[লণ্ডনে প্রদত্ত বক্তৃতা, ১৭ই নভেম্বর, ১৮৯৬]
পূর্বোক্ত (ছান্দোগ্য) উপনিষদ্ হইতেই আমরা পাইতেছি যে, দেবর্ষি নারদ এক সময় সনৎকুমারের নিকট আগমন করিয়া অনেক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলেন। সনৎকুমার তাঁহাকে সোপানারোহণ-ন্যায়ে ধীরে ধীরে লইয়া গিয়া অবশেষে আকাশতত্ত্বে উপনীত হইলেন। ‘আকাশ তেজ হইতে মহত্তর , কারণ আকাশে চন্দ্র সূর্য বিদ্যুৎ তারা—সকলেই রহিয়াছে। আকাশেই আমরা শ্রবণ করিতেছি, আকাশেই জীবনধারণ করিয়া আছি, আকাশেই আমরা মরিতেছি।’১ এখন প্রশ্ন হইতেছে—আকাশ হইতে মহত্তর কিছু আছে কিনা? সনৎকুমার বলিলেন, প্রাণ আকাশ হইতেও বড়। বেদান্তমতে এই প্রাণই জীবনের মূলীভূত শক্তি। আকাশের ন্যায় ইহাও একটি সর্বব্যাপী তত্ত্ব, আর আমাদের শরীরে বা অন্যত্র যাহা কিছু গতি দেখা যায়, সবই প্রাণের কার্য। প্রাণ আকাশ হইতেও মহত্তর। প্রাণের দ্বারাই সকল বস্তু বাঁচিয়া রহিয়াছে, প্রাণই মাতা, প্রাণই পিতা, প্রাণই ভগিনী, প্রাণই আচার্য, প্রাণই জ্ঞাতা।
আমি তোমাদের নিকট ঐ উপনিষদ্ হইতেই আর এক অংশ পাঠ করিব। শ্বেতকেতু পিতা আরুণির নিকট সত্য সম্বন্ধে প্রশ্ন করতে লাগিলেন। পিতা তাঁহাকে নানা বিষয় শিখাইয়া অবশেষে বলিলেন, ‘এই-সকল বস্তুর যে সূক্ষ্ম কারণ, তাহা হইতেই ইহারা নির্মিত, ইহাই সব, ইহাই সত্য; হে শ্বেতকেতো, তুমি তাহাই।’ তারপর তিনি ইহা বুঝাইবার জন্য নানা উদাহরণ দিতে লাগিলেন। ‘হে শ্বেতকেতো, যেমন মধুমক্ষিকা বিভিন্ন পুষ্প হইতে মধু সঞ্চয় করিয়া একত্র করে এবং এই বিভিন্ন মধু যেমন জানে না, তাহারা কোথা হইতে আসিয়াছে, সেইরূপ আমরাও সেই সৎ হইতে উৎপন্ন হইয়াও ভুলিয়া গিয়াছি। হে শ্বেতকেতো, তুমি তাহাই।’
———-
১ ছান্দোগ্য উপ., ৭/১২/১
‘যেমন বিভিন্ন নদী বিভিন্ন স্থানে উৎপন্ন হইয়া সমুদ্রে পতিত হয়, কিন্তু এই নদীসকল যেমন জানে না, ইহারা কোথা হইতে উৎপন্ন হইয়াছে, সেইরূপ আমরাও সেই সৎস্বরূপ হইতে আসিয়াছি বটে, কিন্তু আমরা জানি না যে আমরা তাহাই। হে শ্বেতকেতো, তুমি তাহাই।’১ পিতা পুত্রকে এইরূপ উপদেশ দিতে লাগিলেন।
এখন কথা এই, সকল জ্ঞানলাভের দুইটি মূলসূত্র আছে। একটি সূত্র এই—বিশেষকে সাধারণে এবং সাধারণকে আবার সার্বভৌম তত্ত্বে সমাধান করিয়া জ্ঞানলাভ করিতে হইবে। দ্বিতীয় সূত্র এই : যে-কোন বস্তু ব্যাখ্যা করিতে হইবে, যতদূর সম্ভব সেই বস্তুর স্বরূপ হইতেই তাহার ব্যাখ্যা অন্বেষণ করিতে হইবে। প্রথম সূত্রটি ধরিয়া আমরা দেখিতে পাই, আমাদের সমুদয় জ্ঞান বাস্তবিক উচ্চ হইতে উচ্চতর শ্রেণীবিভাগ মাত্র। একটা কিছু যখন ঘটে, তখন আমরা যেন অতৃপ্ত হই। যখন ইহা দেখানো যায় যে, সেই একই ঘটনা পুনঃ পুনঃ ঘটিতেছে, তখন আমরা তৃপ্ত হই এবং উহাকে ‘নিয়ম’ আখ্যা দিয়া থাকি। যখন একটি প্রস্তর অথবা আপেল পড়িতে দেখি, তখন আমরা অতৃপ্ত হই; কিন্তু যখন দেখি, সকল প্রস্তর বা আপেলই পড়িতেছে, তখন আমরা উহাকে মাধ্যাকর্ষণের নিয়ম বলি এবং তৃপ্ত হই। ব্যাপার এই, আমরা বিশেষ হইতে সাধারণ তত্ত্বে গমন করিয়া থাকি। যদি ধর্মতত্ত্ব আলোচনা করিতে চাই, সেখানেও ইহাই একমাত্র বৈজ্ঞানিক প্রণালী।
ধর্মতত্ত্ব আলোচনা করিতে গেলে এবং উহাকে বৈজ্ঞানিকভাবে করিতে গেলে আমাদিগকে এই মূলসূত্রের অনুসরণ করিতে হইবে। বাস্তবিক আমরা দেখিতে পাই, এই প্রণালীই অনুসৃত হইয়াছে। এই উপনিষদ্, যাহা হইতে তোমাদিগকে শুনাইতেছি, তাহাতেও দেখিতে পাই, সর্বপ্রথমে এই ভাবের উদয় হইয়াছে—বিশেষ হইতে সাধারণে গমন। আমরা দেখিতে পাই—কিভাবে দেবতাগণ ক্রমশঃ পরস্পর অন্তর্ভুক্ত হইয়া এক তত্ত্বরূপে পরিণত হইতেছেন; জগতের ধারণায়ও তাঁহারা ক্রমশঃ অগ্রসর হইতেছেন, কেমন সূক্ষ্ম ভূত হইতে সূক্ষতর ও ব্যাপকতর ভূতে যাইতেছেন, কেমন তাঁহারা বিশেষ বিশেষ ভূত হইতে আরম্ভ করিয়া অবশেষে এক সর্বব্যাপী আকাশতত্ত্বে উপনীত হইয়াছেন, কিভাবে সেখান হইতেও অগ্রসর হইয়া তাঁহারা প্রাণ-নামক সর্বব্যাপিনী শক্তিতে উপনীত হইতেছেন, আর এই-সকলের ভিতরে আমরা এই এক তত্ত্বই পাইতেছি যে, একটি বস্তু অন্য সকল বস্তু হইতে পৃথক্ নহে।আকাশই সূক্ষ্মতররূপে প্রাণ এবং প্রাণ আবার স্থূল হইয়া আকাশ হয়, আকাশ আবার স্থূল হইতে স্থূলতর হইতে থাকে, ইত্যাদি।
———-
১ ছান্দোগ্য উপ, ৬। ৯ -১০
সগুণ ঈশ্বর এই মূলসূত্রের আর একটি উদাহরণ। আমরা পূর্বেই দেখিয়াছি, সগুণ ঈশ্বরের ধারণাও এইরূপ সমান্যীকরণের ফল। ইহা হইতে পাওয়া গিয়াছে এইটুকু যে, সগুণ ঈশ্বর সমুদয় জ্ঞানের সমষ্টিস্বরূপ। কিন্তু ইহাতে একটি শঙ্কা উঠিতেছে, ইহা তো পর্যাপ্ত সামান্যীকরণ হইল না! আমরা প্রকৃতিক ঘটনার একটা দিক অর্থাৎ জ্ঞানের দিক লইলাম, তাহা হইতে সামান্যীকরণ-প্রণালীতে সগুণ ঈশ্বরে উপনীত হইলাম, কিন্তু বাকি প্রকৃতির অন্যদিক বাদ গেল। সুতরাং প্রথমতঃ এই সমান্যীকরণ অসম্পূর্ণ। ইহাতে আর একটি ত্রুটি আছে, তাহা দ্বিতীয় সূত্রের অন্তর্গত। প্রত্যেক বস্তুকে তাহার নিজের ভাব হইতেই ব্যাখ্যা করিতে হইবে। অনেক লোক হয়তো এক সময়ে ভাবিত, মাটিতে যাহা কিছু পড়ে, তাহা ভূতেই ফেলিতেছে, কিন্তু মাধ্যাকর্ষণই বাস্তবিক ইহার ব্যাখ্যা; আর যদিও আমরা জানি, ইহা সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা নহে, তথাপি ইহা অপর ব্যাখ্যা হইতে যে শ্রেষ্ঠ, তাহা নিশ্চয়; কারণ একটি ব্যখ্যা বস্তুর বহিঃস্থ কারণ হইতে, অন্যটি বস্তুর স্বভাব হইতে লব্ধ। এইরূপ আমাদের সমুদয় জ্ঞানের সম্বন্ধেই। যে-কোন ব্যাখ্যা বস্তুর প্রকৃতি হইতে লব্ধ, তাহা বৈজ্ঞানিক; আর যে-কোন ব্যাখ্যা বস্তুর বহির্দেশ হইতে লব্ধ, তাহা অবৈজ্ঞানিক।
এখন ‘সগুণ ঈশ্বরের জগতের সৃষ্টিকর্তা’—এই তত্ত্বটিকেও এই সূত্রটি দ্বারা পরীক্ষা করা যাক। যদি এই ঈশ্বর প্রকৃতির বহির্দেশে থাকেন, যদি প্রকৃতির সঙ্গে তাঁহার কোন সম্বন্ধ না থাকে এবং যদি এই প্রকৃতি শূন্য হইতে—সেই ঈশ্বরের আজ্ঞা হইতে উৎপন্ন হয়, তাহা হইলে স্বভাবতই ইহা অতি অবৈজ্ঞানিক মত হইয়া দাঁড়াইল। আর চিরকাল সগুণ ঈশ্বরবাদের ইহাই একটি দুর্বলতা। এই মতে ঈশ্বর মানবগুণসম্পন্ন, কেবল মানবীয় গুণগুলি অনেক পরিমাণে বর্ধিত। ঈশ্বর শূন্য হইতে এই জগৎ সৃষ্টি করিয়াছেন, অথচ তিনি জগৎ হইতে সম্পূর্ণ পৃথক্—একেশ্বরবাদে এই দুইটি দোষ দেখিতে পাওয়া যায়।
আমরা পূর্বেই দেখিয়াছি, প্রথমতঃ সগুণ ঈশ্বরবাদ পর্যাপ্ত সামান্যীকরণ নয়। দ্বিতীয়তঃ ইহা প্রকৃতি হইতে প্রকৃতির ব্যাখ্যা নয়। এই মতবাদে কারণ হইতে কার্য সম্পূর্ণ পৃথক্। কিন্তু মানুষ যতই জ্ঞানলাভ করিতেছে, ততই তাহার এই ধারণা বাড়িতেছে যে, কার্য কারণের রূপান্তরমাত্র।আধুনিক বিজ্ঞানের সমুদয় আবিষ্ক্রিয়া এই দিকেই ইঙ্গিত করিতেছে, আর আধুনিক সর্ববাদিসম্মত ক্রমবিকাশবাদের তাৎপর্যই এই যে, কার্য কারণের রূপান্তরমাত্র। এই কারণ ও আবার এক পুরাতন কারণের কার্য। শূন্য হইতে সৃষ্টি—আধুনিক বৈজ্ঞানিকদের নিকট উপহাসের বিষয়।
ধর্ম কি পূর্বোক্ত দুইটি পরীক্ষার পর টিকিয়া থাকিতে পারে? যদি এমন কোন ধর্মমত থাকে, যাহা এই দুইটি পরীক্ষায় টিকিয়া যায়, তাহাই আধুনিক চিন্তাশীল মনের গ্রাহ্য হইবে। যদি আজকালকার মানুষকে পুরোহিত, গির্জা অথবা কোন শাস্ত্রের নজির দেখাইয়া কোন মত বিশ্বাস করিতে বলা যায়, তবে সে উহা বিশ্বাস করিতে পারিবে না; তাহার ফল দাঁড়াইবে—ঘোর অবিশ্বাস। যাহারা বাহিরে দেখিতে খুব বিশ্বাসী, তাহারা বাস্তবিক ভিতরে প্রচণ্ড অবিশ্বাসী। অবশিষ্ট লোকে ধর্ম একেবারে ছাড়িয়া দেয়, উহা হইতে দূরে পলাইয়া যায়, যেন ধর্মের সহিত কোন সম্পর্কই রাখিতে চায় না, ধর্মকে তাহারা পুরোহিতদের জুয়াচুরি মনে করে।
ধর্ম এখন একপ্রকার জাতীয় ভাবে পরিণত হইয়াছে। ধর্ম আমাদের প্রাচীন সমাজের একটি মহান্ উত্তরাধিকার, অতএব ইহাকে থাকিতে দাও—ইহাই আমাদের ভাব। কিন্তু আধুনিক লোকের পূর্বপুরুষ ধর্মের জন্য যে প্রকৃত আগ্রহ বোধ করিতেন, এখন তাহা নাই; লোকে ধর্মকে এখন আর যুক্তিসঙ্গত মনে করে না। এইরূপ সগুণ ঈশ্বর ও সৃষ্টির ধারণা, যাহাকে সচরাচর সকল ধর্মেই ‘একেশ্বরবাদ’ বলে, তাহাতে এখন লোকের প্রাণ তৃপ্ত হয় না, আর ভারতে বৌদ্ধদের প্রভাবে একেশ্বরবাদ প্রবল হইতে পারে নাই; এবং এই বিষয়েই বৌদ্ধেরা প্রাচীনকালে জয়লাভ করিয়াছিলেন। তাঁহারা দেখাইয়া দিলেন যে, যদি প্রকৃতিকে অনন্তশক্তিসম্পন্ন বলিয়া মানা যায়, যদি প্রকৃতি নিজের অভাব নিজে পূরণ করিতে পারে, তবে প্রকৃতির অতীত কিছু আছে, ইহা স্বীকার করা অনাবশ্যক। আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করিবারও কোন প্রয়োজন নাই। এই বিষয়ে প্রাচীনকাল হইতে একটি তর্ক-বিতর্ক চলিয়া আসিতেছে। এখনও সেই প্রাচীন কুসংস্কার বর্তমান রহিয়াছে—দ্রব্য ও গুণের বিচার।
ইওরোপে মধ্যযুগে, এমন কি দুঃখের সহিত আমাকে বলিতে হইতেছে, তাহার অনেকদিন পরেও একটি বিশেষ বিচারের বিষয় ছিল : গুণগুলি কি দ্রব্যের ভিতরে আছে, না গুণ ব্যতীত দ্রব্যের অস্তিত্ব আছে? দৈর্ঘ, প্রস্থ, বেধ কি জড়পদার্থ-নামক দ্রব্যবিশেষে লাগিয়া আছে? আর এই গুণগুলি না থাকিলেও দ্রব্যটির অস্তিত্ব থাকে কি না? বৌদ্ধ দার্শনিক বলিতেছেন , এরূপ একটি দ্রব্যের অস্তিত্ব স্বীকার করার কোন প্রয়োজন নাই, এই গুণগুলিরই কেবল অস্তিত্ব আছে। ইহার অতিরিক্ত তুমি আর কিছুই দেখিতে পাও না। ইহাই অধিকাংশ আধুনিক অজ্ঞেয়বাদীদের মত, এই দ্রব্যগুণের বিচার আর একটু উচ্চভূমিতে লইয়া গেলে দেখা যায়, ইহা ব্যাবহারিক ও পারমার্থিক সত্তার বিচারে পরিণত হইয়াছে। এই দৃশ্য জগৎ—নিত্যপরিণামশীল জগৎ রহিয়াছে, এবং ইহার পিছনে এমন কিছু রহিয়াছে, যাহার কখন পরিণাম হয় না; কেহ কেহ বলেন, এই দ্বিবিধ পদার্থেরই অস্তিত্ব আছে। আবার অধিকতর যুক্তির সহিত অপরে বলেন, এই উভয় পদার্থ মানিবার কোন আবশ্যকতা নাই, আমরা যাহা দেখি, অনুভব করি বা চিন্তা করি, তাহা ‘দৃশ্য’ মাত্র। দৃশ্যের অতিরিক্ত কোন পদার্থ মানিবার কোন অধিকার আমাদের নাই। এই কথার কোন সঙ্গত উত্তর প্রাচীনকালে কেহ দিতে পারেন নাই। কেবল বেদান্তের অদ্বৈতবাদ হইতে আমরা ইহার উত্তর পাইয়া থাকি—কেবল একটি বস্তুর অস্তিত্ব আছে, তাহাই কখন দ্রষ্টারূপে কখন বা দৃশ্যরূপে প্রকাশ পাইতেছে। ইহা সত্য নহে যে, পরিণামশীল বস্তুর সত্তা আছে, আর তাহারই অভ্যন্তরে—অপরিণামী বস্তুও রহিয়াছে ; সেই এক অপরিণামী বস্তুই পরিণামশীল বলিয়া প্রতিভাত হইতেছে।
বুঝিবার উপযুক্ত একটি দার্শনিক সিদ্ধান্ত করিবার জন্য আমরা দেহ, মন, আত্মা প্রভৃতি নানা ভেদ করিয়া থাকি, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে একটি সত্তাই বিরাজিত। সেই এক বস্তুই নানারূপে প্রতিভাত হইতেছে। অদ্বৈতবাদীদের চিরপরিচিত উপমা অনুসারে বলিতে গেলে বলিতে হয়, রজ্জুই সর্পাকারে প্রতিভাত হইতেছে। অন্ধকারবশতঃ অথবা অন্য কোন কারণে অনেকে রজ্জুকে সর্প বলিয়া ভ্রম করিয়া থাকে, কিন্তু জ্ঞানের উদয় হইলে সর্পভ্রম ঘুচিয়া যায়, তখন রজ্জুকে রজ্জু বলিয়াই বোধ হয়। এই উদাহরণের দ্বারা আমরা বেশ বুঝিতেছি—মনে যখন সর্পজ্ঞান থাকে, তখন রজ্জুজ্ঞান থাকে না, আবার যখন রজ্জুজ্ঞানের উদয় হয়, তখন সর্পজ্ঞান চলিয়া যায়। যখন আমরা ব্যাবহারিক সত্তা দেখি, তখন পারমার্থিক সত্তা থাকে না; আবার যখন আমরা সেই অপরিণামী পারমার্থিক সত্তা দেখি, তখন অবশ্যই ব্যাবহারিক সত্তা আর প্রতিভাত হয় না।
এখন আমরা প্রত্যক্ষবাদী ও বিজ্ঞানবাদী (Realist and Idealist)উভয়েরই মত বেশ পরিষ্কার বুঝিতেছি। প্রত্যক্ষবাদী কেবল ব্যাবহারিক সত্তা দেখেন, আর বিজ্ঞানবাদী পারমার্থিক সত্তার দিক দেখিতে চেষ্টা করেন। প্রকৃত বিজ্ঞানবাদী, যিনি অপরিনামী সত্তাকে প্রত্যক্ষ করিয়াছেন, তাঁহার পক্ষে পরিণামশীল জগৎ আর থাকে না; তাঁহারই কেবল বলিবার অধিকার আছে যে, জগৎ সমস্তই মিথ্যা, পরিণাম বলিয়া কিছুই নাই। প্রত্যক্ষবাদী কিন্তু পরিণামের দিকেই লক্ষ্য করিয়া থাকেন, তাঁহার পক্ষে অপরিণামী সত্তা বলিয়া কিছু নাই, সুতরাং তাঁহার বলিবার অধিকার আছে—এ-সবই সত্য।
এই বিচারের ফল কি হইল? ফল হইল এই যে, ঈশ্বরের সগুণ ধারণা যথেষ্ট নহে। আমাদিগকে আরও উচ্চতর ধারণা অর্থাৎ নির্গুণের ধারণা করিতে হইবে। উহা দ্বারা যে সগুণ ধারণা নষ্ট হইবে, তাহা নহে। সগুণ ঈশ্বরের অস্তিত্ব নাই—প্রমাণ করিতেছি না, কিন্তু দেখাইতেছি, যাহা আমরা প্রমাণ করিলাম, তাহাই একমাত্র ন্যায়সঙ্গত সিদ্ধান্ত। মানুষকেও আমরা এইরূপে সগুণ-নির্গুণ উভয়াত্মক বলিয়া থাকি। আমরা সগুণও বটে, আবার নির্গুণও বটে। অতএব আমাদের প্রাচীন ঈশ্বরধারণা, অর্থাৎ ঈশ্বরের সগুণ ধারণা, তাঁহাকে কেবল একটি ব্যক্তি বলিয়া ধারণা—অবশ্যই চলিয়া যাওয়া চাই, কারণ মানুষকে যেভাবে সগুণ নির্গুণ উভয়ই বলা যায়, আর একটু উচ্চতর ভাবে ঈশ্বরকেও সেইভাবে সগুণ নির্গুন দুইই বলা যায়। অতএব সগুণের ব্যাখ্যা করিতে হইলে অবশ্যই আমাদিগকে অবশেষে নির্গুণ ধারণায় যাইতে হইবে, কারণ নির্গুণ ধারণা সগুণ ধারণা হইতে আরও ব্যাপক। কেবল নির্গুনই অনন্ত হইতে পারে, সগুণ সান্ত মাত্র। অতএব এই দ্বারা ব্যাখ্যা আমরা সগুনকে রক্ষাই করিলাম, উড়াইয়া দিলাম না। অনেক সময়ে এই সংশয় আসে—নির্গুণ ঈশ্বরের ধারণায় সগুণ ধারণা নষ্ট হইয়া যাইবে, নির্গুণ জীবাত্মার ধারণায় সগুণ জীবাত্মার ভাব নষ্ট হইয়া যাইবে; বাস্তবিক কিন্তু বেদান্তমতে ‘আমিত্বের’ নাশ হয় না, উহাকে প্রকৃতভাবে রক্ষা করা হইয়া থাকে। আমরা সেই অনন্ত সত্তার সমাধান না করিয়া ব্যক্তির অস্তিত্ব কোন-রূপে প্রমান করিতে পারি না। যদি আমরা ব্যক্তিকে সমুদয় জগৎ হইতে পৃথক্ করিয়া ভাবিতে চেষ্টা করি, তবে কখনই তাহাতে সমর্থ হইব না, ক্ষণকালের জন্যও ঐরূপ ভাবা যায় না।
দ্বিতীয়তঃ পূর্বোক্ত দ্বিতীয় তত্ত্বের আলোকে আমরা আরও কঠিন ও দুর্বোধ্য তত্ত্বে উপনীত হই। সামান্যীকরণ-প্রক্রিয়ায় আমরা যে সর্বোচ্চ তত্ত্বে উপনীত হইয়াছি, যদি সকল বস্তুকে তদনুযায়ী তাহার স্বরূপ হইতে ব্যাখ্যা করিতে হয়, তাহা হইলে এই দাঁড়ায় যে, সেই নির্গুণ পুরুষ আমাদের ভিতরেই রহিয়াছেন, বাস্তবিকপক্ষে আমরা তিনিই। ‘হে শ্বেতকেতো, তত্ত্বমসি’১ —তুমি তিনিই, তুমিই সেই নির্গুন সত্তা; তুমিই সেই ব্রহ্ম, যাঁহাকে সমুদয় জগতে খুঁজিয়া বেড়াইতেছে, সর্বদাই তুমি সেই! কিন্তু ‘ব্যক্তি’-অর্থে ‘তুমি’ নহে, নির্গুণ-অর্থে। আমরা এই যে মানুষকে জানিতেছি, যাঁহাকে ব্যক্ত দেখিতেছি, তিনি সগুণ ব্যক্তি হইয়াছেন, কিন্তু তাঁহার প্রকৃত সত্তা নির্গুণ অব্যক্ত। এই সগুণকে জানিতে হইলে আমাদিগকে নির্গুণের ভিতর দিয়া জানিতে হইবে, বিশেষকে জানিতে হইলে সাধারণের ভিতর দিয়া জানিতে হইবে। সেই নির্গুণ সত্তাই বাস্তবিক সত্য, তিনি মানুষের আত্মা—এই সগুণ ব্যক্ত পুরুষকে সেই সত্য বলা হয় নাই।
এ-সম্বন্ধে অনেক প্রশ্ন উঠিবে। আমি ক্রমশঃ সেইগুলির উত্তর দিবার চেষ্টা করিব। অনেক কূট প্রশ্ন উঠিবে, কিন্তু ঐগুলির মীমাংসার পূর্বে আমরা বুঝিতে চেষ্টা করি—অদ্বৈতবাদ কি বলেন। এই যে ব্রহ্মাণ্ড দেখিতেছি, ইহারই একমাত্র অস্তিত্ব আছে, সত্যের অন্বেষণ অন্যত্র করিতে হইবে না। স্থূলসূক্ষ্ম—সবই এখানে; কার্যকারণ—সবই এখানে, জগতের ব্যাখ্যা এখানেই রহিয়াছে। যাহা বিশেষ বলিয়া পরিচিত, তাহা সেই সর্বানুস্যূত সত্তারই সূক্ষ্মভাবে পুনরাবৃত্তিমাত্র। আমরা আমাদের আত্মা সম্বন্ধে আলোচনা করিয়াই
———-
১ ছান্দোগ্য উপ, ৬। ৮। ৭
জগৎ সম্বন্ধে ধারণা করিয়া থাকি। এই অন্তর্জগৎ সম্বন্ধে যাহা সত্য, বহির্জগৎ সম্বন্ধেও তাহাই সত্য। স্বর্গ নরক বলিয়া বাস্তবিক যদি কোন স্থান থাকে, সেগুলিও এই জগতের অন্তর্গত, সমুদয় মিলিয়া এই এক ব্রহ্মাণ্ড হইয়াছে। অতএব প্রথম কথা এই, নানা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরমানুর সমষ্টিস্বরূপ এই ‘এক’ অখণ্ড বস্তু রহিয়াছে, আর আমাদর প্রত্যেকেই যেন সেই একের অংশস্বরূপ। ব্যক্ত-জীবভাবে আমরা যেন পৃথক্ হইয়া রহিয়াছি, কিন্তু সেই একই সত্যস্বরূপ; আর যতই আমরা নিজদিগকে উহা হইতে কম পৃথক্ মনে করিব, ততই আমাদের পক্ষে মঙ্গল। যতই আমরা ঐ সমষ্টি হইতে নিজেদের পৃথক্ মনে করিব, ততই আমাদের দুঃখ বাড়িবে। এই অদ্বৈততত্ত্ব হইতেই আমরা নীতির ভিত্তি প্রাপ্ত হইলাম; আমি স্পর্ধা করিয়া বলিতে পারি, আর কোন মত হইতে আমরা কোনরূপ নীতিতত্ত্ব পাই না। আমরা জানি, নীতির প্রাচীনতম ধারণা ছিল—কোন পুরুষবিশেষ অথবা কতকগুলি পুরুষের ইচ্ছা। এখন আর কেহ উহা মানিতে প্রস্তুত নয়; কারণ উহা আংশিক ব্যাখ্যা মাত্র। হিন্দুরা বলেন—এই কার্য করা উচিত নয়, কারণ বেদ উহা নিষেধ করিতেছেন, কিন্তু খ্রীষ্টান বেদের প্রামাণ্য স্বীকার করিতে প্রস্তুত নন। খ্রীষ্টান আবার বলেন—এ-কাজ করিও না, ও-কাজ করিও না, কারণ বাইবেলে ঐ-সকল কার্য নিষিদ্ধ। যাহারা বাইবেল মানে না, তাহারা অবশ্য এ-কথা শুনিবে না। আমাদিগকে এমন এক তত্ত্ব বাহির করিতে হইবে, যাহা এই নানাবিধ ভাবের সমন্বয় করিতে পারে। যেমন লক্ষ লক্ষ লোক সগুণ সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করিতে প্রস্তুত, সেইরূপ এই জগতে সহস্র সহস্র মনীষী আছেন, যাঁহাদের পক্ষে ঐ ধারণা পর্যাপ্ত বলিয়া বোধ হয় না। তাঁহারা ইহা অপেক্ষা কিছু চাহিয়াছেন; আর যখনই ধর্মসম্প্রদায়গুলি এই মনীষীগণকে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করিবার মতো উদারভাবাপন্ন হয় নাই, তখনই সমাজের উজ্জ্বলতম রত্নগুলি সংগঠিত ধর্মবিশ্বাস (organised faith) ত্যাগ করিয়াছেন , আর বর্তমান কালে বিশেষতঃ ইওরোপে ইহা যত স্পষ্ট দেখা যাইতেছে, আর কখনও কোথাও এরূপ হয় নাই।
মনীষীদিগকে ধর্মের ভিতর রাখিতে হইলে ধর্মকে অবশ্য খুব উদার হইতে হইবে। ধর্ম যাহা কিছু বলে, সবই যুক্তির কষ্টিতে ফেলিয়া পরীক্ষা করা আবশ্যক। কেহই বলিতে পারে না, সকল ধর্মই কেন এই এক দাবি করিয়া থাকে যে, তাহারা যুক্তির দ্বারা পরীক্ষিত হইতে চায় না। বাস্তবিক ইহার কারণ গোড়াতেই গলদ আছে। যুক্তির মানদণ্ড ব্যতীত ধর্মবিষয়েও কোনরূপ বিচার বা সিদ্ধান্ত সম্ভব নহে। কোন ধর্ম হয়তো কিছু বীভৎস ব্যাপার করিতে আজ্ঞা দিল।…মনে কর, মুসলমানধর্মের কোন আদেশের প্রতি একজন খ্রীষ্টান দোষারোপ করিল। তাহাতে মুসলমান স্বভাবতই জিজ্ঞাসা করিবে—কি করিয়া তুমি জানিলে আদেশটি ভাল কি মন্দ? তোমার ভালমন্দের ধারণা তো তোমার শাস্ত্র হইতে! আমার শাস্ত্র বলিতেছে, ‘ইহা সৎকার্য।’ যদি তুমি বলো, তোমার শাস্ত্র প্রচীন, তাহা হইলে বৌদ্ধেরা বলিবেন—আমাদের শাস্ত্র আরও প্রাচীন। আবার হিন্দু বলিবেন—আমার শাস্ত্র সর্বাপেক্ষা প্রাচীন। অতএব শাস্ত্রের দোহাই দিলে চলিবে না। তোমার আদর্শ কোথায়, যাহা লইয়া তুমি সমুদয় তুলনা করিতে পারো? খ্রীষ্টান বলিবেন, ঈশার ‘শৈলোপদেশ’ দেখ; মুসলমান বলিবেন, ‘কোরানের নীতি’ দেখ। মুসলমান বলিবেন—এদুয়ের মধ্যে কোনটি শ্রেষ্ঠ, তাহা কে বিচার করিবে, মধ্যস্থ কে হইবে? বাইবেল ও কোরানে যখন বিবাদ, তখন উভযের মধ্যে কেহই মধ্যস্থ হইতে পারে না। কোন স্বতন্ত্র ব্যক্তি মীমাংসক হইলেই ভাল হয়। কোন গ্রন্থ মীমাংসক হইতে পারে না, সার্বভৌম কোন-কিছু দ্বারাই মীমাংসা হওয়া চাই। যুক্তি অপেক্ষা সার্বভৌম আর কি আছে? কেহ কেহ বলেন, যুক্তি সকল সময়ে সত্যানুসন্ধানে সমর্থ নহে। অনেক সময় যুক্তি ভুল করে বলিয়া এই সিদ্ধান্ত করা হইয়াছে যে, কোন পুরোহিত-সম্প্রদায়ের শাসনে বিশ্বাস করিতে হইবে। …আমি কিন্তু বলি, যুক্তি যদি দুর্বল হয়, তবে পুরোহিত-সম্প্রদায় আরও দুর্বল, আমি তাঁহাদের কথা না শুনিয়া যুক্তিই শুনিব, কারণ যুক্তিতে যতই দোষ থাকুক, উহাতে কিছু সত্য পাইবার সম্ভাবনা আছে, কিন্তু অন্য উপায়ে সত্যলাভের কোন সম্ভাবনাই নাই।
অতএব আমাদিগকে যুক্তির অনুসরণ করিতে হইবে, আর যাহারা যুক্তির অনুসরণ না করিয়া কোন বিশ্বাসে উপনীত হয়, তাহাদের প্রতিও আমাদিগকে সহানুভূতি দেখাইতে হইবে। কারণ কাহারও মতে মত দিয়া বিশ লক্ষ দেবতা বিশ্বাস করা অপেক্ষা যুক্তির অনুসরণ করিয়া নাস্তিক হওয়াও ভাল! আমরা চাই উন্নতি, বিকাশ, প্রত্যক্ষানুভূতি। কোন মত অবলম্বন করিয়াই মানুষ বড় হয় নাই। কোটি কোটি শাস্ত্রও আমাদিগকে পবিত্র হইতে সাহায্য করে না। ঐরূপ হইবার একমাত্র শক্তি আমাদের ভিতরেই আছে। প্রত্যক্ষানুভূতিই আমাদিগকে পবিত্র হইতে সাহায্য করে, আর ঐ প্রত্যক্ষানুভূতি মননের ফল। মানুষ চিন্তা করুক। মৃত্তিকাখণ্ড কখন চিন্তা করে না; ইহা মানিয়া লওয়া যাক যে, উহা সবই বিশ্বাস করে, তথাপি উহা মৃত্তিকাই থাকিয়া যায়। একটি গাভীকে যাহা ইচ্ছা বিশ্বাস করানো যাইতে পারে। কুকুর সর্বাপেক্ষা চিন্তাহীন জন্তু। ইহারা কিন্তু যে কুকুর, যে গাভী, যে মৃত্তিকা তাহাই থাকে, কিছুই উন্নতি করিতে পারে না। কিন্তু মানুষের মহত্ত্ব এই যে, সে মননশীল জীব; পশুদিগের সহিত আমাদের ইহাই প্রভেদ। মানুষের এই মনন স্বভাবসিদ্ধ ধর্ম, অতএব আমাদিগকে অবশ্য মনের চালনা করিতে হইবে। এই জন্যই আমি যুক্তিতে বিশ্বাস করি এবং যুক্তির অনুসরণ করি, শুধু লোকের কথায় বিশ্বাস করিয়া কি অনিষ্ট হয়, তাহা বিশেষরূপে দেখিয়াছি; কারণ আমি যে দেশে জন্মিয়াছি, সেখানে এই অপরের বাক্যে বিশ্বাস করার চূড়ান্ত হইয়া গিয়াছে।
হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, বেদ হইতে সৃষ্টি হইয়াছে। একটা গো আছে, কিরূপে জানিলে? কারণ ‘গো’ শব্দ বেদে রহিয়াছে। মানুষ আছে কি করিয়া জানিলে? কারণ বেদে ‘মনুষ্য’ শব্দ রহিয়াছে। হিন্দুরা ইহাই বলেন। এ যে বিশ্বাসের চূড়ান্ত!—আমি যেভাবে ইহার আলোচনা করিতেছি, সেভাবে ইহার আলোচনা হয় না। কতকগুলি তীক্ষ্ণবুদ্ধি ব্যক্তি ইহা লইয়া কতকগুলি অপূর্ব দার্শনিক তত্ত্ব বাহির করিয়াছেন, এবং সহস্র সহস্র বুদ্ধিমান্ ব্যক্তি সহস্র সহস্র বৎসর এই তত্ত্ব কার্যে রূপায়িত করিতে জীবন উৎসর্গ করিয়াছেন। লোকের কথায় বিশ্বাসের শক্তি অনেক, উহাতে বিপদও অনেক! এরূপ বিশ্বাস মনুষ্যজাতির উন্নতির স্রোত অবরূদ্ধ করে, আর আমাদের বিস্মৃত হওয়া উচিত নয় যে, উন্নতিই আমাদের আবশ্যক। প্রকৃত সত্য অপেক্ষা আপেক্ষিক সত্যের অনুসন্ধানেও আমাদের মনের চালনা আবশ্যক হইয়া থাকে। মননই আমাদের জীবন।
অদ্বৈতবাদের এইটুকু গুণ যে, ধর্মমতের ভিতর এই মতটিই অনেকটা নিঃসংশয়ে প্রমাণ করা যায়। নির্গুণ ঈশ্বর, প্রকৃতিতে তাঁহার অবস্থিতি আর প্রকৃতি যে নির্গুণ পুরুষের পরিণাম, এই সত্যগুলি অনেকটা প্রমাণের যোগ্য, আর অন্য সমুদয় ভাব—যথা ঈশ্বরের আংশিক ক্ষুদ্র ব্যক্তিভাবাপন্ন সগুণ ধারণাগুলি—বিচারসহ নহে। যুক্তিসঙ্গত এই ঈশ্বরবাদের আর একটি গুণ এই যে , ইহা প্রমাণ করে ঐ আংশিক ধারণাগুলি এখনও অনেকের পক্ষে আবশ্যক। এই মতগুলির অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তার পক্ষে ইহাই একমাত্র যুক্তি। দেখিবে, অনেক লোকে বলিয়া থাকে, এই সগুণবাদ অযৌক্তিক, তথাপি ইহা বড় শান্তিপ্রদ। তাহারা সখের ধর্ম চাহিয়া থাকে; আর আমরা বুঝিতে পারি, তাহাদের জন্য ইহার প্রয়োজন আছে। অতি অল্প লোকই সত্যের বিমল আলোক সহ্য করিতে পারে, তদনুসারে জীবনযাপন করা তো দূরের কথা। অতএব এই সখের ধর্মও থাকা দরকার; ইহা অনেককে উচ্চতর ধর্মলাভে সাহায্য করে। যে ক্ষুদ্র মনের পরিধি সীমাবদ্ধ এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সমান্য বস্তুই যে মনের উপাদান, সে মন কখন উচ্চচিন্তার রাজ্যে বিচরণ করিতে সাহস করে না। ক্ষুদ্র ক্ষদ্র দেবতা, প্রতিমা ও আদর্শ সম্বন্ধে তাহাদের ধারণা উত্তম ও উপকারী, কিন্তু তোমাদিগকে নির্গুণবাদও বুঝিতে হইবে, আর এই নির্গুনবাদের আলোকেই এইগুলির উপকারিতা ব্যাখ্যাত হইতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ জন স্টুয়ার্ট মিলের কথা ধর। তিনি ঈশ্বরের নির্গুণভাব বুঝেন ও বিশ্বাস করেন—তিনি বলেন, সগুণ ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায় না। আমি এ-বিষয়ে তাঁহার সহিত একমত; তবে আমি বলি, মনুষ্যবুদ্ধিতে নির্গুণের যতদূর ধারণা করা যাইতে পারে, তাহাই সগুণ ঈশ্বর। আর বাস্তবিকই জগৎটা কি? বিভিন্ন মন সেই নির্গুণেরই যতদূর ধারণা করিতে পারে, তাহাই; উহা যেন আমাদের সম্মুখে প্রসারিত এক একখানি পুস্তক-স্বরূপ, আর প্রত্যেকেই নিজ নিজ বুদ্ধি দ্বারা উহা পাঠ করিতেছে, আর প্রত্যককেই উহা নিজে নিজে পাঠ করিতে হয়। সকল মানুষেরই বুদ্ধি কতকটা একরূপ, সেই জন্য মনুষ্যবুদ্ধিতে কতকগুলি জিনিস একরূপ মনে হয়। তুমি আমি উভয়েই একখানা চেয়ার দেখিতেছি। ইহাতে প্রমানিত হইতেছে, আমাদের উভয়ের মনই কতকটা একভাবে গঠিত। মনে কর, অপর কোন ইন্দ্রিয়সম্পন্ন জীব আসিল; সে আর আমাদের অনুভূত চেয়ার দেখিবে না, কিন্তু যাহারা এক প্রকৃতির, তাহারা সব একরূপ দেখিবে। অতএব এই জগৎ সেই নিরপেক্ষ অপরিণামী পারমার্থিক সত্তা; আর ব্যাবহারিক সত্তা তাহাকেই বিভিন্নভাবে দর্শণমাত্র। ইহার কারণ প্রথমতঃ ব্যাবহারিক সত্তা সর্বদাই স-সীম। আমরা যে-কোন ব্যাবহারিক সত্তা দেখি, অনুভব করি বা চিন্তা করি, দেখিতে পাই—উহা অবশ্যই আমাদের জ্ঞানের দ্বারা সীমাবদ্ধ, অতএব সসীম হইয়া থাকে; আর সগুণ ঈশ্বর সম্বন্ধে আমাদের যেরূপ ধারণা, তাহাতে তিনিও ব্যা্হারিক মাত্র। কার্যকারণ-ভাব কেবল ব্যাবহারিক জগতেই সম্ভব, আর তাঁহাকে যখন জগতের কারণ বলিয়া ভাবিতেছি, তখন অবশ্যই তাঁহাকে স-সীমরূপে ধারণা করিতে হইবে। তাহা হইলেও কিন্তু তিনি সেই নির্গুণ ব্রহ্ম। আমরা পূর্বেই দেখিয়াছি, এই জগৎই আমাদের বুদ্ধির মধ্য দিয়া দৃষ্ট সেই নির্গুন ব্রহ্মমাত্র। প্রকৃতপক্ষে জগৎ সেই নির্গুণ সত্তা মাত্র, আর আমাদের বুদ্ধির দ্বারা উহার উপর নাম-রূপ দেওয়া হইয়াছে। এই টেবিলের মধ্যে যতটুকু সত্য তাহা সেই সত্তা, আর এই টেবিলের আকৃতি ও অন্যান্য যাহা কিছু—সবই সদৃশমানব-বুদ্ধি দ্বারা তাহার উপর আরোপিত হইয়াছে।
উদাহরণস্বরূপ গতির বিষয় ধর। ব্যাবহারিক সত্তার উহা নিত্যসহচর। উহা কিন্তু সেই সার্বভৌম পারমার্থিক সত্তা সম্বন্ধে প্রযুক্ত হইতে পারে না। প্রত্যেক ক্ষুদ্র অণু, জগতের অন্তর্গত প্রত্যেক পরমাণু সর্বদাই পরিবর্তনশীল ও গতিশীল, কিন্তু সমষ্টি হিসাবে জগৎ অপরিণামী, কারণ গতি বা পরিণাম আপেক্ষিক ভাবমাত্র, আমরা কেবল গতিহীন পদার্থের সহিত তুলনায় গতিশীল পদার্থের কথা ভাবিতে পারি। গতি বুঝিতে গেলেই দুইটি পদার্থের আবশ্যক। সমুদয় সমষ্টিজগৎ এক অখণ্ডসত্তাস্বরূপ, উহার গতি অসম্ভব। কাহার সহিত তুলনায় উহার গতি হইবে? উহার পরিণাম হয়, তাহাও বলিতে পারা যায় না। কাহার সহিত তুলনায় উহার পনিণাম হইবে? অতএব সেই সমষ্টি সত্তা নিরপেক্ষ, কিন্তু উহার অন্তর্গত প্রত্যেক অণুই নিরন্তর গতিশীল; একই সময়ে উহা পরিণামী ও অপরিণামী, সগুণ নির্গুণ দুই-ই। ইহাই আমাদের জগৎ, গতি এবং ঈশ্বর সম্বন্ধে ধারণা, ‘তত্ত্বমসি’র অর্থও ইহাই। আমাদিগকে আমাদের স্বরূপ জানিতে হইবে।
সগুণ মানুষ তাহার উৎপত্তিস্থল ভুলিয়া যায়, যেমন সমুদ্রের জল সমুদ্র হইতে বাহির হইয়া আসিয়া সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র হইয়া থাকে। এইরূপ আমরা সগুণ হইয়া, ব্যষ্টি হইয়া আমাদের প্রকৃত স্বরূপ ভুলিয়া গিয়াছি, আর অদ্বৈতবাদ আমাদিগকে এই বিভিন্নরূপে প্রতীয়মান জগৎকে ত্যাগ করিতে শিক্ষা দেয় না, উহা কি তাহাই বুঝিতে বলে। আমরা সেই অনন্ত পুরুষ, সেই আত্মা। আমরা জলস্বরূপ, আর এই জল সমুদ্র হইতে উৎপন্ন, উহার সত্তা সমুদ্রের উপর নির্ভর করিতেছে, আর বাস্তবিকই উহা সমুদ্র—সমুদ্রের অংশ নহে, সমুদয় সমুদ্রস্বরূপ; কারণ যে অনন্ত শক্তিরাশি ব্রহ্মাণ্ডে বর্তমান, তাহার সমুদয়ই তোমার ও আমার। তুমি আমি, এমন কি প্রত্যেক ব্যক্তিই যেন কতকগুলির প্রণালীর মতো—যাহাদের ভিতর দিয়া সেই অনন্ত সত্তা আপনাকে অভিব্যক্ত করিতেছে; আর এই যে পরিবর্তনসমষ্টিকে আমরা ‘ক্রমবিকাশ’ নাম দিই, তাহারা বাস্তবিক পক্ষে আত্মার নানারূপ শক্তি বিকাশ মাত্র। কিন্তু অনন্তের এ-পারে -সান্ত জগতে আত্মার সমুদয় শক্তির প্রকাশ হওয়া অসম্ভব। আমরা এখানে যতই শক্তি, জ্ঞান বা আনন্দলাভ করি না কেন, উহারা কখনই এ-জগতে সম্পূর্ণ হইতে পারে না। অনন্ত সত্তা, অনন্ত শক্তি, অনন্ত আনন্দ আমাদের রহিয়াছে। ঐগুলি যে আমরা উপার্জন করিব, তাহা নহে; ঐগুলি আমাদের ভিতরেই রহিয়াছে, প্রকাশ করিতে হইবে মাত্র।
অদ্বৈতবাদ হইতে এই এক মহৎ সত্য পাওয়া যাইতেছে, এবং ইহা বুঝা বড় কঠিন। আমি বাল্যকাল হইতে দেখিয়া আসিতেছি, সকলেই দুর্বলতা শিক্ষা দিতেছে; জন্মাবধি শুনিয়া আসিতেছি, আমি দুর্বল। এখন আমার পক্ষে আমার স্বকীয় অন্তর্নিহিত শক্তি উপলব্ধি করা কঠিন হইয়া পড়িয়াছে, কিন্তু যুক্তিবিচারের দ্বারা দেখিতে পাইতেছি, আমাকে আমার নিজের অন্তর্নিহিত শক্তি সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করিতে হইবে মাত্র, তাহা হইলেই সব হইয়া গেল। এই জগতে আমরা যে-সকল জ্ঞান লাভ করি, তাহারা কোথা হইতে আসে? উহারা আমাদের ভিতরেই রহিয়াছে। কোন জ্ঞান কি বাহিরে আছে?—আমাকে এক বিন্দু দেখাও তো। জ্ঞান কখনও জড়ে ছিল না, উহা বরাবর মানুষের ভিতরেই ছিল। জ্ঞান কেহ কখনও সৃষ্টি করে নাই; মানুষ উহা আবিষ্কার করে, ভিতর হইতে উহাকে বাহির করে, উহা ভিতরেই রহিয়াছে। এই যে ক্রোশব্যাপী বৃহৎ বটবৃক্ষ, তাহা ঐ সর্ষপ-বীজের অষ্টমাংশের তুল্য ক্ষুদ্র বীজে ছিল—ঐ মহাশক্তিরাশি উহার ভিতরে নিহিত রহিয়াছে। আমরা জানি, একটি জীবাণুকোষের ভিতর সকল শক্তি, প্রখর বুদ্ধি কুণ্ডলীকৃত হইয়া অবস্থান করে; তবে অনন্ত শক্তি কেন না তাহাতে থাকিতে পারিবে? আমরা জানি, তাহা আছে। প্রহেলিকাবৎ বোধ হইলেও ইহা সত্য। আমরা সকলেই একটি জীবাণুকোষ হইতে উৎপন্ন হইয়াছি, আর আমাদের যাহা কিছু শক্তি রহিয়াছে, তাহা ঐ জীবাণুকোষেই কুণ্ডলীভূত হইয়া ছিল। তোমরা বলিতে পার না, উহা খাদ্য হইতে প্রাপ্ত; রাশীকৃত খাদ্য লইয়া খাদ্যের এক পর্বত প্রস্তুত কর, দেখ তাহা হইতে কি শক্তি বাহির হয়! আমাদের ভিতর শক্তি পূর্ব হইতেই অন্তর্নিহিত ছিল, অব্যক্তভাবে কিন্তু উহা ছিল নিশ্চয়ই; অতএব সিদ্ধান্ত এই—মানুষের আত্মাতেই অনন্ত শক্তি রহিয়াছে, মানুষ উহার সম্বন্ধে না জানিলেও উহা রহিয়াছে, কেবল উহাকে জানিবার অপেক্ষামাত্র। ধীরে ধীরে ঐ অনন্তশক্তিমান্ দৈত্য যেন জাগরিত হইয়া নিজ নিজ শক্তি সম্বন্ধে সচেতন হইতেছে, আর যতই সে এই জ্ঞানলাভ করিতেছে, ততই তাহার বন্ধনের পর বন্ধন খসিয়া যাইতেছে, শৃঙ্খল ছিঁড়িয়া যাইতেছে, আর এমন একদিন অবশ্য আসিবে, যখন এই অনন্তজ্ঞান অনুভূত হইবে, তখন জ্ঞানবান্ ও শক্তিমান্ হইয়া এই মানুষ দাঁড়াইয়া উঠিবে। এস, আমরা সকলে সেই অবস্থা আনয়ন করিবার জন্য সাহায্য করি।