গল্প
উপন্যাস
পরিশিষ্ট

১৬. অন্তঃপুরে

ষোড়শ পরিচ্ছেদ – অন্তঃপুরে

গুপ্তদ্বার যে-রমণী ভিতর হইতে খুলিয়া দিয়াছিল সে কুহুর অনুচরী। বিপুল রাজসংসারে বহু পর্যায়ভেদ; রানীর একদল দাসী আছে, সেই দাসীদের আবার দাসী আছে, তস্য দাসী আছে। কুহু পুরী হইতে বাহির হইবার সময় নিজ অনুচরীকে গুপ্তদ্বারে বসাইয়া গিয়াছে। কখন ফিরিবে তাহার স্থিরতা নাই, বেশি রাত হইলে তোরণদ্বার বন্ধ হইয়া যাইবে। অভিসারিকার গতিবিধি অলক্ষ্যে হওয়াই বিধেয়। তাই সতর্কতা।

পুরুভূমিতে প্রবেশ করিয়া কুহু অনুচরীকে বিদায় দিল; তারপর ক্ষণেক কান পাতিয়া শুনিল। রাজপুরী নিদ্রামগ্ন, কেবল একটি ভবন হইতে মৃদঙ্গ-মঞ্জীরার অস্ফুট নিক্কণ আসিতেছে— ঝনি ঝমকি ঝনি ঝমকি। বিনিদ্র রাজ-লম্পটের নৈশ নর্ম-বিলাস এখনও চলিতেছে।

অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়া কুহু দ্রুতপদে চলিল। বিশাল অন্তঃপুরে কক্ষের পর কক্ষ, অলিন্দের পর অলিন্দ; কোথাও বা পুরীর এক অংশ হইতে অন্য অংশে যাইবার গোপন সুড়ঙ্গ। নিস্তব্ধ পুরী অন্ধকার, কদাচিৎ একটি দুটি দীপ জ্বলিতেছে। এই গোলকধাঁধায় দিবাকালেও দিগ্‌ভ্রম হইবার সম্ভাবনা, কিন্তু কুহু অভ্রান্তভাবে পথ চিনিয়া উদ্দিষ্ট স্থানের অভিমুখে চলিল।

একটি অন্ধকার কোণে লুক্কায়িত একশ্রেণী সোপান। কুহু সোপান বাহিয়া উপরে চলিল; দ্বিতল ছাড়াইয়া ত্রিতল, ত্রিতলের পর চতুস্তল। এই চতুস্তলে একটি বৃহৎ কক্ষ, চারিদিকে মুক্ত ছাদ। কক্ষ হইতে স্নিগ্ধ পুষ্পগন্ধ ও দীপপ্রভা বিকীর্ণ হইতেছে। মনে হয় সমস্ত পুরীর মধ্যে এই কক্ষটি জাগিয়া আছে।

কুহু দ্বারের নিকট হইতে সন্তর্পণে উঁকি মারিল, তারপর ভিতরে প্রবেশ করিল।

রানী শিখরিণী পালঙ্কে জাগিয়া শুইয়া ছিলেন; দুই হাতে একটি যূথীমাল্যের ফুলগুলি ছিঁড়িয়া ছিঁড়িয়া হর্ম্যতলে ছড়াইয়া দিতেছিলেন। নিদাঘ নিশীথে তাঁহার দেহে বস্ত্রাদি অধিক নাই, একটি স্বচ্ছ নীল ঊর্ণা তপ্তকাঞ্চন অঙ্গে অঞ্জনরেখার ন্যায় লাগিয়া আছে। এক কিঙ্করী শিথানে দাঁড়াইয়া ফুলের পাখা দিয়া বাতাস করিতেছে।

কুহু প্রবেশ করিলে রানী সুপ্তোত্থিতা বাঘিনীর ন্যায় দুই চক্ষু মেলিয়া তাহার পানে চাহিলেন। কুহু কিঙ্করীকে চোখের ইশারা করিয়া বলিল— ‘তুই যা।’

কিঙ্করী পাখা রাখিয়া নিঃশব্দে চলিয়া গেল। রানী কুহুর পানে নির্নিমেষ চাহিয়া রহিলেন।

কুহু একটু বিকলভাবে হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিল— ‘আজও হল না।’

রানী হাতের যূথীমাল্য খণ্ড খণ্ড করিয়া দূরে নিক্ষেপ করিলেন। কুহুর বুক দুরু দুরু করিয়া উঠিল। সে তাড়াতাড়ি শয্যার উপর নত হইয়া দ্রুতকণ্ঠে বলিল— ‘কিন্তু দেখা হয়েছিল। কথা বলেছি।’

রানী শয্যার উপর এক হাতে ভর দিয়া উঠিয়া বসিলেন, বলিলেন— ‘কি কথা বলেছিস্?’

কুহু বলিল— ‘ঠারে ঠোরে যতদূর বলা যায় তা বলেছি। কিন্তু— তিনি নূতন নগরে এসেছেন, রাজপুরীতে প্রবেশ করতে রাজী নয়।’

তীক্ষ্ণ শিখর-দশন দিয়া রানী অধর দংশন করিলেন। মনে হইল অধর কাটিয়া রক্ত ঝরিয়া পড়িবে। ঠিক এই সময় দূর হইতে মৃদঙ্গ-মঞ্জীরার মৃদু ঝঙ্কার ভাসিয়া আসিল— ঝনি ঝমকি ঝনি ঝমকি।

রানী শিখরিণীর বক্ষ বিমথিত করিয়া উত্তপ্ত নিশ্বাস বাহির হইল, সুন্দর মুখ হিংসায় ক্রোধে বিকৃত হইয়া উঠিল। তিনি নিজ কণ্ঠে একবার অঙ্গুলি স্পর্শ করিয়া কর্কশ স্বরে বলিলেন— ‘পানীয় দে।’

শয্যার পাশে ভৃঙ্গারে কপিত্থ-সুরভিত শীতল পানীয় ছিল, কুহু ত্বরিতে তাহা সোনার পাত্রে ঢালিয়া রানীর হাতে দিল। রানী একবার তাহা অধরে স্পর্শ করিলেন, তারপর ক্রুদ্ধ হস্তসঞ্চালনে পাত্র ছুঁড়িয়া ফেলিয়া শয়ন করিলেন।

ভয়ে কুহুর বুক শুকাইয়া গেল। তবু সে মুখে সাহস আনিয়া রানীর কানে কানে বলিল— ‘দেবি, আপনি অধীর হবেন না। ফুলে মধু আসতে সময় লাগে। আমি কাল আবার যাব।’

উপাধানে মুখ গুঁজিয়া রানী বলিলেন— ‘তুই দূর হয়ে যা।’

কুহু বলিল— ‘আমি যাচ্ছি, আপনি ঘুমান। আমি শয্যা-কিঙ্করীকে ডেকে দিয়ে যাচ্ছি।’

কুহু প্রস্থানোদ্যতা হইলে রানী চকিতে শয্যা হইতে মাথা তুলিলেন। তাঁহার দৃষ্টি সন্দেহে প্রখর। কুহু দ্বারের কাছে পৌঁছিলে তিনি ডাকিলেন— ‘কুহু, শুনে যা।’

কুহু ফিরিয়া শয্যার পাশে আসিল। রানী মর্মভেদী চক্ষে তাহাকে নিরীক্ষণ করিয়া শেষে বলিলেন— ‘তুই আজ আমার ঘরে শো।’

রানীর মনের ভাব কুহু বুঝিল। সে মুখে হাসি আনিয়া বলিল— ‘এ ঘরে শোব আমার ভাগ্যি। শয্যা-কিঙ্করীকে ডেকে দিই, সে বাতাস করুক।’

শয্যা-কিঙ্করী আসিয়া রানীকে বীজন করিতে লাগিল। কুহু পঙ্খের কারুকার্যখচিত মেঝেয় শয়ন করিল। রানী থাকিয়া থাকিয়া সশব্দ উষ্ণ নিশ্বাস ফেলিতে লাগিলেন। কুহু তাহা শুনিতে শুনিতে মনে মনে রানীকে যমালয়ে পাঠাইতে পাঠাইতে ঘুমাইয়া পড়িল।

রাজার প্রমোদভবনে তখনও মৃদঙ্গ-মঞ্জীরা বাজিতেছে— ঝনি ঝমকি ঝনি ঝমকি।

এইখানে রাজ-অবরোধের সংস্থা সংক্ষেপে প্রকাশ করা প্রয়োজন।

সক্রিয় রাজশক্তি যখন স্বধর্ম বিসর্জন দিয়া আত্মপরায়ণতার সঙ্কীর্ণ গণ্ডীতে আবদ্ধ হইয়া পড়ে তখন বদ্ধ জলাশয়ের মত তাহাতে বিষাক্ত কীটাণু জন্মগ্রহণ করিয়া সমস্ত পরিমণ্ডল দূষিত করিয়া তোলে। গৌড়ের রাজপরিবারে তাহাই হইয়াছিল। ভাস্করবর্মা তেজস্বী বীরপুরুষ ছিলেন, নিজ বীর্যবলে সমস্ত দেশ করায়ত্ত করিয়াছিলেন। কিন্তু ভাস্করবর্মার দেহান্তের পর তৎপুত্র অগ্নিবর্মা যখন রাজা হইলেন তখন তিনি পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করিলেন না, সম্পূর্ণ ভিন্ন পথ ধরিলেন। যৌবনের অদম্য ভোগস্পৃহার স্রোতে রাজধর্ম বিবেকবুদ্ধি হিতবুদ্ধি সব ভাসিয়া গেল; নবীন রাজার পৌরুষ যোষিৎমণ্ডলীর মধ্যে সীমাবদ্ধ হইল। লজ্জিতা রাজলক্ষ্মীকে বিদায় দিয়া তিনি অনঙ্গ পূজায় মত্ত হইলেন। অন্তঃপুর ভোগমন্দিরে পরিণত হইল।

রানী শিখরিণীকে বিবাহ করিবার পর কিছুকাল অগ্নিবর্মা রানীর রূপযৌবনের সম্মোহনে আকৃষ্ট হইয়া রহিলেন। কিন্তু ক্রমে নূতনত্বের মোহ অপগত হইলে রাজার মধুলুব্ধ চিত্ত উদ্যানসঞ্চারী চঞ্চরীকের ন্যায় অন্য পুষ্পে ধাবিত হইল। শিখরিণী অন্তঃপুরে পড়িয়া রহিলেন। রাজা অন্তঃপুরের মধু নিঃশেষ করিয়া প্রমোদভবনে গিয়া নূতন সভানন্দিনীদের লইয়া কেলিকুঞ্জ রচনা করিলেন।

রানী শিখরিণী অভিমানিনী রাজকন্যা, তিনি এই অবহেলা সহ্য করিবেন কেন? বিশেষত সম্ভোগতৃষ্ণা তাঁহার অন্তরেও কম ছিল না। রাজার দ্বারা পরিত্যক্তা হইয়া তিনি প্রতিহিংসার ছলে আপন যৌবন-লালসা চরিতার্থ করিবার সুযোগ পাইলেন। মন যাহা চায় বিবেক তাহাতে বাধা দিল না। শুদ্ধান্তঃপুরে জার প্রবেশ করিল।

রানীর প্রধানা দাসী ছিল কুহু, সে হইল দূতী। কুহু অতিশয় চতুরা, সে রানীর জন্য নাগর সংগ্রহ করিয়া আনিত। নিজেকেও বঞ্চিত করিত না, ইচ্ছামত মনের মানুষ বাছিয়া লইত।

কদাচ রানী মন্দিরে পূজা দিবার অছিলায় আন্দোলিকায় চড়িয়া পথে বাহির হইতেন; তখন কোনও সুদর্শন পুরুষ তাঁহার নেত্রপথে পতিত হইলে তিনি কুহুকে ইঙ্গিত করিতেন। কুহু ব্যবস্থা করিত।

এইভাবে পাঁচ বছর কাটিয়াছে। একথা বেশিদিন চাপা থাকে না; নগরের রসিক সমাজে কানাঘুষা চোখ-ঠারাঠারিতে আরম্ভ হইয়া কালক্রমে প্রকাশ্য শ্লেষ-বিদ্রূপে পর্যবসিত হইয়াছে। রানী কিন্তু কিছুই গ্রাহ্য করিতেন না। রাজ-স্বৈরিণীকে শাসন করিবারও কেহ নাই। নামমাত্র আবরণের অন্তরালে লজ্জাহীন ব্যভিচার চলিতেছিল।

বজ্রকে দেখিয়া রানীর লিপ্সা যেমন তাহার প্রতি ধাবিত হইয়াছিল, কুহুও তেমনি মজিয়াছিল। ফলে দুই সহকর্মিণী গোপনে প্রতিদ্বন্দ্বিনী হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। কিন্তু প্রকাশ্যে প্রতিযোগিতা করিবার স্পর্ধা কুহুর নাই, সে অতি সূক্ষ্মভাবে নিজের খেলা খেলিতে আরম্ভ করিয়াছিল। সূক্ষ্ম খেলা খেলিতে কুহু বড় কুশলী।

কুহু ও শিখরিণী দুইজনেই সমান পাপিষ্ঠা, কিন্তু তাহাদের প্রকৃতি সমান নয়। রানীর প্রকৃতি বাঘিনীর ন্যায় নিষ্ঠুর ও আত্মসর্বস্ব, আপনি ক্ষুধা ব্যতীত আর কিছুতেই তাঁহার ভ্রূক্ষেপ নাই। কিন্তু কুহুর প্রকৃতি অন্য রূপ; সে অজগর সাপের মত শিকারকে প্রথমে সম্মোহিত করিয়া আলিঙ্গনের পাকে পাকে জড়াইয়া ধীরে ধীরে আত্মসাৎ করিতে চায়।

প্রকৃতিগত পার্থক্য থাকিলেও দুই নারীই সমান মারাত্মক। বোধহয় কুহু একটু অধিক মারাত্মক।

কুহু গুপ্তদ্বার পথে অন্তর্হিত হইলে বজ্র কিছুক্ষণ অন্ধকারে দাঁড়াইয়া রহিল, তারপর ধীরে ধীরে ফিরিয়া চলিল। রাজপুরীর বিপুল ছায়াতল হইতে নির্গত হইয়া সে দেখিল পূর্বাকাশে কৃষ্ণপক্ষের ক্ষীণচন্দ্র উদয় হইতেছে। আলোক অতি অস্পষ্ট হইলেও পথভ্রষ্ট হইবার ভয় নাই।

ঘুমন্ত নগর, নির্জন পথ, গৃহগুলি ছায়ামূর্তির ন্যায় দাঁড়াইয়া আছে। দেখিলে মনে হয় এই নগর বাস্তব নগর নয়, কোনও মায়াবী মন্ত্রবলে এই অপ্রাকৃত দৃশ্য রচনা করিয়াছে; কোনও দিন ইহা জীবন্ত মানুষের কর্মকোলাহলে মুখরিত ছিল না, প্রভাত হইলে অলীক মায়াকুহেলির ন্যায় অদৃশ্য হইয়া যাইবে।

বজ্রের কিন্তু এই অবাস্তব পরিবেশের প্রতি দৃষ্টি ছিল না। একাকী পথ চলিতে চলিতে সে আপন মনের বিচিত্র রহস্যজালে জড়াইয়া পড়িয়াছিল। তিমিরাবৃত রাজপুরী; তাহার অভ্যন্তরে কুটিল দুর্গম অন্তঃপুর। কুণ্ডলিত সর্প যেন আপন কুণ্ডলীর মধ্যে মাথা রাখিয়া ঘুমাইতেছে; সাপের মাথার মণি ঐ কুণ্ডলীর মধ্যে লুকানো আছে। কুহু এই অপূর্ব রহস্যলোকের দ্বারে দাঁড়াইয়া তাহাকে ডাকিয়াছিল, ভিতরে আহ্বান করিয়াছিল—

কুহু! — একদিক হইতে কুহু যেমন বজ্রকে আকর্ষণ করিয়াছিল, অন্যদিকে তেমনি বিকর্ষণও করিয়াছিল। কুহুর রূপযৌবন তাহাকে লুব্ধ করিতে পারে নাই, বরং কুহুর লোলুপ প্রগল্‌ভতা তাহার অন্তরে বিতৃষ্ণার সঞ্চার করিয়াছিল। কিন্তু অপর পক্ষে কুহুর স্নেহ-তরল মর্মজ্ঞ নারীপ্রকৃতিকেও সে অবহেলা করিতে পারে নাই। কুহু যত দুষ্টাই হোক তাহার প্রীতিসরস হৃদয়ের মূল্য বজ্রের কাছে অল্প নয়। কুহুকে মনের কথা বলিলে সে বুঝিবে, কুহুর সাহচর্যে তাহার প্রবাসের একাকিত্ব ঘুচিবে, মন শান্ত হইবে। কুহুকে অন্তরের দিক দিয়া তাহার প্রয়োজন।

বজ্র যখন আপন কক্ষে ফিরিল তখন রাত্রি তৃতীয় প্রহর, দীপ নিভিয়া গিয়াছে। বজ্র অন্ধকারে কলস হইতে জল ঢালিয়া পান করিল, তারপর শয্যায় শয়ন করিল।

কাল আবার কুহু আসিবে—। ভাবিতে ভাবিতে সে ঘুমাইয়া পড়িল।