১৫-১৭. আকাশের দিকে মুখ করে

১৫.

আকাশের দিকে মুখ করে সমুদ্রের পানিতে শুয়ে আছে সেরিনা। রাতের আকাশে নক্ষত্রগুলো স্ফটিকের মতো জ্বল জ্বল করছে। পূর্ব আকাশে কালপুরুষ নক্ষত্রমালা উঠেছে। শামীম বলেছিল যখন সূর্য ডোবার পর কালপুরুষ ঠিক মাথার উপর থাকবে তখন পূর্ণিমার রাতে সে বালুবেলায় তার জন্যে অপেক্ষা করবে। আকাশে কালপুরুষ নক্ষত্র উঠেছে আর কিছুদিনের ভেতর সূর্যাস্তের সময় কালপুরুষ নক্ষত্রটি ঠিক মাথার উপর থাকবে। সেরিনার সময় এসেছে তার আব্বুর কাছে ফিরে যাবার সে তাই ফিরে যেতে শুরু করেছে।

সেরিনার বুকের ভেতর একটা চাপা বেদনা। গভীর এক ধরণের বিষণ্ণতা। সত্যি কী সে তার আঁঝুঁকে দেখতে পাবে?

.

১৬.

শামীম আকাশের দিকে তাকাল। প্রতি রাতই সে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। আকাশের নক্ষত্রগুলোকে দেখে। কালপুরুষ নক্ষত্রটি একটু একটু করে মাঝ আকাশের দিকে এগিয়ে আসছে। তার মেয়েটি যদি বেঁচে থাকে তাহলে যখন সূর্যাস্তের সময় কালপুরুষ নক্ষত্রটি ঠিক মাথায় উপর থাকবে তখন ভরা জোছনার রাতে তার মেয়েটি সমুদ্র থেকে উঠে আসবে। শামীম সেরিনাকে বলে রেখেছিল, তার মেয়েটি কী মনে রেখেছে তার কথা? মেয়েটি কী সত্যি আসতে পারবে?

শামীম বালুবেলায় বসে মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকাল। এই মাত্র সূর্য ডুবেছে। পশ্চিম আকাশে এখনো সূর্যের লাল আভা। আকাশে নক্ষত্রগুলো একটু একটু করে বের হতে শুরু করেছে। কালপুরুষ নক্ষত্রগুলো ঠিক মাথার উপর জ্বল জ্বল করছে। আজ পূর্ণিমা, এক্ষুণি পূর্ব আকাশে ভরা চাঁদ উঠবে একটু পরে চাঁদের আলোতে চারিদিক থই থই করতে থাকবে।

শামীম বালুবেলায় শুয়ে শুয়ে সমুদ্রের ঢেউ-এর শব্দ শোনে। একটির পর আরেকটি ঢেউ এসে বালুবেলাকে আঘাত করছে। এখন ভাটার সময়, খুব ধীরে ধীরে সমুদ্রের পানি সরে যেতে শুরু করেছে। একজন দুজন মানুষ বালুবেলায় এখনো ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে একটু পরে তারা কেউ থাকবে না। এই পুরো বালুবেলাটি তখন নির্জন হয়ে যাবে। তার মাঝে শামীম একাকী বসে থাকবে। বেশ কিছুদিন থেকেই সে এভাবে একাকী বসে থাকে। তার মেয়েটি যদি আগেই চলে আসে, এসে দেখে কেউ নেই তখন একা একা এই মেয়েটা কী করবে? তাই শামীম প্রতি রাতে এই বালুবেলায় আসে, একা একা ঘুরে বেড়ায়। বালুবেলায় শুয়ে থাকতে থাকতে কখনো তার চোখে ঘুম নেমে আসে, গুটিশুটি হয়ে সে ঘুমিয়ে পড়ে। হঠাৎ তার ঘুম ভেঙ্গে যায়, জেগে উঠে সে চারদিকে তাকায়। তার মেয়েকে সে খোঁজে। যদি তার ঘুমের মাঝে মেয়েটি সমুদ্র থেকে উঠে এসে থাকে, একা একা তাকে খুঁজে বেড়ায়?

শামীম আজকেও বালুবেলায় বসে আছে। আকাশে ভরা চাঁদ, চাঁদটা যখন আরো একটু উপরে উঠবে তখন জোছনার আলোতে চারিদিক থই থই করবে। সেই আলোতে বহুদূর দেখা যাবে, তার মেয়েটি যদি সমুদ্রের পানি থেকে উঠে আসে তাহলে সে তাকে দেখতে পাবে। প্রথম যখন তাকে দেখবে তখন তার কেমন লাগবে?

শামীম সেটা চিন্তা করেও বুঝতে পারে না।

.

১৭.

আব্বু, তুমি আমাকে যে রকম বলেছিলে যে ঠিক সূর্য ডুবে যাবার পর যখন আকাশে নক্ষত্রগুলো মিটি মিটি জ্বলতে শুরু করে তখন যখন কালপুরুষ নক্ষত্রটা ঠিক মাথার উপর থাকে তখন যেন আমি ফিরে আসি। তুমি বলেছিলে ঠিক যখন ভরা চাঁদ আকাশে উঠে চারিদিকে আলো করে দেবে তখন তুমি আমার জন্যে বালুবেলায় অপেক্ষা করবে।

আব্বু, আজ সন্ধেবেলা কালপুরুষ ছি ঠিক মাথার উপর, আব্বু, আজ আকাশে ভরা চাঁদ। চারিদিক জোছনার আলোতে থই থই করছে। আব্বু, আমি আজকে ফিরে এসেছি। কখনো সমুদ্রের স্রোতে ভেসে এসেছি, কখনো ডলফিনের পিঠে করে এসেছি, কখনো কখনো তিমি মাছের ঝাঁকের সাথে এসেছি, তাদের পিঠে শুয়ে এসেছি। কখনো কখনো বিশাল কোনো একটা ট্যাংকরের নিচে কোনো খুপড়িতে শুয়ে শুয়ে এসেছি। তুমি আমাকে যেভাবে আকাশের নক্ষত্র দেখে কীভাবে পথ চিনতে হয় শিখিয়েছ আমি ঠিক সেভাবে পথ চিনে ফিরে এসেছি।

আব্বু, আমি কিন্তু আজকে তোমার সাথে দেখা করতে আসি নি, আমি দূর থেকে তোমাকে শুধু এক নজর দেখতে এসেছি। মনে আছে, তুমি আমাকে বলেছিলে আমি যেন শুধু আমার শরীরের ত্বক দিয়ে অক্সিজেন না নিই, আমি যেন প্রতিদিন বুক ভরে ফুসফুস দিয়ে অক্সিজেন নিই? আব্বু আমি সেটা করতে পারি নি। কীভাবে পারব? আমার চারদিকে শুধু পানি আর পানি। আমি পানির মাঝে থাকি, পানির মাঝে ঘুমাই। বেঁচে থাকার জন্যে আমার পানির মাঝে থাকতে হয়। আমি বুক ভরে ফুসফুস দিয়ে শ্বাস নেয়ার জন্যে দিনের পর দিন রাতের পর রাত কোনো শুকনো জায়গা পাই নি আব্বু।

আলেক্স চাচা যেরকম বলেছিল যদি আমি ফুসফুস ব্যবহার না করি তাহলে ধীরে ধীরে আমার ফুসফুসটা অকেজো হয়ে যাবে আমি আব্বু ফুসফুস দিয়ে শ্বাস নিতে পারব না–ঠিক তাই ঘটেছে আব্বু। আমি আমার ফুসফুস দিয়ে শ্বাস নিতে পারি না। আমি যখন শুকনোতে উঠি যখন আমার শরীর শুকিয়ে যায় তখন আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। আমি আর মানুষ নই আব্বু, আমি এখন একটা মাছের মতোন। আমাকে দেখে তোমার কোনো আনন্দ হবে না আব্বু, আমাকে দেখে তোমার শুধু কষ্ট হবে। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না আব্বু।

শুধু যে আমার ফুসফুস অকেজো হয়ে গেছে তা নয় আব্বু। আমার ত্বকের রক্তনালী পানি থেকে অক্সিজেন নেয়, খুব ধীরে ধীরে আমার ত্বকের রক্তনালীগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আমার শরীরের চামড়াটা এখন অন্য রকম। টকটকে লাল রক্তনালী দিয়ে ঢাকা। দেখে তোমার মনে হবে কেউ বুঝি আমার শরীরকে ফালাফালা করে কেটে রেখেছে। তুমি দেখলে ভয় পাবে আব্বু। খুব ভয় পাবে। আমার চোখ এখন টকটকে লাল; দেখে মানুষের চোখ মনে হয় না, মনে হয় কোনো অশরীরি প্রাণী। আমি তোমাকে ভয় দেখাতে চাই না আব্বু। আমি চাই তোমার স্মৃতিতে যে ছোট মানব শিশু সেরিনার ছবিটি আছে সেটাই থাকুক। এই পাল্টে যাওয়া অন্যরকম সেরিনাকে তুমি নাইবা দেখলে।

আব্বু শুধু তাই নয়। আমি কতোদিন কথা বলি না। পানির নিচে ডলফিনের সাথে তিমি মাছের সাথে কখনো কখনো আক্টোপাস আর স্কুইডের সাথে কথা বলতে বলতে আমার গলার স্বর অন্যরকম হয়ে গেছে। আমি এখন স্বাভাবিক মানুষের মতো কথা বলতে পারি না। আমার মুখ থেকে এখন কথা বের হয় না আব্বু, বিচিত্র এক ধরণের শব্দ বের হয়, সেই শব্দ শুনে তুমি চমকে উঠবে। তুমি আতংকিত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে। আমি তোমাকে আতংকিত করতে চাই না আল্লু! মনে আছে আমি তোমার গলা জড়িয়ে কতো কথা বলতাম। আমি তোমাকে ছড়া শোনাতাম, আমি তোমাকে গান শোনাতাম। তুমি খুশি করার জন্যে বলতে আমার গলাটি খুব মিষ্টি? আমার সেই মিষ্টি গলাটি হারিয়ে গেছে আব্লু। আমি এখন যখন কথা বলার চেষ্টা করি আমার গলা থেকে আর মানুষের কণ্ঠ বের হয়ে আসে না। তাই তুমি যদি আমাকে কিছু প্রশ্ন কর আমি তোমার কথার উত্তর দিতে পারব না আব্বু। তুমি আমাকে ক্ষমা করো আব্বু।

আব্বু, আমি খুব সাবধানে সমুদ্রের ঢেউয়ের ভেতর দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখেছি বালুবেলায় ছোট শিশুর মতো একজন গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে। আমি জানি শিশুর মতো গুটিশুটি হয়ে শুয়ে থাকা মানুষটি তুমি। তুমি যখন ঘুমিয়ে পড়বে তখন আমি সমুদ্রের পানি থেকে উঠে আসব। সমুদ্রের পানিতে থেকে থেকে আমি এখন শুকনো মাটিতে ভালো করে হাঁটতে পারি না, তাল হারিয়ে ফেলি, তারপরও আমি উঠে আসব। আমি শুধু একবার জোছনার আলোতে তোমাকে দেখতে চাই। মাত্র একবার। আমি তোমাকে শুধু একবার তোমাকে স্পর্শ করতে পারলে সারা পৃথিবীটি দিয়ে দিতে পারতাম, কিন্তু আব্বু আমি তোমাকে স্পর্শ করব না। যদি তোমার ঘুম ভেঙ্গে যায়? যদি জেগে উঠে আমাকে দেখে তুমি ভয়ে আতংকে চিৎকার করে উঠ?

তাই আমি তোমাকে স্পর্শ করব না। আমি তোমাকে শুধু একবার দেখব। আমার পাল্টে যাওয়া লাল চোখে তোমাকে দেখব। আব্বু, তুমি আমাকে ক্ষমা করো আব্বু। এই পৃথিবীটাতে এখন আমার জায়গা নেই। আমার জায়গা বিশাল সমুদ্র। আমি তোমাকে কোনোদিন জানাতে পারব না যে বিশাল সমুদ্রে আমি একা নই আব্বু, সেখানে আমার বন্ধু আছে। ডলফিনরা আমার আপনজন, তিমি মাছেরা আমাকে দেখে রাখে। অক্টোপাসেরা আমাকে ভালোবাসে। আব্বু, আমি ছোট একটা মেয়ে, কিন্তু আমি মানুষ তাই আমার তাদের দেখে রাখতে হয়। আমি শত শত তিমি মাছকে বাঁচিয়ে রাখি আব্বু। যদি তোমাকে বলতে পারতাম তাহলে তুমি অবাক হয়ে যেতে, তোমার ছোট মেয়েটা সমুদ্রের নিচে কতো বড় একটা দায়িত্ব নিয়ে থাকে। আমার জন্য তুমি ভাবনা করো না আব্বু, আমি খুব ভালো আছি। শুধু তোমার কথা মনে পড়ে আব্বু। আমি শুধু তোমাকে এক নজর দেখতে চাই।

.

সুমদ্রের পানি থেকে খুব ধীরে ধীরে একটা ছায়ামূর্তি বের হয়ে আসে। খুব সাবধানে পা ফেলে সেটি শামীমের পাশে এসে বসে। মাথা ঘুরিয়ে সেই ছায়ামূর্তি শামীমের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তার হাতটি দিয়ে সে শামীমের কপাল স্পর্শ করতে চায়, কিন্তু স্পর্শ করে না। নিঃশব্দে পাশে বসে থাকে।

একটু পরে ছায়ামূর্তিটি উঠে দাঁড়ায়, তারপর নিঃশব্দে পা ফেলে সমুদ্রের পানির দিকে এগিয়ে যায়। নরম বালুতে তার পায়ের ছাপগুলো সমুদ্রের পানি এসে মুছে দিতে থাকে।

সমুদ্রের লোনা পানি। পৃথিবীর সব দুঃখী মানুষের চোখের পানিতে তৈরী হওয়া লোনা পানি।।