যাঁকে তোমরা ব্যক্তিত্বভাবাপন্ন ঈশ্বর বল, আমার ধারণা তিনি এবং নৈর্ব্যক্তিক সত্তা একই-কালে সাকার ও নিরাকার। আমরাও ব্যক্তিত্ব-সম্পন্ন নৈর্ব্যক্তিক সত্তা। কথাটি নিরপেক্ষভাবে ব্যবহার করলে আমরা ‘অব্যক্ত’, আর আপেক্ষিকভাবে ব্যবহার করলে আমরা ‘ব্যক্তি’। তোমরা প্রত্যেকেই বিশ্ব-সত্তা, সকলেই সর্বব্যাপী। শুনলে প্রথমটা মাথা ঘুরে যায়, কিন্তু আমি তোমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, এ কথা যতখানি সত্য, ঐ কথাও ততখানি সত্য, আত্মা সর্বব্যাপী না হয়ে পারে কি করে? আত্মার দৈর্ঘ্য নেই, প্রস্থ নেই, বেধ নেই—জড়ের কোন ধর্মই আত্মায় নেই। আমরা সবাই যদি আত্মা হই, তা হলে দেশ (space) দ্বারা পরিচ্ছন্ন হতে পারি না, দেশ দেশকেই সীমাবদ্ধ করতে পারে, জড় জড়কে; আমরা যদি শরীরে আবদ্ধ থাকতাম, তাহলে আমাদের জড়বস্তুই হতে হত। শরীর, আত্মা—সব কিছুই জড় হতে। ‘শরীরে বাস করা’, ‘আত্মাকে শরীরে আটকে রাখা’ প্রভৃতি কথাগুলি শুধু সুবিধার জন্য ব্যবহৃত হত, এর অতিরিক্ত এদের কোন অর্থ থাকত না।
তোমাদের অনেকেরই মনে আছে—আত্মার কি সংজ্ঞা আমি দিয়েছি; প্রত্যেকটি আত্মা হচ্ছে এক-একটি বৃত্ত, একটি বিন্দুতে যার কেন্দ্র এবং যার পরিধি কোথাও নেই। কেন্দ্র হচ্ছে শরীরে, সেখানেই সব কর্মশক্তি প্রকাশিত। তোমরা সর্বব্যাপী, তবে সত্তাচেতনা একটি বিন্দুতে ঘনীভূত। সেই বিন্দুটি কিছু জড়কণা সংগ্রহ করে সেগুলিকে আত্মপ্রকাশের যন্ত্রে পরিণত করেছে। যার মাধ্যমে সত্তা নিজেকে প্রকাশ করে, তাকে বলে ‘শরীর’।
তা হলে তুমি সর্বত্র আছ। যখন একটি শরীর বা যন্ত্র আর কাজ করতে পারে না, তখন শরীরের কেন্দ্র ‘তুমি’ সরে যাও, আবার নতুন স্থূল বা সূক্ষ্ম জড়কণা সংগ্রহ করে তাদের মাধ্যমে আবার কাজ করতে থাক। এই হল মানুষ। তা হলে ঈশ্বর কি? ঈশ্বর হচ্ছেন একটি বৃত্ত, যার পরিধি কোথাও নেই এবং যার কেন্দ্র সর্বত্র; এই বৃত্তের প্রতিটি বিন্দু চেতন ও সক্রিয়। সীমাবদ্ধ আত্মা আমাদের সঙ্গে সমানে কাজ করে চলেছে। আমাদের শুধু একটি চেতন বিন্দু, সেই বিন্দু একবার এগিয়ে চলেছে, একবার পিছিয়ে যাচ্ছে।
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের তুলনায় শরীর যেমন অতি ক্ষুদ্র, ঈশ্বরের সঙ্গে তুলনায় বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তেমনি নগণ্য। আমরা যখন বলি, ঈশ্বর কথা বলছেন, তখন তার অর্থ—তিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মাধ্যমে বলছেন। আমরা যখন বলি—তিনি দেশ-কালের সীমার অতীত, তার অর্থ—তিনি ব্যক্তিত্বশূন্য সত্তা। এই উভয়ই এক সত্তা।
একটি দৃষ্টান্ত দিইঃ আমরা এখানে দাঁড়িয়ে সূর্যকে দেখছি। মনে কর, তুমি সূর্যের দিকে এগিয়ে চলেছ। কয়েক হাজার মাইল কাছে গিয়ে দেখবে আর এর সূর্য—অনেক বড়। সবশেষে দেখবে, প্রকৃত সূর্য লক্ষ মাইল জুড়ে। এখন এই যাত্রাটিকে কয়েকটি স্তরে ভাগ করা যাক, প্রত্যেক স্তর থেকে ছবি তোলা হল। প্রকৃত সূর্যেরও ছবি তুলে নিয়ে ফিরে এসে সবগুলি তুলনা কর, মনে হবে প্রত্যেকটি পৃথক্। প্রথম দেখা গিয়েছিল একটি ছোট লাল গোলাকার পদার্থ, এবং শেষে দেখা গেল লক্ষমাইল-ব্যাপী বিরাট প্রকৃত সূর্য। দুটি একই সূর্য।
ঈশ্বর সম্বন্ধেও তাই। অসীম সত্তাকে আমরা দেখছি বিভিন্ন স্থান থেকে, মনের বিভিন্ন স্তর থেকে। নিম্নতম মানুষ দেখছে তাঁকে পূর্বপুরুষ-রূপে; দৃষ্টি যখন আরও বড় হল, তখন তাঁকে দেখছে একটি গ্রহের নিয়ন্তা-রূপে; দৃষ্টি আরও ব্যাপক হলে মানুষ বুঝতে পারে, তিনি বিশ্বের নিয়ামক। সর্বোচ্চ মানব অনুভব করেন, ‘তিনি আমাদের স্বরূপ’। ঈশ্বর সর্বদা একই, তাঁকে যে বিভিন্নভাবে বোধ হয়, তার কারণ দৃষ্টির প্রভেদ ও তারতম্য।