১৬৮তম অধ্যায়
শল্যকর্ত্তৃক বিরাটভ্রাতা শতানীকসংহার
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! মহাবীর মদ্ররাজ দ্রোণাচার্য্যের আক্রমণার্থ সসৈন্য সমাগত বিরাটনৃপতিকে শরনিকরে সমাচ্ছন্ন করিতে লাগিলেন। পূর্ব্বে বলি ও বাসবের যেমন যুদ্ধ হইয়াছিল, এক্ষণে ঐ দুই মহাধনুর্দ্ধরের তদ্রূপ ঘোরতর যুদ্ধ উপস্থিত হইল। মদ্ররাজ সত্বর নতপর্ব্ব শতশরদ্বারা সেনাপতি বিরাটনৃপতিকে আঘাত করিলে, বিরাটরাজ প্রথমতঃ শাণিতনয়শরে মদ্ররাজকে প্রতিবিদ্ধ করিয়া পুনরায় ত্রিসপ্ততি ও তৎপরে শতশরে বিদ্ধ করিলেন। তখন মহাবীর শল্য বিরাটরাজের চারি অশ্ব বিনাশপূর্ব্বক দুইবাণে ছত্র ও ধ্বজ ছেদন করিয়া ফেলিলেন। বিরাটনৃপতি লম্ফপ্রদানপূর্ব্বক স্বীয় অশ্ববিহীন রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া কার্মুক বিস্ফারিত করিয়া শাণিত শরনিকর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। ঐ সময় মহাবীর শতানীক স্বীয় সহোদর বিরাটকে অশ্ববিহীন অবলোকন করিয়া সর্ব্বলোকসমক্ষে রথারোহণে মদ্ররাজসমীপে ধাবমান হইলেন। তখন মহাবীর শল্য শতানীককে সমাগত দেখিয়া ক্ষণকাল শনিকরে বিদ্ধ করিয়া পরিশেষে তাঁহাকে যমরাজের রাজধানীতে প্রেরণ করিলেন।
“হে মহারাজ! এইরূপে মহাবীর শতানীক নিহত হইলে, বাহিনীপতি বিরাট তাঁহার রথে আরোহণ করিয়া নয়ন বিস্ফারণপূর্ব্বক ক্রোধভরে দ্বিগুণতর বিক্ৰম প্ৰকাশপূর্ব্বক শরনিকরে মদ্ররাজের রথ সমাচ্ছন্ন করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর শল্য ক্রোধভরে সেনাপতি বিরাটরাজের বক্ষস্থলে নতপর্ব্ব শতশর নিক্ষেপ করিলেন। মহারথ বিরাটনৃপতি শল্যের শরাঘাতে অতিমাত্র বিদ্ধ হইয়া রথোপরি অবসন্ন ও মূর্চ্ছাগত হইলেন। সারথি তাঁহাকে তদবস্থ দেখিয়া সত্বর সমরাঙ্গন হইতে অপসারিত করিল। তখন সেই বহুল পাণ্ডবসৈন্য শল্যশরে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া চতুর্দ্দিকে ধাবমান হইল। মহাবীর ধনঞ্জয় ও বাসুদেব তদ্দর্শনে সত্বর শল্যসন্নিধানে আগমন করিলেন। তখন রাক্ষসে অলম্বুষ তুরঙ্গবদন ঘোরদর্শন পিশাচগণে সংযুক্ত, রক্তাধ্বজপটপরিশোভিত, মাল্যবিভূষিত, ঋক্ষচর্ম্মসংবৃত, বিচিত্রপক্ষ, বিকটাক্ষ, অনবরত শব্দায়মান, গৃধ্ররাজকর্ত্তৃক অধিষ্ঠিত, উন্নতধ্বজদগুসম্পন্ন, অষ্টচক্রবিশিষ্ট, লৌহময় রথে আরোহণ করিয়া তাঁহাদের দুইজনের প্রতি ধাবমান হইল। শৈলরাজ যেমন সমীরণের গতি রোধ করিয়া থাকে, তদ্রূপ সেই বিদলিত অঞ্জনপুঞ্জসদৃশ রাক্ষসরাজ অনবরত শরনিকর বর্ষণপূর্ব্বক অর্জ্জুনকে অবরোধ করিল। তখন অলম্বুষের সহিত অর্জ্জুনের কাক, গৃ, বক, উলূক, কঙ্ক ও গোমায়ুগণের হর্ষবর্দ্ধন, দর্শকগণের প্রীতিকর ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হইল। মহাবীর অর্জ্জুন ছয়শরে রাক্ষস অলম্বুষকে নিপীড়িত ও শাণিত দশবাণে তাহার ধ্বজদণ্ড খণ্ড খণ্ড করিয়া তিনশরে তাহার সারথি, তিনশরে ত্রিবেণু, একশরে কার্মুক ও চারশরে অশ্বচতুষ্টয় ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তখন রাক্ষস অলম্বুষ পুনরায় জ্যাসম্পন্ন অন্য শরাসন গ্রহণ করিল। মহাবীর অর্জ্জুন অবিলম্বে তাহাও ছেদন করিয়া তাহাকে নিশিত চারিশরে বিদ্ধ করিলেন। অলম্বুষ অর্জ্জুনশরে গাঢ়তর বিদ্ধ হইয়া প্রাণভয়ে সমর পরিত্যাগপূর্ব্বক পলায়ন করিল।
“হে মহারাজ! মহাবীর ধনঞ্জয় এইরূপে অলম্বুষকে পরাজয় করিয়া কুঞ্জর, অশ্ব ও মনুষ্যগণের প্রতি শরনিকর বর্ষণপূর্ব্বক অলিবম্বে দ্রোণসন্নিধানে ধাবমান হইলেন। দ্রোণসৈন্যগণ তাঁহার সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া সমীরণোম্মূলিত মহীরুহসমুদয়ের ন্যায় ভূতলে নিপতিত হইতে লাগিল। তদ্দর্শনে সকলেই নিতান্ত ভীত হইয়া ভয়ব্যাকুলিত মৃগযূথের ন্যায় সমর পরিত্যাগপূর্ব্বক চতুর্দ্দিকে ধাবমান হইল।”