১৫শ অধ্যায় – সঙ্কুল যুদ্ধ– শল্যশরে পাণ্ডব–নিপীড়ন
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! ঐ সময় রাজা দুর্য্যোধন ও ধৃষ্টদ্যুম্ন অসংখ্য শর ও শক্তি পরিত্যাগপূর্ব্বক তুমুল যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। বর্ষাকালীন জলদজাল যেমন জলধারা বর্ষণ করে, তদ্রূপ সেই বীরদ্বয় অনবরত শরধারা বর্ষণ করিতে লাগিলেন। তখন দুর্য্যোধন দ্রোণহন্তা ধৃষ্টদ্যুম্নকে পাঁচবাণে বিদ্ধ করিয়া পুনরায় সাতবাণে নিপীড়িত করিলেন; দৃঢ়বিক্রম ধৃষ্টদ্যুম্নও দুৰ্য্যোধনের উপর সপ্ততি শর নিক্ষেপপূর্ব্বক তাহাকে নিতান্ত ব্যথিত করিলেন। কুরুরাজের সহোদরগণ তাঁহাকে ধৃষ্টদ্যুম্নের শরে নিপীড়িত দেখিয়া অসংখ্য সৈন্যসমভিব্যাহারে দ্রুপদপুত্রকে পরিবেষ্টন করিলেন। মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন সেই মহাবলপরাক্রান্ত মহারথগণকর্ত্তৃক পরিবৃত হইয়াও পাণিলাঘব প্রদর্শনপূর্ব্বক অনায়াসে সমরে বিচরণ করিতে লাগিলেন।
“এদিকে মহাবীর শিখণ্ডী প্ৰভদ্রকগণপরিবৃত মহাধনুর কৃতবর্ম্মা ও কৃপাচার্যের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলেন। ঐ তিন মহাবীরের যুদ্ধ অতি ভয়ানক হইয়া উঠিল। তাঁহারা তিনজনেই জীবিতনিরপেক্ষ হইয়া বাণ বর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলেন। মহাবীর মদ্ররাজ চারিদিকে শুরবর্ষণপূর্ব্বক সাত্যকি ও বৃকোদর প্রভৃতি পাণ্ডবগণকে নিপীড়িত করিয়া বীৰ্য্য ও অস্ত্রবলে কৃতান্তের ন্যায় পরাক্রান্ত নকুল ও সহদেবের সহিত যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। ঐ সময় কোন বীরই সেই শল্যশরবিদ্ধ পাণ্ডবপক্ষীয় মহারথগণের পরিত্রাণে সমর্থ হইলেন না।
“অনন্তর মহাত্মা ধৰ্ম্মরাজ শল্যের শরে নিতান্ত নিপীড়িত হইলে মাদ্রীনন্দন মহাবীর নকুল বেগে ধাবমান হইয়া মাতুল মদ্ররাজকে শরনিকরে সমাচ্ছন্ন করিয়া কৰ্ম্মার পরিমার্জিত সুবর্ণপুঙ্খ দশ বাণে তাঁহার বক্ষঃস্থল বিদ্ধ করিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত শল্য নকুলের শরে বিদ্ধ হইয়া তাহাকে নতপৰ্ব্ব শরনিকরে নিপীড়িত করিতে লাগিলেন। তখন মহারাজ যুধিষ্ঠির, ভীমসেন, সাত্যকি ও সহদেব মদ্ররাজের প্রতি ধাবমান হইলেন। আগমন-সময়ে তাঁহাদিগের রথনির্ঘোষে সমুদয় দিগ্বিদিক প্রতিধ্বনিত ও মেদিনী কম্পিত হইয়া উঠিল। তখন অরাতিনিপাতন সেনাপতি শল্য অনায়াসে সেই বীরগণের অভিমুখীন হইয়া যুধিষ্ঠিরকে তিন, ভীমসেনকে পাঁচ, সাত্যকিকে শত ও সহদেবকে তিনয়বাণে বিদ্ধ করিয়া ক্ষুরপ্ৰদ্বারা মহাত্মা নকুলের সশরশরাসন ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তখন মহারথ মাদ্ৰীতনয় সত্বর অন্য চাপ গ্রহণপূর্ব্বক শরনিকরে শুল্যের রথ সমাচ্ছন্ন করিয়া তাঁহাকে দশবাণে বিদ্ধ। করিলেন। ঐ সময় মহারাজ যুধিষ্ঠির দশ, ভীমসেন ষষ্টি ও সাত্যকি নয়বাণে মদ্ররাজকে নিপীড়িত করিলেন। মদ্ররাজ অরাতিগণের শরাঘাতে একান্ত ক্রোধাবিষ্ট হইয়া প্রথমতঃ নয় ও পশ্চাৎ সপ্ততিশরে সাত্যকিকে বিদ্ধ করিয়া তাহার সশরশরাসন ছেদন করিয়া ফেলিলেন এবং তৎপরে তাঁহার চারি অশ্বের প্রাণসংহারপূর্ব্বক তাঁহাকে শতবাণে বিদ্ধ করিয়া নকুল, সহদেব এবং ভীমসেন ও যুধিষ্ঠিরকে দশবাণে বিদ্ধ করিলেন। তৎকালে আমরা সংগ্রামস্থলে মদ্ররাজের অতি অদ্ভুত পরাক্রম অবলোকন করিলাম। পাণ্ডবগণ একত্র মিলিত হইয়াও তাঁহার সম্মুখীন হইতে পারিলেন না।
‘অনন্তর সত্যবিক্রম সাত্যকি পাণ্ডবগণকে শল্যের বশবর্তী ও নিতান্ত নিপীড়িত দেখিয়া অন্য রথে আরোহণপূর্ব্বক মহাবেগে তাঁহার প্রতি ধাবমান হইলেন; মহারথ শল্যও সাত্যকিকে আগমন করিতে দেখিয়া, মত্তমাতঙ্গ যেমন অন্য মাতঙ্গের প্রতি ধাবমান হয়, তদ্রূপ তাঁহার অভিমুখে গমন করিলেন। পূৰ্ব্বকালে শম্বুরাসুর ও অমররাজের যেরূপ ঘোর সংগ্রাম হইয়াছিল, এক্ষণে মহাবীর শল্য ও সাত্যকির তদ্রূপ ঘোরদর্শন তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ হইল। সত্যবিক্রম সাত্যকি মদ্ররাজকে সমরে অবস্থিত দেখিয়া তাঁহাকে “থাক থাক’ বলিয়া দশবাণে বিদ্ধ করিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত শল্য মহাত্মা যুযুধানের শরে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া তাঁহাকে বিচিত্র পুঙ্খ নিশিতশরনিকরে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। ঐ সময় মহাধনুর্দ্ধর পাণ্ডবগণ মদ্ররাজকে সাত্যকির সহিত সমরে প্রবৃত্ত দেখিয়া মাতুলের নিধনবাসনায় সত্বর তাঁহার প্রতি ধাবমান হইলেন এবং আমিষলোলুপ সিংহের ন্যায় ভীষণ গর্জ্জন করিয়া মহাবেগে শরনিকর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। তাঁহাদিগের শরজালে ধরণীতল সমাচ্ছন্ন ও দিঙ্মণ্ডল অনিৰ্ব্বচনীয় শোভাসম্পন্ন হইল। আকাশমণ্ডল সেই নির্মোক নির্মুক্ত ভুজঙ্গসদৃশ শরজালে নিরন্তর সমাবৃত হওয়াতে বোধ হইতে লাগিল যেন ঘনঘটায় সমাচ্ছন্ন হইয়াছে। ঐ সময় শত্রুসূদন মহাবীর শল্য একাকী সেই অসংখ্য বীরের সহিত সংগ্রাম করিয়া সকলকে আশ্চর্যান্বিত করিলেন। তাহার ভুজনির্ম্মুক্ত ভীষণ শরজালে মেদিনী সমাকীর্ণ হইল এবং রথ অসুরঘাতন দেবরাজের রথের ন্যায় ভ্রমণ করিতে লাগিল।”