১৬২তম অধ্যায়
সত্যধর্ম্ম প্রশংসা—সত্যের বিবিধ লক্ষণ
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! ব্রাহ্মণ, ঋষি, পিতৃলোক ও দেবলোক সতত সত্যধর্ম্মেরই প্রশংসা করিয়া থাকেন; অতএব, সত্য কি? উহা কিরূপে লাভ হইতে পারে, আর লাভ করিলেই বা কি হয়? আপনি এই সমস্ত কীৰ্ত্তন করুন। শ্রবণ করিতে আমার নিতান্ত অভিলাষ হইয়াছে।”
ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! কোন মহাত্মাই ধৰ্ম্মসঙ্করের প্রশংসা করেন না। সত্য অধিকৃত, সত্যই সাধুব্যক্তিদিগের সনাতন ধর্ম্ম ও পরম গতি; অতএব সত্যকে সতত নমস্কার করিবে। সত্য তপঃ, যোগ, যজ্ঞ ও পরব্রহ্মস্বরূপ। একমাত্র সত্যেই সমুদয় প্রতিষ্ঠিত রহিয়াছে। এক্ষণে সত্যের লক্ষণ ও অনুষ্ঠানের বিষয় এবং যেরূপে সত্য লাভ করা যাইতে পারে, তাহা আনুপূর্ব্বিক কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। সত্য ত্রয়োদশ প্রকার অপক্ষপাতিতা, ইন্দ্রিয়নিগ্রহ, অমৎসরতা [মাৎসৰ্য্যহীনতা], ক্ষমা, লজ্জা, তিতিক্ষা, অনসূয়া, ত্যাগ, ধ্যান, সরলতা, ধৈৰ্য্য, দয়া ও অহিংসা এই সমুদয়ই সত্যস্বরূপ।
“সত্য অব্যয়, অধিকৃত, সকল ধর্ম্মের অবিরুদ্ধ ও বিশুদ্ধ যুক্তির অনুমোদিত। ইচ্ছা, দ্বেষ, কাম ও ক্রোধের উপশম হইলেই ইষ্ট, অনিষ্ট ও শত্রুকে অপক্ষপাত জন্মিয়া থাকে। জ্ঞানবলে গাম্ভীৰ্য্য, ধৈর্য্য, নির্ভীকতা ও আরোগিতা লাভ করিতে পারিলেই ইন্দ্রিয়নিগ্রহ করা যায়। দান ও ধর্ম্মে প্রবৃত্তি থাকিলেই অমৎসরতা লাভ হয়। সত্যবাদী ব্যক্তি অনায়াসে উহা প্রাপ্ত হইতে পারেন। ক্ষন্তব্য [ক্ষমার যোগ্য] ও অক্ষন্তব্য এবং প্রিয় ও অপ্রিয় বিষয়ে তুল্যদৃষ্টি হইতে পারিলেই অনায়াসে ক্ষমাগুণসম্পন্ন হইয়া মঙ্গল লাভ করিতে পারা যায়। লজ্জা ধর্ম্মপ্রভাবেই অধিকৃত হইয়া থাকে। লজ্জাসম্পন্ন ব্যক্তি সতত মঙ্গল লাভ করেন; তিনি কখনই বিষণ্ন হয়েন না এবং তাঁহার বাক্য ও মন নিরন্তর প্রশান্তভাব অবলম্বন করিয়া থাকে। তিতিক্ষা ধৈৰ্য্যপ্রভাবে সমুৎপন্ন হয়। ধর্ম্মার্থলাভ ও লোক সংগ্রহ করিবার নিমিত্ত তিতিক্ষা অবলম্বন করা অবশ্য কর্ত্তব্য; বিষয় ও স্নেহপরিত্যাগই ত্যাগপদবাচ্য হইয়া থাকে। লোকে রাগদ্বেষবিহীন না হইলে কখনই ত্যাগরূপ মহাগুণসম্পন্ন হইতে পারে না। যিনি প্রযত্নসহকারে রাগদ্বেষবিহীন হইয়া লোকের শুভানুষ্ঠান করিতে পারেন, তাঁহারই সাধুতালাভ হইয়া থাকে। সুখ বা দুঃখের সময় কিছুমাত্র মনের চাঞ্চল্য না হওয়াই ধৈর্য্যের লক্ষণ! মঙ্গললাভার্থী ব্যক্তি সতত ঐ গুণ অবলম্বন করিবেন; ধৈৰ্য্যাবলম্বন করিলে কদাচ চিত্তবিকার জন্মে না। যাঁহারা ক্ষমাগুণসম্পন্ন ও সত্যপরায়ণ হইয়া হর্ষ, ভয় ও ক্রোধ পরিত্যাগ করিতে পারেন, তাঁহাদিগেরই ধৈৰ্য্যলাভ হইয়া থাকে। কায়মনোবাক্যে কাহারও অনিষ্টচিন্তা না করা এবং সকলের প্রতি অনুগ্রহ ও দান করাই সাধুদিগের নিত্যধৰ্ম্ম। সত্যের এই ত্রয়োদশ লক্ষণ। ইহারা সতত সত্যের আশ্রয়গ্রহণপূৰ্ব্বক উহা পরিবর্দ্ধিত করিয়া থাকে। সত্যের গুণগরিমার [গুণগৌরবের] পরিসীমা নাই। এই নিমিত্তই দেবতা, পিতৃলোক ও ব্রাহ্মণগণ সত্যের সবিশেষ প্রশংসা করিয়া থাকেন। সত্য অপেক্ষা উৎকৃষ্ট ধর্ম্ম ও মিথ্যা অপেক্ষা মহাপাতক আর কিছুই নাই। সত্যই ধৰ্ম্মের আধার; অতএব সত্য বিলুপ্ত করা নিতান্ত গর্হিত কাৰ্য্য, সন্দেহ নাই। সত্যপ্রভাবে দান, সদক্ষিণ যজ্ঞ, তপ, অগ্নিহোত্র, বেদাধ্যয়ন ও অন্যান্য ধর্ম্ম প্রবর্ত্তিত হইয়া থাকে। মানদণ্ডের এক দিকে সহস্র অশ্বমেধ ও এক দিকে সত্য আরোপিত করিলে সহস্র অশ্বমেধ অপেক্ষা সত্যই গুরুতর হইবে, সন্দেহ নাই।”