১৬১তম অধ্যায়
পুনরায় অর্জ্জুনের উক্তি
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! মহাবীর অর্জ্জুন কৃষ্ণের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া উলুকের ভুজাবলম্বনপূর্ব্বক অতিমাত্র লোহিতনয়নে কহিলেন, “হে উলূক’! তুমি কৌরবগণসন্নিধানে উপনীত হইয়া দুৰ্য্যোধনকে কহিবে, যে ব্যক্তি স্বীয় বলবীৰ্য্যের উপর নির্ভর করিয়া রণস্থলে নিৰ্ভয়ে শত্ৰুগণকে আহ্বান করে, সেই পুরুষ। যে স্বয়ং অসমর্থ হইয়া অন্যের আশ্রয় গ্রহণপূর্ব্বক রণস্থলে শত্ৰুগণকে আহ্বান করে, সে ক্ষত্ৰিয়নামধারী কাপুরুষ। রে মূঢ়! তুমি অন্যের বল আশ্রয় করিয়া আপনাকে বলশালী বিবেচনা করিতেছ। স্বয়ং কাপুরুষ হইয়া কি নিমিত্ত শত্রুবিনাশের অভিলাষ করা? তুমি ভূপালগণমধ্যে বৃদ্ধতম হিতজ্ঞানসম্পন্ন [উপকারবুদ্ধিযুক্ত] জিতেন্দ্ৰিয় ভীষ্মকে মৃত্যুমুখে নিপতিত করিতে দীক্ষিত [যুদ্ধে প্রবৃত্তিযুক্ত] করিয়া আত্মশ্লাঘা প্ৰকাশ করিতেছ। আমরা তোমার মনোগত অভিপ্ৰায় অবগত হইয়াছি; তুমি মনে করিয়াছ, পাণ্ডব দয়াপরতন্ত্র [দয়ার্দ্র্য] হইয়া ভীষ্মকে সংহার করিবেন না; কিন্তু তুমি যাহার বীৰ্য্য আশ্রয় করিয়া অহঙ্কার-পরতন্ত্র [অহঙ্কারবশ] হইয়াছ, আমি সকল ধনুৰ্দ্ধারদিগের সমক্ষে প্রথমেই সেই ভীষ্মকে বিনাশ করিব। তুমি বলিয়াছ, রজনী প্ৰভাত হইলে যুদ্ধ উপস্থিত হইবে, তদ্বিষয়ে অর্জ্জুনেরও বিলক্ষণ সম্মতি আছে।
“ ‘সত্যপ্ৰতিজ্ঞ ভীষ্ম কৌরবগণের সন্তোষসম্পাদনা করিয়া কহিয়াছিলেন, “আমি সৃঞ্জয়গণের সৈন্য ও শাল্বেয়াদিগকে বিনাশ করিব; অধিক কি, দ্রোণ ব্যতিরেকে নিখিল লোক সংহার করিতে পারি। যাহা হউক, এক্ষণে এই কাৰ্য্যের ভার আমাকেই বহন করিতে হইবে, পাণ্ডবগণ হইতে তোমার আর কোন শঙ্কা নাই। তুমি তাঁহাদিগকে বিপদসাগরে নিমগ্ন করিয়া এই রাজ্যলাভ করিয়াছ।” ভীষ্মের এইরূপ কথা শ্রবণ করিয়া তোমারও মনোগত ভাব ঐরূপ হইয়াছে। তুমি এই দৰ্পে পরিপূর্ণ হইয়া আপনার অনর্থপরম্পরা [ধারাবাহিক অনিষ্ট] নিরীক্ষণ করিতে সমর্থ হইতেছে না; এক্ষণে আমিও প্রতিজ্ঞা করিতেছি, তোমার সমক্ষে প্রথমেই দ্বীপ [মজ্জমান ব্যক্তির আশ্রয়]-স্বরূপ কুরুবৃদ্ধ ভীষ্মকে রথ হইতে নিপতিত্ব ও বিনষ্ট করিব। দিবাকর উদিত-হইলে তুমি ধ্বজ, রথ ও সৈন্যগণসমভিব্যাহারে তাঁহাকে রক্ষা করিও। তিনি যখন আমার শরজালে সমাচ্ছন্ন হইবেন, তুমি তখন তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিয়া আমার এই সাহঙ্কার বাক্য নিৰ্ম্মফল নয়, ইহা বিবেচনা করিবে, তাঁহাতে সন্দেহ নাই। ভীমসেন ক্ৰোধাপরবশ হইয়া সভামধ্যে অদূরদর্শী দুঃশাসনকে লক্ষ্য করিয়া যেরূপ প্ৰতিজ্ঞা করিয়াছিলেন, তুমি অবিলম্বেই তাহা সমাহিত দেখিবে।
“ ‘তুমি নৃশংসের ন্যায় নিতান্ত অধৰ্মপরায়ণ ও নিত্যবৈরসম্পন্ন। এক্ষণে অভিমান, দৰ্প, ক্ৰোধ, নিষ্ঠুরতা, পারুষ্য [কর্কশতা], অবলোপ [গর্ব্ব], নৃশংসতা, তীক্ষ্ণতা, ধর্ম্মদ্বেষ, অপবাদ, বৃদ্ধতিক্রম [বৃদ্ধজনের অতিক্রম—বৃদ্ধবাক্যের অপালন], কর্ণপ্ৰমুখের উপর নির্ভর, সেনার আধিক্য ও আমাদিগকে প্রত্যাখ্যান করার ফল অবিলম্বেই নিরীক্ষণ করিবে। আমি ও বাসুদেব রোষপরবশ হইলে কিরূপে তোমার রাজ্য ও জীবনের প্রত্যাশা থাকিবে? মহাবীর শান্তস্বভাব ভীষ্ম, সূতপুত্র কর্ণ ও দ্রোণাচাৰ্য্য নিপাতিত হইলে তুমি রাজ্য, জীবিত [জীবন] ও পুত্রের প্রত্যাশায় নিরাশ হইবে। তুমিও পুত্রভ্রাতৃগণের নিধনবার্ত্তা শ্রবণ করিয়া ভীমের হস্তে কলেবর পরিত্যাগপূর্ব্বক আপনার দুষ্কৃতিসমুদয় স্মরণ করিবে। আমি পুনরায় প্রতিজ্ঞা করিতেছি না; কিন্তু সত্য কহিতেছি, এ সমস্তই সত্য হইবে।”
উলূকের প্রতি যুধিষ্ঠিরের উক্তি
“অনন্তর ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির উলূককে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে উলূক! তুমি বাক্যানুসারে দুৰ্য্যোধনসন্নিধানে গমন করিয়া কহিবে, তুমি আপনার চরিত্রের ন্যায় আমার চরিত্র অনুমান করিও না, সত্য ও মিথ্যা উভয়ের অন্তর [পার্থক্য] অনুধাবন কর। জ্ঞাতিবর্গের বধ কামনা করা দূরে থাকুক, আমি কীট, পিপীলিকাপ্রভৃতি ক্ষুদ্র জীবেরও অনিষ্টাচরণে প্রবৃত্ত নাহি। বলিতে কি, পাছে জ্ঞাতিবধ হয় বলিয়া আমি পূর্ব্বে পাঁচখানি গ্রাম প্রার্থনা করিয়াছিলাম; কিন্তু তুমি তাহা না করিয়া কেবল বিষয়বাসনা ও মুর্খতানিবন্ধন আত্মশ্লাঘা করিতেছ; মহামতি বাসুদেবের হিতকর বাক্য শ্রবণগোচর কর নাই। এক্ষণে আর অধিক কি কহিব, তুমি বান্ধবগণসমভিব্যাহারে যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হও। হে উলূক! তুমি আমার অহিতকারী দুৰ্য্যোধনকে কহিবে, আমি তোমার বাক্য শ্রবণ ও তাহার তাৎপৰ্য্য গ্ৰহণ করিয়াছি, এক্ষণে তোমার অভিলাষানুরূপ কাৰ্য্য হইবে।”
পুনর্ব্বার ভীমের উক্তি
“অনন্তর ভীমসেন কহিলেন, “হে দূত! তুমি সেই দুৰ্মতিপরায়ণ দুরাচার দুৰ্য্যোধনকে পুনরায় কহিবে, হয় আমি পশুপক্ষীর উদরে [যুদ্ধে মৃত হইয়া পশুপক্ষীকর্ত্তৃক ভক্ষিত], না হয় হস্তিনাপুরে বাস করিব। আমি সত্যই শপথ [দিব্য-প্রতিজ্ঞা] করিতেছি, সভামধ্যে যাহা প্ৰতিজ্ঞা করিয়াছিলাম, তাহা সংসাধন করিব। আমি তোমার উরুযুগল ভগ্ন ও তোমার দোসরগণকে [ভ্ৰাতাদিগকে] বিনাশ করিয়া রণস্থলে দুঃশাসনের শোণিত পান করিব। অভিমন্যু রাজপুত্রদিগের ও আমি ধার্ত্তরাষ্ট্রগণের মৃত্যুস্বরূপ; হে দুৰ্য্যোধন!! আরও কহিতেছি, আমি ধৰ্মরাজ যুধিষ্ঠিরের সমক্ষে সহোদরগণের সহিত তোমাকে সংহার করিয়া তোমার মস্তকে পদার্পণপূর্ব্বক সকলকে সন্তুষ্ট করিব।”
নকুলসহদেবাদির উক্তি
“অনন্তর মহাবীর নকুল কহিলেন, “হে উলূক! তুমি দুৰ্য্যোধনকে কহিবে, তুমি যাহা কহিয়াছ, আমি তাহা সমস্তই শ্ৰবণ করিয়াছি। এক্ষণে তোমার বাক্যানুসারে তৎসংসাধনে প্রবৃত্ত হইব।”
“সহদেব কহিলেন, “হে উলূক! তুমি দুৰ্য্যোধনকে কহিবে,— হে দুৰ্য্যোধন! তোমার যেরূপ অভিলাষ তাহা অনুষ্ঠান কর। তুমি এক্ষণে আমাদের ক্লেশ দর্শনে হৃষ্ট ও সন্তুষ্ট হইয়া যে অহঙ্কার প্রকাশ করিতেছ, তাহার নিমিত্ত তোমাকে পুত্ৰ, জ্ঞাতি ও বান্ধবগণের সহিত অনুতাপ করিতে হইবে।” পরে বৃদ্ধ বিরাট ও দ্রুপদ উলূককে কহিলেন, “হে উলূক! তুমি দুৰ্য্যোধনকে কহিবে, আমাদিগের অভিলাষ এই যে, আমরা সততই সাধুলোকের দাসত্ব প্রার্থনা করিয়া থাকি। আমরা দাস হই বা না হই, যাঁহার যেরূপ পৌরুষ, তাহা সন্দর্শন করিব।” শিখন্তী কহিলেন, “হে উলূক! তুমি সেই পাপনিরত রাজা দুৰ্য্যোধনকে কহিবে, তুমি আমাকে যুদ্ধে দারুণ কাৰ্য্য অনুষ্ঠান করিতে নিরীক্ষণ করিবে। তুমি যাহার বলবীর্য্যের আশ্রয়লাভ করিয়া যুদ্ধে জয়প্রাপ্তির প্রত্যাশা করিতেছ, আমি সেই পিতামহ ভীষ্মকে রথ হইতে নিপাতিত ও সকল ধনুৰ্দ্ধারীদিগের সমক্ষে বিনাশ করিব; তাঁহাকে সংহার করিবার নিমিত্তই বিধাতা আমাকে সৃষ্টি করিয়াছেন।” ধৃষ্টদ্যুম্ন কহিলেন, “হে উলূক! তুমি আমার বাক্যানুসারে দুৰ্য্যোধনকে কহিবে, আমি বান্ধবগণের সহিত দ্রোণাচাৰ্য্যকে বিনাশ ও অন্যের অসাধ্য ভয়ঙ্কর কাৰ্য্য সমস্ত সংসাধন করিব।”
যুধিষ্ঠিরের করুণাপ্রকাশক উক্তি
‘অনন্তর ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির করুণা প্রকাশ করিবার নিমিত্ত কহিলেন, “হে উলূক! তুমি দুৰ্য্যোধনকে কহিবে, আমার জ্ঞাতিবিনাশের অভিলাষ নাই; প্রত্যুত আমি তদ্বিষয়ে সম্পূর্ণ অনাদর প্রকাশ করিয়াছিলাম; হে দুৰ্মতে! তোমারই দোষবশতঃ এই সকল উপস্থিত হইয়াছে; অতএব সাধারণ লোকের ন্যায় আমিও তদ্বিষয়ে প্রবৃত্ত হইব, তাহাতে সন্দেহ নাই। হে উলূক! তোমার মঙ্গল হউক, এক্ষণে তোমার ইচ্ছা হয়, অবিলম্বে প্রস্থান বা এই স্থানে অবস্থান কর। আমরা তোমার বান্ধব।”
তখন কৈতব্য উলূক ধর্ম্মানন্দন রাজা যুধিষ্ঠিরকে আমন্ত্রণপূর্ব্বক তাহার অনুজ্ঞালাভ ও যত্নপূর্ব্বক সমস্ত বাক্য হৃদয়মধ্যে ধারণ করিয়া দুৰ্য্যোধনসন্নিধানে গমন করিল। পরে তথায় উপনীত হইয়া ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জ্জুন, নকুল, সহদেব, কৃষ্ণ, নিরাট, দ্রুপদ, ধৃষ্টদ্যুম্ন ও শিখণ্ডীর বাক্যসমুদয় নিবেদন করিল। রাজা দুৰ্য্যোধন উলূকমুখে সেই সকল কথা শ্রবণ করিয়া মহাবীর দুঃশাসন, কর্ণ, শকুনি, রাজবল [দুৰ্য্যোধনের নিজ সৈন্য] ও মিত্রবল [কৌরবপক্ষাশ্ৰিত অন্যান্য নৃপতিগণের সৈন্য] দিগকে আজ্ঞা অবস্থান করিবে।” তখন দূতগণ কর্ণের আদেশানুসারে সত্বর রথ, উষ্ট্র, বামী [ঘোটকী] ও মহাজবশালী [অত্যন্ত বেগবান] অশ্বে আরোহণপূর্ব্বক সেনাগণসন্নিধানে উপনীত হইয়া রাজগণকে সূৰ্য্যোদয়ের পূর্ব্বে সুসজ্জিত হইতে আদেশ করিল।”