১৬২তম অধ্যায়
সাত্যকি-সোমদত্ত সমর
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! এদিকে মহাবীর সাত্যকি সোমদত্তকে অবলোকনপূর্ব্বক ক্রোধভরে সারথিকে কহিলেন, সূত! অবিলম্বে আমাকে সোমদত্তসমীপে সমানীত কর; আমি নিশ্চয় কহিতেছি, ঐ কৌরবাধমের প্রাণসংহার না করিয়া সংগ্রাম হইতে নিবৃত্ত হইব না। সারথি সাত্যকির আদেশানুসারে মনোমারুতগামী, শঙ্খবৰ্ণ, অস্ত্রাঘাতসহিষ্ণু সিন্ধুদেশীয় অসমুদয় পরিচালন করিতে আরম্ভ করিল। পূর্ব্বে দৈত্যবধোদ্যত সুররাজের অশ্বগণ তাঁহাকে যেরূপ বহন করিয়াছিল, সাত্যকির অশ্বগণও তাঁহাকে তদ্রূপ বহন করিতে লাগিল। তখন মহাবল সোমদত্ত সাত্যকিকে মহাবেগে সংগ্ৰামাভিমুখে আগমন করিতে দেখিয়া বারিধারার ন্যায় শরবর্ষণপূর্ব্বক জলধর দিনকরকে যেরূপ আবৃত করিয়া থাকে, তদ্রূপ তাঁহাকে আচ্ছন্ন করিলেন, সাত্যকিও অসম্ভ্রান্তচিত্তে কুরুশ্রেষ্ঠ সোমদত্তকে শরনিকরে সমাচ্ছন্ন করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর সোমদত্ত সাত্যকিকে যষ্টিশরে বিদ্ধ করিলেন; সাত্যকিও তাঁহাকে শরজালে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন।
এইরূপে সেই বীরদ্বয় পরস্পরের শরনিকরে বিদ্ধ ও শোণিতাক্তকলেবর হইয়া বসন্তকালীন কুসুমিত কিংশুকদ্বয়ের ন্যায় সুশোভিত হইলেন। তাঁহারা তৎকালে রোষকষায়িতলোচনে। পরস্পরকে দগ্ধ করিয়াই যেন রথমার্গে মণ্ডলাকারে বিচরণপূর্ব্বক বারিবর্ষী অম্বুদের ন্যায় রণক্ষেত্রে অবস্থিত হইলেন। ঐ বীরদ্বয় শরসম্ভিন্নকলেবর হইয়া শল্লকীদ্বয়ের ন্যায়, সুবর্ণপুঙ্খশরে আচ্ছন্ন হইয়া খদ্যোতাবৃত বৃক্ষদ্বয়ের ন্যায় এবং শরসন্দীপিত দেহ হইয়া উল্কাসমবেত কুঞ্জরদ্বয়ের ন্যায় শোভা ধারণ করিলেন।
“অনন্তর মহারথ সোমদত্ত অৰ্দ্ধচন্দ্ৰবাণদ্বারা সাত্যকির শরাসন ছেদনপূর্ব্বক প্রথমতঃ তাঁহাকে পঞ্চবিংশতিশরে বিদ্ধ করিয়া পুনর্ব্বার তাঁহার প্রতি দশবাণ পরিত্যাগ করিলেন। তখন মহাবীর সাত্যকি সত্বর সুদৃঢ় অন্য শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক সোমদত্তকে পাঁচবাণে বিদ্ধ করিয়া সহাস্যবদনে ভল্লদ্বারা তাঁহার কাঞ্চনময় ধ্বজ ছেদন করিয়া ফেলিলেন। সোমদত্ত স্বীয় ধ্বজ নিপাতিত দেখিয়া অসম্ভ্রান্তচিত্তে সাত্যকিকে পঞ্চবিংশতিশরে বিদ্ধ করিলেন। তখন সাত্যকি ক্রোধাবিষ্ট হইয়া নিশিতক্ষুরপ্রদ্বারা ধনুর্দ্ধর সোমদত্তের শরাসন ছেদনপূর্ব্বক নতপর্ব্ব সুবর্ণপুঙ্খ শতবাণে তাঁহাকে সমাচ্ছন্ন করিয়া ফেলিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত মহারথ সোমদত্তও সত্বর অন্য চাপ গ্রহণ করিয়া সাত্যকিকে শরনিকরে আবৃত করিলেন। সাত্যকি তদ্দর্শনে রোষাবিষ্ট হইয়া সোমদত্তকে বিদ্ধ করিতে আরম্ভ করিলে সোমদত্তও তাঁহাকে শরজালে নিপীড়িত করিতে লাগিলেন। ঐ সময় ভীমসেন সাত্যকির রক্ষার্থ সোমদত্তকে দশবাণে আহত করিলেন; সোমদত্ত তদ্দর্শনে অসম্ভ্রান্তচিত্তে ভীমসেনকে শরনিকরে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। অনন্তর মহাবীর সাত্যকি সোমদত্তের বক্ষঃস্থল লক্ষ্য করিয়া সুদৃঢ় ভীষণ পরিঘাস্ত্র পরিত্যাগ করিলেন। কুরুকুলোদ্ভব সোমদত্ত তদ্দর্শনে হাস্যমুখে সেই ঘোরদর্শন পরিঘাস্ত্র দুই খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। লৌহনির্মিত বৃহৎ পরিঘ দ্বিধা ছিন্ন হইয়া বজ্রবিদারিত ভূধরশিখরের ন্যায় পতিত হইল।
সাত্যকিশরে সোমদত্তসংহার
“অনন্তর মহারথ সাত্যকি হাসিতে হাসিতে এক ভল্লে সোমদত্তের শরাসন ও পাঁচশরে শরমুষ্টি ছেদন করিয়া চারিবাণে তুরঙ্গমগণকে যমরাজসদনে প্রেরণপূর্ব্বক আনতপর্ব্ব ভল্লদ্বারা সারথির মস্তক ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তৎপরে তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া প্রজ্বলিত পাবকসদৃশ অতি ভয়ানক সুবর্ণপুঙ্খ শাণিত শরনিক্ষেপ করিলেন। সেই শৈনেয়বিমুক্ত শর শ্যেনপক্ষীর ন্যায় মহাবেগে সোমদত্তের বক্ষঃস্থলে নিপতিত হইল। মহারথ সোমদত্ত সাত্যকির সেই শরহারে অতিমাত্র বিদ্ধ হইয়া ভূতলে নিপতিত হইবামাত্র কলেবর পরিত্যাগ করিলেন। কৌরবপক্ষীয় সৈন্যগণ সোমদত্তকে নিহত নিরীক্ষণ করিয়া অসংখ্য রথসমভিব্যাহারে সাত্যকির প্রতি ধাবমান হইল।
দ্রোণযুধিষ্ঠিরযুদ্ধ-কৃষ্ণের সামরিক উপদেশ
“এ দিকে পাণ্ডবগণ সমুদয় প্রভদ্রক ও মহতী সেনাসমভিব্যাহারে দ্রুতবেগে দ্রোণসৈন্যের অভিমুখে গমন করিলেন। ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া দ্রোণাচার্য্যের সমক্ষেই তাঁহার সৈনিকপুরুষদিগকে বিদ্রাবিত করিতে লাগিলেন। আচার্য্য যুধিষ্ঠিরকে কৌরবসৈন্য বিদ্রাবিত করিতে অবলোকন করিয়া রোষকষায়িতলোচনে দ্রুতবেগে তাঁহার সম্মুখীন হইয়া তাঁহাকে সুতীক্ষ্ণ সাতবাণে বিদ্ধ করিলে রাজা যুধিষ্ঠির ক্রোধভরে দ্রোণকে পাঁচবাণে প্রতিবিদ্ধ করিলেন। যুধিষ্ঠিরশরে অতিমাত্র বিদ্ধ দ্রোণ ক্রোধে সৃক্কণীলেহনপূর্ব্বক তাঁহার ধ্বজ ও কোদণ্ড ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তখন যুধিষ্ঠির সত্বর অন্য এক সুদৃঢ় শরাসন গ্রহণ করিয়া সহস্ৰশরে দ্রোণকে তাঁহার অশ্ব, সারথি, ধ্বজ ও রথের সহিত বিদ্ধ করিলেন। তদ্দর্শনে সকলেই চমকৃত হইল। আচাৰ্য্য এইরূপে যুধিষ্ঠিরশরে নিপীড়িত ও ব্যথিত হইয়া মুহূর্ত্তকাল রথোপরি অবসন্ন হইয়া রহিলেন এবং কিয়ৎক্ষণ পরে সংজ্ঞালাভ করিয়া রোষাবিষ্টচিত্তে ভুজগের ন্যায় নিশ্বাসপরিত্যাগপূর্ব্বক বায়ব্যাস্ত্র নিক্ষেপ করিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত যুধিষ্ঠির নির্ভীকচিত্তে স্বীয় অস্ত্রদ্বারা সেই বায়ব্যাস্ত্র নিরাকৃত করিয়া আচার্য্যের সুদীর্ঘ শরাসন ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তখন ক্ষত্রিয়মর্দ্দন দ্রোণাচাৰ্য্য সত্বর অন্য কোদণ্ড গ্রহণ করিলেন। কুরুপুঙ্গব যুধিষ্ঠির শাণিতভল্লে তাহাও ছেদন করিয়া ফেলিলেন।
“হে মহারাজ! ঐ সময় মহাত্মা বাসুদেব যুধিষ্ঠিরকে কহিলেন, ‘হে মহাবাহো! আমি আপনাকে যাহা কহিতেছি শ্রবণ করুন। আপনি দ্রোণাচার্য্যের সহিত যুদ্ধে নিবৃত্ত হউন, উনি সর্ব্বদা আপনাকে ধৃত করিবার জন্য যত্ন করিতেছেন; অতএব উহার সহিত সংগ্রাম করা আপনার কর্ত্তব্য নহে, বিশেষতঃ যিনি উহার বিনাশের নিমিত্ত উৎপন্ন হইয়াছেন, তিনি উহার বধসাধন করিবেন। অতএব আপনি আচাৰ্য্যকে পরিত্যাগ করিয়া দুৰ্য্যোধনের নিকট গমন করুন। নরপতিরা ভূপাল ভিন্ন অন্য কাহারও সহিত যুদ্ধাভিলাষ করেন না। অতএব যে স্থানে মহাবীর ভীমসেন কৌরবগণের সহিত যুদ্ধ করিতেছেন, আপনি হস্তী, অশ্ব ও রথসমূহে পরিবেষ্টিত হইয়া সেই স্থানে গমন করুন।’
“অরাতিনিপাতন ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির বাসুদেবের বাক্যশ্রবণে মুহূৰ্তকাল চিন্তা করিয়া দ্রুতবেগে ভীমসেনসমীপে গমন করিলেন। এবং দেখিলেন, মহাবীর বৃকোদর ব্যাদিতানন অন্তকের ন্যায় কৌরবসৈন্য সংহার করিতেছেন। তখন ধর্ম্মরাজ বর্ষাকালীন মেঘগর্জ্জনসদৃশ রথনির্ঘোষে ভূমণ্ডল প্রতিধ্বনিত করিয়া অরাতিনিপাতন ভীমসেনের পার্ঞ্চি গ্রহণ করিলেন, এদিকে মহাবীর দ্রোণাচাৰ্য্যও সেই প্রদোষসময়ে পাঞ্চালগণকে বিভ্রাবিত করিতে লাগিলেন।”