১৬০. কুন্তীর প্রশ্নে ব্রাহ্মণের রাক্ষসভীতিবর্ণন
ষষ্ট্যধিকশততম অধ্যায়
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে রাজন্! কুন্তী তাহাদের সন্নিহিত হইয়া অমৃতময় বাক্যে সান্ত্বনা করিয়া কহিতে লাগিলেন, আপনারা কি নিমিত্ত রোদন করিতেছেন? আপনাদের এই দুঃখের কারণ কি? সবিশেষ বনুন; যদি মামাদের সাধ্য হয়, তবে অবশ্য আপনাদের দুঃখ মোচন করিব। ব্রাহ্মণ কুন্তীয় এই মধুময় বাক্য শ্রবণ করিয়া তাহাকে কহিলেন, হে তপোবনে? দুঃখিত ব্যক্তির দুঃখ মোচন করা ভদ্রলোকের কর্তব্য যথার্থ বটে, কিন্তু আমার যে দুঃখ উপস্থিত হইয়াছে, তাহা নিরাকরণ করা মনুষ্যের সাধ্য নহে। হে মনস্বিনি! এই নগরের সমীপে বক নামে এক রাক্ষস বাস করে; মহাবল পরাক্রান্ত দুর্দান্ত নরমাংসাশী সেই দুরাই এই নগরের অধিপতি; সে নিজ ভুজকলে এই জনপদ, নগর ও সমস্ত দেশ রক্ষা করে। তাহার প্রভাবে পরচক্র বা অন্যান্য হিংস্র প্রাণী হইতে অমির। কিছুমাত্র ভয় পাই না। ঐ রাক্ষস আপনার আহারের নিমিত্ত এই গ্রামের এক নিয়ম সংস্থাপন করিয়াছে যে, প্রতিদিন পৰ্য্যায়ক্রমে এক এক গৃহস্থের ভবন হইতে একজন মনুষ্য, বিংশতি খারি-পরিমিত তণ্ডুল ও দুইটা মহিষ লইয়া তাহার নিকটে গমন করিবে। রাক্ষস উপনীত সেই সমস্ত বস্তু ও উপস্থিত ব্যক্তিকে ভক্ষণ করিয়া আত্মজীবিকা নির্বাহ করিবে। হে ভদ্রে। বহুদিবসংবপি এই নিয়ম প্রচলিত থকাতে অত্ৰত্য সমস্ত লোকই বিরক্ত হইয়াছে। বাহা হউক, যে ব্যক্তি তাহার এই নিয়ম রহিত করিতে উদ্যোগী হয়, দুরাত্মা রাক্ষস অবিলম্বে তাহাকে পুত্ৰকল সমভিব্যাহারে ধ্বংস করিয়া স্বীয় অভ্যবহারকার্য সম্পাদন করে। এই প্রদেশের অনতিদূরবর্তী বেত্রকীয়গৃহ নামক স্থানে নয়ানভিজ্ঞ এক রাজা আছেন। তিনি নিতান্ত অবোধ, এই নগরের উপর তাহার কিছুমাত্র যত্ন নাই। যাহাতে আমাদের ভাল হয়, কদাচ এমন কোন চেষ্টাই করেন না। আমরা অনাময়ের প্রকৃত পাত্র; কিন্তু অকর্মণ্য ও দুৰ্বল রাজার রাজ্যে বাস করিয়া আমাদিগকে সর্বদা উদ্বিগ্ন থাকিতে হইয়াছে; নতুবা ব্রাহ্মণদিগকে কি কাহারও কথা শুনিতে হয়, না কাহারও অভিপ্রায়ানুবর্তী হইয়া চলিতে হয়? ইহারা নিজ গুণগ্রামে কামগ পক্ষীর মত যথায় ইচ্ছা তথায় বাস করিতে পারেন। হে ভদ্রে! লোক প্রথমে রাজার আশ্রয় গ্রহণ করিবে, পরে ভাৰ্য্য গ্রহণ, তৎপরে ধনসঞ্চয় করিবে; কারণ, এই তিন প্রকার সমৃদ্ধিদ্বারা জ্ঞাতিদিগকে ও পুত্র সকলকে রক্ষা করিতে পারে। ভাগ্যক্রমে আমার এই তিনই বিপরীতরূপে সংগ্রহ করা হইয়াছে; তন্নিমিত্ত আমি এই প্রকার বিপগ স্ত হইয়া তাপিত হইতেছি। হে তপোধনে! অদ্য আমার পৰ্য্যায় উপস্থিত; অবশ্যই আমাকে সেই রাক্ষসসমীপে তাহার ভোজনীয় তণ্ডুলাদি ও একজন মনুষ্য পাঠাইতে হইবে। আমার এমন অর্থ নাই যে, একজন মনুষ্য ক্রয় করি; স্বীয় সুহৃজ্জনকে প্রদান করাও কোনমতে বিধেয় নহে। এক্ষণে কি করি! কিরূপে রাক্ষসহস্ত হইতে পরিত্রাণ পাই, তাহার কোন উপায়ই দেখিতেছি না; এই নিমিত্ত দুঃখসাগরে মগ্ন হইয়াছি। এক্ষণে স্থির করিয়াছি যে, সবান্ধবে সেই দুরাত্মা রাক্ষসের সমীপে গমন করিব, সে আমাদিগের সকলকে এক কালে ভক্ষণ করিয়া এই বিষ দুঃখ হইতে মোচন করিবে।