১৬. একটা ট্র্যাংক কল

গার্লস আর ইডিয়টস। ডাউনরাইট ইডিয়টস। দাঁতে দাঁত পিষতে পিষতে ববি আর একটা ট্র্যাংক কল করলেন। আবারও কলকাতায় এবং ডিম্যান্ড কল।

ইন্দ্রজিতের ঘুম-ঘুম গলা পাওয়া গেল একটু বাদে, হ্যাল্লো।

শোনো ইন্দ্রজিৎ, দেয়ার ইজ এ গুড নিউজ ফর ইউ। আমি এইমাত্র আবিষ্কার করেছি যে তুমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম গাড়ল নও, সম্ভবত তোমার চেয়েও গাড়ল আছে। অন্তত দেয়ার ইজ এ কিন কমপিটিশন। এবং সে একটি মেয়ে।

ইন্দ্রজিতের ঘুম চড়াক করে কেটে গেল। প্রায় আর্তনাদ শোনা গেল টেলিফোনে, আপনি? আপনি বেঁচে আছেন স্যার? মাইরি, ভূত নন তো!

আমি ভূত হলে তোমার ভবিষ্যৎ যে অন্ধকার। শোনো, আমাকে আর এক ঘণ্টার মধ্যে কলকাতার প্লেন ধরতে হবে। তবু হয়তো সময়মতো পৌঁছোতে পারব না। ইন দা মিন টাইম তুমি যার কাছে বোকামিতে হেরে গেছ তার বাড়ি চলে যাও। শি হ্যাজ বাঙ্গলড় এভরিথিং।

কে স্যার? লীনা?

ওঃ ইউ আর রাইট। থ্যাংক ইউ। যতদূর মনে হয়েছে মিসেস ভট্টাচারিয়া বিপাকে পড়বেন। ভদ্রমহিলাকে ফেস করার দরকার নেই। জাস্ট ফলো হার।

ফলো! ও বাবা, আমার যে গাড়ি নেই।

তোমার অনেক কিছুই নেই ইন্দ্রজিৎ, আমি জানি। কিন্তু গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়। টাকা নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না। যা বলছি করো।

বিপদটা কি খুব সিরিয়াস স্যার? আমার কিন্তু সেই ভাইট্যাল জিনিসটাও নেই।

কোনটা? বুদ্ধি? বুদ্ধির দরকার নেই গাড়ল, দরকার শুধু বুলডগের মতো টেনাসিটি আর অ্যানিম্যাল ইনস্টিংক্ট।

বুদ্ধি নয় স্যার। ভাইট্যাল জিনিসটা হল রিভলভার।

তোমার না থাকলেও চলবে। মিসেস ভট্টাচারিয়ার আছে। সময় নেই, ছাড়ছি।

একটা কথা স্যার। উনি কিন্তু মিসেস নন, মিস…

ববি ফোন রেখে দিলেন। আর চব্বিশ ঘণ্টা বিশ্রাম পেলে বড় ভাল হত। কিন্তু কপালে নেই।

ববি নার্সিং হোমের চার্জ মিটিয়ে গাড়িতে এসে উঠলেন। তিরবেগে গাড়ি চলল এয়ারপোর্টের দিকে।

বোম্বে থেকে ভায়া নাগপুর কলকাতার ফ্লাইটে যথেষ্ট ভিড় হয়। ববি সম্ভবত জায়গা পাবেন না। স্বাভাবিকভাবে পাবেন না, কিন্তু অস্বাভাবিক পন্থায় পেয়ে যেতেও পারেন।

নিজের শারীরিক কষ্টের দিকটা ততটা বোধ করতে পারছেন না ববি। সম্ভবত পেথিডিন ইনজেকশনের প্রতিক্রিয়া এখনও রয়েছে। আর রয়েছে তীব্র উদ্বেগ। মেয়েটা যে কেন নীল মঞ্জিলের কথাটা ফোনে বলে দিল। ওর টেলিফোন ট্যাপ করা হয়েছে, সে বিষয়ে ববি নিশ্চিত। ঘুমন্ত বোম্বের রাস্তায় পোড়া রবারের গন্ধ ছড়িয়ে ববি রায় ফিয়াটটাকে শুধু ওড়াতে বাকি রাখলেন।

এয়ারপোর্ট। ববি জানেন, এই ফ্লাইটটা গন্ডগোলের। এই ফ্লাইটে এমন দু’একজন থাকতেও পারে যারা ববিকে বিশেষ পছন্দ করবে না।

ববি সুতরাং সহজ পথে গেলেন না। লাউঞ্জের ভিড়াক্রান্ত অঞ্চলটা এড়িয়ে তিনি একটু একা রইলেন। লক্ষ রাখলেন এম্বার্কেশন টিকিটের কাউন্টারে। জনা পঞ্চাশেক লোকের লাইন। কাউন্টার খুলতে এখনও হয়তো মিনিট দশ-বারো দেরি আছে।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না ববিকে। হঠাৎ দেখা গেল সেই দৈত্যাকার যুবক এবং আর একজন আধা সাহেব গোছের লোক হন্তদন্ত হয়ে কাউন্টারের দিকে গেল।

ববি জানেন ওদেরও টিকিট নেই। ওরা চেষ্টা করবে শেষ মুহূর্তে টিকিট কাটবার। যদি অবশ্য অন্যরকম বন্দোবস্ত থেকে থাকে।

ববির দ্বিতীয় ধারণাই সত্য। দু’জনে লাইনে দাঁড়াল। হাতে টিকিট।

আনন্দে হাতে হাত ঘষে ববি ইংরিজিতে বললেন, চমৎকার।

পাশ থেকে একজন বুড়োমতো বিদেশি লোক হঠাৎ ধমকের স্বরে ইংরিজিতে বলে উঠল, কী চমৎকার? আঁ! চমত্তারটা আবার কী? ইটস এ লাউজি কান্ট্রি, ইটস এ লাউজি এয়ারলাইনস অ্যান্ড ইউ আর লাউজি পিপল। জানো প্লেন আজও আধ ঘণ্টা লেট!

দ্যাটস এ গুড নিউজ।

ববি স্থানত্যাগ করলেন।

দৈত্যাকার যুবকটির কাঁধে যখন আলতো করে টোকা দিলেন ববি তখনও জানতেন না প্রতিক্রিয়াটা এরকম হবে। লোকটা ফিরে ববির দিকে তাকিয়ে প্রথমে স্ট্যাচু হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। তারপর তার চোয়ালটা ঝুলে পড়ল নীচে।

ববি চাপা গলায় বললেন, একটা আপসরফায় আসবে? আমি মারদাঙ্গা এবং হিরোইকস একদম পছন্দ করি না।

দৈত্য এবং তার সঙ্গী কিছুক্ষণ মুখ চাওয়াচাওয়ি করল, তারপর দৈত্য দাঁতে দাঁত চেপে বলল, কীরকম আপসরফা?

কথাটা একটু আড়ালে হলে ভাল হয়। সাপোজ ইউ গো টু দি ইউরিন্যালস?

দৈত্যটা একটা বড় শ্বাস ফেলে বলল, কোনও চালাকি করলে তুমি খুব বিপদে পড়বে।

ববি মুখখানা করুণ করে বললেন, দি অডস আর ভেরি মাচ এগেইনস্ট মি।

তুমি কাল রাতে আমার পকেট থেকে—

ববি মাথা নেড়ে বললেন, জানি, জানি, আমি টাকাটাও ফেরত দিতে চাই।

দৈত্যটা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, চলো।

এ সময়টায় ইউরিন্যাল ফাঁকাই থাকে। তিনজন যখন ঢুকল তখন মাত্র একজন উটকো লোক প্রাতঃকৃত্য সারছিল। সে বেরিয়ে যেতেই দৈত্যটা হঠাৎ প্রকাণ্ড থাবায় ববির বাঁ কাঁধ ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, এবার বলল বাছাধন!

দ্বিতীয়জনের হাতে যেন জাদুবলে দেখা দিল একটা রিভলভার।

ববি রায় অত্যন্ত খুশির হাসি হাসলেন। এরকমই তো চাই। ঠিক এইরকমই তো চাই।

দৈত্যকে হাতে রেখে ববি প্রথম রিভলভারওয়ালার ঠিকানা নিলেন, তার বাঁ পা নব্বই ডিগ্রি উঠে গেল সমকোণে এবং শরীরকে একটি তৈলাক্ত দণ্ডের উপর ঘুরিয়ে অপ্রত্যাশিত ক্যারাটে কিকটি সংযুক্ত করে দিলেন আততায়ীর মাথায়। এত দ্রুত যে কিছু ঘটতে পারে তা লোকটা কল্পনাও করেনি কখনও। তার রিভলভার গিয়ে সিলিং-এ ধাক্কা খেয়ে খটাস করে মেঝেয় পড়ল এবং তারও আগে লোকটা নিজের ভগ্ন্যুপ হয়ে ঝরে পড়ল মেঝেয়।

দৈত্যটা এই দৃশ্য দেখতে দেখতে ফ্যাকাসে হয়ে গেল।

ববি তাকে আদেশ করলেন, লোকটাকে তুলে পায়খানার মধ্যে ভরে দাও। কুইক…

কিন্তু দৈত্য তখনও এই অশরীরী কাণ্ডটাকে মাথায় নিতে পারেনি। তাই অবাক হয়ে ববির দিকে চেয়ে থাকা ছাড়া সে আর কিছুই করতে পারল না।

কিন্তু নষ্ট করার মতো সময় ববির হাতে নেই। তিনি খুবই দ্রুত এক পা পিছিয়ে গেলেন। তারপর ওয়ালজ নাচের মুদ্রায় প্রায় শত মাইল বেগে তিন ফুট এগিয়ে গিয়ে ঘুসিটা চালালেন দৈত্যের থুতনিতে।

ভূমিকম্প এবং মহীরূহ পতনের শব্দ সৃষ্টি করে দৈত্য পড়ে গেল।

ববি তার টিকিটটা কুড়িয়ে নিলেন। আর দু’জনকে হেঁচড়ে নিয়ে দুটি ছোট ঘরে ভরে দিলেন।

ভাগ্য ভালই ববির। যে মিনিট তিনেক সময় ব্যয় হল তার মধ্যে কেউ ইউরিন্যালে ঢোকেনি।

রিভলভারটা ববি তুলে নিলেন বটে, কিন্তু পকেটে ভরলেন না। আর একটি ছোট ঘরে সেটি কমোডের মধ্যে নিক্ষেপ করে বেরিয়ে এসে লাইনে দাঁড়ালেন।

যে ওজনের মার দিয়েছেন দু’জনকে তাতে ঘণ্টা দেড়-দুইয়ের আগে চেতনা ফেরার কথা নয়। অবশ্য কপাল খারাপ হলে কত কী তো ঘটতে পারে।

ঘটল না অবশ্য। এম্বাকেশন কার্ড নিয়ে ববি রায় গিয়ে এক কাপ কফি খেলেন। ইউরিন্যালটা একবার দেখে এলেন। দুটি ছোট ঘর এখনও বন্ধ, কোনও অঘটন ঘটেনি।

একটু বাদেই সিকিউরিটি চেক-এর ঘোষণা শুনতে পেলেন ববি। তার ঢোলা পোশাক এবং কামানো চিবুক বোধহয় সিকিউরিটির লোকেরা বিশেষ পছন্দ করল না। কিন্তু ববির পকেটে টাকা আর রুমাল ছাড়া কিছু নেই দেখে ছেড়ে দিল।

প্লেন আকাশে উড়বার পর ববি স্বস্তি বোধ করলেন। ক্ষুধার্তের মতো খেলেন ব্রেকফাস্ট এবং নাগপুরের আগেই ঘুমিয়ে পড়লেন।

কলকাতায় যখন প্লেন নামল তখন সাড়ে দশটা বেজে গেছে। ট্যাক্সি ধরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সোয়া এগারোটা। কত কী ঘটে যেতে পারে এব মধ্যে, কত কী…।

ববি লীনার নম্বর ডায়াল করলেন। বাড়ি নেই।

ববি তাড়াহুড়ো করলেন না। আগে দাড়ি কামালেন, দাঁত মাজলেন, তারপর জীবাণুনাশক মিশিয়ে গরম জলে স্নান করলেন। তটস্থ বাবুর্চি চমৎকার ব্রেকফাস্ট সাজিয়ে দিল। অম্লানবদনে ববি দ্বিতীয়বার প্রাতরাশ সারলেন। সারাদিন খাওয়া হয় কি না হয় কে জানে!

দু’-একটা ছোটখাটো জিনিস পকেটে আর হাতব্যাগে পুরে নিলেন ববি। তারপর তোক্সওয়াগনটা বের করলেন গ্যারাজ থেকে।

এমন সময় একটা অ্যাম্বাসাডার এসে বাড়ির সামনে থামল এবং অতিশয় উত্তেজিত ভঙ্গিতে গাড়ি থেকে নেমে এল ইন্দ্রজিৎ। তার দুটো চোখ বড় বড়, মুখখানা লাল।

স্যার!

বলো ইন্দ্রজিৎ।

আপনি এসে গেছেন! বাঁচালেন। ব্যাড নিউজ স্যার, ভেরি ব্যাড নিউজ।

ববি চোখ ছোট করে ইন্দ্রজিতের দিকে চেয়ে বললেন, ইজ শি কিল্ড?

কোনও সন্দেহ নেই।

কী হয়েছে সংক্ষেপে বলল।

আপনার ফোন পেয়েই আমি আমার এক চেনা গ্যারাজ থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করি। পার ডে আড়াইশো টাকা প্লাস তেল আর মবিল…

ওটা বাদ দাও, তারপর বলো।

মিস ভট্টাচার্যের বাড়ির সামনে ঠিক সাতটায় হাজির হয়ে অপেক্ষা করতে থাকি। উইদাউট ব্রেকফাস্ট অ্যান্ড উইদাউট ইভন এ প্রপার কাপ অফ টি…

কাট দি ব্রেকফাস্ট।

ওঃ আপনি তো আবার অন্যের খাওয়ার ব্যাপারটা পছন্দ করেন না। হ্যাঁ, বলছিলাম, ঠিক ন’টায় ওই ছেলেটি আসে, দোলন। মিস ভট্টাচার্য আর দোলন একটা ফিয়াট নিয়ে বেরোয় ন’টা চল্লিশ নাগাদ। এবং একটা পন্টিয়াক গাড়ি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ওদের ফলো করতে শুরু করে।

তুমি কী করলে?

আমিও পন্টিয়াকটাকে ফলো করতে থাকি তবে একটু ডিসট্যান্স রেখে। আপনি তো জানেনই স্যার যে আমার রিভলভার নেই।

তারপর কী হল?

গড়িয়া ছাড়িয়ে আরও কয়েক মাইল যাওয়ার পর মিস ভট্টাচার্য কেন কে জানে, গাড়িটা হঠাৎ একটা কাঁচা রাস্তায় নামিয়ে দিলেন। আর সঙ্গে সঙ্গেই পন্টিয়াক থেকে গুলি ছুটল। পিছনের একটা টায়ার ফেঁসে গিয়েছিল। আর লীনা–কী বলব স্যার–ঝাঁসীর রানি, রানি ভবানী, জোয়ান অব আর্ক, দেবী চৌধুরানি ছেঁকে তৈরি মেয়ে স্যার।

কী করল সে?

গাড়ি থেকে নেমে এসে পিস্তল নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে গুলি চালাতে লাগল।

মাই গড।

একটু দূরে ছিলাম তাই ঠিক বলতে পারব না ব্যাপারটা কী হয়েছিল। তবে একটু বাদেই দেখলাম গুন্ডাদের গুলিতে মেয়েটা পড়ে গেল…

ননসেন্স! ওকে গুলি করবে কেন গাড়লেরা? ওকে মারলে তো সবই গন্ডগোল হয়ে যাবে।

আগেই বলেছি স্যার, আমি একটু দূরে ছিলাম। খুব স্পষ্ট করে দেখিনি। তবে মনে হল মেয়েটা উল্ডেড। গুন্ডারা গিয়ে ওকে ধরে গাড়িতে তুলে হাওয়া।

কোনদিকে গেল তারা?

আমি ফলো করিনি স্যার। দোলন নামে সেই ছোকরাকে গুন্ডারা ঘুসি মেরে অজ্ঞান করে ফেলে গিয়েছিল। আমি দোলনকে রেসকিউ করি। কিন্তু তার কাছ থেকে তেমন কোনও ইনফরমেশন পাইনি। ছোকরাটা আমার চেয়েও কাওয়ার্ড।

হুঁ। তোমার চেয়ে বোকা এবং তোমার চেয়েও কাওয়ার্ড যে আছে তা আমার জানা ছিল না। এনিওয়ে লীনাকে কোথায় নিয়ে গেছে তার খানিকটা আন্দাজ আমার আছে। গাড়িতে ওঠো। ইউ আর গোয়িং ফর এ রাইড।

স্যার, একটা কথা।

কী কথা?

গোলাগুলি চলবে নাকি?

চলতে পারে।

তা হলে আমার হাতেও একটা অস্ত্র থাকা দরকার।

না, বুন্ধু! তোমার হাতে অস্ত্র দেওয়া মানে আমার নিজের বিপদ ডেকে আনা।

আমি কোনওদিন বন্দুক পিস্তল হাতে পর্যন্ত নিতে পারিনি।

ভালই করেছ।

ববি গাড়ি ছাড়লেন। সল্টলেকের রাস্তায় গাড়িটা বিদ্যুৎবেগে ছুটতে লাগল।

স্যার।

বলো।

গাড়িটা মাটির দু’ইঞ্চি ওপর দিয়ে যাচ্ছে। টের পাচ্ছেন?

চুপ করে বসে থাকো।

এ গাড়িতে সিটবেল্ট থাকা উচিত ছিল।

আছে, লাগিয়ে নাও।

ইন্দ্রজিৎ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বুজে বলল, আমি নাস্তিক ছিলাম। কিন্তু এখন আর নই। মা কালী বাবা মহাদেব, রক্ষা করো!

ববি ঘুরপথ নিলেন না। সহজ এবং সবচেয়ে শর্টকাট ধরে তীব্রগতিতে এগোতে লাগলেন। ক্রমে বিবেকানন্দ সেতু পার হয়ে বোম্বে রোডে এসে পড়লেন।

স্যার।

বলো।

আপনি কি–?

কী? বললে আপনি রেগে যাবেন না তো স্যার?

তা হলে বোলো না।

বলছিলাম আপনি কি বাই এনি চান্স ওই মেয়েটিকে একটু পছন্দ করেন?

ববি দু-দুটো লরিকে অত্যন্ত বিপজ্জনকভাবে কাটিয়ে এগিয়ে গেলেন। ইন্দ্রজিৎ টালমাটাল হয়ে আবার সামলে নিয়ে বলল, গুলিতে নয় আমরা মরব অ্যাকসিডেন্টে। স্যার একটু সামলে—

তুমি কিছু বলছিলে ইন্দ্রজিৎ?

বললেও তা উথড্র করে নিচ্ছি, স্যার।

শোনো, গার্লস আর ইডিয়টস। এই মেয়েটি যদি পর্বতপ্রমাণ বোকা না হত তা হলে আমাদের এইভাবে আজ নাকাল হতে হত না। মেয়েটা হয়তো মরবে, কিন্তু তার আগে একটা মস্ত সর্বনাশ করে দিয়ে যাবে।

ইন্দ্রজিৎ একটু চুপ করে থেকে বলল, আপনি অত্যন্ত পাষাণ-হৃদয়ের লোক, স্যার।

হ্যাঁ। আমার কোনও সেন্টিমেন্ট নেই।

তাই দেখছি।

সেই ছোকরাটার কী হল? দোলন না কে যেন।

হোপলেস কেস স্যার। ছোকরাকে আমি এসপ্লানেড অবধি একটা লিফট দিয়েছিলাম। ছোকরাটা এত ঘাবড়ে গিয়েছিল যে আমাকে একটা থ্যাংক ইউ অবধি বলল না।

সেটাই স্বাভাবিক, ইন্দ্রজিৎ। বাঙালিদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ভীষণ কমে যাচ্ছে। একদিন হয়তো দেখা যাবে বাঙালি মাত্রই মেয়েছেলে। কেউ শাড়ি পরে, কেউ বা প্যান্ট শার্ট বা ধুতি পাঞ্জাবি। বাট বেসিক্যালি সবাই স্বভাবে চরিত্রে মেয়েছেলে।

আপনি উত্তেজিত হবেন না স্যার, সামনে একটা পেট্রলট্যাংকার… ওরে বাবা…

ইন্দ্রজিৎ চোখ বুজে ফেলল। একটা প্রবল বাতাসের ঝাপটা আর গাড়িতে একটা ভীষণ ঝাঁকুনি টের পেল সে। তারপর চোখ খুলে দেখল, পরিষ্কার রাস্তায় গাড়ি মসৃণ ছুটছে।

আপনি কি মোটরকার জাম্পিং জানেন স্যার? ট্যাংকারটাকে কাটালেন কী করে?

কাটালাম দু’চাকায় ভর করে। পিছনের ডানদিকের চাকা রাস্তায় ছিল না।

মা কালী দুর্গা দুর্গতিনাশিনী!

আচমকাই বড় রাস্তা ছেড়ে একটা ডাইভারশনে ঢুকে পড়লেন। রাস্তাটা এক সময় পাকা ছিল, এখন খানাখন্দে ভরা।

ইন্দ্রজিৎ।

স্যার।

বাতাসে পেট্রলের গন্ধ পাচ্ছ?

ইন্দ্রজিৎ বাতাস কে বলল, না।

আমি পাচ্ছি। ওরা এই পথেই গেছে।

লীনাকে যেখানে আনা হল সেই জায়গাটা লীনা চিনতে পারল না। তবে নিশ্চয়ই খিদিরপুর ডক-এর কাছাকাছি কোনও অঞ্চল। লীনা জাহাজের ভো শুনতে পেল একবার।

ঘিঞ্জি একটা নোংরা বসতি ছাড়িয়ে গিয়ে গাড়িটা একটা মস্ত পুরনো বাড়ির বাগানে ঢুকে পড়ল। নিশ্চয়ই এককালে জমিদারবাড়ি ছিল। এখনও পাথরের পরি আর ফোয়ারা রয়েছে। বাগানে প্রচুরডালিয়া ফুটে আছে।

গাড়িবারান্দার তলায় গাড়িটা দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে একজন লোক এসে দরজা খুলে দিল।

ছদ্ম-পুলিশ যুবকটি বলল, এরপর থেকে আর আমাদের কিছুই করার থাকল না মিস ভট্টাচার্য।

তার মানে?