া বইছে না। জেনারেটার চালিয়ে দিয়েছিল বটা। হঠাৎ সেটা শব্দ করে থেমে যেতেই পুরো বাড়ি অন্ধকার হয়ে গেল।
মেজর গলা তুলে বললেন, সবাই এক ঘরে এসে বোসো। মোমবাতি কেউ একজন জ্বেলে দাও।
দেওয়া হল। কেমন একটা গা-থমথমে আবহাওয়া হয়ে গেল। গোরানসাহেবকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছিল। তিনি অর্জুনকে জিজ্ঞেস করলেন, এখানে এভাবে বৃষ্টি শুরু হলে কি অনেকক্ষণ ধরে চলে?
অর্জুন মাথা নাড়ল, না। এখন বর্ষাকাল নয়। তখন পাঁচ-সাতদিনেও বৃষ্টি বন্ধ হয় না। সে বলল, এটা বেশিক্ষণ চলবে বলে মনে হয় না।
বটা তাগাদা দিচ্ছিল। তাড়াতাড়ি ডিনার করে নিলে ও নিষ্কৃতি পাবে। অতএব সবাই খেয়ে নিল। টিনের খাবার বাদ দিয়ে এখন বটার তৈরি খাবারেই সবাই খুশি। খাওয়া শেষ হলে গোরানসাহেবের ঘরে গেল অৰ্জুন আর মেজর। এখন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে বৃষ্টির সঙ্গে। তার আলোয় কাচের জানলার বাইরে পৃথিবীটাকে দেখা যাচ্ছিল মাঝে-মাঝে অস্পষ্ট। এই ঘরটা থেকে বাড়ির পেছনের দিকটা দেখা যায়। বিদ্যুতের আলোয় কবর তিনটে যেন জ্বলে উঠেই নিভে যাচ্ছিল।