সদুপদেশদানান্তে কৃষ্ণের দ্বারকাগমনাভিলাষ
জনমেজয় কহিলেন, ব্ৰহ্মণ! পাণ্ডবদিগের জয়লাভের পর রাজ্য নিরুপদ্রব হইলে মহাত্মা বাসুদেব ও ধনঞ্জয় ইঁহারা কি করিয়াছিলেন, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! পাণ্ডবগণের জয়লাভের পর রাজ্য নিরুপদ্রব হইলে বাসুদেব ও ধনঞ্জয়ের আহ্লাদের পরিসীমা রহিল না। তখন তাঁহার অশ্বিনীকুমারদ্বয় যেমন পরমাহ্লাদে নন্দনবনে বিচরণ করেন, তদ্রূপ মহা আহ্লাদে বিচিত্র বন, পর্ব্বতগুহা, পবিত্র তীর্থ, পল্বল[ক্ষুদ্র জলাশয়] ও নদী প্রভৃতি রমণীয় স্থানসমুদয়ে বিচরণ করিতে আরম্ভ করিলেন। পরিশেষে তাঁহারা ইন্দ্রপ্রস্থে আগমনপূৰ্ব্বক সভায় উপবিষ্ট হইয়া কথাপ্রসঙ্গে যুদ্ধবৃত্তান্ত এবং ঋষি ও দেবতাদিগের বংশকীৰ্ত্তন করিতে লাগিলেন। ঐ সময় বাসুদেব বিবিধ বিচিত্র কথা কীৰ্ত্তন করিয়া ধনঞ্জয়ের সহস্র সহস্র জ্ঞাতি এবং পুত্ৰবিনাশজন্য শোকাপনোদন পূৰ্ব্বক তাঁহাকে যুক্তিযুক্ত, মধুর সান্ত্বনাবাক্যে কহিলেন, “পার্থ! ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির তোমার বাহুবল এবং ভীমসেন, নকুল ও সহদেবের পরাক্রমপ্রভাবেই এই সসাগরা ধরণী পরাজিত করিয়াছেন। ধর্ম্মানুসারে এই রাজ্য অকণ্টক হইয়া তাঁহার হস্তগত এবং ধৰ্ম্মানুসারেই দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন নিহত হইয়াছে। যেসকল অধৰ্ম্ম-প্রবৃত্ত রাজ্যলোলুপ দুরাত্মা ধৃতরাষ্ট্রতনয় সৰ্ব্বদা অপ্রিয়বাক্য ব্যবহার করিত, এক্ষণে তাহাৱা সকলেই পরলোকে গমন করিয়াছে। এখন রাজা যুধিষ্ঠির তোমাকর্ত্তৃক রক্ষিত হইয়া অকণ্টকে এই সাম্রাজ্য সম্ভোগ করিতেছেন। তোমার সহিত এই জনসমাজে বাস করিবার কথা দূরে থাকুক, অরণ্যে অবস্থান করিলেও আমি পরম প্রীত হইয়া থাকি। ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির, মহাবলপরাক্রান্ত ভীমসেন, নকুল ও সহদেব ইঁহারা যে স্থানে অবস্থান করেন, সেই স্থান আমার একান্ত প্রিয়।
“আমি তোমার সহিত এই স্বর্গতুল্য পরমপবিত্র রমণীয় সভামধ্যে অবস্থান করিয়া বহুকাল অতিবাহিত করিলাম। এ কাল পৰ্য্যন্ত আমি পুত্র, বলদেব ও বৃষ্ণিবংশীয় অন্যান্য ব্যক্তিদিগের দর্শনে বঞ্চিত রহিয়াছি। সুতরাং এক্ষণে দ্বারকানগরীতে গমন করিতে আমার একান্ত অভিলাষ হইতেছে। অতএব তুমি আমার দ্বারকাগমনে অনুমোদন কর। ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির আমার উপদেষ্টা হইলেও যে সময়ে ভীষ্মদেব তাঁহাকে যুক্তিযুক্ত উপদেশ প্রদান করেন, তৎকালে আমিও তাঁহাকে অনেক উপদেশ প্রদান করিয়াছি। তিনি ধার্ম্মিক, কৃতজ্ঞ, সত্যবাদী, বুদ্ধিমান ও স্থিরনিয়মসম্পন্ন। এক্ষণে যদি তোমার অভিমত হয়, তাহা হইলে ধৰ্ম্মরাজের নিকট গমন করিয়া আমার দ্বারকাগমন প্রস্তাব কর। দ্বারকানগরীতে গমনের কথা দূরে থাকুক, প্রাণরক্ষার নিমিত্তও আমি তাঁহার অপ্রিয়কাৰ্য্য সাধন করিতে সম্মত নহি। আমি সত্য কহিতেছি, কেবল তাঁহারই প্রীতির নিমিত্ত এই যুদ্ধাদিকাৰ্য্য সমুদয়ের অনুষ্ঠান করিয়াছি। এক্ষণে আমার এ স্থানে অবস্থানের উদ্দেশ্য সম্পন্ন হইয়াছে।
“ধৃতরাষ্ট্রপুত্র দুৰ্য্যোধন সবলে নিহত হইয়াছে। ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরও বিবিধ রত্নপূর্ণা সসাগরা পৃথিবী স্ববশে সমানীত করিয়াছেন, অতঃপর উনি সিদ্ধ মুনিগণে পরিবেষ্টিত বন্দিগণকর্ত্তৃক সংস্তুত হইয়া ধৰ্ম্মানুসারে সমুদয় পৃথিবী প্রতিপালন করুন। এক্ষণে তুমি রাজার নিকট গমন করিয়া আমার দ্বারকাগমন প্রস্তাব কর। আমি ধন, প্রাণ প্রভৃতি সমুদয়ই যুধিষ্ঠিরকে সমর্পণ করিয়াছি। তিনি আমার পরমপ্রিয় ও মান্য। এখন তোমার সহিত একত্র অবস্থান ভিন্ন আমার এখানে বাস করিবার আর কোন প্রয়োজন নাই। অতএব এই সময়ে একবার দ্বারকাগমন করা আমার অবশ্য কর্ত্তব্য।”
হে মহারাজ! মহাত্মা বাসুদেব অমিতপরাক্রম অর্জ্জুনকে এই কথা কহিলে, তিনি অতিকষ্টে তাঁহার বাক্যে সম্মত হইলেন।
আশ্বমেধিকপৰ্ব্বাধ্যায় সমাপ্ত