সরমা রাক্ষসী বটে, মহাগুণবতী।
সীতার সহিত তার পরম পীরিতি।।
লঙ্কায় সীতার নাই দুঃখের ভাগিনী।
একমাত্র ছিল সেই সরমা-রমণী।।
সীতা ও সরমা যেন দুইটি ভগিনী।
উভয়ে কহিত কত দুঃখের কাহিনী।।
সীতার দুঃখের কথা সরমা শুনিলে।
সরমা সান্ত্বনা দিত বসিয়া বিরলে।।
সীতা কন, শুন মোর সরমা ভগিনী।
আর কি পাইব রাম চরণ দু খানি।।
আর কি সরমা দিদি হেন ভাগ্য পাব।
শ্রীরামের সঙ্গে আমি অযোধ্যায় যাব।।
আর কি হেরিব চক্ষে রাম রঘুমণি।
আর কি রামের বামে হব পাটরাণী।।
কুটীর রহিল কোথা, পত্রের ছাউনি।
দেবর লক্ষ্মণ কোথা, কোথা গুণমণি।।
বিষম কঠিন বিধি দেখি তব মন।
আমার কপালে কৈলি লিখন এমন।।
কারো মন্দ নাহি করি, সবে করি ভাল।
তবে কেন অভাগীর হেন দশা হল।।
দুঃখের উপরে কারো দাও বিধি দুঃখ।
সুখের উপরে কারো দাও তুমি সুখ।।
যারে সুখ দাও, ভাসে সে সুখ সাগরে।
রামনিধি দিয়া পুনঃ কেড়ে নিলে তাঁরে।।
রাম-সীতা এক বস্তু, ভিন্ন নহে কভু।
ভিন্ন করে দিল আজ নিদারুণ বিভু।।
সাধ করি গলে হার না পরিনু আমি।
হার-অন্তরালে পাছে রণ্ রঘুমণি।।
তাই আমি ভয়ে ভয়ে না পরিনু হার।
সেই রামে রাখে বিধি সাগরের পার।।
এমন দারুণ দুঃখ কেমনে পাসরি।
বৃথা মোর জন্ম, বৃথা জনক-ঝিয়ারী।।
আমারে বেতের বাড়ি মারে চেড়ীগণ।
এ দুঃখে সীতার প্রাণ বাঁচে কতক্ষণ।।
সদাই মারিতে আসে রাক্ষসীর দল।
পলাইতে মনে করি চতুর্দ্দিকে জল।।
এতেক বলিয়া সীতা করেন ক্রন্দন।
সরমা সীতাকে দেন প্রবোধ বচন।।
কমল-লোচন রাম দেব নারায়ণ।
সীতা লক্ষ্মী ঠাকুরাণী, জানে ত্রিভুবন।।
লক্ষ্মী-নারায়ণ কভু ভিন্ন নাহি রবে।
অবিলম্বে উভয়ের মিলন হইবে।।
কাল পূর্ণ হইলেই কার্য্য-সিদ্ধি হয়।
কাল পূর্ণ না হইলে নহে ফলোদয়।।
সত্য-বটে, দৈব ও পুরুষাকার বল।
কিন্তু এই দুয়ে কাজ না হয় সফল।।
কাল পূর্ণ হওয়া চাই তাদের সহিত।
এ তিন মিলনে কার্য্য-সিদ্ধি সুনিশ্চিত।।
এক এক বিন্দু তব নয়নের জল।
ঝরিতেছে ঠিক যেন জ্বলন্ত অনল।।
এ অনলে দহিবেক স্বর্ণ-লঙ্কা-পুরী।
মনে রেখে দিও সীতা বিশেষ বিচারি।।
বহুকাল গেল সীতা অল্পকাল আছে।
ক্রান্দন সম্বর সীতা, হিয়া শুকায় পাছে।।
সরমা সতীর বাক্য করিয়া শ্রবণ।
সীতাদেবী এই কথা বলেন তখন।।
আমি যদি রমা হই, তুমি হে সরমা।
সার্থক তোমার নামে দেখি যে সুষমা।।
ধন্য তব পিতা মাতা, বুঝিনু এখন।
রাখিলা সরমা নাম আমারি কারণ।।
ক্রন্দন সম্বরে সীতা সরমা-বচনে।
সীতার ক্রন্দনে কান্দে পশু-পক্ষীগণে।।
মাথে হাত দিয়া সীতা ছাড়িলা নিঃশ্বাস।
সুন্দর সুন্দরাকাণ্ড গায় কৃত্তিবাস।।