ছোটো গল্প
উপন্যাস
প্রবন্ধ
ফিচার
কবিতা

১৫. স্বজাতির শত্রু

১৫. স্বজাতির শত্রু

রেড ইন্ডিয়ানদের আশ্রিত কুকুরদের সঙ্গে হয়তো হোয়াইট ফ্যাং-এর বন্ধুত্ব হতে পারত। অন্ততঃ সেরকম একটা সম্ভাবনা একেবারে ছিল না জোর করে এমন কথা বলা যায় না। কিন্তু মিট-সা যখন হোয়াইট ফ্যাংকে স্লেজবাহক কুকুরদের দলপতি হিসাবে নিযুক্ত করল, তখনই তার সম্পর্কে তীব্র ঘৃণা ও বিদ্বেষ পোষণ করতে লাগল সমগ্র কুকুর-বাহিনী।

দলপতি সম্পর্কে অন্যান্য কুকুরদের হিংস্র বিদ্বেষের কারণ এর আগেই বলা হয়েছে। ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদে, অতএব এখানে পুনরাবৃত্তি অনাবশ্যক।

দিনের বেলা স্লেজ টানার সময়ে মিট-সার হাতের দীর্ঘ চাবুক কুকুরগুলোকে লড়াই থেকে নিরস্ত রাখত। কিন্তু অন্যসময়ে, বিশেষ করে রাত্রে, যখন তাদের বন্ধনমুক্ত করে ছেড়ে দেওয়া হত, তখনই ঘটত কলহের সূত্রপাত। কুকুরগুলো সর্বদাই দল বেঁধে হোয়াইট ফ্যাংকে আক্রমণ করত। তারা জানত এককভাবে নেকড়েটার সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে মৃত্যু অবধারিত। তাই কোনো একটি কুকুরের সঙ্গে কলহের সূত্রপাত হলেই সম্পূর্ণ দলটা ঝাঁপিয়ে পড়ত হোয়াইট ফ্যাং-এর উপর।

কিন্তু মিলিতভাবে আক্রমণ চালিয়েও তারা কখনোই হোয়াইট ফ্যাংকে ঘায়েল করতে পারত না। সে অসম্ভব ধূর্ত ও ক্ষিপ্র, কুকুরগুলো তাকে ঘেরাও করার আগেই সে ব্যুহভেদ করে সরে পড়ত। চারপায়ে মাটি আঁকড়ে সে যখন রুখে দাঁড়াত, তখন তাকে স্থানচ্যুত করে মাটিতে আছড়ে ফেলার ক্ষমতা কোনো কুকুরেরই ছিল না। একমাত্র স্লেজ টানার সময় ছাড়া দিনে রাতে সব সময়ই সুযোগ পেলেই কুকুরের দল আক্রমণ করত হোয়াইট ফ্যাংকে। হোয়াইট ফ্যাং-এর সর্বাঙ্গে ছিল অসংখ্য দংশনের শুষ্ক ক্ষতচিহ্ন এবং দলের প্রত্যেকটি কুকুরের শরীরেই ছিল নেকড়েটার দাঁতের হিংস্র স্বাক্ষর। মনে প্রাণে সব কুকুরগুলিকেই ঘৃণা করত হোয়াইট ফ্যাং। ক্রমে ক্রমে জাতভাইদের সঙ্গে তার গড়ে উঠল আমরণ শত্রুতার সম্পর্ক। এই শত্রুতার যেন শেষ নেই।

হোয়াইট ফ্যাং যখন পঞ্চমবর্ষে পদার্পণ করছে, সেইসময় তাকে নিয়ে এক দীর্ঘ পদযাত্রা শুরু করল গ্রে বিভার। পথে যে সব গ্রাম পড়েছিল, সেইসব গ্রামের কুকুরদের মধ্যে যে হত্যার তাণ্ডবলীলা চালিয়েছিল হোয়াইট ফ্যাং, তার ভয়াবহ স্মৃতি কোনোদিনই মুছে যাবে না গ্রে বিভারের মন থেকে। কুকুরদের লড়াই করার কয়েকটা নির্দিষ্ট রীতি আছে। শত্রুকে আক্রমণ করার আগে তাদের ঘাড় ও পিঠের লোম খাড়া হয়ে ওঠে, পাঁয়তারার ভঙ্গিতে মাটির উপর চেপে বসে চারটি নখর যুক্ত থাবা, ঠোঁট ফাঁক হয়ে বেরিয়ে আসে তীক্ষ্ণ দাঁতের সারি– তারপর উত্তেজনা যখন তীব্র থেকে তীব্রতর হয় তখনই তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রুর উপর। এসব প্রস্তুতির বালাই ছিল না হোয়াইট ফ্যাং-এর, নিঃশব্দে সে আঘাত হানত বিদ্যুৎবেগে। আক্রান্ত কুকুর ভালোভাবে লড়াই শুরু করার আগেই রক্তাক্ত শরীর নিয়ে শুয়ে পড়ত মৃত্যুশয্যায়।

গ্রীষ্মকালে ইউকন দুর্গে এসে পৌঁছাল গ্রে বিভার। আসার পথে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে শিকার করেছে সে। সাদা মানুষদের কাছে ওই সব পশুচর্ম যে অত্যন্ত মূল্যবান সেকথা তার অজানা ছিল না। সময়টা ছিল ১৯৯৮ সাল- উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নদীর অববাহিকায় সোনার সন্ধান পেয়ে ছুটে আসছে স্বর্ণলোভী মানুষ এমন কি পৃথিবীর অন্য প্রান্ত থেকে অব্যাহত ছিল লুব্ধ জনতার স্রোত।

স্বর্ণসন্ধানী জনতার গুজব গ্রে বিভারের কানে এসেছিল। তাই জনতা যেখানে ভিড় করেছে, তারই কাছাকাছি বাণিজ্যের পসরা সাজিয়ে বসল গ্রে বিভার। শুধু পশুচর্ম নয়, হাতে-বোনা দস্তানা আর নরম মোকাসিন জুতো ছিল তার সঙ্গে। ভালো লাভ করার আশাতেই সে এই দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে এসেছে বহু কষ্ট সহ্য করে। কিন্তু লাভের পরিমাণ দেখে সে চমকে গেল। শতকরা এক-শো ভাগ লাভের আশা সে করতে পারত, কিন্তু স্বপ্নেও শতকরা হাজার ভাগ লাভের আশা সে করতে পারেনি। তবু তাই হল। এই কল্পনাতীত সৌভাগ্যে তার লোভ বাড়ল। ধীরে ধীরে অতি সন্তর্পনে ব্যবসা চালিয়ে সে লাভের মাত্রা বাড়িয়ে ফঁপিয়ে তুলতে চাইল। রেড ইন্ডিয়ানদের ধৈর্য অসীম– প্রয়োজন হলে গ্রীষ্মকাল থেকে শুরু করে সমস্ত শীতকাল ধরে মাল বেচতেও তার আপত্তি ছিল না। অতএব ইউকন দুর্গের কাছেই সে তাঁবু খাটাল।

হোয়াইট ফ্যাং সাদা মানুষদের প্রথম দেখল ইউকন দুর্গে। ছোটবেলায় রেড ইন্ডিয়ানদের তাঁবুগুলো দেখে চমকে উঠেছিল হোয়াইট ফ্যাং। ওই ফাপানো ফোলানো প্রকাণ্ড বস্তুগুলি যারা তৈরি করেছিল, তারা যে চতুষ্পদ পশুদের চাইতে উন্নত এক শক্তিমান জাতি এবিষয়ে তার সন্দেহ ছিল না কিছুমাত্র। হোয়াইট ফ্যাং-এর কাছে লাল মানুষরা (রেড ইন্ডিয়ান) হচ্ছে এক ধরনের দেবতা, যাদের অস্ত্রশস্ত্র, আগুন ও স্ফীতকায় তাঁবুগুলো দেখে ভয়ে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে তাদের কাছে নতি স্বীকার করেছিল সে। এখন আর সে বাচ্চা নয়, কিন্তু পরিণত বয়সেও সাদা মানুষদের বাড়িগুলো এবং ইউকন দুর্গের বিশাল বিস্তার তাকে স্তম্ভিত করে দিল। সে অনুমান করল সাদা মানুষরা তার পূর্বপরিচিত লাল মানুষদের চাইতেও শক্তিশালী দেবতা। লাল মানুষদের মধ্যে সবচেয়ে প্রতাপশালী গ্রে বিভারকেও সাদা চামড়ার দেবতাদের তুলনায় শিশুর মতোই তুচ্ছ ও নগণ্য বলে মনে করল হোয়াইট ফ্যাং।

যুক্তি আর বিচার দিয়ে ওইসব কথা ভাবেনি সে, কিন্তু বন্যপশুর সহজাত অনুভূতি দিয়ে সে বুঝে নিয়েছিল সাদা চামড়ার মানুষ লাল মানুষের চাইতে অনেক বেশি শক্তিমান।

তবে সাদা মানুষরা যতই শক্তিমান হোক, তাদের কুকুরগুলি যে একেবারেই অকম, কয়েকদিনের মধ্যেই তার প্রমাণ পেল হোয়াইট ফ্যাং। যেসব শ্বেতাঙ্গ নদীপথে জাহাজে চড়ে যাতায়াতের পথে ফোর্ট ইউকনের জাহাজঘাটায় নামত, তাদের সহচর কুকুরগুলোকে সুযোগ পেলেই হত্যা করত সে। নেকড়েটিকে দেখলেই সাদা মানুষের কুকুর সগর্জনে ছুটে আসত। ক্ষিপ্রচরণে সরে গিয়ে তার আক্রমণ ব্যর্থ করে দিত হোয়াইট ফ্যাং এবং পরক্ষণেই প্রচণ্ড ধাক্কায় শত্রুকে ছিটকে ফেলে কণ্ঠনালী বিদীর্ণ করে দিত হিংস্র দংশনে।

আহত কুকুর যখন মাটিতে পড়ে যন্ত্রণায় ছটফট করত, তখন রেড ইন্ডিয়ানদের কুকুরগুলো ছুটে এসে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলত তাকে। স্থানীয় কুকুরের দলটা জাহাজঘাটায় অপেক্ষা করত। তারা জানত জাহাজ থেকে নেমে নবাগত কুকুর মাটিতে পা রাখলেই মজার খেলাটা শুরু হবে। তাই হত। হোয়াইট ফ্যাং চতুষ্পদ আগন্তুকের সামনে উপস্থিত হলেই নবাগত কুকুর তাকে আক্রমণ করত এবং কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আহত অবস্থায় ছটফট করত মাটিতে পড়ে। অপেক্ষমান কুকুরের দল যখন ধরাশায়ী আহত কুকুরকে টুকরো টুকরো করে ছিড়ত, সেইসময় দূরে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা উপভোগ করত হোয়াইট ফ্যাং। সে বুদ্ধিমান জীব, রেড ইন্ডিয়ানদের হত্যাপাগল সারমেয়-বাহিনীর মতো মুখ নয় সে। দেবতারা তাদের পোষা কুকুর মারা পড়লে যে ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এই তথ্য তার অজানা ছিল না। লাল দেবতাদের সঙ্গে এবিষয়ে সাদা দেবতাদের কোনো তফাৎ নেই। কুকুরের আর্তনাদ আর চিৎকার শুনে অকুস্থলে ছুটে এসে সাদা মানুষরা দেখতে পায় তাদের সাদরের পোষা জীবটিকে নিষ্ঠুর আক্রোশে ছিন্নভিন্ন করছে একদল স্থানীয় কুকুর। তৎক্ষণাৎ কুকুর-বাহিনীর উপর পড়তে থাকে লাঠি, কঠার আর পাথর। সেই নিদারুণ প্রহারে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় খনী ককরের দল।

সব-নষ্টের গোড়া হোয়াইট ফ্যাং একটু দূরে দাঁড়িয়ে মজা উপভোগ করে। সাদা মানুষরা তার বিরুদ্ধে অস্ত্র নিক্ষেপ করে না- নিরীহভাবে যে জন্তুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী করে না কোনো শ্বেতাঙ্গ।

খুনোখুনির খেলায় ওই হতচ্ছাড়া গ্রাম্য কুকুরগুলোর সহায়তা গ্রহণ করলেও তাদের সঙ্গে মেলামেশা করত না হোয়াইট ফ্যাং। নবাগত কুকুরকে খুনী কুকুরগুলোর খপ্পরে ফেলে দিয়ে সে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করত ক্রুদ্ধ সাদা মানুষদের আক্রমণে বিপন্ন কুকুরগুলোর দুর্দশা দেখার জন্য।

অনেক সময় সাদা মানুষরা প্রতিশোধ নেওয়ার আগেই কাজ শেষ করে ছত্রভঙ্গ হয়ে যেত খুনি কুকুরের দল। ক্রুদ্ধ শ্বেতাঙ্গ প্রভুর চোখের সামনে পড়ে থাকত তার আদরের পোষা জীবটির রক্তাক্ত মৃতদেহ। তবে সবসময়ে অতসহজে নিষ্কৃতি পাওয়া যেত না। একদিন একটা সেটার জাতীয় কুকুরকে যখন হতচ্ছাড়া নেড়ি কুত্তাগুলো টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ছে, সেইসময় আক্রান্ত সেটারের মালিক রিভলভার বার করল। পর পর ছয়বার অগ্নিবৃষ্টি করল রিভলভার, আহত ও নিহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল ছয়টি গ্রাম্য কুকুরের মৃতদেহ। সেই অগ্নিবর্ষণের স্মৃতি গভীরভাবে দাগ কাটল তরুণ শ্বাপদের মানসপটে, শ্বেতাঙ্গ দেবতার প্রচণ্ড প্রাণঘাতী ক্ষমতার পরিচয় পেল হোয়াইট ফ্যাং।

রিভলভারের গুলিতে হতাহত জন্তুগুলির দুর্দশা দেখে দারুণ আনন্দ উপভোগ করল সে। কুকুরমাত্রেই তার শত্রু। তাদের নির্যাতন দেখলে সে সর্বদাই খুশি হয়। গ্রে বিভার এখন ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। হোয়াইট ফ্যাং-এর কোনো কাজ নেই। অতএব জাহাজ থেকে নবাগত সাদা মানুষদের কুকুরগুলোকে সে হত্যা করতে লাগল পরমানন্দে।

কোনো জাহাজ ঘাটে লাগলেই প্রাণান্তকর মজার খেলাটা শুরু হয়ে যায়। আগন্তুক শ্বেতাঙ্গরা তাদের পোষা কুকুরদের উপর এমন অতর্কিত আক্রমণের সম্ভাবনা ভাবতেই পারত না। তারা বিস্ময়ের চমক কাটিয়ে ওঠার আগেই নেড়ি কুত্তার দল হত্যাকাণ্ড সমাধা করে আগন্তুক শ্বেতাঙ্গদের দৃষ্টির বাইরে অন্তর্ধান করত।

এই ভয়ংকর হত্যাকাণ্ডের নায়ক হোয়াইট ফ্যাং কিন্তু সর্বদাই থাকত ধরাছোঁয়ার বাইরে। সে যেমন ধূর্ত, তেমনি সতর্ক, আর হত্যার নেশায় উন্মাদ। লিপ-লিপ নামে ককরটা যদি বাচ্চা বয়সে তাকে বিরক্ত না করত, যদি সমবয়সী কুকুরশাবকদের সঙ্গে সে স্বাভাবিকভাবে খেলাধুলা করার সুযোগ পেত, তাহলে স্বভাবচরিত্রে সে হত অন্যান্য কুকুরদের মতন জাতভাইদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে তার আপত্তি থাকত না।

কিন্তু লিপ-লিপের নির্মম শত্রুতা এবং তার নেতৃত্বে ছোটোবেলা থেকেই দলবদ্ধ কুকুরশাবকদের অন্যায় আক্রমণ তাকে করে তুলেছিল নিঃসঙ্গ, বিষণ্ণ ও নিষ্ঠুর সমগ্র কুকুরজাতি সম্পর্কে হিংস্র বিদ্বেষ পোষণ করত হোয়াইট ফ্যাং।

.

১৬. উন্মত্ত দেবতা

ইউকন দুর্গের শ্বেতাঙ্গ বাসিন্দারা নবাগত সাদা মানুষদের পছন্দ করত না। সুতরাং হোয়াইট ফ্যাং আর তার হতচ্ছাড়া চ্যালা-চামুণ্ডাদের হত্যালীলা তাদের কাছে ছিল মস্ত মজার ব্যাপার। পোষা কুকুরের শোচনীয় মৃত্যুতে নবাগত সাদা মানুষের শোকদুঃখ দুর্গের বাসিন্দাদের কাছে। অতিশয় উপভোগ্য। তাই জাহাজঘাটায় নতুন জাহাজ এসে ভিড়লেই মজা দেখার আশায় সেখানে ভিড় জমাত দুর্গের যাবতীয় সাদা চামড়ার মানুষ।

দুর্গবাসীদের মধ্যে ওই খুনোখুনি দেখে যে লোকটি সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেত, তার নাম বিউটি স্মিথ। পূর্বোক্ত মানুষটির দেহে ও মুখে বিউটি বা সৌন্দর্য নামক বস্তুটি ছিল সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। সত্যি কথা বলতে কি বিউটি স্মিথের মতো কুৎসিত মানুষ খুব কমই চোখে পড়ে। প্রশ্ন হতে পারে এমন কুৎসিত মানুষের নামের আগে বিউটি বিশেষণ কেন? খুব সম্ভব কোনো রসিক ব্যক্তি ওই নামটি রেখেছিল এবং তাতেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল দুর্গবাসী মানুষ। আমাদের দেশেও কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন বা নজরালি রাখার উদাহরণ বিদ্রূপ হিসাবে প্রচলিত।

দুর্গবাসীদের জন্য রান্না ও অন্যান্য ছোটোখাটো কাজ করত বিউটি স্মিথ। দুর্গবাসীরা তাকে ভয় করত। ভয় করার কারণ ছিল– দুর্গবাসীরা জানত, কারোর উপর অসন্তুষ্ট হলে কফিতে বিষ মিশিয়ে অথবা পিছন থেকে গুলি করে বিরাগভাজন ব্যক্তিকে হত্যা করা বিউটি স্মিথের পক্ষে আদৌ অসম্ভব নয়। তবে রান্নার কাজ সে ভালোই জানত, তাই নিতান্ত প্রয়োজনের তাগিদেই তাকে নিযুক্ত করেছিল দুর্গবাসী মানুষ। উক্ত বিউটি স্মিথকে মনে-প্রাণে ঘৃণা করত হোয়াইট ফ্যাং। বন্যপশুর তীব্র অনুভূতি ও সহজাত সংস্কার দিয়ে বর্ণসঙ্কর নেকড়েটি বুঝেছিল। বিউটি স্মিথ নামক শ্বেতাঙ্গটি দেবতাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হলেও অতিশয় বিপদজনক দেবতা।

প্রথম যেদিন গ্রে বিভারের তাবুতে উপস্থিত হল বিউটি স্মিথ, সেইদিন থেকেই তাকে অপছন্দ করত হোয়াইট ফ্যাং। বন্যপশুর ইন্দ্রিয় তাকে আসন্ন বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছিল। বিউটি স্মিথ গিয়েছিল গ্রে বিভারের কাছে বর্ণসংকর জন্তুটিকে নগদ মূল্যে কিনে নেওয়ার জন্য। কিন্তু গ্রে বিভার এতদিনের বিশ্বস্ত সঙ্গীকে বিক্রি করতে রাজি হল না। বাণিজ্যে প্রচুর লাভ করেছিল সে, অতএব অর্থের লোভ দেখিয়েও সুবিধা করতে পারলো না বিউটি স্মিথ।

টাকা দেখিয়ে যখন লাভ হল না, তখন ধূর্ত শ্বেতাঙ্গ অন্য কৌশল অবলম্বন করল। সে জানত সাদা মানুষের তৈরি হুইস্কি সম্বন্ধে রেড ইন্ডিয়ান জাতির দুর্বলতা আছে। সে গ্রে বিভারকে হুইস্কির নেশা ধরিয়ে দিল। নেশায় আসক্ত গ্রে বিভার দিনরাত্রি ডুবে থাকতে লাগল সেই তরল অগ্নিস্রোতের মধ্যে। একসময়ে দেখা গেল তার সমস্ত টাকা নিঃশেষ হয়ে গেছে। কিন্তু হুইস্কির তৃষ্ণা তার তখনও অতৃপ্ত।

এইবার যখন বিউটি স্মিথ হোয়াইট ফ্যাংকে কিনে নিতে চাইল, তখন আর তাকে ফিরিয়ে দিতে পারল না গ্রে বিভার। বর্ণসংকর নেকড়ের গলায় চামড়ার বাঁধন লাগিয়ে তাকে টানতে টানতে দুর্গের মধ্যে নিয়ে গেল বিউটি স্মিথ। হোয়াইট ফ্যাং অবশ্য সহজে নতুন মালিকের কাছে আত্মসমর্পণ করতে সম্মত হয়নি। হিংস্র আক্রোশে দাঁত খিঁচিয়ে সে তেড়ে এসেছিল সাদা মানুষটার দিকে। কিন্তু শত্রুর দেহের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগেই সাদা মানুষের হাতের মুগুর প্রচণ্ড আঘাতে মাটির উপর লুটিয়ে দিল। সশব্দে হেসে উঠে গ্রে বিভার জানাল কুকুর বুঝে মুগুরের ব্যবস্থা করলেই জন্তুটা নতুন মালিকের বশ্যতা স্বীকার করবে। হোয়াইট ফ্যাং বোকা নয়- সে বুঝল এই শ্বেতাঙ্গ দেবতাটি খুব জোরে মুগুর হাঁকাতে পারে এবং মুগুরের বিরুদ্ধে তার দাঁতগুলি কিছুতেই কার্যকরী হবে না। অতএব, গলায় বাঁধা দড়ি ধরে আবার যখন টান দিল বিউটি স্মিথ, তখন অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাকে অনুসরণ করে ইউকন দুর্গে এসে পোঁছাল হোয়াইট ফ্যাং।

সেই রাতেই বাঁধন কেটে সে পালিয়ে গেল আগের মালিকের কাছে। কিন্তু পরের দিন সকালেই তার পূর্বতন মনিব গ্রে বিভার তাকে বিউটি স্মিথের হাতে সমর্পণ করল। আবার পালাল বর্ণসংকর নেকড়ে এবং আবার আশ্রয় নিল পুরানো মনিবের তাবুতে। গ্রে বিভারকে সে যে খুব ভালোবাসত তা নয়, তবে লাল মানুষটির প্রতি বিশ্বস্ত ছিল হোয়াইট ফ্যাং। তার ধারণা অনুসারে সে ছিল গ্রে বিভারের সম্পত্তি, তাই তার দেহ ও মনের উপর লাল মানুষটির অধিকার মেনে নিতে সে আপত্তি করেনি। সুতরাং মালিকানার বদল হলেও বিউটি স্মিথ নামে শ্বেতাঙ্গটির আনুগত্য স্বীকার করতে সম্মত হল না হোয়াইট ফ্যাং।

কিন্তু তার পুরাতন ও নূতন দুই মনিবের মধ্যে কেউ তার ইচ্ছার দাম দিল না। প্রথম বারের মতো দ্বিতীয়বারও তাকে গ্রে বিভার ফিরিয়ে দিল বিউটি স্মিথের হাতে।

অবাধ্যতার জন্য ভীষণ শাস্তি পেল হোয়াইট ফ্যাং। প্রহারে জর্জরিত হয়ে সে অর্ধ-মুৰ্ছিত অবস্থায় শুয়ে পড়ল মাটির উপর। বিউটি স্মিথ যখন তাকে মারছিল, তখন গ্রে বিভার নিশ্চেষ্টভাবে দাঁড়িয়েছিল। এখন আর কুকুরটা তার সম্পত্তি নয়। অতএব নতুন মালিকের ইচ্ছায় বাধা দেওয়া অনুচিত মনে করেই প্রহারে বাধা দেয়নি গ্রে বিভার।

এমন ভীষণভাবে কখনো মার খায়নি হোয়াইট ফ্যাং। দক্ষিণ-অঞ্চলের কোনো কুকুর অমনভাবে প্রহারে জর্জরিত হলে অকুস্থলেই মৃত্যুবরণ করত। কিন্তু হোয়াইট ফ্যাং নামক বর্ণসংকর পশুটার দেহে ছিল অফুরন্ত জীবনীশক্তি– তাই প্রচণ্ড প্রহার হজম করেও সে বেঁচে রইল, কিন্তু মার যখন থামল তখন আর উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা ছিল না তার। প্রায় আধ ঘণ্টা বিশ্রাম নেওয়া পর উঠে দাঁড়িয়ে সে টলতে টলতে অনুসরণ করল তার নূতন মালিককে এবং প্রায় অন্ধের মতো স্বলিতচরণে প্রবেশ করল ইউকন দুর্গে।

এইবার তাকে লোহার শিকল দিয়ে বাঁধল বিউটি স্মিথ, চামড়ার বাঁধনের উপর তার ভরসা ছিল না। লোহার শিকল কাটার মতো শক্তিশালী নয় হোয়াইট ফ্যাং-এর দাঁত, নিরুপায় হয়েই সে বন্ধন-দশা মেনে নিল। সে বুঝে নিল এই কুৎসিত সাদা দেবতাটি তার বর্তমান প্রভু, তার ইচ্ছা-অনুসারেই তাকে চলতে হবে, বিদ্রোহ করলেই ঘাড়ে পড়বে চাবুক অথবা মুগুর। প্রথম দিন থেকেই বিউটি স্মিথকে সে অপছন্দ করেছিল। বর্ণসংকর নেকড়েটার ধারণা হয়েছিল ওই কুৎসিত মানুষটির সাহচর্য তার পক্ষে মঙ্গলজনক হবে না। পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয়েছিল হোয়াইট ফ্যাং-এর ধারণা সম্পূর্ণ সত্য। তার কাছে সব মানুষই দেবতা; কেউ ভালো, কেউ খারাপ। কিছুদিনের মধ্যেই হোয়াইট ফ্যাং বুঝল এক ভয়ংকর উন্মত্ত দেবতার খপ্পরে পড়েছে। সে, তার বর্তমান মনিব যেমন হিংস্র, তেমনই নির্মম দয়ামায়ার লেশমাত্র নেই তার নূতন মনিব-দেবতার চরিত্রে।

.

১৭. ঘৃণা ও সন্ত্রাসের রাজত্বে

দুর্গের পিছনদিকে একটা মস্ত কাঠের খোঁয়াড়ে বন্দি করে নানাভাবে তার উপর নির্যাতন চালাতে লাগল বিউটি স্মিথ। হোয়াইট ফ্যাং বর্ণসংকর পশু তার দেহে বুনো নেকড়ের রক্ত থাকলেও মানুষের সাহচর্য তাকে কিছুটা ভদ্র, কিছুটা সহনশীল করেছিল। কিন্তু তার শ্বেতাঙ্গ মনিবের অত্যাচার তার রক্তে নিদ্রিত বন্য হিংসাকে আবার জাগিয়ে তুলল। বিউটি স্মিথের সাহচর্যে আসার আগে সে ছিল মনুষ্যসমাজ সম্পর্কে উদাসীন, দেবতাদের অর্থাৎ মানুষদের সে নিতান্ত কোণঠাসা না হলে আক্রমণ করত না। তার জেহাদ ছিল কেবলমাত্র জাতভাই কুকুরদের বিরুদ্ধে। বিউটি স্মিথের পরিকল্পিত অত্যাচারের ফলে মানুষ কিংবা কুকুর, দ্বিপদ অথবা চতুষ্পদ- সব প্রাণীকেই সে শত্রু হিসাবে ভাবতে শুরু করল।

বিশেষ উদ্দেশ্যেই হোয়াইট ফ্যাং-এর হিংস্র স্বভাবকে আরও-হিংস্র, আরও বেপরোয়া করে তুলতে চেয়েছিল স্মিথ। জাহাজঘাটায় বর্ণসংকর জন্তুটার রণকৌশল দেখতে দেখতে পরিকল্পনাটা মাথায় এসেছিল তার। জন্তুটার লড়াই-এর ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে বেশ কিছু টাকা রোজগার করতে চেয়েছিল সে।

একদিন কয়েকজন মানুষ এসে ভিড় করল খোঁয়াড়ের পাশে। তারপর দরজা খুলে একটা করকে খোঁয়াড়ের ভিতর ঢুকিয়ে আবার দরজা বন্ধ করে দেওয়া হল। এমন প্রকাণ্ড অতিকায় কুকুর আগে কখনো দেখেনি হোয়াইট ফ্যাং (কুকুরটা ছিল মাটিফ)। আগন্তুকের দেহের আয়তন আর ভয়াবহ মুখশ্রী হোয়াইট ফ্যাংকে সন্ত্রস্ত বা বিচলিত করতে পারল না। ভয় পেল না সে, বরং খুশি হল। আজ আর নিষ্ফল আক্রোশের খোঁয়াড়ের কাঠ আর লোহা কামড়াতে হবে না। তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে রক্তমাংসের একটা জীবন্ত প্রাণী, যার উপর অনায়াসে ক্রোধ চরিতার্থ করতে পারবে সে। সে ঝাঁপ দিল, বিদ্যুঝলকের মতো চমকে উঠল তীক্ষ্ণ দাঁতের সারি, মাটিফের ঘাড়ের পাশে দেখা দিল বিদীর্ণ ক্ষতচিহ্ন। মাথায় ঝাঁকুনি দিয়ে ভাঙা গলায় একবার গর্জে উঠল মাটিফ, তারপর হোয়াইট ফ্যাংকে লক্ষ্য করে লাফ দিল। কিন্তু হোয়াইট ফ্যাংকে আঘাত করতে পারল না সে এপাশে, ওপাশে পাক দিয়ে ঘুরছে বর্ণসংকর নেকড়েটা অতর্কিতে লাফিয়ে এসে তীক্ষ্ণ দন্তাঘাতে শত্রুর রক্তপাত করে। সে আবার পিছিয়ে যাচ্ছে মুহূর্তের মধ্যে, সুকৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছে শত্রুর আক্রমণ। মাটিফের দেহ বিশাল, গতি মন্থর। নাতিস্থূল নাতিক্ষীণ হোয়াইট ফ্যাং পেশল বলিষ্ঠ, গতিবেগ বিদ্যুৎ ক্ষিপ্র। প্রথম থেকেই মাটিফ কুকুরটার জয়লাভের কোনো আশা ছিল না। অবশেষে একটা মুগুরের সাহায্যে বিউটি স্মিথ হোয়াইট ফ্যাংকে খোয়াড়ের পিছনদিকে তাড়িয়ে দিল আর সেই সুযোগে মাটিফের প্রভু এসে তার পোষা জীবটিকে টেনে নিয়ে গেল খোয়াড়ের বাইরে। অতঃপর কিছু টাকা পেল বিউটি স্মিথ। আজকের বাজি জিতেছে সে। হোয়াইট ফ্যাং-এর হিংস্র রণকৌশল বিউটি স্মিথের পকেট ভারি করে দিয়েছে। কুৎসিত মানুষটার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হল। হোয়াইট ফ্যাংকে লড়াইতে নামিয়ে তার উপর বাজি রাখলে বেশ কিছু অর্থাগম হবে মনে করেই গ্রে বিভারের কাছ থেকে সে জন্তুটাকে কিনে নিয়েছিল। আজ সে বুঝল তার হিসাবে ভুল হয়নি। ভবিষ্যতে বেশ মোটা রকম অর্থপ্রাপ্তির সম্ভাবনা ভেবে উল্লসিত হয়ে উঠল সে।

হোয়াট ফ্যাং-এর মধ্যেও উৎসাহের সঞ্চার হল। একঘেয়ে বন্দিজীবন তাকে তিক্ত করে তুলেছিল। নানা ধরনের অত্যাচার চলত তার উপর। দর্শকরা তাকে লাঠি দিয়ে খোঁচাত, আঙ্গুল দেখিয়ে তাকে নিয়ে হাসাহাসি করত। দারুণ আক্রোশে ফেটে পড়ত হোয়াইট ফ্যাং মানুষগুলোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের ছিন্নভিন্ন করার জন্য প্রাণপণে কাঠ আর লোহার বেষ্টনী ভাঙার চেষ্টা করত সে, কিন্তু দর্শকদের সৌভাগ্য ও তার দুর্ভাগ্যবশত কোনো সময়েই তার চেষ্টা সফল হত না। তবে খোঁয়াড়ের পাশে জনতার সমাগম হলেই সে বুঝত তার সামনে লড়াই করার সুযোগ আসছে। একটা জীবন্ত কুকুরকে টুকরো টুকরো করে ঘৃণা ও আক্রোশ চরিতার্থ করার মধ্যেই সে এখন খুঁজে পায় জীবনের চরম সার্থকতা। অতএব অধীর আগ্রহে সে অপেক্ষা করতে থাকে খোঁয়াড়ের মধ্যে একটা জীবন্ত শত্রুর জন্য। তার সেই প্রত্যাশা পূর্ণ হয় বার বার। কারণ, হোয়াইট ফ্যাং-এর সঙ্গে আর একটি কুকুরের লড়াই হলে কিছু টাকা আসে বিউটি স্মিথের পকেটে।

একদিন পর পর তিনটি কুকুরের বিরুদ্ধে লড়তে হল হোয়াইট ফ্যাংকে। পর পর তিনটি যুদ্ধেই বিজয়ী হল হোয়াইট ফ্যাং। আর একদিন বন থেকে ধরে-আনা একটা পূর্ণবয়স্ক নেকড়েকে হোয়াইট ফ্যাং-এর খাঁচায় ঢুকিয়ে দেওয়া হল। সেখানেই শেষ নয়- একদিন একসঙ্গে দুটি কুকুরকে তার উপর লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই লড়াইটা ছিল সবচেয়ে ভয়ংকর। নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে লড়েছিল হোয়াইট ফ্যাং। শেষ পর্যন্ত কুকুর দুটিকে সে হত্যা করেছিল বটে, কিন্তু নিজেও হয়ে পড়েছিল আধমরা– তার দুই শত্রু তাকে প্রায় মৃত্যুর দুয়ার পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিল।

কুকুরের লড়াইতে বেশ ভালো টাকা পাচ্ছিল বিউটি স্মিথ। উপার্জন আরও বাড়ানোর লোভে বছরের শেষে হোয়াইট ফ্যাংকে নিয়ে জাহাজে উঠে ইউকন নদী পেরিয়ে সে এসে পৌঁছাল ডসন নামক প্রদেশে। জাহাজ থেকে ডাঙায় উঠে এল হোয়াইট ফ্যাং। তখনো সে খাঁচায় বন্দি। তাকে জনসাধারণের সামনে উপস্থিত করা হল লডুয়ে নেকড়ে নাম দিয়ে। শুধুমাত্র তাকে দেখার জন্য দর্শকরা পঞ্চাশ সেন্ট মূল্যের সোনার গুঁড়ো দর্শনী দিত। তাকে বিশ্রাম নিতে দেওয়া হত না। সে ঘুমোনোর চেষ্টায় শুয়ে পড়ার চেষ্টা করলেই তাকে লাঠির খোঁচা মেরে তুলে দেওয়া হত। ক্রদ্ধ বিরক্ত পশু খাঁচার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে খাঁচা ভাঙার চেষ্টা করত দর্শকদের দিকে তাকিয়ে। উদ্দেশ্যমূলক ভাবেই তাকে সবসময় উত্তেজিত করে রাখা হত। তার হিংস্র আচরণ দর্শকদের আকর্ষণ করত। ফলে, বিউটি স্মিথের পকেটে অর্থের সমাগম ছিল অব্যাহত।

তবে শুধু দর্শনীর অর্থ নিয়ে বিউটি স্মিথের উচ্চাভিলাষ তৃপ্ত হওয়ার নয়। লড়াই দেখতে এবং বাজি ধরতে মানুষ অনেক বেশি টাকা খরচ করে, কাজেই আবার লড়াই-এর ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল হোয়াইট ফ্যাং-এর প্রভু।

ব্যবস্থা হল। শহর থেকে কয়েক মাইল দূরে একটা ফাঁকা জায়গা নির্বাচিত হল বনের মধ্যে। উপযুক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী পেলেই খাঁচা থেকে হোয়াইট ফ্যাংকে বার করে পূর্বোক্ত স্থানে নিয়ে যেত বিউটি স্মিথ। পুলিসের অবাঞ্ছনীয় হস্তক্ষেপ এড়ানোর জন্য সাধারণত রাতের অন্ধকারে কুকুর নিয়ে রওনা হত স্মিথ। দিনের আলো ফুটে ওঠার পর যখন প্রতিদ্বন্দ্বী কুকুর এবং দর্শকের দল নির্দিষ্ট স্থানে এসে পৌঁছাত, তখনই শুরু হত লড়াই। এখন আর খাঁচার মধ্যে নয়, ফাঁকা মাঠের উপর মৃত্যুপণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হত দুটি হিংস্র পশু। বন্য প্রকৃতির বুকে বন্য হিংসার ওই রক্তাক্ত লড়াই যারা দেখতে আসত, সেই মানুষগুলোর স্বভাবও ছিল যুদ্ধে অবতীর্ণ পশুদের মতোই হিংস্র, বন্য, রক্তলোলুপ। সাধারণত একটি পশুর মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত লড়াই থামতো না।

প্রত্যেক যুদ্ধেই জয়লাভ করত হোয়াইট ফ্যাং। প্রত্যেক যুদ্ধেই নিহত হত তার প্রতিদ্বন্দ্বী কুকুর। বর্ণসংকর নেকড়ে হোয়াইট ফ্যাং-এর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল বিভিন্ন জাতির কুকুর। নেকড়ে আর কুকুর একই গোষ্ঠীর অন্তর্গত যেসব অতিকায় হিংস্র কুকুরের ধমনীতে নেকড়ের রক্ত আছে, তারা সকলেই প্রতিদ্বন্দ্বীর কাঁধে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় এবং ভূপতিত প্রতিদ্বন্দ্বী আঘাতের বেগ সামলে ওঠার আগেই তার গলায় কামড় বসিয়ে শত্ৰুনিপাত করে। ম্যাকেজি হাউন্ড, এস্কিমো আর ল্যাব্রাডর, হাসকি আর মেলমিউট প্রভৃতি যেসব বলিষ্ঠ কুকুর যোদ্ধা হিসাবে পরিচিত তারা সকলেই বিভিন্ন কৌশলে হোয়াইট ফ্যাংকে মাটিতে ফেলার চেষ্টা করেছে, কিন্তু কেউ সফল হয়নি। বর্ণসংকর পশুটির চারটি পা সজোরে মাটি আঁকড়ে ভারসাম্য বজায় রাখে, কোনোমতেই তার শত্রু তাকে মাটিতে আড়ছে ফেলতে পারে না।

কিছুদিন পর দেখা গেল অত্যন্ত শক্তিশালী কুকুরও হোয়াইট ফ্যাং-এর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না। সে দ্রুতবেগে ঘুরতে ঘুরতে আক্রমণ করে; চোখের পলকে কামড় বসিয়ে প্রতিপক্ষকে রক্তাক্ত করে সরে যায় অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্র বেগে, প্রতিদ্বন্দীর চোয়ালের নিশানা ব্যর্থ আক্রোশে শুন্যকেই দংশন করে বার বার, কিন্তু বর্ণসংকর পশুটার দেহে কামড় বসাতে পারে না। তারপর একসময়ে কাঁধের উপর দারুণ ধাক্কা খেয়ে চিত হয়ে ছিটকে পড়ে প্রতিদ্বন্দ্বী কুকুর, পরক্ষণেই প্রচণ্ড প্রাণঘাতী আঘাতে শত্রুর কণ্ঠনালী বিদীর্ণ করে সরে যায় হোয়াইট ফ্যাং এবং মৃত্যুযাতনায় ছটফট করতে করতে প্রাণ হারায় আহত কুকুর।

কুকুরদের মধ্যে যখন উপযুক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী দুর্লভ হয়ে উঠল, তখন বুনো নেকড়ের সঙ্গে হোয়াইট ফ্যাং-এর লড়াই এর ব্যবস্থা করতে বাধ্য হল বিউটি স্মিথ। নেকড়েগুলোকে ফঁদ পেতে ধরা হত রেড ইন্ডিয়ানদের সাহায্যে। হোয়াইট ফ্যাং এবং নেকড়ের লড়াই দেখতে অনেক মানুষ ভিড় করত এবং স্মিথের পকেট টাকা পয়সায় ভারি হয়ে উঠত দস্তুরমতো। একবার একটা পূর্ণবয়স্ক মাদী লিংক্সকে সংগ্রহ করা হল লড়াই এর জন্য। এইবার হোয়াইট ফ্যাং-এর জীবন বিপন্ন হয়ে উঠল। ক্ষিপ্রতায় ও ভীষণতায় অতিকায় বনবিড়ালী হোয়াইট ফ্যাং-এর সমকক্ষ, হোয়াইট ফ্যাং লড়ছিল দাঁতের সাহায্যে, কিন্তু বিড়ালী দাঁতের সঙ্গে তার ধারাল নখরযুক্ত থাবাগুলোকেও ব্যবহার করছিল সমানভাবে…. একসময়ে শেষ হল লড়াই। অতিকষ্টে এই লড়াইটা জিতেছিল হোয়াইট ফ্যাং।

পূর্বোক্ত ঘটনার পর বেশ কিছুদিন লড়াই বন্ধ রইল। হোয়াইট ফ্যাং-এর উপযুক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী পাওয়া যাচ্ছিল না। শুধু তাকে দেখিয়ে দর্শনীয় টাকা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে বাধ্য হল স্মিথ। শীতের শেষে বসন্তের সমাগমে ওই অঞ্চলে টিম কীনান নামে এক জুয়াড়ি এসে উপস্থিত হল, তার সঙ্গে এল একটা বুলডগ। ক্লনড়াইল প্রদেশে ইতিপূর্বে কখনো বুলগের আবির্ভাব ঘটেনি। থ্যাবড়ামুখো বেঁটে কুকুরটার সঙ্গে হোয়াইট ফ্যাং-এর লড়াই-এর ব্যবস্থা হবে, এমন একটা আশা উঁকি দিল স্থানীয় মানুষের মনে। কয়েকদিন ধরে সম্ভাব্য লড়াইটা হল শহরের মধ্যে প্রধান আলোচনার বিষয়।

.

১৮. মরণ-ফাঁদ

বিউটি স্মিথ শিকলটা গলা থেকে খুলে নিয়ে পিছিয়ে গেল। চিরকালই প্রতিপক্ষকে প্রস্তুতির অবসর না দিয়ে আক্রমণ করেছে হোয়াইট ফ্যাং। জীবনে সর্বপ্রথম সে এগিয়ে গিয়ে শত্রুকে আঘাত করার চেষ্টা করল না। এমন ঘটনা এর আগে কোনোদিন ঘটেনি। তবে এমন অদ্ভুত চেহারার কুকুরও আগে কখনো দেখেনি হোয়াইট ফ্যাং। টিম কীনান তার বুলডগকে সামনে এগিয়ে দিল, অনুচ্চস্বরে বলল, যাও, ওর কাছে এগিয়ে যাও।

দুটি কুকুরকে ঘিরে একটি বৃত্ত রচনা করে দাঁড়িয়েছিল উৎসুক জনতা। সেই বৃত্তের মধ্যস্থল লক্ষ্য করে হেলে-দুলে কিছুটা এগিয়ে গেল বুলডগ, তারপর হঠাৎ থেবড়ে বসে পড়ে হোয়াইট ফ্যাং এর দিকে তাকিয়ে চোখ পিট পিট করতে লাগল।

জনতা চিৎকার করে উঠল, ওকে কামড়ে ধরো চেরোকী!- ওকে চেপে ধরো চেরোকী!– ওকে খেয়ে ফেল চেরোকী, ওকে খাও!

যে লোকগুলো চিৎকার করছিল, তাদের দিকে ঘুরে তাকিয়ে চোখ পিট পিট করতে লাগলো চেরোকী, বেঁটে-খাটো লেজটাকে ও নাড়তে লাগল মহা-আনন্দে। স্পষ্টই বোঝা গেল সামনের জন্তুটাকে সে ভয় করছে না বটে, কিন্তু তার সঙ্গে মারামারি করতে সে ইচ্ছুক নয়।

টিম কীনান তার কুকুরের স্বভাব জানত। সে এবার এগিয়ে এসে চেরোকীর দুই কাঁধে হাত ঘষতে শুরু করল, সেই সঙ্গে ধীরে ধীরে তাকে ঠেলতে লাগল হোয়াইট ফ্যাং-এর দিকে। চেরোকী এবার উত্তেজনা প্রকাশ করল, তার গলা থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল গুরুগম্ভীর ধ্বনি। টিমের হস্তচালনার তালে তালে অদ্ভুত ছন্দে বাজতে লাগল চেরোকীর কণ্ঠস্বর। ক্রুব্ধ ঝংকারের রেশ ছড়িয়ে মৃদু থেকে আরও-মৃদু হয়ে মিলিয়ে যায় সেই শব্দ, পরক্ষণেই দূরাগত বজ্রের গুরু গুরু ধ্বনির মতো বেজে ওঠে অবরুদ্ধ কণ্ঠের চাপা গর্জন।

বুলডগ আর তার মালিকের আচরণ হোয়াইট ফ্যাং নামে বর্ণসংকর পশুটার মধ্যেও পরিবর্তন আনল। তার ঘাড় আর পিঠের লোম খাড়া হয়ে উঠলো। চেয়োকীকে শেষবারের মতো একটা ধাক্কা মেরে সামনে ঠেলে দিল টিম কীনান, তারপর পিছিয়ে এসে দর্শকদের মধ্যে দাঁড়াল। টিমের ধাক্কায় কিছুটা এগিয়ে এল চেরোকী, তারপর নিজে থেকেই সামনের দিকে ছুটতে লাগল– তার বাঁকা বাঁকা চারটি পা দুলকি চালে মাটির উপর পড়ছিল দ্রুতছন্দে। আর ঠিক তখনই আঘাত হানল হোয়াইট ফ্যাং। চোখের পলকে মধ্যবর্তী দূরত্ব পার হয়ে বুলডগের ঘাড়ে কামড় বসিয়ে সরে গেল সে শত্রুর নাগালের বাইরে। সমবেত দর্শকদের মধ্যে জাগল বিস্ময় ও প্রশংসার গুঞ্জন।

বুলগের কানের পিছনে পুরু ঘাড়ের মাংস বিদীর্ণ হয়ে ঝরে পড়তে লাগল রক্তের ধারা। জন্তুটার দেহ বা মুখের একটি পৌশও কাঁপল না। তার নীরব কণ্ঠ একবারও সশব্দ গর্জনে ক্রোধ বা যন্ত্রণা প্রকাশ করল না, ঘুরে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে শত্রুকে অনুসরণ করল সে। এক পক্ষের ক্ষিপ্র গতিবেগ এবং অপরপক্ষের নির্বিকার দৃঢ়তা দর্শকদের মধ্যে বিপুল উত্তেজনার সৃষ্টি করল। নতুন করে বাজি ফেলতে লাগলো মানুষ। পুরানো বাজির দর বাড়তে, লাগল সঙ্গেসঙ্গে। আবার ঝাঁপ দিল হোয়াইট ফ্যাং দস্তাঘাতে রক্তাক্ত করে দিল শত্রুর শরীর এবং শত্রু তাকে স্পর্শ করার আগেই একলাফে সরে গেল নিরাপদ দূরত্বে। হোয়াইট ফ্যাং সবিস্ময়ে দেখল এই আশ্চর্য শত্রু তখনও তাকে অনুসরণ করছে নিঃশব্দে কখনো দ্রুত বা মন্থর হচ্ছে না তার গতি– একইভাবে দৃঢ় পদক্ষেপে সে এগিয়ে চলেছে লক্ষ্য অভিমুখে। মনে হয় নিজস্ব পদ্ধতিতে একটা বিশেষ উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতেই সে এগিয়ে চলেছে এবং কোনো কারণেই যে, তার উদ্দেশ্য সাধনের চেষ্টা বিফল হবে না, এবিষয়ে সে নিশ্চিত।

হোয়াইট ফ্যাং হতভম্ব- এমন অদ্ভুত কুকুর কখনো তার চোখে পড়েনি। অন্যান্য কুকুরের শরীরে ফুলে-ওঠা লোমগুলি শত্রুর দাঁতে জড়িয়ে আঘাতের বেগ কিছুটা কমিয়ে দেয়। কিন্তু বুলড়গের পাতলা চামড়ার উপর ঘন লোমের আবরণ না থাকায় হোয়াইট ফ্যাং-এর দাঁত খুব সহজেই ঢুকে যাচ্ছিল মাংসের ভিতর। প্রত্যেকবারই আঘাতের ফলে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল বুলগের শরীর থেকে, তবু একবারও সগর্জনে প্রতিবাদ জানাচ্ছে না সে। সম্পূর্ণ নিঃশব্দে শত্রুর নির্মম দন্তাঘাত বার বার শরীরের উপর গ্রহণ করে নির্বিকার চেরোকী দৃঢ় পদক্ষেপে অনুসরণ করছে শত্রুকে ক্লান্তি বা যন্ত্রণা নামে কোনো শারীরিক অনুভূতির সঙ্গে যেন তার পরিচয় নেই।

চেরোকীও বিস্মিত হয়েছিল। এর আগে যেসব কুকুরের সঙ্গে সে লড়াই করেছে, তারা। সবাই কাছে এসে শত্রুর দেহ কঠিন দংশনে চেপে ধরতে চায়। কিন্তু এ কেমন শত্রু। এই কুকুরটা কখনো কাছে আসে না ড়িয়ে লাফাতে থাকে, নাচতে নাচতে আক্রমণ এড়িয়ে যায়। তারপর হঠাৎ জীবন্ত বিদ্যুতের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে চকিত দংশনে শত্রুকে রক্তাক্ত করে দূরে সরে যায় মুহূর্তের মধ্যে কখকো ধরা দেয় না নখদন্তের আলিঙ্গনে।

এর মধ্যে একবার চেরোকীর একটা রক্তাক্ত কানের অবশিষ্ট অংশ এক কামড়ে উড়িয়ে দিয়ে যখন ফিরে যাচ্ছে হোয়াইট ফ্যাং, সেই সময় হঠাৎ শত্রুর গলা লক্ষ্য করে ঝাঁপ দিল বুলডগ। অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রবেগে উলটোদিকে পাক দিয়ে ঘুরে গেল হোয়াইট ফ্যাং, একচুলের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হল বুলডগের দাঁতালো চোয়াল।

উল্লসিত কোলাহলে হোয়াইট ফ্যাংকে প্রশংসা জানাল সমবেত জনতা- ভারসাম্য রেখে দেহের এমন বিদ্যুত্বৎ ক্ষিপ্র সঞ্চালন কল্পনার অতীত।

সময় এগিয়ে চলল। যুদ্ধ চলেছে একইভাবে। চেরোকীর মাথা আর ঘাড় ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত; কান দুটো আর নেই বললেই চলে, ঠোঁট দুটিও অক্ষত নয়– হোয়াইট ফ্যাং-এর দাঁত নির্ভুল লক্ষ্যে ছোবল মেরেছে বার বার, তাই বুলগের এই দুর্দশা। অপরপক্ষে হোয়াইট ফ্যাং রয়েছে সম্পূর্ণ অক্ষত, তাকে একবারও স্পর্শ করতে পারেনি বুলডগ।

চেরোকীকে কয়েকবার মাটিতে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছে হোয়াইট ফ্যাং। সে জানে বুলডগকে একবার ফেলে দিয়ে যদি তার গলায় দাঁত বসানো যায়, তাহলে তৎক্ষণাৎ লড়াই ফতে হয়ে যাবে। কিন্তু দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর উচ্চাশায় খুব বেশি তফাৎ থাকার জন্যই হোয়াইট ফ্যাং-এর চিরাচরিত রণকৌশল কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছিল না।

সুযোগ এল হঠাৎ। হোয়াইট ফ্যাং লাফিয়ে কাছে আসতেই তাড়াতাড়ি তার মোকাবিলা করার জন্য চেরোকী মাথা ঘোরাল। তৎক্ষণাৎ নেকড়েসুলভ ক্ষিপ্রবেগে ঘুরে গেল হোয়াইট ফ্যাং আর একমুহূর্তের জন্য শত্রুর একদিকের কঁধ অরক্ষিত অবস্থায় পেয়ে গেল সে। প্রচণ্ড বেগে হোয়াইট ফ্যাং ধাক্কা মারল বুলডগের কাঁধে। কিন্তু চেয়োকীর কাধ অনেক নিচু বলে নিশানা ফসকে গেল, সঙ্গেসঙ্গে শত্রুর দেহের উপর দিয়ে ছিটকে পড়ল হোয়াইট ফ্যাং। এতদিনের লড়াই-এর ইতিহাসে সর্বপ্রথম মাটির উপর থেকে বর্ণসংকর পশুটার পা সরে গেল, শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে তার শরীরটা নেমে এল মাটির দিকে। হোয়াইট ফ্যাং-এর পিঠ নির্ঘাত ভূমিস্পর্শ করত, কিন্তু পায়ের তলায় মাটি পাওয়ার জন্য শূন্যপথেই শরীরটাকে ঘুরিয়ে দিল সে। হোয়াইট ফ্যাং-এর চেষ্টা সম্পূর্ণ সফল হল না, কারণ, কুকুর বা নেকড়ের শরীর বিড়ালের মতো নমনীয় নয়–শূন্যে ঘুরে যাওয়ার জন্য পিঠের পরিবর্তে তার দেহের পার্শ্বদেশ সবেগে আছড়ে পড়ল ভূমিপৃষ্ঠে। পরমুহূর্তেই সে উঠে দাঁড়াল, আর ঠিক সেই মুহূর্তেই চেরোকীর দংশন পড়ল তার গলায়। কামড়টা খুব সুবিধার হয়নি; গলার ঠিক মাঝখানে না পড়ে একটু তলায় বুকের দিকেই কামড় পড়েছে। কিন্তু চেরোকী দাঁত আলগা করল না, গলা আর বুকের মাঝামাঝি জায়গায় কামড় বসিয়ে ঝুলতে লাগল। হোয়াইট ফ্যাং লাফিয়ে উঠল, পাগলের মতো লাফালাফি করে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করল এবং কিছুতেই কিছু করতে না পেরে চক্রাকারে ঘুরতে শুরু করল শরীর থেকে বুলডগকে ঝেড়ে ফেলার জন্য।

 একসময়ে সে ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিতে থাকল। সঙ্গেসঙ্গে সে অনুভব করল চেরোকীর মুখের মধ্যে তার গলার চামড়া ঢুকে যাচ্ছে বুকের দিক থেকে চিবোতে চিবোতে গলার চামড়া মুখের মধ্যে টেনে নিয়ে ক্রমশঃ কণ্ঠনালীর দিকে এগিয়ে আসছে দন্তসজ্জিত দুই ভয়ংকর চোয়াল। সর্বনাশ যদি একবার কণ্ঠনালীর উপর কঠিন দংশনে চেপে বসে ওই দুটি চোয়াল, তবে মৃত্যু নিশ্চিত- তড়াক করে লাফিয়ে উঠে শত্রুর দেহটাকে জেড়ে ফেলতে সচেষ্ট হল হোয়াইট ফ্যাং।

বৃথা চেষ্টা। ছিনে জোঁকের মতো কামড় বসিয়ে ঝুলে রইল চেরোকী। প্রচণ্ড বেগে ঝাঁকুনি দিতে লাগল হোয়াইট ফ্যাং; তার ফলে বার বার চেরোকীর শরীর আছড়ে পড়ল মাটির উপর সজোরে, তবু সেই আঘাতের যন্ত্রণা সহ্য করল বুলডগ, মুহূর্তের জন্যও শিথিল হল না তার মারাত্মক দংশন। শত্ৰু ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিতে থামলেই চেরাকী তার কামড় আলগা করে চামড়া চিবিয়ে চিবিয়ে বুকের দিক থেকে গলার মাঝামাঝি অংশে চোয়াল দু-দিকে এগিয়ে নিতে চায়– সে জানে শত্রুর কণ্ঠনালী বজ্র-দংশনে চেপে ধরলেই লড়াই শেষ হয়ে যাবে। সেই ভয়ংকর পরিণতি সম্পর্কে হোয়াইট ফ্যাং সম্পূর্ণ সচেতন চেরোকীর চোয়াল গলার দিকে এগোতে শুরু করলেই সে আবার লাফিয়ে উঠে বলুডগকে ঝেড়ে ফেলতে চেষ্টা করে। কিন্তু বুলডগ একবার কামড় বসালে তাকে ঝেড়ে ফেলা খুবই কঠিন, এমনকী অসম্ভব বললেও অত্যুক্তি হয় না। কিছুতেই নিজেকে ছাড়াতে না পেরে পালটা আক্রমণের কথা ভাবল হোয়াইট ফ্যাং। তার গলা আর বুকের মাঝখানে যেভাবে চেরোকী কামড় বসিয়ে ঝুলছে, তাতে শুধু বুলডগের ঘাড়ের ফুলে-ওঠা অংশটাই হোয়াইট ফ্যাং-এর নাগালের মধ্যে রয়েছে। ঘাড় আর কাঁধের সন্ধিস্থল কামড়ে ধরে চিবিয়ে চিবিয়ে গুঁড়ো করে দিলে বুলডগ কাবু হয়ে পড়ত, কিন্তু চিবিয়ে লড়াই করার পদ্ধতি জানত না হোয়াইট ফ্যাং, তার চোয়ালের গঠনও ওইভাবে লড়াই করার উপযুক্ত নয়। কয়েকটা ঝটাক কামড় বসিয়ে বুলডগের ঘাড়ের স্ফীত অংশটা সে রক্তাক্ত করে দিল। তারপর হঠাৎ পরিস্থিতি বদলে গেল। বুলডগ তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে চিত করে ফেলে বুকের উপর উঠে পড়ল, অবশ্য শত্রুর গলার উপর থেকে তার দাঁতের বাঁধন মুহূর্তের জন্যও শিথিল হয়নি। হোয়াইট ফ্যাং পিছনের পা দুটি বাঁকিয়ে শত্রুর পেটের তলায় এনে ফেলল এবং নখ বসিয়ে সজোরে আঁচড় কাটতে লাগল। তৎক্ষণাৎ নিজের শরীরটা যদি শত্রুর দেহের উপর থেকে সরিয়ে না আনতে চেরোকী, তাহলে নখের আঘাতে তার পেট চিরে নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে পড়ত। অবশ্য শরীরটাকে সরিয়ে সমকোণে রাখলেও শত্রুর গলার উপর দাঁতের বাঁধন একটুও আলগা করেনি বুলডগ।

অবশেষে ফুরিয়ে এল বর্ণসংকর পশুটার জীবনীশক্তি, নিঃশেষ হয়ে গেল তার লড়াই করার ক্ষমতা চিৎপাত হয়ে মাটিতে পড়ে রইল হোয়াইট ফ্যাং।

দর্শকদের মধ্যে যারা বুলডগের উপর বাজি রেখেছিল, তারা উল্লসিত কণ্ঠে বিজয়ীকে সংবর্ধনা জানাল, চেরোকী! চেরোকী! চেরোকী!

বেঁটে লেজটা জোরে জোরে নেড়ে সাড়া দিল বুলডগ। তবে লেজ নড়লেও তার মুখ অনড় হয়ে অবস্থান করিছল শত্রুর গলায়। ইতিমধ্যে তার চোয়াল দুটি সরে এসে কণ্ঠনালীর খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। এর মধ্যে দর্শকদের মধ্যে একটা শোরগোল উঠেছে। দুটি মানুষ হঠাৎ ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসার চেষ্টা করছে জনতার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ফাঁকা জায়গাটার দিকে যেখানে মৃত্যুপণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে হোয়াইট ফ্যাং আর চেরোকী।

জনতা হঠাৎ পুলিস ভেবে সন্ত্রস্ত ও বিচলিত হয়ে উঠেছিল, কিন্তু একটু দূরে পথের উপর একাট স্লেজ গাড়িকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আশ্বস্ত হল– তার বুঝল, পথ-চলতি দুটি মানুষ স্লেজ চালিয়ে যেতে যেতে পথের মধ্যে জনতার সমাবেশ দেখে কৌতূহলী হয়ে উঠেছে এবং স্লেজ থামিয়ে এগিয়ে এসেছে কৌতূহল নিরসনের জন্য। আগন্তুকের মধ্যে যার বয়স বেশি, সে হচ্ছে স্লেজচালক। চালকের চাইতে তার কমবয়সী সঙ্গী কিছুটা লম্বা। তার গোঁফদাড়ি নেই, চালকের মুখে গোঁফ আছে।

এদিকে লড়াই প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। হোয়াইট ফ্যাং মাঝে মাঝে শত্রুকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে বটে, কিন্তু বেশ বোঝা যায় তার অন্তিম দশা উপস্থিত। সে ভালো করে নিশ্বাস নিতে পারছে না, চেরোকী ক্রমেই তার গলায় কঠিন দংশনে চেপে বসে তার দম বন্ধ করার উপক্রম করেছে।

এইবার যুধ্যমান পশু দুটির দিকে এগিয়ে এল বিউটি স্মিথ। সে যখন দেখল হোয়াইট ফ্যাং-এর দুই চোখ কাঁচের মতো স্বচ্ছ হয়ে এসেছে তখনই সে বুঝল জন্তুটার মৃত্যু নিশ্চিত। অতএব এই লড়াইতে স্মিথকে যে মোটা টাকার বাজি হারতে হবে, সে বিষয়ে সন্দেহ নাস্তি। সে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল, এগিয়ে এসে নিষ্ঠুরভাবে হোয়াইট ফ্যাং-এর দেহের উপর মারতে লাগল লাথির পর লাথি। জনতার ভিতর থেকে গুঞ্জন উঠল, কেউ কেউ চিৎকার করে প্রতিবাদ জানাল। বিউটি স্মিথ কারও প্রতিবাদে কর্ণপাত করল না, ক্রমাগত পদাঘাত করে চলল মরণাহত পশুটার দেহে। হঠাৎ জনতার মধ্যে জাগল আলোড়ন। স্লেজচালকের সঙ্গী দীর্ঘদেহী যুবকটি ডাইনে-বাঁয়ে ধাক্কা মারতে মারতে এগিয়ে এল জনতা ভেদ করে এবং সে দাঁড়াল রণাঙ্গনের মধ্যে। বিউটি স্মিথ তখন একটি পা তুলেছে লাথি মারার জন্য, অপর একটি পায়ের উপর রয়েছে তার শরীরের সম্পূর্ণ ওজন। কিন্তু স্মিথের পা শূন্য থেকে হোয়াইট ফ্যাং-এর দেহের উপর নেমে আসার আগেই নবাগত যুবকের ঘুসি পড়ল তার মুখে এবং ভারসাম্য হারিয়ে বিউটি স্মিথ হল ধরাপৃষ্ঠে লম্বমান। আগন্তুক এইবার জনতার দিকে ফিরল।

ভীরু! কাপুরুষ! প্রচণ্ড ক্রোধে ফেটে পড়ল নবাগত যুবক, তোমরা মানুষ নও! তোমরা জানোয়ার!

ইতিমধ্যে সাহস সঞ্চয় করে মাটি থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে বিউটি স্মিথ, তারপর গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসেছে আগন্তুকের দিকে। বিউটি স্মিথ নিতান্তই কাপুরুষ, অসহায় পশুকে নির্যাতন করলেও বলিষ্ঠ পুরুষের সঙ্গে হাতাহাতি করার সাহস তার ছিল না। সম্ভবত আগন্তুকের রূঢ় ব্যবহারের বিরুদ্ধে একটা দুর্বল প্রতিবাদ জানাতেই সে এগিয়ে আসছিল, কিন্তু যুবকটি তাকে ভুল বুঝলা। সে ভাবল লোকটা বুঝি তাকে আক্রমণ করার উদ্যোগ করছে। সুতরাং ওরে জানোয়ার! বলেই আগন্তুক যুবক তার দ্বিতীয় ঘুষিটি বসিয়ে দিল বিউটি স্মিথের মুখে এবং প্রথমবারের মতো দ্বিতীয়বারও তুষারশয্যায় শুয়ে পড়ল বিউটি স্মিথ। তবে এইবার সে আর উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল না, সে বুঝে নিল বর্তমান পরিবেশে তুষারশয্যা হচ্ছে সবচেয়ে নিরাপদ স্থান।

ওহে ম্যাট, এগিয়ে এসে হাত লাগাও, নবাগত যুবক স্লেজচালককে উদ্দেশ করে বলল। ম্যাট নামক স্লেজচালকটি যুবককে অনুসরণ করে আগেই রণাঙ্গনের বেষ্টনীর মধ্যে প্রবেশ করেছিল। এইবার দুজনে মিলে টানাটানি করে কুকুর দুটোকে ছাড়াতে চেষ্টা করল। বৃথা চেষ্টা- বুলডগ তার কামড় ছাড়তে রাজি নয়। যুবক তখন কোমর থেকে রিভলভার বার নলটা বুলডগের মুখের ভিতর ঢুকিয়ে চাপ দিতে লাগল। বুলডগের মালিক টিম কীনাল বাধা দিতে চেষ্টা করেছিল, যুবক তার প্রতিবাদে কর্ণপাত না করে প্রশ্ন করল, কুকুরটা তোমার?

-হ্যাঁ।

–তাহলে ওর কামড় ছাড়িয়ে দাও।

অসম্ভব। বুলড়গের কামড় ছাড়ানোর কৌশল আমি জানি না।

–তাহলে আমাকে বাধা দিও না।

রিভলভারের নল চেরোকীর মুখের একপাশ থেকে অন্যপাশে বেরিয়ে আসতেই সজোরে চাপ দিল যুবক সঙ্গেসঙ্গে খুলে গেল দাঁতালো চোয়ালের মরণফাঁদ।

ওহে ম্যাট, যুবক বলল, একটা ভালো স্লেজ-টানা কুকুরে দাম কত হতে পারে?

ম্যাট অর্থাৎ তার সঙ্গী উত্তর দিল, তিনশো ডলার।

আর এই কুকুরটা মতো দাঁতের আঘাতে ক্ষত বিক্ষত আধমরা জন্তুর দাম কত হবে?

-দেড়শো ডলার।

ব্যাগ খুলে দেড়শো ডলার বিউটি স্মিথের দিকে বাড়িয়ে ধরল যুবক, আমি এই কুকুরটাকে কিনে নিলাম। টাকাটা ধরো।

এক পা পিছিয়ে স্মিথ বলল, আমার কুকুর আমি বিক্রি করব না।

 যুবক ক্রুদ্ধ স্বরে বলল, তোমার ঘাড় করবে। আমার কথা না শুনলে তোমাকে আমি শহর থেকে তাড়িয়ে দেব, বুঝেছ?… ভালো চাও তো, টাকা নিয়ে সরে পড়ো।

নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে দেড়শো ডলার গ্রহণ করলেন বিউটি স্মিথ। তার দিকে সম্পূর্ণ পিছন ফিরে সঙ্গীকে সাহায্য করতে এগিয়ে গেল যুবক। তার সঙ্গী ম্যাট তখন আহত হোয়াইট ফ্যাংকে সেবা-শুশ্রূষা করে সুস্থ করার চেষ্টায় ব্যস্ত।

লোকজন এখন চলে যাচ্ছে। জায়গায় জায়গায় কিন্তু লোক দাঁড়িয়ে কথা বলছে আর মাঝে মাঝে নবাগত যুবক, তার সঙ্গী এবং আহত হোয়াইট ফ্যাং-এর দিকে দৃষ্টিপাত করছে।

এইরকম একটা ছোটো জমায়েতের মধ্যে এসে টিম কীনান প্রশ্ন করল, লোকটা কে?

উত্তর এল, ওর নাম উইডন স্কট। দারুণ প্রভাবশালী মানুষ। শহরের গণ্যমান্য রাজ কর্মচারীদের সঙ্গে ওর দারুণ খাতির। এমনকী কমিশনারের সঙ্গেও দারুণ ভাব ওই উইডন স্কটের।

আমিও ভেবেছিলাম লোকটা হোমরা-চোমরা গোছের কেউ হবে, জুয়াড়ি টিম কীনান বলল, সেইজন্যই আমি লোকটার সঙ্গে ঝগড়া করিনি।

.

১৯. অদম্য বন্য

দুটি সপ্তাহ কাটল। এর মধ্যে একবারও হোয়াইট ফ্যাংকে শৃঙ্খলমুক্ত করা হয়নি। কারণ তার আচরণ ছিল সর্বদাই অত্যন্ত হিংস্র ও ভয়ংকর। স্লেজ-টানা অন্যান্য কুকুরগুলোর উপর যখনই তার নজর পড়ত, তখনই তার গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠত, সগর্জনে দাঁত খিঁচিয়ে সে শিকল টানাটানি করত কুকুরগুলোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য।

উইডন স্কট ভেবেছিল জন্তুটা একেবারেই বুনো, একে দিয়ে কোনো কাজ করানো যাবে না। কিন্তু কুকুরদের সারথি স্লেজচালক ম্যাট হোয়াইট ফ্যাং-এর বুকের উপর স্লেজের সঙ্গে যুক্ত চর্মরঙ্কুর দাগ আবিষ্কার করেছিল, সে জানাল অতীতে যে- জানোয়ার স্লেজ চালিয়েছে, ভবিষ্যতেও সে স্লেজ টানতে রাজি হবে না এমন কথা ভাবার কোনো কারণ নেই।

ওকে একটা সুযোগ দাও, ম্যাট বলল, কিছুক্ষণের জন্য শিকলটা খুলে দাও।

উইডন সঙ্গীর দিকে বিস্মিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। সেই দৃষ্টির অর্থ বুঝতে ম্যাটের দেরি হল না, সে বলল, জানি, তুমি একবার সে-চেষ্টা করেছ। কিন্তু তোমার হাতে মুগুর ছিল না বলেই তুমি ব্যর্থ হয়েছ।

–বেশ, তুমি নিজেই তাহলে চেষ্টা করে দেখতে পারো।

 কুকুরদের চালক ম্যাট একটা মুগুর হাতে নিয়ে এগিয়ে এসে হোয়াইট ফ্যাং-এর গলা থেকে শিকলটা খুলে নিল। তৎক্ষণাৎ জন্তুটার সর্বাঙ্গের লোম খাড়া হয়ে ফুলে উঠল, ঠোঁট ফাঁক হয়ে ভয়ংকর দাঁতগুলো আত্মপ্রকাশ করল, চাপা হিংস্র গর্জনে ক্রোধ প্রকাশ করতে করতে সে নিচু হয়ে মাটিতে গুঁড়ি মেরে বসে পড়ল, কিন্তু মুগুর-ধরা হাতটার দিকে সবসময়ই নিবদ্ধ ছিল তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।

হঠাৎ বন্ধনমুক্ত হয়ে অবাক হয়ে গিয়েছিল হোয়াইট ফ্যাং। সে কি করবে ভেবে পেল। এখনই যে, তার উপর এই নূতন মানুষ দুটি অত্যাচার করবে এই বিষয়ে সে ছিল নিঃসন্দেহে। কিন্তু লোক দুটি যখন একবারও তার দিকে এগিয়ে এল না, তখন সে এককোণে সরে গেল। তখনো কিছু ঘটল না, সে আরও অবাক হল– একটু এগিয়ে সে লোকদুটিকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে। উইডন স্কট আর ম্যাট বুঝল জন্তুটা বোকা নয়– মুগুরের মহিমা সে জানে, ম্যাটের হাতে মুগুর বলেই সে কামড়ানোর চেষ্টা করে নিজেকে বিপন্ন করেনি।

জস্তুটা পালিয়ে যাবে না তো? হোয়াইট ফ্যাং-এর নূতন মালিক প্রশ্ন করল।

ওইটুকু ঝুঁকি নিতেই হবে, ম্যাট বলল, যদি পালায় তো পালাবে।

উইডন স্কট এগিয়ে এসে একটুকরো মাংস বর্ণসংকর নেকড়েটার দিকে ছুঁড়ে দিল। হোয়াইট ফ্যাং সচমকে পিছিয়ে এসে খাদ্যটাকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল সন্দিগ্ধ। চক্ষে।

ঠিক সেই মুহূর্তে মোরে নামে কুকুরটা মাংসের টুকরো লক্ষ্য করে ঝাঁপ দিল। সঙ্গেসঙ্গে ঝাঁপ দিল হোয়াইট ফ্যাং। ম্যাট দৌড়ে এগিয়ে গেল। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে– প্রাণঘাতী আঘাতে ছিন্ন কণ্ঠনালী নিয়ে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে পড়েছে মোরে।

ততক্ষণে ম্যাটের একটি পা প্রচণ্ডবেগে এগিয়ে গেছে হোয়াইট ফ্যাং-এর দিকে। একটি লাফ, সাদা দাঁতের চকিত ঝলক, বিস্মিত কণ্ঠের একটা চিৎকার- হোয়াইট ফ্যাং কয়েকগজ পিছিয়ে এসে দাঁত খিঁচিয়ে গর্জাতে লাগল, আর ম্যাট নিচু হয়ে তার আহত পায়ের দিকে দৃষ্টিনিবদ্ধ করল।

তার প্যান্ট এবং তলার অঙ্গাবরণ ছিঁড়ে লাল রক্তের দাগ ক্রমশঃ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

উইডন স্কট কোমর থেকে রিভলভার টেনে নিয়ে নিশানা স্থির করতে লাগল। অনেক কষ্টে তাকে নিরস্ত করল ম্যাট। তার মতে জন্তুটা ভীষণভাবে অত্যাচারিত হয়েছে, নতুন পরিবেশকে বুঝে ওঠার মতো যথেষ্ট সময় সে পায়নি– অতএব আরও কিছুদিন না দেখে জন্তুটাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া অনুচিত।

আমি ওকে মারতে চাইনি, স্কট রিভলভার সরিয়ে রাখল, বেশ, আমরা এবার ওর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করব। দেখি, সদয় ব্যবহারে হয়তো ওর চরিত্রের পরিবর্তন ঘটতে পারে।

উইডন স্কট হোয়াইট ফ্যাং-এর দিকে এগিয়ে গিয়ে ধীরে ধীরে ভালোভাবে কথা কইতে লাগল। হোয়াইট ফ্যাং দাঁত খিঁচিয়ে গর্জে উঠল। দেবতাদের একটি কুকুরকে এইমাত্র সে খুন করেছে, আর একজন দেবতার পায়ে কামড় বসিয়েছে, সুতরাং এইবার যে তাকে ভীষণ শাস্তি দেওয়া হবে, এবিষয়ে সন্দেহ নাস্তি। তবে দেবতার হাতে মগুর ছিল না বলেই সে দূরে সরে যায়নি, কিন্তু দেবতার গতিবিধির উপর সে ভালোভাবেই নজর রাখছিল।

উইডন স্কট তার হাত নামিয়ে আনল কুকুরটার দিকে। মাথার উপর নেমে-আসা হাতটার দিকে তাকিয়ে ক্রমশঃ নিচু হয়ে ঝুঁকে পড়ছিল হোয়াইট ফ্যাং। হাতটা যে তাকে আঘাত করতে চাইছে, এই কথা ভেবেই সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল সে। ক্রমশঃ নিচু হয়ে মাটির সঙ্গে মিশে গেল হোয়াইট ফ্যাং, ওই হাতটাকে সে কামড়াতে চায় না। হাতটা তবু নেমে আসতে লাগল। একসময়ে সে আর আত্মসংবরণ করতে পারল না, বন্য শ্বাপদের সহজাত অনুভূতি তাকে সক্রিয় করে তুলল।

একটা বিস্মিত আর্তনাদ বেরিয়ে এল উইডন স্কটের গলা থেকে। তার বিশ্বাস ছিল কুকুরটা কামড়ানোর চেষ্টা করলেই সে হাত সরিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু এত দ্রুত চকিত আক্রমণ তার কল্পনার অতীত, বিষাক্ত সর্পের ছোবল মারার ভঙ্গিতেই ধারাল দাঁতগুলো বিদ্যুৎবেগে আঘাত করে সরে গেল, রক্তাক্ত হয়ে গেল উইডনের হাত। তবে হাতের দিকে নজর দেওয়ার বিশেষ সময় পেল না উইডন, সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে উদবিগ্ন স্বরে সে বলে উঠল, আরে! তুমি কী করছ?

ঘরের ভিতর থেকে একটা রাইফেল তুলে নিয়ে জন্তুটার দিকে লক্ষ্য স্থির করতে করতে ম্যাট ঠান্ডা গলায় বলল, এটা নিতান্তই বুনো জানোয়ার। এটাকে এখনই শেষ করব।

একটু আগে উইডন যখন হোয়াইট ফ্যাং-এর দিকে রিভলভার তুলেছিল, তখন ম্যাটই জন্তুটার স্বপক্ষে যুক্তি দেখিয়ে তাকে প্রাণদণ্ড থেকে অব্যাহতি দিতে অনুরোধ করেছিল। এবার উইডনের পালা, জন্তুটা আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যাপারটা ভালোভাবেই বুঝতে পারে। ওর দিকে তাকিয়ে দেখ ম্যাট। এমন বুদ্ধিমান জানোয়ারকে একটা সুযোগ দেওয়া উচিত। তুমিই বলেছ। এতো তাড়াতাড়ি ওর বিচার করা উচিত নয়।

কথাটা সত্যি। হোয়াইট ফ্যাং এখনও হিংস্রভাবে দাঁত খিঁচিয়ে গর্জন করছে বটে, কিন্তু উইডনের পরিবর্তে ম্যাটের দিকেই রয়েছে তার সতর্ক দৃষ্টি।

ম্যাট রাইফেল নামাল। জন্তুটার ঠোঁট দুটি বন্ধ হল, দাঁতের সারি অদৃশ্য হল মুখের মধ্যে, বন্ধ হয়ে গেল গর্জন ধ্বনি।

ম্যাট রাইফেল তুলল। সঙ্গেসঙ্গে হিংস্র দন্ত বিস্তার করে গর্জে উঠল হোয়াইট ফ্যাং।

আবার রাইফেল নামাল ম্যাট। সঙ্গেসঙ্গে শান্ত হয়ে গেল জন্তুটা। ম্যাট তার মনিবের দিকে তাকাল, মি. উইডন, তোমার কথাই ঠিক। এমন বুদ্ধিমান কুকুরকে মেরে ফেলা উচিত নয়।