১৬৪তম অধ্যায়
পাণ্ডবগণ সমীপে মহর্ষিগণের আগমন
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! সত্যপরায়ণ ধৈৰ্য্যশালী ব্রতাচারকুশল মাহাত্মা পাণ্ডবেরা সেই পর্ব্বতে অর্জ্জুনের দর্শনপ্রতীক্ষায় প্রমুদিতমনে পরমসুখে কালক্ষেপ করিতে লাগিলেন।
একদা বহুসংখ্যক গন্ধর্ব্ব ও মহর্ষিগণ প্রীত হইয়া তাঁহাদিগের নিকট আগমন করিলেন। যেমন স্বৰ্গপ্রাপ্ত হইলে সুরগণের অনির্ব্বচনীয় চিত্তপ্ৰসাদ জন্মে, তদ্রূপ সুপুষ্পিত-পাদপশোভিত। সেই নগোত্তম সন্দর্শন করিয়া মহাবীর পাণ্ডবগণের আনন্দের আর পরিসীমা রহিল না। তাঁহারা মহীধরবারের শিখরদেশে অধিরূঢ় হইয়া ময়ূরের কেকা-বাণী ও হংসকুলের কলরব-শ্রবণ এবং নানাজাতীয় কুসুমের-সুষুমা-সন্দর্শনে অপার আনন্দপ্রবাহে নিমগ্ন হইলেন। তথায় কুবেরকৃত শত শত সুরম্য সরোবর তাঁহাদিগের নয়নগোচর হইল; সেই সকল সরসীতে সর্ব্বদাই হংস, কারণ্ডব প্রভৃতি জলচর পক্ষিগণ ক্রীড়া করিতেছে; উৎপল-সকল বিকসিত হইয়া রহিয়াছে ও শৈবালদ্বারা তীরভূমিসকল সংবৃত রহিয়াছে। অত্ৰত্য ক্রীড়াপ্রদেশসকল অতিরমণীয় সুবিচিত্র মাল্যদামে সুশোভিত, নানাবিধ মণিনিচয়ে অলঙ্কত ও ধনাধিপতি কুবেরের ঐশ্বৰ্য্যানুরূপ, সুসমৃদ্ধ ছিল। মুনিগণ ইহার সুগিন্ধ কুসুমসমূহ শোভিত নানাবিধ পাদপে সমাকীর্ণ শৃঙ্গ-সকলে সুখস্বচ্ছন্দে মনের আনন্দে বিচরণ করেন।
পাণ্ডবগণ-প্ৰতি মহর্ষিগণের আশীৰ্বাদ
হে পুরুষপ্রবীর! সেই নগোত্তমের স্বীয় তেজ ও মহৌষধির প্রভাবে তথায় দিবস-রজনীর কোন বিশেষ নয়নগোচর হইত না। বহ্নি যাহার সাহায্যে যামিনীযোগে চরাচর জগৎ উদ্ভাসিত করেন, পর্ব্বতস্থ মহাপুরুষ পাণ্ডবেরা সেই সূৰ্য্যের উদয় ও অস্ত সন্দর্শন করিতেছেন। ‘হে বীরগণ! তোমরা তিমিরারি কিরণজালসমুদ্ভাসিত দিগদিগন্ত এবং তাহার উদয় ও অস্তগমনস্থান অবলোকন করিয়া স্বাধ্যায়সম্পন্ন, শুচিব্ৰত ও সত্যপরায়ণ হইয়া এই স্থানেই মহারথ পার্থের সমাগমপ্রতীক্ষায় কালক্ষেপ কর; আমরা আশীর্ব্বাদ করিতেছি, তোমরা অচিরাৎ সংগৃহীতাস্ত্ৰ ধনঞ্জয়ের সাক্ষাৎকারলাভ করিয়া সাতিশয় হৰ্ষিত হইবে, সন্দেহ নাই।”
পাণ্ডবেরা মহর্ষিগণের এইরূপ আদেশে তপস্যা ও যোগানুষ্ঠান করিতে লাগিলেন। পর্ব্বতস্থ বিচিত্র বনরাজি নিরীক্ষণ করিয়া নিরন্তর অর্জ্জুনকে চিন্তা করাতে দিবারাত্ৰ সংসংসরের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। অর্জ্জুন যখন ধৌম্যের অনুমতিক্রমে জটাধারণপূর্ব্বক প্রব্রাজিত হইয়াছেন, তদবধি তাঁহাদের হর্ষ বিলুপ্ত হইয়াছে; এক্ষণে কেবল অর্জ্জুনচিন্তায় তাঁহাদিগের চিত্ত ব্যাসক্ত রহিয়াছে; অতএব কিরূপেই বা মনের সন্তোষ হইবে।
গজেন্দ্রগামী জিষ্ণু জ্যেষ্ঠের আদেশক্রমে যে অবধি কাম্যাকবন পরিত্যাগপূর্ব্বক ইন্দ্ৰসকাশে গমন করিয়াছেন, তদবধি সকলেই শোকসাগরে নিমগ্ন হইয়া রহিয়াছেন। তাঁহারা তখন সেই পর্ব্বতে অবস্থিতি করিয়া দিনযামিনী কেবল সেই অর্জ্জুনকে চিন্তা করিয়া অতিকষ্টে একমাস অতিবাহিত করিলেন।
এদিকে ধনঞ্জয় ইন্দ্ৰালয়ে পঞ্চবর্ষ বাস করিয়া তাঁহার নিকট আগ্নেয়, বারুণক, সৌম্য, বায়ব্য, বৈষ্ণব, ঐন্দ্ৰ, পাশুপত, ব্রাহ্ম, পারমেষ্ঠ্য, যাম্য, ধাত্র, সাবিত্র ও বৈশ্রাবণেীয় অস্ত্রশস্ত্ৰলাভ করিয়া শতক্রতুকে প্ৰণাম ও প্রদক্ষিণপূর্ব্বক তৎকর্ত্তৃক অনুজ্ঞাত হইয়া শ্ৰীতিপ্ৰফুল্লমনে গন্ধমাদনে পুনরায় প্রত্যাগমন করিলেন।
যক্ষযুদ্ধপর্ব্বাধ্যায় সমাপ্ত।