১৬৩তম অধ্যায়
কাম-ক্রোধাদি কুকার্য্যপ্রবৃত্তির প্রশমনপন্থা
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! কাম, ক্রোধ, মোহ, মদ, মাৎসর্য্য, ঈর্ষা, শোক, নিন্দা, অকার্য্যপ্রবৃত্তি, অসূয়া, কৃপা, ভয় ও প্রতিবিধানেচ্ছা এই ত্রয়োদশ দোষ যাহা যাহা হইতে উৎপন্ন হয়, তৎসমুদয় কীৰ্ত্তন করুন।”
ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! এয়োদশ দোষ মানবগণের ভীষণ শত্রুস্বরূপ। উহারা নিরন্তর অনবহিত মানবগণকে [স্থিরচিত্ত মানবগণকে আশ্রয়পূৰ্ব্বক অস্থিরচিত্ত করিয়া নিরন্তর ক্লেশ প্রদান করে] আশ্রয় করিয়া অবহিতচিত্তে ক্লেশ প্রদান করে। উহারা ব্যাঘ্রের ন্যায় দর্শনমাত্র বলপূৰ্ব্বক মনুষ্যকে আক্রমণ করিয়া থাকে। উহাদিগের হইতে যে অশেষ পাপ ও দুঃখ উপস্থিত হয়, তাহা অবগত হওয়া মনুষ্যগণের অবশ্য কর্ত্তব্য। এক্ষণে উহাদিগের উৎপত্তি, স্থিতি ও বিনাশের বিষয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, অবহিতচিত্তে শ্রবণ কর।
“লোভ হইতে ক্রোধের উৎপত্তি হইয়া থাকে। পরদোষকীৰ্ত্তননিবন্ধন উহা পরিবর্দ্ধিত হয় এবং ক্ষমাপ্রভাবেই উহার লয় হইয়া যায়। সঙ্কল্প হইতে কামের আবির্ভাব হইয়া থাকে। উহাকে সেবা করিলেই উহা উত্তরোত্তর পরবর্দ্ধিত হয় এবং উহা হইতে বিরত হইলে উহা নিবৃত্ত হইয়া যায়। অসূয়া পরদোষদর্শন, ক্রোধ ও লোভ হইতে উৎপন্ন হয় এবং দয়া ও তত্ত্বজ্ঞানের আবির্ভাব হইলেই উহা একেবারে উন্মূলিত হইয়া থাকে। মোহ অজ্ঞতা ও পাপানুষ্ঠাননিবন্ধন আবির্ভূত হয়, কিন্তু একবার সাধুসহবাস হইলে আর উহা অবস্থান করিতে সমর্থ হয় না। মোহবশতঃ বিরুদ্ধ শাস্ত্রের আলোচনা করিলেই বিবিধ কার্য্যারম্ভ করিতে বাসনা হয়, কিন্তু তত্ত্বজ্ঞান জন্মিলে উহা এককালে নিরাকৃত হইয়া যায়। বন্ধুবিয়োগ উপস্থিত হইলে স্নেহের আধিক্যবশতঃ শোকের উদয় হইয়া থাকে, কিন্তু যখন সমুদয় অনিত্য বলিয়া বোধ হয়, তখন আর উহার সম্পর্কও থাকে না। ক্রোধ ও লোভবশতঃ অকার্য্যপ্রবৃত্তির উৎপত্তি হইয়া থাকে এবং দয়া ও বৈরাগ্য উপস্থিত হইলেই উহার শান্তি হয়। সত্যত্যাগ ও অসাধুসংসর্গনিবন্ধন মাৎসর্য্যের উদয় হয়, কিন্তু সাধুসহবাস হইলে উহা অচিরাৎ বিনষ্ট হইয়া যায়। কৌলীন্যাভিমান, অজ্ঞতা ও ঐশ্বৰ্য্য এই তিনের প্রভাবেই মদ উপস্থিত হইয়া থাকে, কিন্তু এই তিন বিষয়ের যথার্থ মৰ্ম্ম অবগত হইলেই উহা একেবারে দূরীভূত হয়। কাম ও হর্ষবশতঃ ঈর্ষা জন্মিয়া থাকে এবং প্রজ্ঞাপ্রভাবেই উহা বিনষ্ট হইয়া যায়। লোকাচারবিরুদ্ধ কাৰ্য্য দর্শন ও অপ্রিয়জনক বিদ্বেষবাক্য শ্রবণনিবন্ধন নিন্দাপ্রবৃত্তির উৎপত্তি হয় এবং উপেক্ষাদ্বারা উহার উপশম হইয়া থাকে। বলবান্ শত্রুর প্রতিকারসাধনে অসমর্থ হইলেই লোকের তীব্রতর অসূয়ার উদ্রেক হয়; কিন্তু করুণার আবির্ভাব হইলেই উহা নিবৃত্ত হইয়া যায়। দীনজনকে দর্শন করিলেই দয়ার উদ্রেক হইয়া থাকে; কিন্তু ধৰ্ম্মের পরাকাষ্ঠাদর্শনে প্রবৃত্ত হইলে উহার উপশম হয়। অজ্ঞান প্রযুক্ত প্রাণীগণের চিত্তে ভয়সঞ্চার হইয়া থাকে; কিন্তু তত্ত্বজ্ঞানের যাথার্থবোধ হইলে আর তাহার প্রসঙ্গও থাকে না।
“হে ধৰ্ম্মরাজ! একমাত্র শান্তিগুণ থাকিলেই এই ত্রয়োদশ দোষকে পরাজিত করা যায়। ধৃতরাষ্ট্রতনয়েরা সকলেই এই সমুদয় দোষে দূষিত ছিল, কিন্তু তুমি ইহাদিগকে পরাজয় করিয়াছ।”