১৬১তম অধ্যায়
বীরত্বদর্শন সন্তুষ্ট কুবেরের ভমিপ্রতি অভয়দান
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! রাজা যুধিষ্ঠির, নকুল, সহদেব, দ্রৌপদী, তাহাদিগের বন্ধুবৰ্গ, ধৌম্য ও অন্যান্য ব্ৰাহ্মণগণ বহুবিধ শব্দে গিরি-গুহা প্ৰতিধ্বনিত হইতেছে শ্রবণ করিয়া ভীমের অদর্শনে সাতিশয় উদ্বিগ্ন হইলেন। অনন্তর কৃষ্ণকে আর্ষ্টিষেণের নিকট সমর্পণ করিয়া সকলে অস্ত্রশস্ত্র গ্রহণপূর্ব্বক পর্ব্বতোপরি আরোহণ করিলেন। তথায় তাহারা ইতস্ততঃ দৃষ্টিপাত করিয়া দেখিলেন যে, বৃকোদর দেবরাজের ন্যায়। গদা, খড়্গ ও শরাসন ধারণ করিয়া শোভা পাইতেছেন এবং তৎকর্ত্তৃক নিপাতিত মহাবলপরাক্রান্ত গীতজীবন রাক্ষস-সকল ভূপৃষ্ঠে বিলুষ্ঠিত হইতেছে। তখন তাঁহারা ভ্রাতাকে আলিঙ্গন ও তথায় উপবেশন করিয়া পরম পরিতোষলাভ করিলেন। মহাভাগ লোকপালগণের সান্নিধ্যে যেমন স্বর্গের শোভা হয়, সেইরূপ ভ্রাতৃচতুষ্টয়দ্বারা ভূধরশিখরের অতি আশ্চর্য্য সৌন্দর্য্য সমুদ্ভূত হইল।
রাজা যুধিষ্ঠির কুবেরসদন ও ধরাশায়ী রাক্ষসগণকে নিরীক্ষণ করিয়া ভীমসেনকে কহিলেন, “হে বৃকোদর! সাহস অথবা মোহবশত নিরর্থক এই প্রাণীবধ করা তোমার অনুরূপ কাৰ্য্য হয় নাই; ইহাতে তুমি নিশ্চয় পাপগ্ৰস্ত হইয়াছ; ধর্ম্মবেত্তারা কহিয়া থাকেন, রাজার অনভিমত কাৰ্য্য করা অনুচিত; কিন্তু তুমি আজি যে কর্ম্ম করিয়াছ, কি দেব, কি নরপতি, সকলেরই অনভিমত। যে ব্যক্তি ধর্ম্মার্থের প্রতি দৃষ্টিপাত না করিয়া পাপে আসক্ত হয়, সে অবশ্যই সেই পাপের ফলভোগ করে, তাহাতে সন্দেহ নাই। হে পাৰ্থ! তুমি যদি আমার প্ৰিয়চিকীৰ্ষ হও, তাহা হইলে কদাপি এরূপ সাধুবিগৰ্হিত কাৰ্য্যে প্রবৃত্ত হইও না।”
ধর্ম্মাত্মা যুধিষ্ঠির এইরূপে ভ্রাতাকে উপদেশ প্রদানপূর্ব্বক নিস্তব্ধ হইয়া সেই সকল বিষয় চিন্তা করিতে লাগিলেন। এদিকে হতাবিশিষ্ট রাক্ষসগণ দ্রুতবেগে কুবেরের আলয়ে উপনীত হইয়া ভীমভয়ে অতি কঠোর আর্ত্তস্বর করিয়া উঠিল; তাহাদিগের হস্তে আয়ুধ নাই, সর্ব্বাঙ্গ শোণিতসিক্ত, শরীর অবসন্ন এবং শিরোরুহ [কেশ]- সকল বিপ্ৰকীর্ণ [বিক্ষিপ্ত—আলুথালু] হইয়া রহিয়াছে। পরে তাহারা নিতান্ত ক্লান্ত-বচনে যক্ষাধিপতিকে নিবেদন করিল, “দেব! আপনার যে-সকল যোদ্ধৃপুরুষেরা গদা, পরিঘ, নিস্ত্রিংশ, তোমর ও প্রাস লইয়া যুদ্ধ করিত, সেই সমস্ত প্রধান প্রধান যক্ষ ও রাক্ষসেরা একজন মহাবলপরাক্রান্ত মুনষ্যকর্ত্তৃক সমরে নিহত হইয়া ধরাতলে শয়ন করিয়াছে, কেবল আমরা এই কয়েকজন পরিত্ৰাণ পাইয়াছি। আপনার সখা মণিমানও ভীষণ শমনসদনে প্রবিষ্ট হইয়াছেন। এই দারুণ কাৰ্য্য একজন মনুষ্যকর্ত্তৃক অনুষ্ঠিত হইয়াছে, এক্ষণে যাহা কর্ত্তব্য হয় করুন।”
যক্ষাধিপতি কুবের তাহাদের মুখে ভীমসেনের এই প্রকার অপরাধ-শ্রবণে একেবারে ক্ৰোধে অধীর হইয়া উঠিলেন; তাঁহার নেত্রদ্বয় রক্তবর্ণ হইল; মুখমণ্ডলে ক্রোধের লক্ষণ-সকল লক্ষিত হইতে লাগিল। তিনি তখন রোষাভরে সত্বর রথযোজনা করিতে অনুমতি প্ৰদান করিলেন। অনুচরগণ তাঁহার অনুমতি প্রাপ্তিমাত্র হেমমাল্যধারি-অশ্বগণযুক্ত, অভ্রপুঞ্জসদৃশ, গিরিশৃঙ্গের ন্যায় সমুন্নত রথ যোজনা করিল। সর্ব্বগুণসম্পন্ন, নানা-রত্নবিভূষিত, মনোমারুতগামী অশ্ব রথে যোজিত হইয়া বিজয়াবহ হ্রেষারব করিতে লাগিল। ভগবান গুহ্যকেশ্বর সেই রথবারে আরোহণ করিয়া গমন করিলে দেবগণ ও গন্ধর্ব্বগণ তাঁহাকে স্তব করিতে লাগিলেন। রক্তনয়ন সুবর্ণবৰ্ণ মহাবলপরাক্রান্ত মহাকায়-সমুদয় যক্ষগণ কুবেরকে গমন করিতে দেখিয়া অস্ত্রশস্ত্র গ্রহণপূর্ব্বক গগনমার্গে মহাবেগে সেই ধনাধিপতিপালিত গন্ধমাদনপর্ব্বতে গমন করিতে লাগিল। পরে পাণ্ডবগণ লোমাঞ্চিতকলেবরে সেই যক্ষগণপরিবৃত প্রিয়দর্শন মহাত্মা কুবেরকে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। দেবকাৰ্য্যচিকীর্ষু যক্ষাধিপতি কুবেরও সেই মহাসত্ব পাণ্ডুনন্দনগণকে গৃহীতাস্ত্র অবলোকনে মনে মনে পরম পরিতুষ্ট হইলেন।
অনন্তর ধনেশ্বরপ্রমুখ সেই যক্ষগণ পক্ষিকুলের ন্যায় গগন হইতে গন্ধমাদনশৃঙ্গে পাণ্ডবগণের সম্মুখে অবতীর্ণ হইলেন । সমুদয় যক্ষ ও গন্ধর্ব্বগণ কুবেরকে পাণ্ডবগণের প্রতি প্ৰসন্ন দেখিয়া নির্ব্বিকীরচিত্তে রহিল। তখন ধর্ম্মাত্মা যুধিষ্ঠির, নকুল ও সহদেব যক্ষাধিপতিকে প্ৰণাম করিয়া অপরাধীর ন্যায় কৃতাঞ্জলিপুটে তাঁহাকে বেষ্টন করিয়া দণ্ডায়মান রহিলেন। যক্ষাধিপতি কুবের বিশ্বকর্ম্মবিনির্ম্মিত বিচিত্ৰ আসনশ্রেষ্ঠ পুষ্পকে উপবেশন করিলে পর মহাকায় শঙ্কুবৰ্ণ [খোঁটার ন্যায় কর্ণ যাহাদের, তাদৃশ] সহস্ৰ সহস্ৰ যক্ষ, রাক্ষস, অন্সরা ও গন্ধর্ব্বগণ তাঁহার চতুর্দ্দিকে উপবেশন করাতে বোধ হইতে লাগিল যেন, সুররাজ শতক্ৰতু দেবগণে পরিবৃত হইয়া রহিয়াছেন। মহাবলপরাক্রান্ত ভীমসেন মস্তকে সুবৰ্ণময়ী মালা এবং করে পাশ, খড়্গ ও শরাসন ধারণপূর্ব্বক কুবেরকে অবলোকন করিতে লাগিলেন। রাক্ষসগণের দারুণ প্ৰহারে তাঁহার শরীর ক্ষতবিক্ষত হইলেও রাক্ষসগণপরিবৃত কুবেরকে সম্মুখীন নিরীক্ষণ করিয়া তাহার মনে গ্লানির লেশমাত্ৰও উদিত হইল না।
যক্ষাধিপতি পুণ্যজনেশ্বর শাণিতশারধারী ভীমসেনকে যুদ্ধাভিলাষী দেখিয়া ধর্ম্মানন্দন যুধিষ্ঠিরকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন, “হে কৌন্তেয়! সকলেই তোমাকে সর্ব্বভূতহিতাকাঙ্কী বলিয়া অবগত আছে; তুমি ভ্রাতৃগণ-সমভিব্যাহারে নির্ভয়চিত্তে এই শৈলশৃঙ্গে বাস কর, ভীমসেনের প্রতি কদাচ ক্রুদ্ধ হইবে না। আমার অধিকৃত লোকগণ কালকর্ত্তৃক নিহত হইয়াছে; তোমার অনুজ কেবল নিমিত্তমাত্র। এই সমুদয় যক্ষ-রাক্ষস নিহত হইয়াছে বলিয়া লজ্জা করিও না। পূর্ব্বে দেবগণসমক্ষে যে-সকল যক্ষ ও রাক্ষস বিনাশপ্রাপ্ত হইয়াছিল, তন্নিমিত্ত আমি ভমিসেনের প্রতি ক্রূদ্ধ হই নাই, প্রত্যুত পরম পরিতুষ্ট হইয়াছি এবং উহার কাৰ্য্যদ্বারা পূর্ব্বেও সাতিশয় প্রীত হইয়াছিলাম।”
যক্ষরাজ রাজা যুধিষ্ঠিরকে এই সকল কথা বলিয়া ভীমসেনকে কহিলেন, “হে বৃকোদর! তুমি যে কৃষ্ণার প্রতিসাধনাৰ্থ এই অলৌকিক ও সাহসিক কাৰ্য্য করিয়াছ, তন্নিমিত্ত আমি কিছুমাত্র ক্ষুন্ন হই নাই। তুমি আমাকে ও দেবগণকে উপেক্ষা করিয়া যে আপনার বাহুবলে রাক্ষস ও যক্ষগণের প্রাণসংহার করিয়াছ, ইহাতে আমি তোমার প্রতি পরম পরিতুষ্ট হইয়াছি। হে ভীমসেন! অদ্য আমি তোমার নিমিত্তই দারুণ শাপ হইতে মুক্ত হইলাম। পূর্ব্বে কোন অপরাধবশতঃ মহর্ষি অগস্ত্য ক্রুদ্ধ হইয়া আমাকে শাপ প্ৰদান করেন; তাহাতে আমি সকল লোকসমক্ষে ক্লেশভোগ করিয়াছি; আজি তুমি তাহার নিষ্কৃতি করিলে; হে বীরবর! ইহাতে তোমার কিছুমাত্র অপরাধ নাই।”
কুবেরের প্রতি অগস্ত্য-শাপ-বৃত্তান্ত
অনন্তর যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে ভগবান! মহাত্মা অগস্ত্য কি নিমিত্ত আপনাকে শাপ প্ৰদান করিয়াছিলেন, আপনি যে সেই ধীমান মহর্ষির ক্রোধানলে সসৈন্যে সানুচরবর্গে ভস্মসাৎ হয়েন নাই, ইহা অত্যন্ত আশ্চৰ্য্য বোধ হইতেছে এবং শ্রবণ করিতেও আমার সাতিশয় অভিলাষ জন্মিয়াছে; অতএব তৎসমুদয় বর্ণন করুন।’
কুবের কহিলেন, “হে নরনাথ! একদা কুশাবতী নগরীতে দেবগণের মন্ত্রণা হইয়াছিল, আমিও আমন্ত্রিত হইয়া ঘোররূপী বিবিধায়ুধধারী ত্রিশত-পদ্মসংখ্যক যক্ষ-সমভিব্যাহারে তথায় গমন করিতেছিলাম। পথিমধ্যে নিরীক্ষণ করিলাম যে, ঋষিসত্তম অগস্ত্য নানা পক্ষিগণসমাকীর্ণ পুষ্পিত—দ্রুমসুশোভিত যমুনাতীরে উৰ্দ্ধহস্তে সূৰ্য্যাভিমুখে অবস্থিতি করিয়া অতি কঠোর তপস্যা করিতেছেন; দেখিলে বোধ হয় যেন, হুতাশন জাজ্বল্যমান হইয়া রহিয়াছেন। আমার সখা মণিমাননামে প্রধান রাক্ষস আমার সমভিব্যাহারে ছিল; সে মূর্খতা, অজ্ঞানতা, দৰ্প বা মোহবশতঃ অন্তরীক্ষ হইতে সেই মহর্ষির মস্তকে নিষ্ঠীবণ ত্যাগ করিল। তখন মহর্ষি অগস্ত্য ক্ৰোধকম্পিত্যকলেবরে আমাকে কহিলেন, “তোমার এই সখা নিতান্ত দুরাত্মা; নিরপরাধে তোমার সমক্ষে আমার অবমাননা করিল, এই অপরাধে এই দুরাত্মা তোমার এই সমস্ত সৈন্যসমভিব্যাহারে মনুষ্যহস্তে বিনষ্ট হইবে। তুমি এই সমুদয় সৈন্যের নিধনে যৎপরোনাস্তি ক্লেশপ্ৰাপ্ত হইয়া পরিশেষে সেই মনুষ্যকে অবলোকন করিয়া পাপ হইতে বিমুক্ত হইবে এবং তোমার সৈন্যগণও পুত্রপৌত্র-সমভিব্যাহারে পুনর্জীবিত হইয়া চিরকাল তোমার আজ্ঞা প্ৰতিপালন করিবে।”
“হে ধর্ম্মনন্দন! পূর্ব্বে আমি মহর্ষি অগস্ত্যের নিকট এইরূপ অভিশপ্ত হইয়াছিলাম; এক্ষণে তোমার অনুজ ভীমসেন সেই পাপ হইতে আমাকে বিমুক্ত করিলেন।”