১৬৩তম অধ্যায়
রথাতিরথসংখ্যানপর্ব্বাধ্যায়
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! দৃঢ়ধন্বা [স্থিরযোদ্ধা] অর্জ্জুন ভীষ্মকে বিনাশ করিবার নিমিত্ত প্ৰতিজ্ঞারাঢ় [কৃতপ্ৰতিজ্ঞ— কর্ত্তব্যবিষয়ে অটুট-সঙ্কল্প] হইলে মন্দবুদ্ধি দুৰ্য্যোধনপ্রমুখ আমার পুত্ৰগণ কি করিল? আমি দেখিতেছি [আমি নিশ্চয় বুঝিতেছি] মহাবীর অর্জ্জুন বাসুদেবের সাহায্যে সমরে ভীষ্মকে সংহার করিবে। সেই সমধিক ধীশক্তিসম্পন্ন ভীষ্ম অর্জ্জুনের প্রতিজ্ঞ শ্রবণ করিয়া কি কহিলেন এবং কৌরবগণের সেনাপতিপদে প্রতিষ্ঠিত হইয়াই বা কিরূপ অনুষ্ঠান করিতে লাগিলেন?”
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! মহাবল পরাক্রান্ত ভীস্ম, কৌরবগণের সেনাপতিপদ পরিগ্রহ [গ্রহণ] করিয়া দুর্য্যোধনের সন্তোষ সম্পাদনপূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন, “হে কুরুরাজ! আজ আমি দেবসেনানী [দেবসেনাপতি] শক্তিধর কুমার কার্ত্তিকেয়কে নমস্কার করিয়া তোমার সেনাপতি হইব, তাহাতে সন্দেহ নাই। আমি সেনানী কাৰ্য্যে অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছি, বিবিধ ব্যূহরচনায় আমার নৈপুণ্য জন্মিয়াছে এবং আমি বেতনভুক [যাহারা মাহিনা লইয়া কাৰ্য্য করে] ও অবৈতনিকদিগকে [যাহারা বিনা মাহিনায় কাৰ্য্য করে—বর্ত্তমান ভলান্টিয়ার সৈন্য] কাৰ্য্যানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত করিতে সম্পূর্ণ পারদর্শী [সখের সৈন্যের উপর আদেশ-নির্দ্দেশ যে বেতনভোগী সৈন্যের মত করা চলে না, সেনাপতি ভীস্ম সে যুদ্ধনীতিতে বিশেষ অভিজ্ঞ।] হইয়াছি। আমি সুরগুরু বৃহস্পতির ন্যায় যান, যুদ্ধ ও পরপ্ৰযুক্ত [শক্ৰনিক্ষিপ্ত] অস্ত্রের প্রতিকার সম্পূর্ণরূপে অবগত আছি এবং দৈব, গন্ধৰ্ব ও মানুষব্যূহ
[দেব-বিষয়ক গন্ধৰ্ববিষয়ক ও মানুষবিষয়ক সেনাসন্নিবেশ—জটিল ব্যূহ।] রচনা করিতে একান্ত সমর্থ; আমি তদ্বারা পাণ্ডবগণকে বিমোহিত ও যথার্থ শাস্ত্রানুসারে তোমার সেনাগণকে রক্ষা করিয়া সংগ্রাম করিব; তুমি এখন হৃদয়সন্তাপ [মনস্তাপ] দূর কর।”
“দুৰ্য্যোধন কহিলেন, “হে পিতামহ! আমি সত্য কহিতেছি, দেবাসুরের সহিত সংগ্রাম করিতেও আমি শঙ্কিত নহি; বিশেষত আপনি সেনাপতিপদ পরিগ্রহ ও পুরুষসিংহ দ্রোণাচাৰ্য্য যুদ্ধে অবস্থান করিলে আর শঙ্কার বিষয় কি? আপনাদের সাহায্যে আমার অবশ্যই বিজয়লাভ হইবে; অধিক কি, দেবরাজ্যও আমার পক্ষে দুর্লভ হইবে না। আপনি শত্ৰুগণের ও আমাদের সমুদয় বিষয়ই অবগত আছেন; অতএব এক্ষণে আমি এইসকল ভূপালের সহিত উভয় পক্ষের রথী [রথারোহণে যুদ্ধকারী] ও অতিরথের [বহু বিপক্ষসৈন্যের সহিত যুদ্ধসমর্থ যোদ্ধার] সংখ্যা শ্রবণ করিতে নিতান্ত অভিলাষী হইয়াছি।”
দুৰ্য্যোধনের প্রতি ভীষ্মের আশ্বাসবাণী
“ভীষ্ম কহিলেন, “হে দুৰ্য্যোধন! তোমার সেনাগণমধ্যে সহস্ৰ সহস্ৰ, প্রযুত [লক্ষের পরবর্ত্তী সংখ্যা নিযুত। ১০ লক্ষে এক নিযুত হয় প্রযুত নিযুতের পরবর্ত্তী সংখ্যা হওয়া উচিত। সুতরাং সংখ্যার সংজ্ঞায় নাম না থাকিলেও ১০ নিযুত। নিযুতের পরই খর্ব্ব হয়। এ হিসাবে ১০ প্রযুতে এক খর্ব্ব। বস্তুতঃ এই যে অযুত অধুত অবুদ-অবুদ শব্দের প্রয়োগ, ইহা আনন্ত্যিবাচক-অসীম, অসংখ্য এই শব্দের বোধক।] প্রযুত ও অবুদ অবুদ রথী ও অতিরথ আছে, আমি তাঁহাদের প্রাধান্যানুসারে আনুপূর্ব্বিক সংখ্যাকীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। তুমি দুঃশাসনপ্রমুখ একশত সোদর-সমভিব্যাহারে রথী হইয়া অগ্রে অবস্থান করিবে। ইহারা সকলেই অস্ত্রশস্ত্ৰে কৃপ ও দ্রোণাচার্য্যের শিষ্য; ইঁহারা আসি, চর্ম্ম, গদা, প্রাস প্রভৃতি অস্ত্রশস্ত্র পরিগ্রহ করিয়া তোমার রথপ্রান্তে [রথের সমীপে] ও হস্তিস্কন্ধে অবস্থান করিবেন। তাঁহারা শত্রুসৈন্যকে সংযুত [বন্দী], প্ৰহত [বিনাশ] ও ছিন্নভিন্ন করিতে একান্ত সমর্থ এবং যুদ্ধভার বহনে নিতান্ত পারগ [সমরপরিচালনায় সম্যক পারদর্শী]। পাণ্ডবগণের নিকট মনস্বী ধার্ত্তরাষ্ট্রগণ অপরাধী হইলেও ইঁহারাই সমরভূমিতে যুদ্ধদুর্ম্মদ পঞ্চালগণকে বিনাশ করিবেন, তাহাতে সন্দেহ নাই।
পাণ্ডবগণকে তুচ্ছ জ্ঞান করিয়া অন্যান্য শত্রুদিগকে বিনষ্ট করিব। তুমি আমার সমুদয় গুণ বিদিত হইয়াছ; এক্ষণে তাহা উল্লেখ করিবার আবশ্যকতা নাই। অতিরথ ধনুৰ্দ্ধারাগ্রগণ্য [ধনুর্ব্বাণদ্বারা যুদ্ধকারিগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ] ভোজরাজ। কৃতবর্ম্মা রণস্থলে তোমার সমস্ত কাৰ্য্য সংসাধন করিবেন, সন্দেহ নাই। যেমন দেবরাজ দানবগণকে সংহার করিয়াছিলেন, সেইরূপ নিতান্ত দুৰ্দ্ধৰ্ষ অতিরথ মদ্ররাজ শল্য শক্রগণের সেনাসকল বিনাশ করিবেন। তিনি স্বীয় ভাগিনেয় গণকে পরিত্যাগ করিয়া প্রতিনিয়ত বাসুদেবের প্রতি স্পর্দ্ধা প্রকাশ করিয়া থাকেন; অতএব তিনিই সাগরতরঙ্গমালার ন্যায় শরজালদ্বারা শত্ৰুগণকে প্লাবিত [আচ্ছাদিত] করিয়া মহারথ পাণ্ডবদিগের সহিত যুদ্ধ করিবেন। তোমার প্রিয়সুহৃৎ শিক্ষিতাস্ত্ৰ ভূরিশ্রব ও অতিরিথ সোমদত্ত অবশ্যই তোমার বিপক্ষগণের বল ক্ষয় করিবেন। দ্বিরথ [দুইজন রখীর সমান] সিন্ধুরাজ জয়দ্ৰথ দ্রৌপদীহরণকালে পাণ্ডবগণকর্ত্তৃক পরাভূত হইলে অতি কঠোর তপানুষ্ঠান করিয়া পাণ্ডবগণের সহিত যুদ্ধ করিবার নিমিত্ত দুর্লভ বরলাভ করিয়াছেন। এক্ষণে তিনি সেই শত্রুভাব ও ক্লেশপরম্পর স্মরণপূর্ব্বক প্ৰাণপরিত্যাগে [প্ৰাণপণ করিয়া] নিরপেক্ষ হইয়া তাহাদিগের সহিত যুদ্ধ করিবেন।’ ”