সামাজিক আচার (ব্রাহ্মণ)
আমরা জানি যে, প্রত্নকথার অন্যতম দায়িত্ব ছিল প্রচলিত সামাজিক রীতির বৈধতা প্ৰতিপাদন। ব্রাহ্মণ সাহিত্যে তার বহু নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায়। তবে, প্ৰাথমিকভাবে যজ্ঞানুষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হওয়ায় সামাজিক রীতিনীতি সম্পর্কে প্ৰত্যক্ষ তথ্য দেবার কোনো সুযোগ ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যের ছিল না। শতপথ ব্ৰাহ্মণের একটি দেব কাহিনীতে (১ : ৭ : ৪ : ৪) নিজ কন্যা উষার প্রতি প্ৰজাপতির কামাসক্তি, তার জন্য প্রজাপতির প্রতি দেবতাদের ক্রোধ এবং রুদ্র কর্তৃক প্রজাপতির শাস্তিদানের বর্ণনায় এই ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, তৎকালীন সমাজে অবৈধ যৌন সম্পর্ক নিন্দিত হলেও সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ছিল না। অন্য একটি কাহিনীতে আমরা বুঝতে পারি যে, গোমাংস ভক্ষণ নিষিদ্ধ না হলেও লোকসমাজে তার প্রচলন ক্রমে কমে আসছিল।
বিভিন্ন ব্ৰাহ্মণে ঋষিদের প্রতি সমাজের বিশেষ সম্মান বোধ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। জীবনের চতুর্থাশ্রম অর্থাৎ সন্ন্যাস যে প্রবর্তিত হয়ে গেছে, তারও প্রমাণ আমরা এ সাহিত্যে পাই। সামাজিক রীতিনীতি জনপ্রিয় ধর্মের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। তবে, রক্ষণশীল বা প্ৰশাসন-অনুমোদিত ধর্ম থেকে লোকায়ত ধর্মের বৃত্তকে পৃথক করা সত্যই খুব দুরুহ; বিভিন্ন তথ্য আমরা এ সম্বন্ধে কিছু কিছু অনুমান করতে পারি মাত্র। নির্দিষ্ট কয়েকটি ধর্মীয় আচারকে বৃহৎ ঐতিহ্যের সঙ্গে প্ৰত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত করা হয় নি বলেই আমাদের এই বিভাজন সম্পর্কে বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যের শেষ পর্যায়ে ‘ব্ৰহ্মা’ অর্থাৎ অথর্ববেদের পুরোহিতকে সমাজে গ্রহণযোগ্য করে তোলার সচেতন প্ৰয়াস লক্ষ্য করা যায়। অন্য তিন প্ৰধান পুরোহিতের মতো তার জন্য কোনো মুখ্য কর্তব্য যেহেতু নির্দিষ্ট করা যায়নি, তাই তাকে অধিকতর অপরিহার্য করে তোলার একটি চেষ্টা চলেছিল, বিশেষত অথর্ববেদের ধারার মধ্যে। কৌষীতকি ব্ৰাহ্মণে (৫ : ১১) বলা হয়েছে যে, বাক্যের দ্বারা কর্ম অন্য পুরোহিতেরা করেন, কিন্তু মনের দ্বারা অনুষ্ঠেয় কর্ম শুধু ব্ৰহ্মাই করে থাকেন। এই সঙ্গে আমরা এও বুঝতে পারি যে, এ সময় মন ও চিন্তার প্রাধান্যের প্রতি প্রবণতা ধর্মে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল; তা না হলে, ব্ৰাহ্মণের প্রাধান্য মনের সঙ্গে সম্পূক্ত অনুষঙ্গের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হতে পারত না। রচনাকালের দিক দিয়ে যত আমরা অর্বাচীনতর ব্ৰাহ্মণগুলির সঙ্গে পরিচিত হই, ততই দেখি যে, তাদের মধ্যে অধিক সংখ্যক গাৰ্হস্থ্য অনুষ্ঠান গুরুত্ব পেয়ে যাচ্ছে; যেমন গোপথ ব্ৰাহ্মণে নিম্নোক্ত দ্বাদশ সংস্কার উল্লিখিত : গর্ভাধান, পুংসবন, সীমান্তোন্নয়ন, জাতকর্ম, নামকরণ, নিষ্কমণ, অন্নপ্রাশন, গোদান, চুড়াকরণ, উপনয়ন, আপ্লবন ও অগ্নিহোত্র। যে সমস্ত জনপ্রিয় ধর্মীয় উপাদান বহু শতাব্দী ধরে সামূহিক অবচেতনে নিহিত ছিল ও রক্ষণশীল যাজকতান্ত্রিক ধর্মের সঙ্গে অসম্পূক্ত সেই উপাদানগুলিই লোকায়ত ধর্মের সাক্ষ্য নিয়ে যজ্ঞধর্মে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছিল।
ঋগ্বেদে আমরা গন্ধৰ্ব্বদের উল্লেখ পাই; শতপথ-ব্ৰাহ্মণে বহু অপ্সরার অস্তিত্বও বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় : মেনকা, সহজন্যা, প্রম্লোচনী, অনুম্লোচনী, বিশ্বাচী, ঘৃতাচি, উর্বশী ও পূর্ববিত্তি। এদের মধ্যে উর্বশীকে কেন্দ্র করে ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের বিখ্যাত সংবাদ-সূক্তটি গড়ে উঠেছে। অন্সরার সম্পর্কে বিশ্বাস যে অন্ততপক্ষে ইন্দোইয়োরোপীয় ঐতিহ্যের মতো প্ৰাচীন, তা গ্রিক ও ল্যাটিন দেবকাহিনীগুলিতেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ বিশ্বাস যে যজ্ঞধর্মে অনুপ্রবিষ্ট তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ সম্ভবত লোকায়ত ধর্মের বিভিন্ন উপাদানের ইন্দ্ৰজাল ও জাদুবিদ্যার অস্তিত্বের মধ্যেই নিহিত, অর্থাৎ যে সমস্ত অনুষ্ঠানকে কোনও আপাত যুক্তির সাহায্যে যুক্তিসিদ্ধ করে তোলার চেষ্টা দেখা যায় নি, তাও এর মধ্যে স্বীকৃতি পেয়েছে। তবে, এখানে আমাদের স্মরণ করা প্রয়োজন যে, সমস্ত প্ৰাচীনপহী যাজক-তান্ত্রিক ধর্মেই ইন্দ্ৰজাল ও জাদুবিদ্যা অবিচ্ছেদ উপাদােনরূপে স্বীকৃত। ব্রাহ্মণসাহিত্যে প্রতিফলিত লোকায়ত ধর্মকে এদের থেকে পৃথক করার একমাত্র মাপকাঠি হ’ল ছদ্মযুক্তির উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি।
সমাজের প্রত্যাশা ছিল এই যে, মানুষ সতর্কভাবে জীবনধারণ করে তার শতবর্ষব্যাপী আয়ুষ্কালের পূর্ণ সদব্যবহার করবে এবং অবহেলায় তার পরমায়ুর কোনও অপচয় করবে না। মানুষ তিনটি ঋণ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে : দেবষণ, ঋষিঋণ ও পিতৃঋণ। দেবখণ পরিশোধ করার জন্য যজ্ঞ অনুষ্ঠান করা প্রয়োজন, ঋষিঋণ পরিশোধ করার জন্য বিদ্যাশিক্ষার প্রয়োজন এবং পিতৃঋণ শোধ করতে হলে পুত্ৰ উৎপাদন আবশ্যক।
শিক্ষার্থী অর্থাৎ ব্ৰহ্মচারীর গভীর ও রহস্যময় তাৎপৰ্য সম্পর্কে গোপথ ব্ৰাহ্মণের ব্যাখ্যা থেকে বোঝা যায় যে পঠন-পাঠনের মধ্য দিয়ে পিতৃপুরুষেরণজ্ঞানচর্চার ধারা পরিশীলিত হত। অক্ষর-জ্ঞান আবিষ্কৃত হবার পূর্বস্তরে সমাজে সর্বপ্রকার জ্ঞানই মৌখিকভাবে এক প্ৰজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে প্রবাহিত হ’ত; ফলে বিদ্যার্থী স্বভাবতই ঐতিহ্যগত বিদ্যার আধার ও সঞ্চরণের আধার হয়ে উঠত এবং ব্ৰহ্মচারীর উপর আধ্যাত্মিক কিছু অনুষঙ্গ আরোপিত হত। ব্ৰহ্মচারীকে তপস্বীর কঠোর বিধি অনুসরণ করতে হত, সংগীত উপভোগ বা নৃত্যে অংশগ্রহণ কিংবা উচ্চশয্যায় নিদ্রা ইত্যাদির অধিকার তার ছিল না। জ্ঞানলাভের জন্য অপূর্ব তৃষ্ণা ও সভ্রমবোধ এবং জ্ঞানের প্রতি শ্রদ্ধা ব্ৰাহ্মণ গ্রন্থে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আবার একই সঙ্গে আমরা জ্ঞান ও আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে দ্বন্দ্বের আভাস পাই। ব্রাহ্মণ ও উপনিষদগুলিতে জ্ঞানের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত শ্রদ্ধার বিশেষ এক ধরনের তাৎপৰ্য লক্ষ্য করি।