১৬৪তম অধ্যায়
বহু রথীরক্ষিত দ্রোণের পাণ্ডবসহ যুদ্ধ
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! এইরূপে সেই ধূলিজাল সমাচ্ছাদিত রণস্থল প্রদীপশিখায় সুপ্রকাশিত হইলে রথীসকল পরস্পর বিনাশমানসে শস্ত্র, প্রাস ও অসি ধারণপুর্ব্বক তথায় সমাগত হইয়া পরস্পরকে অবলোকন করিতে লাগিলেন। তখন সেই সহস্র সহস্র প্রদীপ, রত্নখচিত স্বর্ণদণ্ড ও দেবগন্ধর্ব্বগৃহীত গন্ধতৈলসুবাসিত সমধিক উজ্জ্বল প্রদীপের প্রভায় রণভূমি গ্রহপরিপূর্ণ নভোমণ্ডলের ন্যায় শোভাপ্রাপ্ত হইল। মহোল্কাসকল লোকের অভাবে বসুন্ধরাকে দগ্ধ করিতে প্রবৃত্ত হইয়াই যেন প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। বর্ষাকালে প্রদোষসময়ে পাদপসমুদয় খদ্যোতপরিপূর্ণ হইয়া যেরূপ শোভমান হয়, দিঙ্মণ্ডল প্রদীপপ্রভায় উদ্ভাসিত হইয়া তদ্রূপ শোভা পাইতে লাগিল। তখন মহারাজ দুৰ্য্যোধনের আদেশানুসারে গজারোহিগণ গজারোহিগণের সহিত, অশ্বরোহিগণ অশ্বরোহিগণের সহিত এবং রথীগণ রথীগণের সহিত কুতূলসহকারে ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ করিল। হে মহারাজ! এইরূপে সেই চতুরঙ্গসেনা ঘোরতর যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলে মহাবীর। অর্জ্জুন সত্বর মহীপালগণকে বিনাশ করিয়া কৌরবসৈন্যদিগকে বিদ্ৰাবিত করিতে লাগিলেন।”
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! নিতান্ত দুর্দ্ধর্ষ একান্ত অসহিষ্ণু মহাবীর অর্জ্জুন ক্রোধভরে আমার সৈন্যমধ্যে প্রবিষ্ট হইলে তোমাদিগের মন কিরূপ হইল এবং আমার পুত্র দুর্য্যোধনই বা তৎকালোচিত কি কৰ্তব্য অবধারণ করিল? আর কোন্ কোন্ বীর অর্জ্জুনের সম্মুখগমনে প্রবৃত্ত হইলেন? আর কোন্ কোন্ বীরই বা তৎকালে দ্রোণাচাৰ্য্যকে রক্ষা করিতে লাগিলেন? হে সঞ্জয়! মহাবীর দ্রোণাচাৰ্য্য যখন যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন, তখন কোন্ কোন্ বীর তাঁহার দক্ষিণচক্র ও কোন্ কোন্ বীর বামচক্র এবং কোন্ কোন্ বীরই বা তাঁহার পশ্চাদ্ভাগরক্ষায় প্রবৃত্ত হইলেন? আর কাহারাই বা তাঁহার সম্মুখে গমন করিলেন? হে সঞ্জয়! যিনি রথমার্গে নৃত্য করিয়াই যেন পাঞ্চালসৈন্যমধ্যে প্রবিষ্ট হইয়াছিলেন এবং ধূমকেতুর ন্যায় ক্রোধাবিষ্ট হইয়া পাঞ্চাল মহারথদিগকে শরানলে দগ্ধ করিয়াছিলেন, সেই মহাবীর দ্রোণ কিরূপে মৃত্যুমুখে নিপতিত হইলেন? হে সঞ্জয়! তুমি বিপক্ষদিগকে অব্যগ্র, অপরাজিত ও হৃষ্ট এবং মৎপক্ষীয় রথীগণকে রথশূন্য ও অন্যান্য যোদ্ধাদিগকে নিহত, বিবর্ণ ও বিকীর্ণ বলিয়া নির্দেশ করিতেছ।”
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! রাজা দুর্য্যোধন যুদ্ধার্থী দ্রোণাচার্য্যের অভিপ্রায় অবগত হইয়া সেই রজনীতে স্বীয় বশংবদ ভ্রাতা, মহাবলপরাক্রান্ত বিকর্ণ, চিত্রসেন, সুপার্শ্ব, দুর্দ্ধর্ষ ও দীর্ঘবাহু এবং তাঁহাদিগের পদানুগগণকে কহিলেন যে, ‘তোমরা সযত্নে দ্রোণাচার্য্যের পশ্চাদ্ভাগে অবস্থানপূর্ব্বক তাঁহাকে রক্ষা কর। হার্দ্দিক্য তাঁহার দক্ষিণচক্র, শল্য বামচক্র এবং মৃতাবশিষ্ট ত্রিগৰ্ত্তদেশীয় মহারথগণ তাঁহার পুরোভাগরক্ষণে নিযুক্ত হউন। আচার্য্য ক্ষমাশীল, বিশেষতঃ পাঞ্চালগণ সাতিশয় যত্নসহকারে যুদ্ধ করিতেছে; অতএব তোমরা ঐকমত্য অবলম্বনপূর্ব্বক তাঁহাকে রক্ষা কর। আচার্য্যও বলবান্, ক্ষিপ্রহস্ত ও পরাক্রমশীল। সোমকগণসমবেত পাণ্ডবদিগের কথা দূরে থাকুক, তিনি একাকী দেবগণকেও পরাজয় করিতে অসমর্থ নহেন। অতএব তোমরা মিলিত হইয়া মহারথ ধৃষ্টদ্যুম্ন হইতে দ্রোণাচার্য্যের রক্ষণে যত্নবান্ হও। পাণ্ডবসৈন্যমধ্যে ধৃষ্টদ্যুম্ন ভিন্ন আর কোন বীরই আচাৰ্য্যকে পরাজয় করিতে সমর্থ নহে। অতএব প্রাণপণে তাঁহাকে রক্ষা করিলে তিনি অনায়াসে সোমক ও সৃঞ্জয়গণকে সবলে উন্মূলিত করিতে সমর্থ হইবেন। সেনামুখস্থিত সৃঞ্জয়গণ নিহত হইলে অশ্বত্থামা নিশ্চয়ই ধৃষ্টদ্যুম্নকে নিপাতিত করিবেন। অর্জ্জুন মহারথ কর্ণের নিকট পরাজিত হইবে এবং আমিও বর্ম্মধারী ভীমসেনপ্রমুখ অবশিষ্ট পাণ্ডবগণকে পরাজিত করিব। তাহা হইলে অন্যান্য যোধগণ সহসা হীনবীৰ্য্য ও আমার অনন্তকালব্যাপী জয়লাভ হইবে সন্দেহ নাই। অতএব তোমরা রণস্থলে মহারথ দ্রোণাচাৰ্য্যকে রক্ষা কর।’
“হে ভরতশ্রেষ্ঠ! আপনার পুত্র রাজা দুর্য্যোধন সেই নিশাকালে সৈন্যগণকে এইরূপ আদেশ করিলে পর, বিজয়াভিলাষী উভয়পক্ষীয় সৈন্যগণের ঘোরতর সংগ্রাম হইল। মহাবীর অর্জ্জুন কৌরবসৈন্যগণকে এবং কৌরবগণ অর্জ্জুনকে নানাবিধ অস্ত্রাঘাতে নিপীড়িত করিতে লাগিলেন। মহাবীর অশ্বত্থামা দ্রুপদরাজকে এবং দ্রোণাচাৰ্য্য সৃঞ্জয়গণকে সন্নতপর্ব্ব শরনিকরে সমাচ্ছন্ন করিলেন। তখন সেই পরস্পরপ্রহারে প্রবৃত্ত পাণ্ডু, পাঞ্চাল ও কৌরবসৈন্যগণের ঘোরতর আর্ত্তনাদ সমুত্থিত হইল। হে মহারাজ! সেই রাত্রিকালে যেরূপ ভয়ানক যুদ্ধ হইয়াছিল, তদ্রূপ যুদ্ধ আমাদিগের বা পূর্ধ্বতন লোকদিগের কখন দৃষ্টিগোচর হয় নাই।”