১৬২তম অধ্যায়
যুধিষ্ঠিরাদির প্রতি কুবেরের সাধু উপদেশ
কুবের কহিলেন, “হে যুধিষ্ঠির! লোকযাত্ৰাবিধানের ধৈৰ্য্য, দক্ষতা, দেশ, কাল ও পরাক্রম এই পঞ্চ প্রকার বিধি আছে। সত্যযুগে মনুষ্যেরা ধৈৰ্য্যশালী, পরাক্রমবিধানজ্ঞ ও আত্মকর্ম্মে সুনিপুণ ছিল সর্ব্বধর্ম্মবিধিবেত্তা দেশকালবিৎ ও ধৈৰ্য্যাগাম্ভীৰ্য্যসম্পন্ন ক্ষত্ৰিয়ই চিরকাল এই পৃথিবী শাসন করিয়া থাকেন। হে মহারাজ! যিনি এইরূপ বিধানানুসারে সমুদয় কাৰ্য্য নির্ব্বাহ করেন, তাঁহার ইহলোকে যশ ও পরলোকে সদগতিলাভ হইয়া থাকে। দেখুন, দেশকালাভিজ্ঞ দেবরাজ ইন্দ্র বসুগণের সহিত পরাক্রম প্রকাশ্যপূর্ব্বক দেবলোকের আধিপত্যলাভ করিয়াছেন। যে ব্যক্তি একমাত্র ক্রোধের বশবর্ত্তী হইয়া আপনার অনিষ্টপাতে দৃষ্টিপাত না করে, সে ব্যক্তি একান্ত পাপবুদ্ধি, পাপাত্মা ও কাৰ্য্যবিভাগানভিজ্ঞ হইয়া পাপেরই অনুবর্ত্তী হয়, যে ব্যক্তি কার্য্যবিশেষানভিজ্ঞ, নিতান্ত মন্দবুদ্ধি, অকালজ্ঞ, বৃথাচার ও বৃথাসমারম্ভ [ব্যর্থ কর্ম্মের উদযোগশালী] সেই ব্যক্তিকে ইহকাল ও পরকালে অশেষ-ক্লেশে কালব্যাপন করিতে হয়, আর যে ব্যক্তি সাহসপ্ৰিয়, সামৰ্থ্যাভিলাষী, প্রবঞ্চনাপর ও দুরাত্মা, সে নিশ্চয়ই পাপপঙ্কে নিমগ্ন হয়।
“হে মহারাজ! ভীমসেন নিতান্ত বালস্বভাব, অধর্ম্মপরায়ণ, অহঙ্কৃত ও নির্ভীক, এক্ষণে উহাকে শাসন করা অবশ্য কর্ত্তব্য। তুমি এখন শোকভয় পরিত্যাগপূর্ব্বক পুনরায় রাজর্ষি আর্ষ্টিষেণের আশ্রমে অবস্থিতি করিয়া অসিতপক্ষ [কৃষ্ণপক্ষ] অতিবাহিত কর। অলকাধিবাসী যক্ষ ও পার্ব্বতীয়েরা আমার আদেশানুসারে গন্ধর্ব্ব ও কিন্নরগণ-সমভিব্যাহারে তোমাকে ও বিপ্ৰসকলকে রক্ষা করিবে। আমার অনুগত ভৃত্যগণ সর্ব্বদা তোমাদিগের রক্ষণাবেক্ষণ, সেবাশুশ্রীষা ও নানাবিধ সুস্বাদু। অন্নপান আহরণ করিবে। দেবরাজের অর্জ্জুন, বায়ুর ভীম, ধর্ম্মের তুমি এবং অশ্বিনীকুমারের নকুল-সহদেব যেমন নিয়োগোৎপন্ন পুত্র বলিয়া নিরন্তর রক্ষণীয়, তদ্রূপ তোমরাও আমার সংরক্ষণীয় হইয়াছ।
“অর্থতত্ত্ববিধান জ্ঞ সর্ব্বধর্ম্মবেত্তা অর্জ্জুন দেবলোকে কুশলে আছেন। যে সমস্ত পরম-সম্পত্তি স্বৰ্গপ্ৰাপ্তির সোপান বলিয়া কীর্ত্তিত আছে, তৎসমুদয় জন্মাবধি অর্জ্জুনেই বিদ্যমান রহিয়াছে এবং দম, দান, বল, বুদ্ধি ও তেজ এই সমস্ত উত্তম গুণ মহাসত্ত্ব অর্জ্জুনে বিরাজমান আছে। তিনি কদাচ মোহাবিষ্ট হইয়া অন্যায্য ও গৰ্হিত কর্ম্মের অনুষ্ঠান করেন না; কাহাকেও তাঁহার মিথ্যাবাদ কীর্ত্তন করিতে দেখি না; তিনি দেব, গন্ধর্ব্ব ও পিতৃলোকর্ত্তৃক সমাদৃত হইয়া অমরাবতীতে অস্ত্ৰশিক্ষা করিতেছেন। যিনি ধর্ম্মানুসারে সমস্ত মহীপালদিগকে পরাজিত ও বশীভূত করিয়াছিলেন, কুলধুরন্ধর অর্জ্জুন। এখন দেবলোকস্থ তোমার সেই প্রপিতামহ মহারাজ শান্তনুকে প্রীত ও প্রসন্ন করিতেছেন। যিনি পিতৃগণ, দেব, ঋষি ও বিপ্রগণকে অৰ্চনা করিয়া যমুনাতীরে সপ্ত অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পন্ন করিয়াছিলেন, এক্ষণে ইন্দ্ৰলোকস্থ স্বৰ্গজিৎ সেই অধিরাজ শান্তনু ধনঞ্জয়ের সহিত কথোপকথন করিতেছেন।”
পাণ্ডবগণ কুবেরের মুখে এই কথা শ্রবণ করিয়া সাতিশয় হৃষ্ট ও সন্তুষ্ট হইলেন। অনন্তর বৃকোদর গদাশক্তিগ্রহণ, শরাসনে জ্যারোপণ ও অসি কোষনিষ্কাশিত করিয়া ধনাধ্যক্ষ কুবেরকে নমস্কার করিলেন। তখন শরণ্য কুবের শরণাগত ভীমকে কহিতে লাগিলেন, “হে ভীমসেন! তুমি শক্রগণের মানহানি ও সুহৃদগণের সমৃদ্ধি-বৰ্দ্ধন কর, তোমরা যখন স্বীয় সুরম্য হর্ম্ম্যপৃষ্ঠে বাস করিবে, তখন যক্ষেরা অবশ্যই তোমাদিগের অভিলাষ পূরণ করিবে; আর অর্জ্জুনও অস্ত্ৰশিক্ষায় দক্ষ হইয়া দেবরাজের নিকট বিদায় গ্রহণপূর্ব্বক শীঘ্রই প্রত্যাগমন করিবেন।”
গুহ্যকেশ্বর কুবের পাণ্ডবগণকে এইরূপ কহিয়া স্বৰ্গভিমুখে যাত্ৰা করিলে সহস্ৰ সহস্র রাক্ষস ও যক্ষেরা বিচিত্ৰ কম্বল-সংস্তীর্ণ বিবিধ রত্নবিভূষিত যানে আরোহণ করিয়া কুবেরের অনুগমন করিল। তখন অশ্বের হ্রেষারব ও যক্ষরাক্ষসের কোলাহল-শব্দে অলকা পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। কুবেরের তুরঙ্গমগণ যেন বায়ুপথে সঞ্চরণ ও ঘনজাল আকর্ষণ করিয়াই দ্রুতবেগে গগনমার্গে গমন করিতে লাগিল। অনন্তর যক্ষেরা কুবেরের আদেশানুসারে অচলশিখর হইতে রাক্ষসদিগের মৃতকলেবর-সকল অপসারিত করিল ও ভগবান অগস্ত্যনির্দ্দিষ্ট যক্ষ-রাক্ষসদিগের শাপেরও অবসান হইল। পাণ্ডবেরা যক্ষরাক্ষসগণকর্ত্তৃক সমাদৃত ও সৎকৃত হইয়া নিরুদ্বিগ্ন-মনে কুবেরনিকেতনে কতিপয় যামিনী অতিবাহিত করিলেন।