১৬৯তম অধ্যায়
নাড়ীজঙ্ঘনামক বকসহ গৌতম-সম্ভাষণ
“হে ধৰ্ম্মরাজ! পরদিন শর্ব্বরী প্রভাত হইবামাত্র সেই আগন্তুক ব্রাহ্মণ বিদায় গ্রহণ করিলে গৌতম স্বীয় আবাস হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া সমুদ্রাভিমুখে যাত্রা করিলেন। গমনকালে পথিমধ্যে একদল সমুদ্রগমনোন্মুখ বণিকের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হইল। তিনি সেই বণিক্দিগকে নিরীক্ষণপূৰ্ব্বক পরমাহ্লাদে তাহাদিগেরই সমভিব্যাহারে গমন করিতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে সেই বণিক্দল কোন গিরিগহ্বরে প্রবেশ করিলে এক মত্ত-মাতঙ্গ অকস্মাৎ বহির্গত হইয়া সেই বণিক্দিগকে বিনাশ করিতে আরম্ভ করিল। তদ্দর্শনে গৌতম নিতান্ত ভীত হইয়া সেই হস্তীর হস্ত হইতে কথঞ্চিৎ মুক্তিলাভপূৰ্ব্বক প্রাণরক্ষাৰ্থ প্রাণপণে উত্তরাভিমুখে ধাবমান হইলেন এবং অসহায় একাকী কিম্পুরুষের ন্যায় অরণ্যমধ্যে বিচরণ করিতে লাগিলেন। পরিশেষে তিনি সমুদ্রগমনের পথ অবলম্বনপূৰ্ব্বক গমন করিতে করিতে নন্দনকাননবৎ সুন্দর এক সুরম্য কাননে উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন যে, ঐ স্থানে পাদপসমুদয় নিরন্তর ফলপুষ্পে সুশোভিত রহিয়াছে। চূতবৃক্ষ [আম্র] সকল ঋতুতেই ফল প্রসব করিতেছে। শাল, তাল, তমাল, চন্দন ও কালাগুরু বৃক্ষ উহার অপূৰ্ব্ব শোভা সম্পাদন করিয়াছে। যক্ষ ও কিন্নরগণ উহাতে বিহার করিতেছে এবং মনুষ্যবদন [মানুষতুল্য মুখ—মুখের আকৃতি মানুষের মুখের ন্যায়] ভারুণ্ড ও ভূলিঙ্গ প্রভৃতি সামুদ্রিক ও পার্ব্বতীয়। বিহঙ্গমগণ রমণীয় মধুরগন্ধে আমোদিত পৰ্ব্বতপ্রস্থে সুস্বরে গান করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছে। গৌতম সেই সমস্ত পক্ষীদিগের শ্রুতিসুখকর সঙ্গীত শ্রবণ করিতে করিতে কিয়দ্দূর গমন করিয়া এক কাঞ্চন-বালুকাসমাচ্ছন্ন স্বর্গতুল্য সুরম্য সমতল প্রদেশে একটি বটবৃক্ষ নিরীক্ষণ করিলেন। উহার শাখা-প্রশাখা চতুর্দ্দিকে পরিব্যাপ্ত হওয়াতে উহা ছত্রের ন্যায় শোভা ধারণ করিয়াছে। ঐ বৃক্ষ নিরন্তর পুষ্পফলে পরিশোভিত ও উহার মূলদেশ চন্দনবারিদ্বারা সংসিক্ত। গৌতম সেই মনোহর পবিত্র বটবৃক্ষ নিরীক্ষণ করিয়া প্রফুল্লমনে উহার মূলদেশে উপবেশন করিলেন। ঐ সময় সুগন্ধি সমীরণ গৌতমের কলেবর পুলকিত করিয়া প্রবাহিত হইতে লাগিল। গৌতম সেই সুশীতল বায়ুপ্রভাবে গতক্লম [বিগতশ্রম] হইয়া তথায় পরমসুখে শয়ন করিলেন।
“কিয়ৎক্ষণ পরে দিবাকর অস্তগত ও সন্ধ্যাকাল প্রাদুর্ভূত হইল। ইত্যবসরে ব্রহ্মার প্রিয়সখা কশ্যপপুত্র নাড়ীজঙ্ঘনামক বক ব্রহ্মলোক হইতে তথায় সমুপস্থিত হইল। উহার আর একটি নাম রাজধৰ্ম্ম। ঐ বিহঙ্গম দেবকন্যার গর্ভসম্ভূত ও দেবতার ন্যায় প্রভাসম্পন্ন।
“গৌতম সেই সমলঙ্কৃতকলেব [অলঙ্কৃত দেহ]র বিহঙ্গমকে নিরীক্ষণ করিবামাত্র অতিমাত্র বিস্মিত হইলেন এবং ক্ষুৎপিপাসায় নিতান্ত কাতর হইয়া উহাকে বধ করিবার অভিসন্ধি করিতে লাগিলেন। বিহগরাজ রাজধৰ্ম্ম সেই ব্রাহ্মণকে তথায় সমুপস্থিত দেখিয়া স্বাগতপ্রশ্ন করিয়া কহিল, ‘ব্রহ্মন্! আজ আমার পরম সৌভাগ্য যে, আপনি অতিথিরূপে আমার আবাসে উপস্থিত হইয়াছেন। এক্ষণে দিবাকর অস্তগত ও সন্ধ্যাকালও সমুপস্থিত হইল, অতএব এই রাত্রি এইস্থানেই পান-ভোজন করিয়া অতিবাহিত করুন; কল্য প্রাতঃকালে স্বেচ্ছানুসারে গমন করিবেন।’ ”