১৫-১৬. নির্জন রাস্তা দিয়ে তানুস্কা

১৫.

নির্জন রাস্তা দিয়ে তানুস্কা তার ভ্যানটি চালিয়ে নিচ্ছে। তানুস্কার পাশে রিটিন নিঃশব্দে বসে আছে। পেছনের সিটে নীল ঘুমিয়ে আছে। তাদেরকে প্রায় বারোশত কিলোমিটার যেতে হবে, একটানা গাড়ি চালিয়ে গেলেও চব্বিশ ঘণ্টা থেকে বেশি লেগে যাবে। একটানা গাড়ি চালানো সম্ভব নয়, রিটিন গাড়ি চালাতে পারে না। সে যে পৃথিবী থেকে এসেছে সেখানে কোনো মানুষ গাড়ি চালায় না। একজন মানুষ যে গাড়ি নামের এই বিপজ্জনক যন্ত্রটাকে সরু একটা রাস্তার উপর দিয়ে ঠিকভাবে চালিয়ে নিতে পারে সেটি নিজের চোখে দেখেও রিটিনের এখনো বিশ্বাস হয় না।

ভ্যানের পেছনে রিটিনের যন্ত্রপাতি। একটি ধাতব টিউব, এর ভেতরে সে পাঁচশত বছরের জন্যে ঘুমিয়ে যাবে। এই টিউবটিকে শীতল রাখার জন্যে ছোট একটি ফিউসান ইঞ্জিন, সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে যন্ত্রপাতি। মাটি খুঁড়ে নিচে নামার জন্যে কিছু ভারী যন্ত্রপাতি। পাঁচশ বছর পর আবার এই যন্ত্রপাতিগুলো ব্যবহার করে সে উপরে উঠে নিয়ন্ত্রণ ভবনে ঢুকে যাবে। নিয়ন্ত্রণ ভবন ধ্বংস করার জন্যে তার কাছে প্রচুর বিস্ফোরক, যে বিস্ফোরক দিয়ে সম্ভবত পৃথিবীর একটা বড় শহর ধ্বংস করে ফেলা সম্ভব। এছাড়া আছে কিছু ভয়ংকর দর্শন অস্ত্র। বারোশত কিলোমিটার যাবার সময় পথে যদি কোনো কারণে পুলিশ তাদের থামিয়ে পেছনে কী আছে সেটা পরীক্ষা করতে চায় তাহলে খুব বড় বিপদে পড়ে যেতে পারে! তবে পাঁচশ বছর পরের প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি এই মুহূর্তে কেউ যেন চিনতে না পারে সে জন্যে যথেষ্ট যত্ন করে নকল খোলস দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। বাইরে থেকে এগুলোকে পানির পাম্প, সার ছিটানোর স্প্রে, ট্রাক্টরের ইঞ্জিন এরকম মনে হবে।

রিটিন তানুস্কাকে সবকিছু খুলে বলেছে। তানুস্কা সবকিছু খুঁটিনাটি বুঝেছে তা নয় কিন্তু অন্তত এটুকু বুঝতে পেরেছে তার সাথে হঠাৎ করে ক্ষণিকের পরিচয়ের এই মানুষটির উপর ভবিষ্যতের পৃথিবীর বিশাল একটি দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এই মানুষটিকে ধরে রাখা যায় না। ভবিষ্যৎ থেকে একজন মানুষ তার কাছে চলে এসেছে এই বিষয়টিই সে এখনো পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না।

নির্জন পথে গাড়ি চালাতে চালাতে দুজনে কথা বলছে। প্রথম প্রথম তাদের কথা হয়েছে নিজেদের জগৎ নিয়ে, একসময় সেই কথার প্রয়োজন ফুরিয়েছে, তখন কথা শুরু হয়েছে নিজেদের নিয়ে। নিজেদের কথা শেষ হওয়ার পর কথা হয়েছে একজন অপরজনকে নিয়ে।

গাড়ি চালাতে চালাতে একসময় তানুস্কা গাড়ি থামিয়েছে। কোনো একটা পার্কে কিংবা বনভূমিতে গাড়ি থামিয়ে বিশ্রাম নিয়েছে। তানুস্কা গাড়ির সিট লম্বা করে গুটিসুটি হয়ে ঘুমিয়ে গেছে, রিটিন নীলকে কোলে নিয়ে তার সাথে গল্প করছে।

যখন তাদের ক্ষুধা পেয়েছে তখন তারা পথের ধারে কোনো একটা ছোট ক্যাফেতে গাড়ি থামিয়ে কিছু একটা খেয়েছে। গাড়ি চালাতে চালাতে হঠাৎ যদি নদীতীরে কিংবা পাহাড়ের পাদদেশে অপূর্ব একটি দৃশ্য ফুটে ওঠে তখন তারা সেখানে তাদের গাড়ি থামিয়ে পথের ধারে পা ছড়িয়ে বসে থেকেছে। কখনো দুজনে নিচু গলায় কথা বলে, কখনো চুপচাপ বসে থাকে। কখনো তানুস্কা করুণ সুরে একটি গান গায়। তানুস্কার মিষ্টি গলার স্বর শুনে রিটিন আনমনা হয়ে যায়। বুকের ভেতর থেকে হাহাকারের মতো একটি দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে।

তৃতীয় দিন সকাল বেলা তারা তাদের গন্তব্যে পৌঁছাল। রাস্তা থেকে নেমে তাদের আরো ভেতরে যেতে হবে, পুরো এলাকাটি একটি বনভূমি। এখানে কেমন করে এত যন্ত্রপাতি নিয়ে যাবে তানুস্কা ঠিক অনুমান করতে পারছিল না, কিন্তু সে দেখল কাজটি বেশ সহজ। রিটিন যেসব যন্ত্রপাতি এনেছে তার মাঝে একটি হচ্ছে মিনি বাইভার্বাল। তার উপর সবকিছু চাপিয়ে রিটিন কিছুক্ষণের মাঝেই সবাইকে নিয়ে বনভূমির গভীরে ঢুকে গেল।

ঠিক কোথায় হিমঘরটি বসাবে সেটি রিটিন খুব নিখুঁতভাবে বের করল। জায়গাটি নিশ্চিত করার পর রিটিন যন্ত্র দিয়ে মাটি খুঁড়তে শুরু করল। প্রায় পাঁচশ মিটার গভীরে পাথরের নানা স্তর ভেদ করে সে একটা ছোট ঘর তৈরি করে নেয়, তারপর সেখানে যন্ত্রপাতি নামাতে থাকে।

সন্ধেবেলার আগেই তার কাজ শেষ হয়ে যায়। এখন শুধু ভেতরে গিয়ে টিউবের ভেতরে আশ্রয় নেয়া। পুরো সময়টুকু তানুস্কা একটা গাছের গুঁড়িতে চুপচাপ বসে ছিল। নির্জন বনভূমিতে পাখির ডাক, গাছের পাতার শব্দ কিংবা বুনো পশুর পদচারণা কিছুই সে শুনছিল না। যখন রিটিন তার কাছে বিদায় নিতে এল তখন তানুস্কা প্রথমবার ভেঙে পড়ল। রিটিনকে গভীর আলিঙ্গনে কিছুক্ষণ ধরে রেখে ছেড়ে দিয়ে বলল, “তোমাকে ছেড়ে দিতে মন চাইছে না রিটিন। মনে হচ্ছে তোমাকে বুকে চেপে ধরে রাখি।”

রিটিন নিচু গলায় বলল, “যে কষ্ট মানুষ সইতে পারে না, মানুষকে সেই কষ্ট কেন পেতে হয় আমি জানি না।” তারপর মুখে জোর করে একটু হাসি ফুটিয়ে বলল, “অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে তানুস্কা। তুমি এখন যাও, তোমাকে অনেকটা পথ যেতে হবে।”

তানুস্কা চোখের পানি লুকিয়ে হেঁটে যেতে থাকে। কয়েক পা গিয়ে হঠাৎ করে সে আবার ছুটে ফিরে আসে। রিটিনকে জাপটে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমি পারব না রিটিন। আমি তোমাকে ছেড়ে যেতে পারব না, আমাকে তুমি তোমার সাথে নিয়ে যাও।”

নীল অনুচ্চ স্বরে বলল, “মা। রিটিন তোমাকে নিয়ে গেলে আমি কার সাথে থাকব?”

রিটিন নিঃশব্দে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল।

দুই ঘণ্টা পর তানুস্কা তার ভ্যানটি চালিয়ে উত্তরে যেতে থাকে। সে তার মস্তিষ্কটিকে পুরোপুরি শূন্য করে রাখার চেষ্টা করছে।

ঠিক তখন রিটিন মাটির পাঁচশ মিটার নিচে একটা টিউবের ভেতর শুয়ে তার মাথার কাছে একটা যন্ত্রপাতির প্যানেলের সুইচ টিপে দেয়। খুব অস্পষ্ট একটা চাপা গুঞ্জন শুনতে পেল। টিউবের ভেতর একধরনের মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। রিটিনের চোখে ঘুম নেমে আসতে থাকে।

সুদীর্ঘ একটি ঘুম। টানা পাঁচশ বছরের ঘুম।

.

১৬.

খুব ধীরে ধীরে রিটিনের ঘুম ভেঙে যায়। প্রথমে কিছুক্ষণ রিটিন বুঝতে পারে না সে কোথায় আছে, কেন আছে। ধীরে ধীরে তার চেতনা ফিরে আসতে থাকে এবং হঠাৎ করে তার সবকিছু মনে পড়ে যায়। তানুস্কা তাকে গভীর আলিঙ্গনে ধরে রেখে আকুল হয়ে কাঁদছে, দৃশ্যটার কথা সে ভুলতে পারছে না, কিন্তু সেই ঘটনাটি ঘটেছিল আজ থেকে পাঁচশ বছর আগে। পাঁচশ বছর দীর্ঘ সময়, এই সময়ে পুরো পৃথিবী ওলটপালট হয়ে গেছে। পৃথিবীর এই সময়ে তানুস্কা নেই–রিটিন সেটি মেনে নিতে পারছিল না। তার মনে হতে থাকে ক্যাপসুল থেকে বের হয়ে এলেই দেখবে ঘন অরণ্য। সামনে ছুটে গেলেই দেখবে তানুস্কা তার ভ্যানটিতে হেলান দিয়ে বিষণ্ণ মুখে দাঁড়িয়ে আছে। কাছে দাঁড়িয়ে আছে নীল, তার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে কী হচ্ছে।

রিটিন জানে আসলে গত পাঁচশ বছরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সে মাটির গহ্বরে যে কক্ষটিতে শুয়ে আছে তার উপরে সেই অভিশপ্ত নিয়ন্ত্রণকক্ষ। তাকে সেখানে যেতে হবে, কক্ষটিকে ধ্বংস করতে হবে। তানুস্কা নেই। নীল নেই, কয়েকদিনের সেই দিনগুলোর কোনো অস্তিত্ব নেই। সেটি শুধুমাত্র স্মৃতি। তার মস্তিষ্কের কিছু কিছু নিউরনে জমা করে রাখা একটি পরাবাস্তব স্মৃতি।

রিটিন তার মাথা থেকে সব চিন্তা জোর করে সরিয়ে দিল। তাকে যে কাজ করার জন্যে পাঠানো হয়েছে তাকে সেই কাজটি শেষ করতে হবে। পৃথিবীতে মানুষের বিভাজনটি শেষ হবে কি হবে সেটা নির্ভর করছে সামনের কয়েকটি ঘণ্টায় সে ঠিক করে তার দায়িত্বটি শেষ করতে পারবে কি না তার উপর।

রিটিন সরু ক্যাপসুলটিতে উঠে বসে। মাথার কাছে রাখা মনিটরটির দিকে তাকায়, ছোট প্যানেলটির কয়েকটি জায়গা স্পর্শ করতেই তার শরীরে কিছু উত্তেজক তরল প্রবাহিত হতে শুরু করে এবং প্রায় সাথে সাথেই রিটিন সতেজ অনুভব করতে থাকে।

রিটিন ছোট ক্যাপসুলটির ভেতর বসে তার ব্যাক প্যাকটি পরীক্ষা করল। এর ভেতর যে পরিমাণ বিস্ফোরক আছে সেটি দিয়ে পুরো একটি শহরকে মুহূর্তে ধ্বংস করে ফেলা সম্ভব। রিটিন তার পোশাক পাল্টে নেয়, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রগুলো পরীক্ষা করে তারপর উপরের মাটি ভেদ করে বের হয়ে আসার কাজে লেগে যায়।

রিটিন পুরো সিস্টেমটি পরীক্ষা করল, সবকিছু ঠিকভাবে কাজ করছে। এখন কয়েকটি বোতাম টিপে তাকে অপেক্ষা করতে হবে। নিও মিসাইল উপরের মাটি পাথর কংক্রিট ধাতব শিলা সবকিছু কেটে একটা গোল গর্ত তৈরি করে দেবে। রিটিনকে সেই গর্ত দিয়ে নিয়ন্ত্রণকক্ষের ভেতর ঢুকে যেতে হবে। সেখানে কী দেখবে সে জানে না।

রিটিন কন্ট্রোল প্যানেলের বোতামগুলো স্পর্শ করল। সাথে সাথে সে একটি ঝাঁকুনি অনুভব করল এবং ভোতা একটি যান্ত্রিক শব্দ শোনা যেতে থাকে। রিটিন মনিটরের দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকে।

রিটিন ভেবেছিল গর্তটি করতে বুঝি অনেক সময় নেবে। কিন্তু বেশি সময় নিল না, হঠাৎ করে যান্ত্রিক শব্দটি থেমে যায় এবং মনিটরে একটা লাল বাতি জ্বলতে থাকে। রিটিনের বের হবার সময় হয়েছে।

রিটিন তখন ক্যাপসুল খুলে বের হয়ে আসে। ঠিক তার মাথার উপর গোল একটি গর্ত। মাটি পাথর ধাতব দেয়াল আর কংক্রিট কেটে গর্ত করা হলে নিচে যে পরিমাণ জঞ্জাল আর ধুলো বালি থাকার কথা সেরকম নেই। গর্ত করায় যে নিও মিসাইলটি ব্যবহার হয়েছে সেটি নিশ্চয়ই প্রথম শ্রেণির যন্ত্র।

রিটিন তার শরীরে জেট প্যাক লাগিয়ে নিল, তারপর ব্যাক প্যাকের বিস্ফোরকের সুইচটা টিপে সেটাকে ট্রিগার করে নিল। তারপর গর্তের নিচে দাঁড়িয়ে জেট প্যাকটির কন্ট্রোল রডটি ধরে চাপ দিতেই সে ধীরে ধীরে উপরে উঠতে শুরু করে। উপরে কী আছে সে জানে না। বের হওয়ামাত্রই গুলি করে তাকে ছিন্নভিন্ন। করে দেবে কি না সেটাও সে জানে না। দিলেও ক্ষতি নেই, সে যতক্ষণ বেঁচে থাকবে বিস্ফোরকটি নিজে নিজে বিস্ফোরিত হবে না, তার নিজের হাতে সেটিকে বিস্ফোরিত করতে হবে। কিন্তু কোনো কারণে সে মারা গেলে বিস্ফোরকটি নিজে নিজে বিস্ফোরিত হবে।

গর্তটির মুখের কাছে এসে সে এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে, তারপর একটা ঝটকা দিয়ে উপরে উঠে আসে। একটা আলোকোজ্জ্বল হলঘর, চারপাশে থরে থরে যন্ত্রপাতি সাজানো। যন্ত্রপাতিগুলো আশ্চর্য রকম নীরব, এতগুলো যন্ত্র থেকে বিন্দুমাত্র শব্দ বের হচ্ছে না। রিটিন অস্ত্রটি হাতে নিয়ে তার দৃষ্টি ফিরিয়ে মাথা ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে হঠাৎ করে পাথরের মতো স্থির হয়ে যায়। অনেকগুলো মানুষ সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে তার দিকে নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মানুষগুলো সবাই একই রকম। সাদা ওভার অল পরে আছে। আর সবচেয়ে যেটি আশ্চর্য সেটি হচ্ছে সবগুলো মানুষ শুধু যে দেখতে একরকম তা নয় মানুষগুলোর মুখের অভিব্যক্তি এক রকম। তারা সবাই একসাথে মুখটা উপরে তুলে রিটিনের দিকে তাকাল, তারপর এক সাথে সবাই চোখের দৃষ্টি নামিয়ে আনে।

রিটিন শক্ত করে অস্ত্রটা ধরে রাখল, যদি মানুষগুলো বিন্দুমাত্র বিপদের আভাস দেয় এক পশলা গুলি দিয়ে সবাইকে শেষ করে দেবে। কিন্তু মানুষগুলো একটু নড়ল না, কোনো রকম বিপজ্জনক কিছু করল না, শুধুমাত্র স্থির দৃষ্টিতে রিটিনের দিকে তাকিয়ে রইল।

রিটিন মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে আনার চেষ্টা করে বলল, “শুভ সকাল।”

মানুষগুলো কোনো উত্তর না দিয়ে তার দিকে নিস্পলক চোখে তাকিয়ে রইল। রিটিন বলল, “আমি বলেছি শুভ সকাল।”

এবারে মানুষগুলো একজন কিংবা বেশ কয়েকজন মিলে বলল, “আসলে সময়টা সকাল না। সন্ধে হয়ে গেছে।”

গলার স্বর যান্ত্রিক। রিটিন অস্ত্রটা তাক করে রেখে বলল, “তোমরা কী রোবট?”

মানুষগুলো পুতুলের মতো একসাথে মাথা নাড়ে, তারপর বলে, “না, আমরা রোবট না। আমরা মানুষ।”

রিটিন অবাক হয়ে লক্ষ করল সবগুলো মানুষ মিলে কথা বলছে কিন্তু তারা এক সাথে কথা বলছে না, একেকজন একেকটা শব্দ উচ্চারণ করছে, কিন্তু এত বিস্ময়করভাবে একজনের পর আরেকজন কথা বলে যাচ্ছে যে শুনে মনে হচ্ছে বুঝি একজন কথা বলছে।

রিটিন অস্ত্রটা তাক করে ধরে রেখে বলল, “তোমরা ক্লোন।”

“হ্যাঁ, আমরা একে অপরের ক্লোন।”

রিটিন কী বলবে বুঝতে পারল না। একটু ইতস্তত করে বলল, “তোমাদের সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম।”

মানুষগুলো উত্তর দিল না, তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। রিটিন বলল, “আমি একটা বিশেষ কাজ করতে এসেছি। আশা করি তোমরা আমাকে কাজটা করতে দেবে। আমার কাজে বাধা দেবে না।”

 “কী কাজ?”

“আমি এই যন্ত্রগুলো ধ্বংস করতে এসেছি। যদি আমার কাজে বাধা দাও আমায় তোমাদেরকে মেরে ফেলতে হবে।”

মানুষগুলো নিচু গলায় কিছু একটা বলল, রিটিন ঠিক বুঝতে পারল না। জিজ্ঞেস করল, “কী, বললে তোমরা?”

“বলেছি যন্ত্রগুলো ধ্বংস করলে আমরা এমনিতেই মরে যাব।”

“এমনিতেই মরে যাবে? কেন?”

“আমরা হচ্ছি যন্ত্রগুলোর আত্মা। যন্ত্রগুলো আমাদের শরীর। শরীর ধ্বংস হলে আত্মা বেঁচে থাকে না।”

রিটিন শব্দ করে হাসল। বলল, “যন্ত্র হচ্ছে যন্ত্র। যন্ত্রের আত্মা থাকে না। তোমরা নিশ্চিন্ত থাকো তোমরা মারা যাবে না। কিন্তু আমার কাজে বাধা দিলে তোমাদের অবশ্যই মেরে ফেলতে হবে।”

মানুষগুলো কোনো কথা না বলে রিটিনের দিকে তাকিয়ে রইল। রিটিন বলল, “তোমরা পেছন দিকে সরে যাও আমি এখন যন্ত্রগুলোতে বিস্ফোরক লাগাব।”

মানুষগুলো জিজ্ঞেস করল, “কেন তুমি যন্ত্রগুলো ধ্বংস করতে চাও?”

“এই যন্ত্রগুলো দিয়ে পৃথিবীর মানুষের বিভাজন করা হয়। আমরা বিভাজন দূর করে দিতে চাই।”

“পৃথিবীতে কি অনেক মানুষ?”

রিটিন একটু অবাক হয়ে মানুষগুলোর দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, “তোমরা পৃথিবীর কিছু জানো না?”

মানুষগুলো বলল, “এটা আমাদের পৃথিবী। এই যন্ত্রগুলো আমাদের শরীর, আমরা যন্ত্রগুলোর আত্মা। বাইরের পৃথিবীতে কী আছে আমরা জানি না। জানতেও চাই না।”

এই নিয়ে দ্বিতীয়বার মানুষগুলো যন্ত্রের আত্মা কথাটি বলেছে। কেন বলেছে কে জানে। রিটিন তার কাঁধ থেকে ব্যাকপ্যাকটা খুলে ভেতর থেকে বিস্ফোরকগুলো বের করতে থাকে। ছোট ছোট চতুষ্কোণ ব্লক। উপরে একটি ডায়াল, ডায়ালটিতে সময় নির্ধারণ করে দিতে হয়। নির্ধারিত সময়ে বিস্ফোরকগুলো বিস্ফোরিত হয়।

রিটিন একটা বিস্ফোরক হাতে নিয়ে মানুষগুলোকে লক্ষ করে বলল, “তোমরা পেছনে সরে যাও, এই বিস্ফোরকগুলো প্রচণ্ড শক্তিশালী। যখন যন্ত্রগুলো ধ্বংস হবে তখন দূরে থাকতে হবে।”

মানুষগুলো বলল, “আমরা কি যন্ত্রগুলোর কাছে থাকতে পারি?”

রিটিন মাথা নাড়ল, বলল, “না। পারো না।”

“জন্ম থেকে আমরা এই যন্ত্রগুলোকে লালন করেছি। মৃত্যুর সময় আমরা তার পাশে থাকতে চাই।”

রিটিন কঠিন মুখ করে বলল, “না, আমি যখন যন্ত্রগুলো ধ্বংস করব তখন তোমরা তার কাছে থাকতে পারবে না। আমি যন্ত্র ধ্বংস করতে এসেছি, মানুষ ধ্বংস করতে আসিনি। যাও, পিছিয়ে যাও।”

মানুষগুলো পিছিয়ে গেল না। বলল, “তুমি কেন যন্ত্রগুলো ধ্বংস করতে চাও? যন্ত্রগুলো ধ্বংস করলে আমরাও ধ্বংস হয়ে যাব।”

“না, তোমরা ধ্বংস হবে না।”

“এই যন্ত্র ছাড়া আমাদের জীবনে আর কিছু নেই।”

“এখন থাকবে। এখান থেকে বের হওয়ার পর তোমাদের নতুন একটা জীবন হবে।”

“কিন্তু কেন যন্ত্রগুলো ধ্বংস করতে চাও?”

রিটিন মাথা ঘুরিয়ে মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমরা কি জানো এই যন্ত্রগুলো কী করে?”

“না। জানি না।”

“তাহলে জেনে রাখো। এই যন্ত্রগুলো পৃথিবীর সব মানুষের সব তথ্য সংরক্ষণ করে। সেই তথ্য দিয়ে মানুষের সাথে মানুষের বিভাজন করা হয়। যদি এই যন্ত্রগুলো ধ্বংস করে দেয়া হয় তাহলে মানুষে মানুষে আর বিভাজন থাকবে না।”

মানুষগুলো এক সাথে মাথা নাড়ল, তারপর বলল, “যন্ত্র দিয়ে কী হয় আমরা জানতে চাই না, আমরা শুধু যন্ত্রটা চাই।”

রিটিন মানুষগুলোর দিকে তাকাল এবং হঠাৎ করে বুঝতে পারল এই মানুষগুলো কিছুতেই তাকে যন্ত্রগুলোর মাঝে বিস্ফোরক লাগাতে দেবে না। শুধু তাই নয়, এই মানুষগুলো একে অপরের ক্লোন, তারা এক সাথে একভাবে চিন্তা করে, তাই হঠাৎ করে সবাই যদি তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সে তাদের থামাতে পারবে না। মানুষগুলোর মাথায় কী আছে সে জানে না। তারা কী ভাবছে সেটাও সে জানে না।

রিটিন অস্ত্রটা হাতে ধরে চিৎকার করে বলল, “তোমরা সবাই পিছিয়ে যাও। নইলে আমি গুলি করব। পিছিয়ে যাও।”

মানুষগুলো যন্ত্রের মতো এক পা পিছিয়ে গেল। শুধু পিছিয়ে গেল না, একজন থেকে আরেকজন সরে গেল। এরা নিজেদের ভেতর একটা দূরত্ব তৈরি করছে।

রিটিন আবার চিৎকার করল, “পিছিয়ে যাও।”

মানুষগুলো আবার এক পা পিছিয়ে গেল, রিটিন লক্ষ করল কেউ একটু বেশি পিছিয়েছে, কেউ কম। মানুষগুলো আসলে বৃত্তাকারে তাকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে। রিটিন প্রথমবার এক ধরনের বিপদ আঁচ করতে পারে, কিছু একটা ঘটছে যেটা সে বুঝতে পারছে না। হঠাৎ করে তার কী মনে হলো কে জানে, সে মাথা ঘুরিয়ে পেছন দিকে তাকাল, দেখল পেছন থেকে নিঃশব্দে অনেকগুলো ক্লোন তার দিকে এগিয়ে আসছে।

কিছু বোঝার আগেই সবগুলো ক্লোন এক সাথে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। রিটিন হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা দিয়ে গুলি করার চেষ্টা করল কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে, কেউ একজন পেছন থেকে তার মাথায় আঘাত করেছে। কী হচ্ছে বোঝার আগেই চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। রিটিন শক্ত গ্রানাইটের মেঝেতে লুটিয়ে পড়ার আগে আবছা আবছা দেখতে পেল অসংখ্য ক্লোন হিংস্র মুখে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে, মনে হচ্ছে তার সমস্ত শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে।

জ্ঞান হারানোর আগে রিটিন হঠাৎ করে নিজের ভেতর এক ধরনের প্রশান্তি অনুভব করে। ক্লোনগুলো তাকে এখানে মেরে ফেলবে। তাতে এখন আর কিছু আসে যায় না। বিস্ফোরকগুলো তার শরীরের সাথে ট্রিগার করে রাখা আছে। তার হৃৎস্পন্দন থেমে যাওয়া মাত্রই বিস্ফোরকগুলো বিস্ফোরিত হয়ে সবকিছু ধ্বংস করে ফেলবে।

সে বেঁচে থাকবে না কিন্তু মৃত্যুর ভেতর দিয়ে তার দায়িত্ব সে পালন করে যাবে। ক্লোনগুলোর হিংস্র আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হতে হতে রিটিন তার চোখ বন্ধ করল। ধীরে ধীরে সে অচেতন অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে, জীবনের শেষ মুহূর্তটি সে সুন্দর কিছু ভাবতে চায়।

রিটিনের চোখের সামনে তানুস্কার চেহারাটি ভেসে ওঠে। রিটিন দেখল তানুস্কা গভীর মমতা নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

রিটিন তখন জ্ঞান হারাল।