১৬৭তম অধ্যায়
যুধিষ্ঠির জিজ্ঞাসায় অর্জ্জুনের অস্ত্ৰাদিলাভ বর্ণন
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! পুরন্দর প্রস্থান করিলে ধনঞ্জয় কৃষ্ণা ও ভ্রাতৃগণের সহিত ধর্ম্মপুত্রকে অভিবাদন করিলেন। রাজা যুধিষ্ঠির তাহার মস্তকাঘ্রাণ করিয়া হৃষ্টান্তঃকরণে গদগদ বচনে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ভ্ৰাতঃ! কি প্রকারে তোমার এতাবৎকাল সুরলোকে অতিবাহিত হইল? কি প্রকারে শতক্রতুকে পরিতুষ্ট করিয়া অস্ত্ৰ-সমস্ত গ্রহণ করিলে? তুমি কি সমুদয় অস্ত্রে সম্যক শিক্ষিত হইয়াছ? মহেন্দ্র ও মহাদেব কি তোমার প্রতি প্রীত হইয়াই তোমাকে এই সকল অস্ত্ৰ প্ৰদান করিয়াছেন? হে অরিন্দম! তুমি ভগবান ইন্দ্রের এমন কি প্রিয়কাৰ্য্য সম্পাদন করিয়াছ যে, তিনি তোমাকে প্রিয়কারী বলিয়া নির্দেশ করিলেন? যে প্রকারে ভগবান পুরন্দর ও পিনাকধারী তোমার দর্শনগোচর হইলেন, তুমি যে প্রকারে অস্ত্রসমুদয় হস্তগত করিলে, যে প্রকারে তাহাদিগের আরাধনা করিয়াছ এবং দেবরাজের যে সকল প্রিয়কাৰ্য্য করিয়াছে, তৎসমুদয় বিস্তারিতরূপে শ্রবণ করিবার নিমিত্ত কৌতুহলাক্রান্ত হইয়াছি; অতএব তুমি তাহা আনুপূর্ব্বিক বর্ণনা কর।”
শিবের নিকট পাশুপতা-অস্ত্ৰপ্ৰাপ্তি-কথা
অর্জ্জুন কহিলেন, “মহারাজ! আমি যেরূপ অনুষ্ঠানের অনুবর্ত্তী। হইয়া সুরেশ্বরের ও শঙ্করের সাক্ষাৎকারলাভ করিয়াছিলাম, তাহা শ্রবণ করুন। আমি আপনার নিকটে সেই বিদ্যা অধ্যয়ন করিয়া আপনার আদেশানুসারে কাম্যক-কানন হতে ভৃগুতুঙ্গে গমনপূর্ব্বক তপস্যা আরম্ভ করিলাম। একরাত্ৰি বাসের পরে পথিমধ্যে এক ব্রাহ্মণের সহিত সাক্ষাৎ হইলে তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “হে কৌন্তেয়! তুমি কোথায় গমন করিবে? আমি তাঁহার নিকট সমুদয় বৃত্তান্ত অবিকল বর্ণন করিলাম। তিনি আমার বাক্যশ্রবণে আমার প্রতি প্রীতিমান হইয়া সৎকারপূর্ব্বক কহিলেন, “হে ভারত! প্রফুল্প হইয়া তপশ্চৰ্য্যা কর; তুমি অচিরকালমধ্যেই সুররাজের সাক্ষাৎকার লাভ করিবে।”
“আমি তাঁহার বাক্যে হিমালয়-পর্ব্বতে আরোহণপূর্ব্বক প্রথম মাস ফলমূলভোজনে, দ্বিতীয় মাস জলমাত্র-পানে, তৃতীয় মাস নিরশনে ও চতুর্থ মাস। ঊৰ্দ্ধবাহু হইয়া অতিবাহন করিলাম; কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, তাহাতেও আমার প্রাণবিয়োগ হইল না। অনন্তর পঞ্চম মাসের প্রথম বাসর অতীত হইলে অবলোকন করিলাম, এক বরাহ মুহুর্মুহু বিবর্ত্তিত হইয়া পোত্র [নাসাগ্ৰ] ও চরণদ্বারা ধরাতল বিদার এবং জঠরদ্বারা সংমার্জ্জনপূর্ব্বক আমার অভিমুখে আগমন করিতেছে। কিরাতবেশধারী এক পুরুষ স্ত্রীগণে পরিবৃত হইয়া ধনুর্ব্বাণ-খড়্গ গ্রহণপূর্ব্বক তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আগমন করিতেছে। আমি যে সময়ে ধনু ও অক্ষয় তূণীরদ্ধয় গ্রহণ করিয়া সেই ভীষণ জন্তুকে আঘাত করিলাম, সেই সময় সেই কিরাতও শরাসন আকর্ষণপূর্ব্বক যেন আমার হৃৎকম্প উৎপাদন করিয়াই তাহাকে দৃঢ়তররূপে তাড়না করিল এবং উচ্চৈঃস্বরে আমাকে আহ্বান করিয়া কহিল, ‘তুমি মৃগয়াধর্ম্মের প্রথা পরিত্যাগ করিয়া কি নিমিত্ত আমার পূর্ব্বপরিগ্রহ লক্ষ্যের প্রতি শরাঘাত করিলে? অতএব এক্ষণে এই নিশিত শরজালে তোমার দর্পচূৰ্ণ করিতেছি।” সেই মহাকায় ধনুৰ্দ্ধর এই কথা কহিয়া শরবর্ষণপূর্ব্বক আমাকে আচ্ছাদন করিল। আমিও তাহার উপর শরনিক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিলাম; পর্ব্বত যেমন বজ্রপরম্পরাদ্বারা আহত হয়, কিরাতের কলেবরও সেইরূপ আমার নিক্ষিপ্ত অনুমন্ত্রিত, দীপ্তমুখ শরসমূহদ্বারা বিদ্ধ হইল। পরে তাহার সেই শরীর শতসহস্র প্রকার হইয়া উঠিল; তথাপি আমি তাহার তাদৃশ ভিন্ন ভিন্ন শরীরে শরাঘাত করিতে লাগিলাম, কিন্তু সেই সকল শরীর পনরায় একীভূত হইয়া গেল, ইহা দেখিয়াও আমি শরাঘাত করিতে নিরস্ত হইলাম না। পরে সেই কিরাত আমার সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইয়া কখন শরীর সূক্ষ্ম ও মস্তক বৃহৎ, কখন বা শরীর বৃহৎ ও মস্তক ক্ষুদ্র, কখন বা একীভূত হইয়া রণভূমিতে বিচরণ করিতে লাগিল। আমি বারংবার সরনিকর বর্ষণেও তাহাকে পরাভব করিতে না পারিয়া শরাসনে বায়ব্যাস্ত্ৰ সংযোজনা করিলাম, কিন্তু তদ্বারাও তাঁহাকে পরাভব করিতে সমর্থ হইলাম না; প্রত্যুত, সেই মহাস্ত্ৰ প্ৰতিহত হইল দেখিয়া একেবারে বিস্ময়সাগরে নিমগ্ন হইলাম। মহারাজ! আমি পুনর্ব্বার দীপ্তিমান শঙ্কুকৰ্ণ, বারুণ, শর বর্ষ, প্রস্তরবর্ষ ও প্ৰকাণ্ড শলভাস্ত্ৰ গ্ৰহণ করিয়া তাহার সহিত যুদ্ধ করিতে আরম্ভ করিলাম, কিন্তু কিরাত সেই সমুদয় অস্ত্রই গ্রাস করিয়া ফেলিল। তখন আমি শরাসনে ব্রহ্মাস্ত্র সংযোজন করিলাম। সেই সংযোজিত ব্রহ্মাস্ত্র প্রজ্বলিত শর সমূহ প্রসব করিয়া বৰ্ধিত হইতে লাগিল; তাহার তেজঃপ্রভাবে ক্ষণমাত্রে সমুদায় লোকক সন্তাপিত হইল এবং দিঙ্মণ্ডল ও নভোমণ্ডল এককালে প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল। কিন্তু মহাতেজাঃ কিরাত তাহাও বিনষ্ট করিল দেখিয়া, আমার অন্তঃকরণে সাতিশয় ভয় সঞ্চার হইল ; তথাপি ধনুঃ ও অক্ষয় তূণীরদ্বয় গ্ৰহণপূর্ব্বক তাহাকে আঘাত করিলাম, কিন্তু সে সহসা সে সকল অস্ত্র ও ভক্ষণ করিয়া ফেলিল। এই রূপে সমুদায় অস্ত্র প্রয়োগ বিফল হইল অবলোকন করিয়া তাহার সহিত বাহুযুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলাম। কিন্তু মুষ্ট্যাঘাত ও তল প্রহারপূর্ব্বক ব্যায়াম করিয়া তাহাকে পরাভূত করিতে পারিলাম না; প্রত্যুত আমিই অবসন্ন হইয়া ধরাতলে পতিত হইলাম।
অনন্তর সেই কিরাত হাস্য করিয়া আমার সমক্ষেই স্ত্রীগণের সহিত অন্তর্হিত হইল; পরে কিরাতমূৰ্ত্তি পরিহারপূর্ব্বক দিব্যাম্বরশোভিত ভুজঙ্গভূষিত পিনাকপাণি বিগ্রহ পরিগ্রহ করিয়া পরক্ষণেই ঊমা সমভিব্যাহারে আবিভূত হইলেন। আমি তৎকাল পর্য্যন্ত ও পূর্ব্বের ন্যায় সমর ভূমিতে সম্মুখীন হইয়া রহিয়াছি দেখিয়া, তিনি আমার সমীপে আগমনপূর্ব্বক কহিলেন, হে পরন্তপ ! আমি তোমার প্রতি সাতিশয় সন্তুষ্ট হইয়াছি ; এই ধনুঃ ও অক্ষয় তূণীরদ্ব গ্রহণ কর; ইহা কহিয়া সেই শরাসন ও অক্ষয় তূণীরদ্বয় আমাকে প্রদান করিলেন; পরে পুনরায় কহিলেন, হে কৌন্তেয়! আমি তোমার প্রতি একান্ত সন্তুষ্ট হইয়াছি; তোমার প্রার্থণীয় কি? ব্যক্ত কর, আমি তোমাকে অমরত্ব ভিন্ন আর সমুদায় বর প্রদান করিব। তখন আমি তাহাকে মনে মনে প্রণাম করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলাম, ভগবন্! যদি আমার প্রতি প্রসন্ন হইয়া থাকেন, তাহা হইলে আমাকে সমুদয় দেব অস্ত্র প্রদান করুন, ইহাই আমার প্রর্থনা। অনন্তর ভগবান্ ত্রিলোচন কহিলেন, হে পাণ্ডব! আমি তাহা প্রদান করিলাম ; আমার রৌদ্রাস্ত্র তোমাকে নিরন্তর উপসনা করিবে, কিন্তু এই সনাতন অস্ত্র কদাপি মানবের প্রতি প্রয়োগ করিও না, ইহা দুর্ব্বলের প্রতি প্রয়োগ করিলে সমস্ত জগৎ ভস্মসাৎ করিবে। যখন তুমি নিতান্ত পীড্যমান হইবে ও অন্যান্য অস্ত্র সমূহ প্রতিহত করিবার মানস করিবে, তখন ইহা প্রয়োগ করিও। তিনি এই কথা কহিয়া প্রীতিপ্রফুল্লচিত্তে পাশুপত অস্ত্র প্রদান করিলেন।
এই রূপে দেবদেব মহাদেব প্রসন্ন হইলে, অরাতিগণের উৎসদিন, পরসেনার নিকৰ্ত্তন, সুর, দানব ও রাক্ষসগণের দুঃসহ মূৰ্ত্তিমান পাশুপত অস্ত্র তৎক্ষণাৎ আমার পার্শ্বে অসিয়া উপস্থিত হইল। অনন্তর আমি তাঁহার আজ্ঞানুসারে সেই স্থানে উপবেশন করিলে, তিনি আমার সমক্ষেই অন্তর্হিত হইলো।