উত্তর কহেন তবে ধনঞ্জয় প্রতি।
রথ চালাইয়া তুমি দেহ শীঘ্রগতি।।
যথায় কৌরব-সৈন্য, করহ গমন।
সাক্ষাতে দেখহ আজি তাদের মরণ।।
এত গর্ব্বী হৈল সবে, হরে মম গরু।
তার সমুচিত ফল পাবে আজি কুরু।।
পুনঃ পুনঃ প্রতিশ্রুতি করি বীর কয়।
হাসি রথ চালালেন বীর ধনঞ্জয়।।
আকাশে উঠিল রথ চক্ষুর নিমিষে।
মুহূর্ত্তেকে উত্তরিল কুরুসৈন্য পাশে।।
ব্যস্ত হয়ে রাজসুত অর্জ্জুনেরে বলে।
কেমন চালাহ রথ, কোথায় আনিলে।।
তথায় লইবে রথ, যথায় গোধন।
আনিলে সাগর মধ্যে বল কি কারণ।।
পর্ব্বত প্রমাণ উঠে লহরী হিল্লোল।
কর্ণেতে না শুনি কিছু পূরিল কল্লোল।।
নৌকাবৃন্দ দেখি মম আকুলিত চিত্ত।
জলজন্তু কলরব করে অপ্রমিত।।
হাসিয়া অর্জ্জুন তবে বলিবলেন তায়।
সমুদ্র প্রমাণ বটে, জলনিধি প্রায়।।
ধবল আকার যত দেখহ কুমার।
জল নহে, এই সব গোধন তোমার।।
নৌকাবৃন্দ নহে, সব মাতঙ্গ-মণ্ডল।
না হয় লহরী, রথ পতাকা সকল।।
সৈন্য কোলাহল-শব্দ সিন্ধু-শব্দ প্রায়।
কৌরবের সৈন্য এই, জানাই তোমায়।।
উত্তর বলিল, মোর মন নাহি লয়।
না জানহ বৃহন্নলা, সমুদ্র নিশ্চয়।।
সমুদ্র না হয় যদি হবে সৈন্যগণ।
এ সৈন্য সহিত তবে কে করিবে রণ।।
দেবের দুস্তর এই সৈন্য সিন্ধুমত।
মানুষে কি শক্তি ধরে তাহার অগ্রতঃ।।
এত সৈন্য বলি মোর নাহি ছিল জ্ঞান।
জন কত লোক বলি ছিল অনুমান।।
মহা মহা রথিগণ দেখি হৈল ভয়।
পৃথিবীর ক্ষত্র যার নামে কম্প হয়।।
দেবতা তেত্রিশ কোটি লয়ে পুরন্দর।
না পারিলে যার সহ করিতে সমর।।
যথা ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ অশ্বত্থামা কৃপ।
বিবিংশতি দুঃশাসন দুর্য্যোধন নৃপ।।
কুবুদ্ধি লাগিল মোরে হইনু অজ্ঞান।
তেঁই কুরু-সৈন্য মধ্যে করিনু প্রয়াণ।।
থাকুক যুদ্ধের কাজ, দেখি ছন্ন হৈনু।
শরীর ছাড়িল প্রাণ, তোমারে কহিনু।।
ত্রিগর্ত্তের সহ রণে পিতা মোর গেল।
এক গোটা পদাতিক পুরে না রাখিল।।
এক মোরে রাখি গেল রাজ্যের রক্ষণে।
মোর কিবা শক্তি কুরুরাজ সহ রণে।।
কহ বৃহন্নলা, তব কিবা মনে আসে।
তবু রথ রাখিয়াছ কেমন সাহসে।।
শীঘ্র রথ বাহুড়াহ পাছে কুরু দেখে।
ধেনু হেতু মিথ্যা কেন মরিব বিপাকে।।
উত্তর-বচনে হাসি কন ধনঞ্জয়।
শত্রু দেখি কিবা হেতু এত তব ভয়।।
কৃষ্ণবর্ণ হৈল মুখ শীর্ণ হৈল অঙ্গ।
জিহ্বাতে উড়িল ধূলি, কম্পে কর জঙ্ঘ।।
না করিয়া যুদ্ধ তব দেখি হৈল ডর।
কোন্ মুখে বাহুড়িয়া পুনঃ যাবে ঘর।।
কহিলে যে রথ বাহুড়াহ শীঘ্রগতি।
চিত্তেনা করিহ, আমি এমন সারথি।।
না করিয়া কার্য্যসিদ্ধি বাহুড়াব কেনে।
পূর্ব্বে কহিয়াছি, তাহা ভুলিলে এক্ষণে।।
কিসের কারণে আমি রথ বাহুড়িব।
সর্ব্বসৈন্য মধ্যে রথ এখনি লইব।।
স্ত্রীগণের মধ্যে যত প্রতিজ্ঞা করিলে।
কি কহিবে, তারা সবে এ কথা শুনিলে।।
যুদ্ধ-ভয় ত্যজ এবে, ধর বীরপণ।
ধনু ধরি নিজ বলে জিন কুরুগণ।।
কুরু জিনি গোধনেরে নাহি লয়ে গেলে।
মহা লজ্জা হবে তবে পৃথিবী মণ্ডলে।।
হাসিবেক যত লোক সর্ব্ব ক্ষত্রগণ।
হাসিবেক নারীলোক আর যত জন।।
আমার সারথ্য-গুণ সৈরন্ধ্রী কহিল।
তব সঙ্গে আসি মোর সব নষ্ট হৈল।।
তোমার এ কর্ম্ম যদি পূর্ব্বেতে জানিব।
তবে কেন তব সঙ্গে সংগ্রামে আসিব।।
হাসিবেক অন্তঃপুরে নারী পুনঃ পুনঃ।
কহিল সৈরন্ধ্রী মিথ্যা বৃহন্নলা গুণ।।
যে জনের কর্ম্মে লোকে করে উপহাস।
নিন্দিত জীবনে তার কিবা হেতু আশ।।
উপহাস হৈতে মৃত্যু বরং শ্রেষ্ঠ কর্ম্ম।
বিশেষ ক্ষত্রিয়ে যুদ্ধে মৃত্যু বড় ধর্ম্ম।।
ইহা না করিয়া আমি বাহুড়িব কেনে।
ধৈর্য্য ধরি যুদ্ধ কর, ভয় ত্যজ মনে।।
উত্তর বলিল, কিবা কহ বৃহন্নলা।
মহাসিন্ধু পার হৈতে বান্ধ তৃণভেলা।।
অগ্নির কি করিবেক পতঙ্গ-শকতি।
মত্তগজ আগে কোথা শশকের গতি।।
মৃত্যু সহ বিবাদেতে বাঁচে কোন্ জন।
দেখি ফণিমুখে হস্ত দিব কি কারণ।।
জীবন থাকিলে সব পাব পুনর্ব্বার।
গবী-রত্ন নিক মোর, হাসুক সংসার।।
হাসুক রমণীগণ, আর বীরগণ।
ঘরে যাব, যুদ্ধে মোর নাহি প্রয়োজন।।
দৈবে নপুংসক তুমি, হীন সর্ব্বসুখে।
তেঁই মৃত্যু শ্রেয়ঃ বলি কহ নিজমুখে।।
জীবন মরণ তব একই সমান।
তব বোলে কি কারণে হারাব পরাণ।।
সমানের সহ ক্ষত্র করিবেক রণ।
লজ্জা নাহি বলবানে দেখি পলায়ন।।
মোর বোলে যদি তুমি না ফিরাও রথ।
পদব্রজে চলি আমি যাব এই পথ।।
এত বলি ফেলাইয়া দিল শরচাপ।
রথ হৈতে ভূমিতলে পড়ে দিয়া লাফ।।
শীঘ্রগতি চলি যায় নিজ রাজ্যমুখে।
রহ রহ বলি ডাকে ধনঞ্জয় তাকে।।
হেন অপকীর্ত্তি করি জীয়ে কোন্ ফল।
এত বলি নিজে পার্থ নামে ভূমিতল।।
ভরত-পঙ্কজ-রবি মহামুনি ব্যাস।
বিরচিল পাঁচালি প্রবন্ধে কাশীদাস।।