সামগান আর অন্নআহরণ
কুকুর মানে তাহলে সত্যিই কুকুর নয়। মানুষ। তবে আমার-আপনার মতো এ-কালের মানুষ নয়। টোটেম-সমাজের মানুষ। সে-সমাজের প্রধান লক্ষণ হলো, একান্ত দলগত বা গোষ্ঠীগত জীবন। ছোটোয়-বড়োয় তফাত নেই,–শক্তির দিক থেকে নয়, ঐশ্বর্যের দিক থেকেও নয়। তাই এই সমাজকে বলা হয় আদিম সাম্য-সমাজ। শ্রেণীবিভাগ দেখা দেবার আগেকার পর্যায়ের এই সমাজে পরান্নজীবী হিসেবে কারুরই স্থান নেই—দলের কাজে সবাইকেই যোগ দিতে হয়। অর্থাৎ, শ্রমের দায়িত্ব গ্রহণের দিক থেকেও সবাই সমান।
উপনিষদের মধ্যে এ-হেন একটা টোটেম-সমাজের স্পষ্ট ছবি কেমন ভাবে টিকে থেকেছে তা ভাবতে সত্যিই আশ্চর্য লাগে! কেননা, উপনিষদে মোটের উপর যে-সমাজের পরিচয় পাওয়া যায় তা আর যাই হোক সাম্যসমাজ নয়, শ্রেণীবিভক্ত সমাজই। অথচ মানতেই হবে, যেমন করেই হোক নতুন পর্যায়ের সাহিত্যেও পুরোনো পর্যায়ের স্মারক থেকে গিয়েছে। ঠিক কী করে টিকে থাকলো তার স্পষ্ট জবাব দিতে না পারলেও ওই সমাজের ছবি যে টিকে রয়েছে এ-কথা কোনো মতেই অস্বীকার করবার উপায় নেই।
সমাজ-বিকাশের ওই পুরোনো পর্যায়টির কথা মনে না রাখলে ছান্দোগ্য-বর্ণিত কুকুরগুলির বাকি আচরণটুকুও বোঝা যাবে না। অপর পক্ষে ওই সামাজিক পটভূমিটিতে বিচার করতে পারলে উপনিষদের এই অংশটির বাকি প্রায় প্রতিটি কথারই স্পষ্ট ও যুক্তিসঙ্গত অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়।
একে একে বাকি কথাগুলির আলোচনা তোলা যাক।
স্বাধ্যায়-অন্বেষী বক দালভ্য, ওরফে গ্লাব মৈত্রেয়, কী দেখলেন? প্রথমত একটি সাদা কুকুর : সাদা বিশেষণটি বয়স-ব্যঞ্জক কিনা তা বোঝবার উপায় নেই। হতেও পারে, না হতেও পারে। যদি প্রাচীনত্বসূচকই হয় তাহলে তাকে ওই কুকুরদলের মধ্যে প্রাচীন বলতে বাধা হবে না। তার প্রতি অন্য কুকুরদের আচরণটাও দলপতি-সূচক। তাই সাদা বলতে ‘সাদা চুল’—এমন অর্থ খুব বেশি অসম্ভব নাও হতে পারে।
কিন্তু তা হোক আর নাই হোক, তার প্রতি অন্য কুকুরদের অনুরোধটা আপাতদৃষ্টিতে একেবারেই অসম্ভব আর আজগুবি মনে হয় : তাদের ক্ষিদে পেয়েছে, তারা অন্ন চায়—এ-পর্যন্ত বুঝতে নিশ্চয়ই কোনো অসুবিধে হয় না। কিন্তু অন্নলাভের উপায় হিসেবে অপর কুকুরগুলি যা বললো তার কোনো রকম তাৎপর্য যে থাকতে পারে তা আমাদের পক্ষে ভাবাই কঠিন। সাদা কুকুরটিকে ঘিরে অন্য কুকুরেরা বললো : ক্ষিদে পেয়েছে, অন্ন চাই, অতএব একটা গান গাও।
অন্নং নো ভগবানাগায়ত্বশনায়াম্
কুকুরদের ছোটো মুখে এ-হেন একটা বড়ো কথা শুনে আধুনিক যুগের অনেক নন্দনতত্ত্ববিশারদ নিশ্চয়ই বিলক্ষণবিরক্ত হবেন। কেননা, তাঁদের মধ্যে আজ অনেকেই খুব জোর-গলায় ঘোষণা করছেন : Art for Art’s sake—শিল্প নিছক শিল্পের খাতিরেই। অনাশক্ত ও নির্লিপ্ত রসসম্ভোগ ছাড়াও শিল্পের যে আর কোনো রকম উপযোগিতা থাকতে পারে এ-কথা আজকের যুগে নানাভাবে অস্বীকার করা হয়।
অবশ্যই, নন্দনতত্ত্বের এ-জাতীয় মতবাদ হলো ভাববাদী মতবাদ—অভিনব গুপ্ত থেকে ক্রোচে পর্যন্ত যে-মতবাদের প্রচারক। কিন্তু ছান্দোগ্যের ওই কুকুরগুলি ভাববাদ কাকে বলে তা জানে না! তাদের দৃষ্টিভঙ্গিটা আগাগোড়াই বস্তুবাদী।
নন্দনতত্ত্বের মতাদর্শের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। কিন্তু আমাদের সাধারণ অভিজ্ঞতার সঙ্গেও কুকুরদের ওই কথাগুলির যেন আকাশ-পাতাল তফাত। আমরা আজ এমন একটা যুগে বাস করছি যেখানে সংগীতের সঙ্গে অন্ন আহরণের কোনো রকম কার্যকারণ সম্পর্ক একেবারে অসম্ভব ও আজগুবি কল্পনা বলেই মনে হবার কথা।
তবু, এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই যে, উপনিষদের ঋষিদের কাছে সম্পর্কটার সম্ভাবনা অতো অসম্ভব বা আজগুবি ছিলো না। এবং এর কারণটাও রহস্যজনক নয় : আমরা বাস করি আধুনিক সমাজে, এবং আধুনিক সমাজ-ব্যবস্থাই আমাদের ধ্যানধারণার উৎস। উপনিষদের ঋষিরা বাস করতেন প্রাচীন সমাজে, এবং সেই প্রাচীন সমাজ-ব্যবস্থাই তাঁদের ধ্যানধারণার উৎস ছিলো। তাঁদের ওই প্রাচীন সমাজের সঙ্গে আমাদের আধুনিক সমাজের অনেক তফাত, তাঁদের ধ্যানধারণার সঙ্গে আমাদের ধ্যানধারণারও অনেক তফাত। তাই, তাঁদের ধ্যানধারণার সঙ্গে আমাদের ধ্যানধারণারও অনেক তফাত। তাই, তাঁদের স্মৃতি থেকে সংগীতের সঙ্গে অন্ন-আহরনের সম্পর্কটা একেবারে বিলুপ্ত হয় নি, যে-রকম বিলুপ্ত হয়েছে আমাদের মন থেকে।
উপনিষদ-সাহিত্যে যদি শুধুমাত্র কুকুরদের ওই সামগানের দৃশ্যটিই সংগীতের সঙ্গে অন্নআহরণের কার্যকারণ-সম্পর্ক-সূচক হতো তাহলেও কথাটাকে উড়িয়ে দেবার উপায় থাকতো না। কিন্তু উপনিষদের সাক্ষীর জোর অনেক বেশি, কেননা, দেখা যায় ওই সম্পর্কের কথা বারবার ঋষিদের চিন্তায় উঁকি দিচ্ছে। এখানে দু’-একটা নমুনা উদ্ধৃত করা যায়। বৃহদারণ্যক উপনিষদে লেখা আছে :
অথাত্মনেহন্নাদ্যমাগায়দ্যদ্ধি কিংচান্নমদ্যতেহনেনৈব তদদ্যত ইহ প্রতিতিষ্ঠতি।।১।৩।১৭।।
অর্থাৎ, অনন্তর নিজের জন্য অন্নাদিকে গান করিয়া লাভ করিয়াছিলেন। কেননা, যে-কিছু অন্ন ভুক্ত হয় তা ইহার দ্বারাই ভুক্ত হয়, ইহাতে (অন্নতে) প্রতিষ্ঠিত থাকে।
গানের সাহায্যেই যে অন্ন লাভ করা গিয়েছে এ-কথা উপনিষদের ঋষিদের মনগড়া কথা নয়। তাঁরা লিখছেন, স্বয়ং দেবতারাও এই কথাটি স্বীকার করে গিয়েছেন। বৃহদারণ্যকে তাই বলা হয়েছে :
তে দেবা অব্রুবন্নেতাবদ্ধা ইদং যদন্নং তদাত্মন আগাসীরনু নোহস্মিন্নন্ন আভজস্বেতি…।।১।৩।১৮।।
অর্থাৎ, সেই দেবগণ বলিলেন, এ-পর্যন্ত এই যে অন্ন সেই অন্নকে নিজের জন্য গান করিয়া লাভ করিয়াছ। এখন (পশ্চাৎ) আমাদের সেই অন্নে অংশী করো…
তাহলে দেখা যাচ্ছে, উপনিষদের যুগ পর্যন্ত খোদ দেবতারাও মানতেন যে অন্নলাভার্থে গানের কার্যকারিতা আছে। গান শুধুমাত্র অবসর-বিনোদন নয়, উৎপাদন-পদ্ধতির অঙ্গও।
অন্নলাভের সঙ্গে গানের কোনো যোগ থাকা সম্ভব কিনা এ-বিষয়ে আজকের দিনে আমার-আপনার একটা মত থাকতে পারে, আছেও নিশ্চয়ই। কিন্তু আমাদের বর্তমান আলোচনা মোটেই তা নিয়ে নয়। আমরা শুধু দেখতে চাইছি, প্রাচীনদের ধারণা অনুসারে এ-রকম কোনো যোগাযোগ মানা দরকার কিনা।
প্রাচীনদের ধারণায় গানের সঙ্গে অন্নের যোগটা যে কতো ঘনিষ্ঠ তার অন্যান্য পরিচয় উপনিষদেই দেখতে পাওয়া যায়। উপনিষদের ঋষিরা উদ্গীথ শব্দটিকে কী ভাবে বিশ্লেষণ করতে চান তাই দেখুন। ছান্দোত্য-উপনিষদে বলা হয়েছে, তাই উদ্গীথের অক্ষরগুলিকে সম্যকভাবে বুঝতে হবে (উপাসীত) :
খলুদ্গীথাক্ষরাণ্যুপাসীতোদ্গীথ ইতি প্রাণ এবোং প্রাণেন হ্যত্তিষ্ঠতি বাগ্গীর্বাচো হ গির ইত্যাচক্ষতেহন্নং থমন্নে হীদং সর্বং স্থিতম্।।১।৩।৬।।
অর্থাৎ, অনন্তর উদ্গীথের অক্ষরসমূহকে উপাসীত। উদ্গীথ এই : প্রাণই হইল উৎ অক্ষর, কেননা, প্রাণের দ্বারাই উত্তিষ্ঠ হয়। বাক্-ই হইল গী অক্ষর, (কেননা) বাক্কেই গী বলা হয়। অন্নই হইল থম্ এই অক্ষর, (কেননা) এই সমুদয় অন্নেরই অবস্থিত।
তাহলে, সামগানের ওই উদ্গীথ বলে নামটিকে ভেঙে দেখলেই দেখতে পাবেন, তার মধ্যে অন্নের অভাব নেই! এবং এ-কথা একালের কোনো চিন্তাশীলের কল্পনা নয়—স্বয়ং ঋষিদের দস্তখৎ করা দলিল।
সামগানের সঙ্গে অন্নের সম্পর্ক নিয়ে উপনিষদে আরো কথা লেখা আছে। সামগানের চতুর্থ পর্যায়টিকে বলে প্রতিহার—আধুনিক পণ্ডিতদের তর্জমায় response। ছান্দোগ্য-উপনিষদেই প্রশ্ন উঠেছে, এই প্রতিহারের অনুগমনকারী দেবতাটির স্বরূপ নিয়ে। ঊষস্তি চাক্রায়নকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো, কে সেই দেবতা? প্রশ্নের শর্তটা অবশ্যই খুব কঠিন : এই দেবতাকে না জেনে ঊষস্তি চাক্রায়ন যদি প্রতিহার-কর্ম করনে তাহলে তাঁর মাথা কাটা যাবে। উত্তরে ঊষস্তি চাক্রায়ন যা বলেছিলেন তা সত্যিই বিস্ময়কর :
অন্নমিতি হোবাচ সর্ব্বাণি হ বা ইমানি ভূতান্যন্নমেব প্রতিহরমাণানি জীবন্তি সৈষা দেবতা প্রতিহারমন্বায়ত্তা তাং চেদবিদ্বান্ প্রত্যহরিষ্যে মুর্দ্ধা তে ব্যপতিষ্যত্তথোক্তস্য ময়েতি তথোক্তস্য ময়েতি।।১।১।১৯।।
অর্থাৎ, তিনি বলিলেন, অন্নই সেই দেবতা। এই সমুদয় ভূতই অন্ন আনয়ন করিয়া (প্রতিহরমাণানি=প্রতি+হৃ+শানচ্=আনয়ন করিয়া) জীবনধারণ করে। সেই দেবতাই প্রতিহারের অনুগমন করেন। তাহাকে না জানিয়াই আপনি যদি প্রতিহার-কর্ম করিয়া থাকেন তাহা হইলে আপনারই শির নিপতিত হইবে।
ঊষস্তি চাক্রায়ণের শির নিপতিত হয়েছিলো—এমনতরো কোনো কথা উপনিষদে লেখা নেই। বরং, ঊষস্তি চাক্রায়ণের সংবাদ ওইখানেই শেষ হলো। তার থেকেই বোঝা যায়, উপনিষদের ওই অংশে তাঁর এই কথাগুলিই উপনিষদের ঋষিদের কাছে এ-বিষয়ে চরম প্রতিপাদ্য ছিলো।
তাহলে, উপনিষদের ওই কুকুরগুলি গানের সঙ্গে—সামগানের সঙ্গে—অন্ন-আহরণের সম্পর্ক উল্লেখ করে এমন কোনো কথা বলছে না যা কিনা সাধারণভাবে উপনিষদের ঋষিদের মতবাদের সঙ্গে খাপ খায় না। বরং, উপনিষদের ঋষিদের চেতনায় এই সম্পর্কের কথাটা যেন এই স্থির বিশ্বাসের মতো—বারবার তা ঘুরে আসছে দেখা যাক।