পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ – স্কন্ধাবারে
মধ্যাহ্ন ভোজনের পর স্কন্দগুপ্ত শিবিরের একটি কক্ষে শয্যায় শায়িত হইয়া বিশ্রাম করিতেছিলেন। দুইজন সম্বাহক তাঁহার পদসেবা করিতেছিল, একজন কিঙ্করী চামর ঢুলাইয়া ব্যজন করিতেছিল। ভুক্তা রাজবদাচরেৎ! সেকালে মধ্যাহ্ন ভোজনের পর বিশ্রামের রীতি ছিল; রাজা হইতে আপামর সাধারণ সকলেই দ্বিপ্রহরে কিয়ৎকালের জন্য রাজবৎ আচরণ করিতেন।
স্কন্দের বস্ত্রাবাসে অনেকগুলি প্রকোষ্ঠ, তন্মধ্যে এইটি সর্বাপেক্ষা বৃহৎ। এটি মন্ত্রগৃহরূপে ব্যবহৃত হইত; সেনাপতি ও অমাত্যগণের সহিত বসিয়া রাজা মন্ত্রণা করিতেন। সিংহাসনাদি কিছুই ছিল না; ভূমির উপর স্থূল আস্তরণ বিস্তৃত; তদুপরি রাজার জন্য উচ্চ গদির শয্যা। মন্ত্রণাকালে ইহাই রাজার আসন; দ্বিপ্রহরে বিশ্রামের জন্য ইহাই তাঁহার পালঙ্ক।
কিন্তু বিধাতা যাহাকে অসামান্য কর্মভার প্রদান করিয়াছেন তাহার বিশ্রামের সময় কোথায়? স্কন্দের তন্দ্রা থাকিয়া থাকিয়া বিঘ্নিত হইতেছিল। গুপ্তচর চুপি চুপি প্রবেশ করিয়া তাঁহার কানে কানে কথা বলিয়া নিঃশব্দে চলিয়া যাইতেছিল। আবার কিছুক্ষণ পরে অন্য গুপ্তচর আসিতেছিল—
এইরূপ অর্ধ-তন্দ্রিত অবস্থায় স্কন্দের মস্তিষ্কের ক্রিয়া চলিতেছিল— হূণ পঞ্চাশ ক্রোশ উত্তরে দল বাঁধিতেছে…কোন দিকে যাইবে? এক— আমাকে আক্রমণ করিতে পারে…তাহা বোধহয় করিবে না। দুই— আমাকে পাশ কাটাইয়া আর্যাবর্তের সমতল ভূমিতে নামিবার চেষ্টা করিতে পারে…তাহা করিতে দিব না। তিন— আমাকে দক্ষিণে রাখিয়া বিটঙ্ক রাজ্যটা অধিকার করিয়া বসিতে পারে…বিটঙ্ক রাজ্যের রাজাটা হূণ…সম্মুখে শত্রু ভাল, কিন্তু পিছনে শত্রু যদি ঘাঁটি গাড়িয়া বসে…
দুই তিন দণ্ড এইভাবে কাটিবার পর, স্কন্দের তন্দ্রাবেশ দূর হইল; তিনি শয্যায় উঠিয়া বসিলেন। সম্বাহকদের হস্ত সঞ্চালনে বিদায় করিয়া ডাকিলেন— ‘পিপুল।’
কক্ষের এক অন্ধকার কোণে বিপুলকায় রাজবয়স্য পিপ্পলী মিশ্র অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যথেচ্ছ প্রসারিত করিয়া রাজবৎ আচরণ করিতেছিলেন, স্কন্দের আহ্বানে জাগিয়া উঠিয়া একটি প্রকাণ্ড জৃম্ভণ ত্যাগ করিলেন। বলিলেন— ‘বয়স্য, আমি ঘুমাই নাই, চক্ষু মুদিয়া ব্রাহ্মণীর চিন্তা করিতেছিলাম।’
রাজা প্রশ্ন করিলেন— ‘পিপুল, ব্রাহ্মণীর জন্য কি বড়ই বিরহ-বেদনা অনুভব করিতেছ?’
‘ঠিক বিরহ নয়; তবু চারিদিক ফাঁক-ফাঁক ঠেকিতেছে।’ বলিয়া ব্রাহ্মণ রাজসমীপে আসিয়া বসিলেন।
যে কিঙ্করী চামর ঢুলাইতেছিল, রাজা তাহাকে বলিলেন— ‘লহরি, বয়স্যের জন্য তাম্বূল আনয়ন কর।’
কিঙ্করী চামর রাখিয়া চলিয়া গেল। লহরী নাম্নী এই দাসীটি উত্তীর্ণযৌবনা কিন্তু সুদর্শন। স্কন্দের যৌবনকাল হইতে সে তাঁহার সেবা করিয়াছে, যুদ্ধক্ষেত্রেও তাঁহার সঙ্গ ছাড়ে নাই। রাজপরিজনের মধ্যে লহরীই একমাত্র নারী; স্কন্দ তাহার হস্তে আপন গৃহস্থালীর সমস্ত ভার ছাড়িয়া দিয়াছিলেন। সে তাঁহার পাচিকা সন্নিধাতা তাম্বূলকরঙ্কবাহিনী দেহরক্ষিণী। যুদ্ধ শিবিরে ছায়ার ন্যায় সে তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে থাকিত, যক্ষিণীর ন্যায় তাঁহাকে চোখে চোখে রাখিত। স্কন্দ তাঁহাকে সহোদরার ন্যায় স্নেহ করিতেন।
পিপ্পলী মিশ্র দীর্ঘশ্বাস ছাড়িয়া বলিলেন— ‘কবি কালিদাস লিখিয়াছেন— কিং পুনর্দূরসংস্থে; মেঘ দেখিলে প্রবাসী ব্যক্তির নাকি বড়ই কষ্ট হয়। মেঘ না দেখিয়াই আমার যেরূপ অবস্থা—’
‘তোমার কিরূপ অবস্থা?’
‘এত সৈন্যসামন্ত রহিয়াছে, তবু মনে হয় যেন কেহ নাই। বয়স্য, বয়স যতই বাড়িতে থাকে গৃহিণীর অভাবে দশদিক ততই শূন্য মনে হয়। কিন্তু এসকল গূঢ় বৃত্তান্ত তুমি বুঝিবে না। গৃহিণী কী বস্তু তাহা তো ইহজন্মে জানিলে না।’
‘গৃহিণী কী বস্তু?’
পিপ্পলী বলিলেন— ‘গৃহিণী সচিবঃ সখী প্রিয়শিষ্যা ললিতে কলাবিধৌ।’
স্কন্দ বলিলেন— ‘তোমার অবস্থা দেখিতেছি শঙ্কাজনক; বারম্বার কালিদাস আবৃত্তি করিতেছ। তোমার যুদ্ধ দেখিবার সাধ হইয়াছিল তাই সঙ্গে আনিয়াছিলাম; এমন জানিলে তোমার ব্রাহ্মণীকেও সঙ্গে লইয়া আসিতাম।’
‘না বয়স্য, এই ভাল। আমার একটু ক্লেশ হইতেছে তাহাতে ক্ষতি নাই। সে যদি আসিত, এত সৈন্য আর হাতি ঘোড়া দেখিয়া ভয়েই মরিয়া যাইত।’ পিপ্পলী মিশ্র অতিদীর্ঘ নিশ্বাস মোচন করিলেন; মনে হইল নিশ্বাসটি তাঁহার মূলাধার চক্রে জন্মলাভ করিয়া ষট্চক্র ভেদ করিয়া বাহির হইয়া আসিল।
এই সময় লহরী তাম্বূলকরঙ্ক আনিয়া পিপ্পলী মিশ্রের অগ্রে রাখিল এবং পুনর্বার চামর লইয়া ব্যজন করিতে লাগিল। তাম্বূল পাইয়া ব্রাহ্মণের মুখ প্রফুল্ল হইল, তিনি শঙ্কুলার সাহায্যে গুবাক কাটিয়া স্বয়ং তাম্বূল রচনায় প্রবৃত্ত হইলেন।
স্কন্দ তখন বলিলেন— ‘পিপুল, এবার হূণের সহিত যুদ্ধ করার নূতন এক পন্থা আবিষ্কার করিয়াছি।’
পিপুল হৃষ্ট হইয়া বলিলেন— ‘ভাল ভাল। পলাণ্ডুসেবী দুর্গন্ধ ছুছুন্দরগুলাকে ভাল করিয়া শিক্ষা দাও। কী পন্থা বাহির করিয়াছ?’
স্কন্দ বলিলেন— ‘দেখ, হূণের ঘোড়ার পিঠে ছাড়া যুদ্ধ করিতে পারে না। কিন্তু পার্বত্য দেশে ঘোড়ায় চড়িয়া যুদ্ধ ভাল হয় না। তাই স্থির করিয়াছি—’
পিপুল বলিলেন— ‘বুঝিয়াছি, হস্তী চড়িয়া যুদ্ধ করিবে।’
স্কন্দ বলিলেন— ‘তুমি একটি হস্তি-মূর্খ। আমি পদাতি দিয়া যুদ্ধ করিব।’
পিপুল অবাক হইয়া বলিলেন— ‘পদাতি দিয়া! তবে পাল পাল হাতি আনিয়াছ কেন?’
স্কন্দ বলিলেন— ‘হাতিও কাজে লাগিবে। কিন্তু আসল যুদ্ধ করিবে পদাতি।’
‘কিন্তু ইহাতে নূতন আবিষ্কার কী আছে?’
‘নূতন আবিষ্কার এই যে, পদাতিদের হাতে দ্বাদশহস্ত পরিমিত দীর্ঘ বংশদণ্ড থাকিবে।’
‘অ্যাঁ! বাঁশ দিয়া হূণ তাড়াইবে?’
স্কন্দ হাসিলেন— ‘শুধু বাঁশ নয়, বাঁশের অগ্রভাগে ভল্লের ফলক থাকিবে। বর্তমানে যে ভল্ল ব্যবহৃত হয় তাহার দৈর্ঘ্য মাত্র ছয় হস্ত। কিছু বুঝিলে?’
পিপ্পলী মিশ্র কিছুক্ষণ তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিয়া শেষে মাথা নাড়িলেন— ‘যুদ্ধবিদ্যায় আমার তেমন পারদর্শিতা নাই। কিন্তু যখন আবিষ্কার করিয়াছ তখন নিশ্চয় কিছু মানে আছে।’
স্বন্দে হতাশ হইয়া নিশ্বাস ফেলিলেন— ‘কাহাকেই বা বলি!’
এই সময় দ্বারপাল আসিয়া সংবাদ দিল, বিটঙ্ক রাজ্যের রাজকন্যা এক অনুচরসহ আয়ুষ্মানের দর্শন ভিক্ষা করেন।
স্কন্দ ঈষৎ বিস্ময়ে কিয়ৎকাল চাহিয়া রহিলেন, তারপর বলিলেন— ‘বিটঙ্কের রাজকন্যা! হূণদুহিতা! লইয়া এস।’
দ্বারপাল চলিয়া গেল। লহরী একটি সূক্ষ্ম মল্লবস্ত্রের উত্তরীয় দিয়া রাজার নগ্ন স্কন্ধ আবৃত করিয়া দিল। পিপুল তাঁহার তাম্বূলকরঙ্ক লইয়া একপাশে সরিয়া বসিলেন।
অনতিকাল পরে রট্টা আসিয়া শিবির দ্বারের অগ্রে দাঁড়াইল, পশ্চাতে চিত্রক। রট্টার হৃদ্যন্ত্র দ্রুত স্পন্দিত হইতেছিল; সে দেখিল কক্ষের মধ্যস্থলে এক পুরুষসিংহ বসিয়া আছেন। রট্টা অনুমান করিয়াছিল ভারতবর্ষের চক্রবর্তী অধীশ্বর স্কন্দ অবশ্য বয়স্থ পুরুষ হইবেন; কিন্তু স্কন্দের সুগৌর দেহে জরার করাঙ্ক চিহ্নিত হয় নাই। তেজঃপুঞ্জ মুখমণ্ডল হইতে যৌবনের লাবণ্য বিকীর্ণ হইতেছে। তাঁহার অনুভব এত প্রবল যে শিবির-প্রকোষ্ঠে অন্য কেহ আছে তাহা সহসা লক্ষ্য হয় না।
অপরপক্ষে রাজা দেখিলেন, এক অপরূপ সুন্দরী কন্যা। মনে হইল এক ঝলক বিদ্যুৎ আকাশ হইতে নামিয়া আসিয়া তাঁহার সম্মুখে স্থির হইয়া দাঁড়াইয়াছে। তিনি বিস্ময়োৎফুল্ল নেত্রে চাহিয়া রহিলেন।
রট্টা ত্বরিতে রাজার সম্মুখে আসিয়া নতজানু হইল, পুটাঞ্জলি হইয়া বলিল— ‘রট্টা যশোধরার প্রণতি গ্রহণ করুন রাজাধিরাজ।’ চিত্রকও রট্টার পশ্চাতে থাকিয়া রাজাকে প্রণাম করিল।
স্কন্দ হস্তের ইঙ্গিতে উভয়কে বসিবার অনুমতি দিয়া ধীরকণ্ঠে বলিলেন— ‘রট্টা যশোধরা! তুমি বিটঙ্করাজের দুহিতা?’
‘হাঁ রাজাধিরাজ।’
‘হূণকন্যা?’
রট্টার গ্রীবা ঈষৎ বক্র হইল। সে বলিল— ‘হাঁ, আমি হূণকন্যা। কিন্তু সেজন্য আমার লজ্জা নাই। আমার পিতা মহানুভব পুরুষ।’
স্কন্দের অধরে অল্প হাসি দেখা দিল; তিনি বলিলেন— ‘তোমাকে লজ্জা দিবার জন্য এ প্রশ্ন করি নাই। তোমাকে দেখিয়া আর্যকন্যা বলিয়া মনে হয় তাই জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম।’
রট্টা বলিল— ‘আমার মাতা আর্য ছিলেন।’
স্কন্দ বলিলেন— ‘ভাল, এখন বুঝিলাম। রাজা কি তোমাকে দূতরূপে পাঠাইয়াছেন?’
‘না, মহারাজ, আমি নিজ ইচ্ছায় আসিয়াছি।’
স্কন্দের ভ্রূ ঈষৎ উত্থিত হইল; বলিলেন— ‘তুমি সাহসিনী বটে। এই বিপুল সেনাসমুদ্রে অন্য কোনও নারী প্রবেশ করিতে পারিত না। তুমি কোথা হইতে আসিতেছ?’
রট্টা বলিল— ‘উপস্থিত এক পান্থশালা হইতে। পর্বত পার হইতে দুই দিন লাগিয়াছে।’
‘দুই দিন! রাত্রি কোথায় যাপন করিলে?’
‘পর্বতের গুহায়।’
স্কন্দ প্রশ্ন-কুঞ্চিত চক্ষে রট্টার পানে চাহিলেন। রট্টাও নির্ভীক অকপট নেত্রে রাজার পানে চাহিয়া রহিল। রাজার চক্ষু নিমেষের জন্য একবার চিত্রকের মুখের উপর গিয়া ফিরিয়া আসিল। তিনি বলিলেন— ‘ভাল কথা, তুমি কুমারী না বিবাহিতা?’
রট্টা বলিল— ‘আমি কুমারী।’ চিত্রকের দিকে নির্দেশ করিয়া বলিল— ‘ইনি চিত্রক বর্মা, বিটঙ্ক রাজ্যের এক সেনানী।’
চিত্রক আবার জোড়হস্তে প্রণাম করিল। অভিজ্ঞান অঙ্গুরীয় সে পূর্বেই কটিদেশে লুকাইয়াছিল।
স্কন্দ বলিলেন— ‘তোমরা অবশ্য কোনও প্রয়োজনে আমার নিকট আসিয়াছে। কিন্তু পর্বত লঙ্ঘন করিয়া তোমরা ক্লান্ত; আজ বিশ্রাম কর, কাল তোমাদের কথা শুনিব।’
রট্টা বলিল— ‘দেব, গুরুতর রাজকার্যে আপনার নিকট আসিয়াছি; অগ্রে আমার বক্তব্য নিবেদন করিব, তারপর বিশ্রাম।’
স্কন্দ বলিলেন— ‘ভাল। কিন্তু তৎপূর্বে একটি কথা জানিতে ইচ্ছা করি। বিটঙ্করাজার নিকট পত্র দিয়া আমি এক দূত পাঠাইয়াছিলাম। সে দূত কি পৌঁছে নাই?’
পিপ্পলী অদূরে বসিয়া সকল কথা শুনিতেছিলেন, জনান্তিকে বলিলেন— ‘শশিশেখর— আমার ব্রাহ্মণীর ভ্রাতুষ্পুত্র।’
রট্টা একবার চিত্রকের দিকে কটাক্ষ করিল; চিত্রক বলিল— ‘দূতের কথা জানি না আয়ুষ্মন্, কিন্তু রাজকীয় পত্র পৌঁছিয়াছে।’
স্কন্দ বলিলেন— ‘তবে পত্রের উত্তর আমি পাই নাই কেন?’
রট্টা বলিল— ‘মহারাজ, আমার বক্তব্য শুনিলেই সকল কথা বুঝিতে পরিবেন।’
স্কন্দ শিরঃসঞ্চালনে সম্মতি দিলেন। রট্টা তখন চষ্টন দুর্গ ঘটিত সমস্ত বৃত্তান্ত প্রকাশ করিয়া বলিল; কেবল চিত্রকের দূত-পরিচয় গোপন রাখিল। রাজা মনোযোগের সহিত শুনিলেন। বৃত্তান্ত শেষ হইলে জিজ্ঞাসা করিলেন— ‘এই কিরাত কি হূণ?’
রট্টা বলিল— ‘হাঁ মহারাজ, আমারই মতন।’
স্কন্দ সপ্রশংস নেত্রে চাহিয়া বলিলেন— ‘তোমার মতন অল্পই আছে। তোমার ন্যায় পিতৃভক্তি কর্তব্যনিষ্ঠা সাহস অতি বিরল। কিরাতের দোষ নাই; রূপে ও গুণে তুমি সকল পুরুষের লোভনীয়।’ বলিয়া মৃদু হাসিলেন।
রট্টা নতমুখে রহিল। স্কন্দ তখন বলিলেন— ‘আমি তোমার পিতাকে উদ্ধার করিব। আমার নিজেরও স্বার্থ আছে।’ লহরীর দিকে ফিরিয়া বলিলেন— ‘লহরি, গুলিক বর্মাকে ডাকিয়া পাঠাও!’
লহরী এতক্ষণ একাগ্রমনে বাক্যালাপ শুনিতেছিল এবং স্কন্দের মুখভাব নিরীক্ষণ করিতেছিল। সে চামর রাখিয়া দ্রুত বাহির হইয়া গেল।
গুলিক বর্মা একজন কনিষ্ঠ সেনানায়ক এবং স্কন্দের পার্শ্বচর; ব্যূঢ়োরস্ক বৃষস্কন্ধ মূর্তি; ধূমকেতুর ন্যায় গোঁফ। সে আসিয়া প্রণাম করিয়া দাঁড়াইলে স্কন্দ প্রশ্ন করিলেন— ‘গুলিক, চষ্টন দুর্গ কোথায় জানো?’
গুলিক বলিল— ‘জানি আয়ুষ্মন্। চষ্টন দুর্গ বিটঙ্ক রাজ্যের উত্তর সীমান্তে অবস্থিত। এখান হইতে প্রায় বিংশ ক্রোশ উত্তর-পূর্বে।’
স্কন্দ বলিলেন— ‘শোনো। চষ্টন দুর্গের দুর্গাধিপ কিরাত বিটঙ্করাজকে ছলে নিজ দুর্গে লইয়া গিয়া আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে। তুমি একশত অশ্বারোহী লইয়া কল্য প্রত্যূষে যাত্রা করিবে। বিটঙ্ক রাজ্যের এই সেনানী চিত্রক বর্মা তোমার সঙ্গে যাইবেন। তুমি দুর্গাধিপ কিরাতকে আমার নাম করিয়া বলিবে যেন তদ্দণ্ডেই বিটঙ্করাজকে তোমার হস্তে সমর্পণ করে। অতঃপর রাজাকে লইয়া তুমি অবিলম্বে ফিরিয়া আসিবে।’
গুলিক বলিল— ‘যথা আজ্ঞা। যদি কিরাত রাজাকে সমর্পণ করিতে সম্মত না হয়?’
‘তাহাকে বলিও— আদেশ উপেক্ষা করিলে সহস্র রণহস্তী লইয়া আমি স্বয়ং গিয়া তাহার দুর্গ সমভূমি করিব।’
‘আজ্ঞা। যদি তাহাতেও ভয় না পায়?’
‘তখন আমার কাছে দূত পাঠাইবে। উপস্থিত চিত্রক বর্মাকে তোমার শিবিরে লইয়া যাও, উত্তমরূপে অতিথি সৎকার কর।’
চিত্রক একটু ইতস্তত করিল, কিন্তু স্কন্দের আদেশ অলঙ্ঘনীয়। সে রট্টার প্রতি একবার পশ্চাদ্দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া গুলিক বর্মার সহিত প্রস্থান করিল।
চিত্রককে চলিয়া যাইতে দেখিয়া রট্টার মনে ঈষৎ শঙ্কার উদয় হইল। কিন্তু সে তাহা দমনপূর্বক অল্প হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিল— ‘আর আমি? আমি কি চষ্টন দুর্গে যাইব না?’
স্কন্দ মাথা নাড়িয়া বলিলেন— ‘না। তুমি আমার শিবিরে থাকিবে। তুমি রাজকন্যা; অনেক বিপদ উত্তীর্ণ হইয়া আমার কাছে আসিয়াছ। আবার তোমাকে বিপদের মুখে পাঠাইব না।’
রট্টা বলিল— ‘দেব, আপনার অসীম করুণা। কিন্তু—’
স্কন্দ বলিলেন— ‘রট্টা যশোধরা, ভয় করিও না। তুমি তোমার পিতার প্রাসাদে যেরূপ নিরাপদ থাকিতে আমার শিবিরে তদপেক্ষা অধিক নিরাপদে থাকিবে। — লহরি, রাজকন্যাকে লইয়া যাও। উনি পথশ্রান্ত; তোমার উপর মাননীয়া অতিথির পরিচর্যার ভার রহিল।’
ইহার পর রট্টার মুখে আর আপত্তির কথা যোগাইল না। লহরী তাহার পাশে আসিয়া স্নিগ্ধস্বরে বলিল— ‘আসুন, কুমার-ভট্টারিকা।’
লহরী রট্টাকে লইয়া প্রস্থান করিলে পিপ্পলী মিশ্র জানু সাহায্যে রাজার পাশে আসিয়া বসিলেন, তাঁহার কানে কানে বলিলেন— ‘বয়স্য, কেমন দেখিলে?’
স্কন্দ মৃদুহাস্যে বললেন— ‘অপূর্ব।’
পিপ্পলী বলিলেন— ‘তবে আর বিলম্ব করিও না। যদি গার্হস্থ্য ধর্ম অবলম্বন করিতে চাও, এই সুযোগ। গৃহিণী সচিব সখী— এমনটি আর পাইবে না।’
স্কন্দ স্মিতমুখে নীরব রহিলেন।
নৈশ ভোজনের পর রাত্রি প্রথম প্রহরে চিত্রক রক্টর সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিল। প্রত্যূষে যাত্রা করিতে হইবে।
কক্ষে আর কেহ ছিল না; দীপদণ্ডে স্নিগ্ধজ্যোতি বর্তিকা জ্বলিতেছিল। রট্টা আসিয়া চিত্রকের হাত ধরিয়া দাঁড়াইল, বলিল— ‘আমি তোমার সঙ্গে যাইতে পাইলাম না।’
নিম্নস্বরে কথা হইতে লাগিল। চিত্রক বলিল— ‘এই ভাল। এখানে তুমি নিরাপদে থাকিবে।’
রট্টা বলিল— ‘তুমি কাছে না থাকিলে আমার আর নিরাপদ মনে হয় না।’
চিত্রক রট্টার স্কন্ধের উপর হাত রাখিল— ‘রট্টা, লক্ষ্য করিয়াছ কি, স্কন্দ তোমার প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছেন।’
চিত্রকের মুখের কাছে মুখ আনিয়া রট্টা বলিল— ‘লক্ষ্য করিয়াছি। ইহাতে ভালই হইবে।’
‘সে তুমি জানো।’ চিত্রক রট্টার স্কন্ধ হইতে হাত নামাইয়া লইল।
রট্টা বলিল— ‘হাঁ, আমি জানি। আমার মন আমি জানি।’
‘তবে আজ চলিলাম। আবার কবে দেখা হইবে, দেখা হইবে কিনা জানি না।’
‘তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। আবার শীঘ্রই দেখা হইবে।’
চিত্রকের মনে কিন্তু কাঁটা ফুটিয়া রহিল। চতুঃসাগরা পৃথ্বীর একচ্ছত্র অধীশ্বর, তাঁহার একমাত্র মহিষী— এই প্রলোভন কোন্ নারী ছাড়িতে পারে? কিন্তু সে মুখে কিছু প্রকাশ করিল না; আরও দুই চারিটি কথার পর রট্টার নিকট বিদায় লইল। মনে মনে ভাবিল, এই বুঝি শেষ সাক্ষাৎ।
অতঃপর রট্টা শয্যায় আসিয়া শয়ন করিল। কিয়ৎকাল শূন্যে চক্ষু মেলিয়া থাকিবার পর দেখিল, দাসী লহরী নিঃশব্দে পদপ্রান্তে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। লহরী মৃদুকণ্ঠে বলিল— ‘দেবি, আপনার পদ-সম্বাহন করিয়া দিই?’
রট্টা স্মিতমুখে বলিল— ‘তুমি অনেক সেবা করিয়াছ। আর প্রয়োজন নাই।’
লহরী বলিল— ‘সে কি কথা। আমি পদসেবা করি, আপনি ঘুমান। আপনি ঘুমাইলে আমিও আপনার পদতলে ঘুমাইব।’
রট্টা বুঝিল, এই কক্ষটি এবং এই শয্যা লহরীর; যে বস্ত্র রট্টা পরিধান করিয়াছে তাহাও লহরীর। সৈন্য শিবিরে অন্য নারী-বস্ত্র কোথা হইতে আসিবে? রট্টা আর আপত্তি করিল না; লহরী শয্যাপ্রান্তে বসিয়া তাহার পদসেবা করিতে লাগিল।
কিছুক্ষণ নীরবে কাটিল; তারপর রট্টা বলিল— ‘শিবিরে অন্য নারী কি নাই?’
‘না দেবি।’
‘তোমার নাম লহরী? তুমি কতদিন রাজ-সংসারে আছ?’
‘দশ বৎসর বয়সে কুমার স্কন্দের তাম্বূলকরঙ্কবাহিনী হইয়া রাজ-সংসারে প্রবেশ করিয়াছিলাম; সে আজ বিশ বছরের কথা। সেই অবধি আছি।’
‘যুদ্ধক্ষেত্রেও তোমাকে আসিতে হয়?’
‘আমি না থাকিলে কুমার স্কন্দের সেবা হয় না। তিনি সেবা লইতে জানেন না। ভৃত্যেরা অবহেলা করে। তাই আমাকে আসিতে হয়।’
‘তুমি এখনও রাজাকে স্কন্দ বলো?’
‘হাঁ দেবি। পুরাতন অভ্যাস ছাড়িতে পারি নাই।’
‘তুমি বিবাহিতা?’
‘না দেবি।’
‘বিবাহ কর নাই কেন?’
‘আমি বিবাহ করিলে কুমার স্কন্দের সেবা করিবে কে?’
রট্টা কিছুক্ষণ লহরীর মুখের পানে চাহিয়া রহিল। স্কন্দের প্রতি এই দাসীর মনের ভাব কিরূপ? দাস্যভাব? বাৎসল্য? সখ্য? প্রেম? হয়তো সব ভাব মিশিয়া একাকার হইয়া গিয়াছে।
রট্টা প্রশ্ন করিল— ‘মহারাজ বিবাহ করেন নাই কেন?’
লহরী বলিল— ‘যুদ্ধ করিয়াই জীবন কাটিয়া গেল, বিবাহ করিবেন কখন? তাছাড়া, কোন্ জ্যোতিষী নাকি বলিয়াছিল তিনি চিরকুমার থাকিবেন।’
‘ইহাই বিবাহ না করার কারণ?’
লহরী ক্ষণেক নীরব থাকিয়া বলিল— ‘কুমার স্কন্দের ভোগে রুচি নাই। মনের মধ্যে তিনি বড় একাকী! কখনও মনের সঙ্গিনী পান নাই। পাইলে হয়তো বিবাহ করিতেন।’
রট্টা বলিল— ‘বিবাহ করিলে হয়তো মনের সঙ্গিনী পাইতেন। কিন্তু এখন উপায় নাই।’
‘উপায় নাই কেন?’
‘এখন কি তিনি আর বিবাহ করিবেন?’
‘তাঁহার বিবাহের বয়স উত্তীর্ণ হয় নাই। অন্তরে বাহিরে তিনি যুবাপুরুষ। উপযুক্ত সঙ্গিনী পাইলে কেন বিবাহ করিবেন না?’
‘তা বটে।’
আর কোনও কথা হইল না। ক্রমে রট্টা ঘুমাইয়া পড়িল। রাত্রে কিন্তু ভাল নিদ্রা হইল না; বারবার কোন নিভৃত উৎকণ্ঠার পীড়নে ভাঙ্গিয়া যাইতে লাগিল।
শিবিরের আর একটি কক্ষে স্কন্দ শয়ন করিয়াছিলেন। তাঁহারও আজ ভাল নিদ্রা হইল না।