গান আর কাজ
কিন্তু ব্যাপারটা কী? আমাদের আধুনিককালের ধারণার সঙ্গে এই কথাগুলির সঙ্গতি নেই। আর তা যদি না থাকে তাহলে এগুলিকে বোঝবার একমাত্র উপায় হতে পারে আধুনিক যুগের সামাজিক পরিবেশটিকে ছেড়ে প্রাচীন সমাজের দিকে চেয়ে দেখা, সন্ধান করা যে এমন কোনো সমাজব্যবস্থা সত্যিই সম্ভব কিনা যেখানে গান আর খাদ্য-উৎপাদন সত্যিই অঙ্গাদি সম্পর্কে সংযুক্ত।
সত্যিই কি ওই রকম কোনো সমাজের খবর জানা আছে? আছে। সে-সমাজ অবশ্যই খুব পিছিয়ে-পড়া সমাজ—তার আদি ও অকৃত্রিম রূপ নিশ্চয়ই আদিম সাম্যসমাজ, যদিও আদিম সাম্যসমাজ ভেঙে যাবার পরও মানুষের চিন্তায় কাজের সঙ্গে গানের যোগাযোগটির রেশ বহুদিন ধরেই থেকে গিয়েছে।
বিষয়টিকে স্পষ্টভাবে বুঝতে সুবিধে হবে অধ্যাপক জর্জ টম্সনের(৮৯) রচনা অনুসরণ করলে।
অধ্যাপক টম্সন শুরু করছেন একেবারে গোড়ার কথা থেকে। গান বা সংগীতের জন্ম হলো কী করে? এ-কথা বুঝতে হলে ভাষার জন্মবৃত্তান্তও মনে রাখা দরকার। কেননা, বাক বা ভাষা ছাড়া গান হয় না—অন্তত আধুনিক যুগের বিশুদ্ধ যন্ত্রসঙ্গীতের বেলায় যাই হোক না কেন, পুরোনো আমলে ভাষা বাদ দিয়ে গানের কথা ভাবা যায় না। উদ্গীথের শব্দার্থ-বিশ্লেষণে ঋষিরাও বলছেন, বাক্-ই গী(৯০)! কিন্তু ভাষার জন্মবৃত্তান্ত অনুসন্ধান করতে হলে মানুষের জন্মবৃত্তান্ত নিয়েও আলোচনা তুলতে হয়, কেননা, মানুষের পক্ষে পশুজগৎ ছেড়ে আসবার পরিচয় প্রধানত দু’দিক থেকে : হাতিয়ার আবিষ্কার ও ভাষা আবিষ্কার। জানোয়ারেরা হাতিয়ার বানাতে পারে না, কথা কইতে পারে না—পৃথিবীতে শুধুমাত্র মানুষই তা পারে।
মানুষের পক্ষে হাতিয়ার আবিষ্কার এবং ভাষা আবিষ্কার—দুটো খুব স্বতন্ত্র ঘটনা নয়। হাতিয়ারের সাহায্যে মানুষ উৎপাদন-কাজে আত্মনিয়োগ করতে পারলো। কিন্তু গোড়ার দিকে কারুর পক্ষেই এই উৎপাদন-কাজ একাএকা সম্পাদন করা সম্ভব নয়—দশহাত এক হয়ে একসঙ্গে কাজ করেছে। আর এরই দরুন পরস্পরের মধ্যে চিন্তার আদান-প্রদানের প্রয়োজন দেখা দিলো—সেই তাগিদেই মানুষের কণ্ঠস্বরের সঙ্গে সংযোজিত হতে লাগলো অর্থ : মানুষ আর জানোয়ারদের মতো চিৎকার করে না, রীতিমতো কথা বলে। পুরো দলের ওই একান্ত দলগত কাজটিকে সুনিয়ন্ত্রিত করবার তাগিদেই মানুষের ভাষা উন্নত হতে লাগলো। তাই গোড়ার দিকে হাতের কাজের সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গি(৯১)।
শিশুরা কথা বলবার সময় খু বেশি অঙ্গভঙ্গি করে যদি মানবজাতিরও শৈশবকে পরীক্ষা করা যায় তাহলে চোখে পড়ে কথা বলার সঙ্গে হাত নাড়ানোর যোগাযোগটা কতো ঘনিষ্ঠ। আমরাও হয়তো মুখের কথাকে ভালো করে বোঝাবার জন্যে অল্পবিস্তর হাত নাড়াই—অঙ্গভঙ্গি করি। কিন্তু অসভ্য মানুষদের বেলায় ঠিক তা নয়—অন্যেরা যাতে কথাটাকে আরো ভালো করে বুঝতে পারে এইজন্যে তারা হাত নাড়ায় না। কেননা, বৈজ্ঞানিকেরা লক্ষ্য করেছেন যে, ওরা যখন আপন মনে কথা বলে তখনো প্রচুর অঙ্গভঙ্গি করে(৯২)। আমাদের কাছে কথাটাই মূখ্য, অঙ্গভঙ্গিটুকু গৌণ। কিন্তু আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে তা নয়। কেননা, হাতের কাজের সংগেই তাদের মুখের ভাষা ফুটেছিল। আদিম মানুষদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে যাঁরাই গবেষণা করেছেন তাঁরাই বলছেন, ওদের বেলায় মুখের ভাষাটা অনেকাংশেই হাতের অঙ্গভঙ্গির উপর নির্ভরশীল। অধ্যাপক টম্সন নজির দিচ্ছেন গ্রে, স্মাইথ, রট্টে প্রভৃতি বৈজ্ঞানিকদের(৯৩)। অর্ধশতাব্দী আগেই এই সব সাক্ষ্যের ভিত্তিতে বূশের(৯৪) প্রমাণ করতে ছিলেন, হাতিয়ার-ব্যবহারের দরুন পেশীগুলিতে যে-জোর পড়ে তারই প্রতিবর্তী-ক্রিয়া হিসেবে স্বরতন্ত্রের প্রতিক্রিয়াটি থেকেই মানুষের গলায় ভাষা ফুটে উঠেছিলো। তারপর, হাতের কাজের যতো উন্নতি হয়েছে ততোই উন্নত হয়েছে স্বরতন্ত্র এবং শেষ পর্যন্ত মানুষের চেতনাও উন্নত হতে হতে একটা পর্যায়ে পৌঁছে দেখা গেলো এই প্রতিবর্তী ক্রিয়াটিকেই তারা সচেতনভাবে ভাবের আদান-প্রদান কাজে নিযুক্ত করতে পারছে।
শ্রমের সঙ্গে ভাষার এই সংযোগটিকে আজো খুঁজে পাওয়া যায় শ্রম-সঙ্গীত বা ‘কাজের গান’-এর মধ্যে। যে-সব দেশে কলকারখানার শব্দে শ্রমিকদের কণ্ঠস্বর একেবারে চাপা পড়ে যায় নি সেই সব দেশে কলকারখানার শব্দে শ্রমিকদের কণ্ঠস্বর একেবারে চাপা পড়ে যায় নি। সেই সব দেশে ওই শ্রম-সঙ্গীত শুনতে পাওয়া একটুও কঠিন নয়(৯৫)। নৌকো বাওয়ার গান, ধান কাটার গান থেকে শুরু করে ছাদ পেটাবার গান বা শ্রমিকদের পক্ষে প্রকাণ্ড ভারি কিছু টানবার সময়কার গানগুলোকে একটুখানি নজর করলেই বোঝা যাবে, এ-সব ক্ষেত্রে কাজ শুধুমাত্র হাতের উপর নির্ভর করছে না, ভাষার উপরও নির্ভর করছে, অবশ্যই সে-ভাষার সঙ্গে সংযোজিত হয়েছে সুর। তারই নাম গান। এ-গান মোটেই অবসর-বিনোদন নয়—কাজের অঙ্গ। বিশজন শ্রমিক মিলে যখন একটা ভারি কাজ করছে তখন সর্দার দাঁড়িয়ে গানের দায়িত্ব নিয়েছে এবং সে নিজে কাজে হাত লাগাচ্ছে না বলে বাকি শ্রমিকদের মনে কোনো বিক্ষোভ নেই। কেননা, তার ওই গানের দরুনই বাকি বিশজনের পক্ষে অমন শ্রমসাধ্য কাজটাও সহজসাধ্য হয়। গান এখানে শ্রমকে সাহায্য করছে—সবাইকেই একসঙ্গে একতালে একটি কাজ করবার অবস্থায় এনে প্রত্যেকেরই শ্রমলাঘব করছে।
অসভ্য মানুষদের মধ্যে এই শ্রম-সঙ্গীদের তাৎপর্য আরো অনেক স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে। যখনই তারা কোনোরকম শ্রমসাধ্য কাজে লিপ্ত হয় তখনই যেন স্বতঃস্ফূর্তভাবেই তাদের ম্যখে গান জেগে ওঠে। মেয়েরা দৈনন্দিন কাজ ছাড়া করতে পারে কিনা সন্দেহ(৯৬)!
বূশের প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, কাজের তাল থেকেই মানুষের ভাষায় ছন্দের জন্ম হয়েছে। তাঁর সিদ্ধান্ত আরো স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে পরবর্তী কালের গবেষনায়।
———————
৮৯. G. Thomson SAGS ch. Xiv.
৯০. ছান্দোগ্য উপনিষদ ১.৩.৬।
৯১. G. Thomson FP ch. I.
৯২. G. Thomson SAGS 445.
৯৩. Ibid 446.
৯৪. Ibid
৯৫. Ibid
৯৬. Ibid