১৫.
আর একটি সঙ্কটময় রাত্রির অবসান হলো।
প্রাতঃরাশ সারা হলো রান্নাঘরে। লোক তো মোটে তিনজন, কে আবার খাবার ঘরে কষ্ট করে খাবার টেনে নিয়ে যায়।
বাইরের আবহাওয়াটা এখন গতকালের ঠিক বিপরীত। ভোরের নরম রোদে আকাশ ঝলমল করছে। মেঘমুক্ত আকাশ। সমুদ্রের দিক থেকে ভেসে আসছে হাল্কা বাতাস। কে বলবে কালকের আকাশ ছিলো মেঘে ঢাকা, বাতাসে ছিল ঝড়ের দাপট।
দুর্যোগের রাত তো নয় যেন একটা দুঃস্বপ্নের রাত, শেষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা। সবার মুখে হাসি ফুটেছে, নতুন আশায় বুক বাঁধতে শুরু করেছে সবাই। আশার ছলনায় কি ফল লভিনু। আশার ফল যে আশানুরুপ হয় না, তা জানা সত্ত্বেও ওঁরা ভাবেন আশা থাকে বলেই তো মানুষ আজও বেঁচে আছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। আর এই আশাটা না থাকলে কবেই মানুষ পাগল হয়ে যেতো। এ দ্বীপ ছেড়ে পালাবার আশা নিয়েই তো বেঁচে আছি আজও। এখানে কেই বা মরতে চান বলুন।
এবার আমাকেও উঠে পড়ে লাগতে হবে। লম্বার্ড বলে সূর্যের আলোয় হিলিওগ্রাফে সংকেত পাঠাবার চেষ্টা করবো প্রথমে। তাতে সফল না হলে আজ সন্ধ্যায় আগুন জ্বেলে স্টিকলহ্যাভেনের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করবো।
আপনার দুটো পন্থাই যথেষ্ট আশাপ্রদ বলে মনে হচ্ছে আমার, তাকে সমর্থন করে বললো ভেরা, মানুষের নজর পড়তে বাধ্য।
তবে অসুবিধেও যে একেবারে নেই তা নয়। লম্বার্ড আরো বললো সমুদ্র এখনো পুরোপুরি শান্ত হয়নি।
এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, আর একটা রাত কাটাতে হবে এই ভুতুড়ে দ্বীপে।
সবে তো সকাল, রাত নামতে অনেক দেরী মিস ক্লেথর্ন। দেখুন দিনেই না আমরা সাবাড় হয়ে যাই। তাই বলি কি, রাতের ভাবনা রাতেই করা যাবেক্ষণ।
ডঃ আর্মস্ট্রং এর ব্যাপারে আমরা কিছুই ভাবছি না। বাধা দিয়ে বলেছেন ব্লোর তার কি হলো বলুন তো?
যা হবার হয়েছে। তিনি মারা গেছেন। প্রত্যুত্তরে লম্বার্ড বলে কেন খাবার ঘরে মাত্র তিনটে পুতুল অবশিষ্ট থাকতে দেখেন নি। তার মানে, আপনি, আমি আর মিস্ ক্লেথর্ন–
বেশ তো মারাই যদি গিয়ে থাকে, তার মৃতহেটা তাহলে গেলোই বা কোথায়? একটা ভাল প্রশ্ন করলো ভেরা।
উত্তরটা দিলেন ব্লোর সম্ভবত, মৃতদেহটা খুনী সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়েছে–
রাখুন তো মশাই আপনার সব কাল্পনিক গল্প। ধমকে উঠলো লম্বার্ড কে, কে ফেলতে পারে? আপনি। নাকি আমি? প্ৰথম খবরটা তো আপনিই দিলেন ডঃ আর্মস্ট্রং তাঁর ঘরে নেই। প্রাসাদের প্রধান ফটক পেরিয়ে তাকে আপনিই বাইরে চলে যেতে দেখেছেন। তারপর ছুটে এসে আমাকে ডাকলেন। আপনার কথা মতো দুজনে মিলে সারাটা নিগার দ্বীপে খুঁজে দেখলাম, কিন্তু তাকে কোথাও পাওয়া গেলো না। এখন আপনিই বলুন, এই অল্প সময়ে তাকে হত্যা করে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেওয়া কি আমার পক্ষে সম্ভব?
অতএব আমি জানি না বাপু, তবে আপনার কাছে পিস্তল আছে বলেই সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক।
কি যে বলেন মশাই? আপনাকে বলিনি পিস্তলটা আমি ফিরে পাই রাতে শোবার সময়। তা এর মধ্যে আপনি সন্দেহের কি এমন কারণ দেখতে পেলেন?
রাতে শুতে যাবার সময় পিস্তলটা ফিরে পাওয়ার গল্পটা বানানোও তো হতে পারে। আমি যদি বলি পিস্তলটা আগাগোড়াই আপনার কাছে ছিলো? তল্লাশীর ভয়ে কোথায় লুকিয়ে রেখে থাকবেন, রাতে শোবার সময় সেটা আবার বার করে রেখেছেন।
চঞ্চল হলো লম্বার্ড, জোরে জোরে মাথা দুলিয়ে বললো, আপনি নেহাতই একটা গবেট?
তার মানে আপনার বানানো গল্পটা আপনি আমাকে জোর করে বিশ্বাস করাতে চাইছেন? আরে মশাই, বানানো গল্প আরো একটু বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হয়, তা না হলে বাজারে চালানো যায় না।
ঠিক আছে, এখন কাজের কথায় আসা যাক। জোর দিয়ে বললেন ব্লোর আমার সাফ কথা হলো, আপনার কাছে পিস্তলটা থাকা মানেই আমাদের দুজনকে আপনার আজ্ঞাবহ হয়ে থাকতে বাধ্য করা। সেট আমার চাই না। আগেকার ব্যবস্থা মতো পিস্তলটা আপনি সেই বাক্সে রেখে দিন। তারপর বাক্সটা আলমারিতে রেখে চাবি যেমন দুজনের কাছে থাকার কথা থাকবে।
বোকার মতো কথা বলবেন না
অর্থাৎ এ প্রস্তাব আপনি মানতে রাজী নন, এই তো?
হ্যাঁ, মানেটা তো তাই দাঁড়ায়। পিস্তল আমি কিছুতেই হাতছাড়া করবো না।
তা হলে আপনার সম্পর্কে অন্য রকম ধারণা করে নিতে হয়।
কি ধারণা শুনি? আমি মিঃ ওয়েন এই তো। আপনি তো একজন গোয়েন্দা, আপনাকে খুন করার মতলব যদি আমার থাকতো, তাহলে কাল রাত থেকে আজ সকাল পর্যন্ত আপনাকে বহুবার একলা পেয়েছি, ইচ্ছে করলে অনায়াসে তখন কাজটা সেরে ফেলতে পারতাম, কিন্তু কেন পারিনি জানেন?
সে আপনিই জানেন, আপনার ব্যাপার, হয়তো কোনো কারণ থাকতে পারে, যার জন্য আপনি
বোকার মতো আপনারা দুজনে কি ঝগড়া করতে শুরু করে দিয়েছেন, এবার ভেরা চুপ করে থাকতে পারলো না, থামবেন আপনারা।
থামতে যাবো কেন? ভেরার দিকে তাকিয়ে বললো লম্বার্ড। আর বোকামিই বা বলছেন কেন?
কি আশ্চর্য। এটা বোকামো নয়? মিঃ ব্লোরের প্রশ্নের উত্তরটা আপনি জানেন না? সে তো সেই কবিতাটার মধ্যেই আছে। সেই যে চারটি কালো মানিক সাগর জলে নাচে ধিন ধিন্ একটি গেলো সিন্ধুপাখীর পেটে ফিরলো বাকী তিন। কিন্তু এখানে সেই কবিতাটির একটি ব্যতিক্রম আছে বলে আমার ধারণা, অর্থাৎ আর্মস্ট্রং সিন্ধু পাখীর পেটে যায় নি? বেঁচে আছে। মনে হয় এই দ্বীপেরই কোথাও লুকিয়ে আছে সে। যদি বলেন, সেই পুতুলটাই বা গেলো কোথায়? তার উত্তরও আমার জানা হয়ে গেছে, আমাদের ধোঁকা দেওয়ার জন্য এই প্রাসাদ ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় একটা পুতুল সে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে থাকবে।
গভীর ভাবে চিন্তা করার পর মাথা নেড়ে তার দিকে তাকালো লম্বার্ড, হ্যাঁ, মনে হচ্ছে। তুমিই ঠিকই বলেছে, তোমার যুক্তিটাই ঠিক। তুমি একজন জিনিয়াস ভেরা–
লজ্জায় আরক্ত হয়ে উঠলো ভেরার মুখ। আড় চোখে একবার লম্বার্ডকে দেখে নিয়েই মাথা নিচু করলো ভেরা। আসন্ন বিপদে তাদের মনের দূরত্ব কমেছে, এ ওর হৃদয়ের কাছাকাছি এসে পড়েছে কোন সময়ে, তা আর খেয়াল করতে পারে না কেউ।
ব্লোর কিন্তু তাদের কথা সরাসরি মেনে নিতে পারলেন না। মৃদু প্রতিবাদ করলেন, দ্বীপটা ছোট, আর এই ছোট্ট দ্বীপে তন্ন তন্ন করে আমরা খুঁজেছি তাকে। কিন্তু কোথাও তার অস্তিত্ব আমরা দেখতে পাইনি।
শুনুন মিঃ ব্লোর, ফুঁসে উঠলো ভেরা, পিস্তলটার খোঁজেও আমরা চিরুনী চেরা অভিযান চালিয়েছি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। অথচ পরে আবিষ্কার হলো, পিস্তলটা এই দ্বীপেই লুকনো ছিলো।
এবার লম্বার্ড মৃদু হেসে বললো, তুমি কিন্তভুল করছ ভেরা, পিস্তলের আকৃতি আর মানুষের আকৃতির মধ্যে ফারাক অনেক। এ দুটো ব্যাপার এক সঙ্গে গুলিয়ে ফেলার মতো বোকামো করো না।
আপনি যাই বলুন না কেন, মাথা দুলিয়ে বললো ভেরা, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই দ্বীপেই কোথাও লুকিয়ে আছে সে। এ রকম পাগল এর আগে আমি কখনো দেখিনি। কবিতায় যেমন লেখা আছে হুবহু সেই ভাবেই আমাদের দুজন সঙ্গীকে খতম করলো সে। দম আটকে মারলো মার্স্টানকে। চির ঘুমে পাড়িয়ে রাখলো মিসেস রগার্সকে। রগার্সকে গলাটা নামিয়ে দিলো ধড় থেকে আর মিস্ ব্লেন্টকে মারলো মৌমাছির হুল ফুটিয়ে। কি সাংঘাতিক ব্যাপার বলুন তো। আমাদের প্রাণ নিয়ে এ কি সর্বনাশ খেলায় মেতে উঠেছে ঐ খুনে লোকটা।
ভয় নেই, হাল্কা সুরে বললেন ব্লোর, এখানে কোথাও চিড়িয়াখানা নেই। তাই ভালুক /৫৪ আমদানি করে তাকে দিয়ে কাউকে মারতে খুনীকে যথেষ্ট কসরত করতে হবে। এই বলে হাসলেন তিনি শব্দ করে।
ভেরা তাকালেন ব্লোর-এর দিকে, কে বললে আপনাকে এখানে চিড়িয়াখানা নেই? গতকাল যে ভাবে আমরা রাত কাটিয়েছি তা তো পশুরই নামান্তর। আমরা পশু না হলে অমন সন্দেহ মানুষ মানুষকে কি করে করতে পারে?
তার সেই কঠিন কথাটা শুনে স্তব্দ বিমূঢ় হয়ে গেলেন ব্লোর।
সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পাহাড়ের চূড়ায় বসে এক নাগাড়ে আয়নায় সূর্যের রশ্মি ফেলতে গিয়ে পুরোপুরি ব্যর্থ হলো লম্বার্ড। চারিদিকে কুয়াশা তখন, সেই কুয়াশা ভেদ করে সে রশ্মি স্টিকলহ্যাভেন পর্যন্ত পৌঁছলো কিনা, তা সেখানকার লোকরাই বলতে পারে। তবে ওপার থেকে একখানা লঞ্চ দূরের কথা একখানা ডিঙি নৌকাও এগিয়ে এলো না তাদের উদ্ধার করার জন্য।
এরই মাঝে পলাতক ডঃ আর্মস্ট্রংকে খুঁজে বার করার জন্য সব রকম চেষ্টাই ব্যর্থ হলো। নিগার দ্বীপের ত্রিসীমানায় তার অস্তিত্ব দেখা গেলো না।
ব্যর্থ কাজের আবর্জনা সরিয়ে অন্য দুজন যখন কপালের ঘাম মুছে ফেলতে ব্যস্ত, ভেরা তখন অস্ফুটে বলে উঠলেন আমি আর প্রাসাদে ফিরে যাচ্ছি না। এখানে এই আকাশের নিচে উন্মুক্ত জায়গায় অনেক নিরাপদ।
কথাটা তুমি মন্দ বলো নি। তাকে সমর্থন করলো লম্বার্ড। এখানে থাকার সুবিধে হলো, চারিদিক খোলা, যেদিক দিয়েই খুনী আসুক না কেন, আমাদের দৃষ্টি এড়াতে পারবে না সে।
তাই বলে সারা রাত এখানে পড়ে থাকা যায় না, মাথা নাড়লেন ব্লোর। দিনের বেলায় সেখানেই থাকি না কেন রাতে একটা আস্তানা চাই বৈকি। তাই প্রাসাদে আমাদের ফিরে যেতেই হবে।
আপনারা যান, আমি যাবো না। ওই মৃত্যু পুরীতে, উঃ কি ভয়ঙ্কর ছিলো কালকের রাতটা, ভাবলে গায়ে কাঁটা দিয়ে দেয়, অজানা আতঙ্কে থরথর করে কেঁপে উঠলো ভেরা।
আমার চিন্তা শুধু রাতের জন্য নয়, মিঃ লম্বার্ড, ব্লোর বললেন, এখন আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে। পেটে কিছু না দিলেই নয়। আপনার কি অভিমত?
আ-আমি কি আবার বলবো। একটু ইতস্ততঃ করে কোনো রকমে বললো লম্বার্ড, আপনি যান, আমি বরং মিস ক্লেথনের সঙ্গে থেকে যাই।
ঠিক আছে, আপনারা এখানে থাকতে চাইছেন থাকুন। আমি আর বাধা দেবো না। ভেবেছিলাম, এখানে যে কদিন থাকি সবাই এক সঙ্গে থাকবো। তাছাড়া সত্যি কথা বলতে কি আমরা এখন কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছি না। যাই হোক লম্বার্ডের দিকে ফিরে ব্লোর বলেন, প্রাসাদে আমি এখন একাই থাকবো। দেখবেন পিস্তলের মুখটা যেন আমার দিকে ঘুরিয়ে দেবেন না, আপনার কাছে পিস্তলটা এখনো আছে। বিশ্বাসঘাতকতা করবেন নানা।
তারপর এক মুহূর্তও আর দাঁড়ালেন না তিনি সেখানে। তাঁর গমন পথের দিকে তাকিয়ে মুখ খারাপ করলো লম্বার্ড, একেবারে জানোয়ার। ক্ষিদে সহ্য করতে পারে না, পেটের টানে চললো এখন প্রাসাদে।
চিন্তায় পড়লো ভেরা, উনি একা গেলেন, কাজটা বোধ হয় ভালো করলেন না।
ভয় নেই, আর্মস্ট্রং এর হাতে কোনো অস্ত্র নেই। আর শক্তিতে ওঁরা দুজনেই সমান। যাই হোক প্রাসাদে আর্মস্ট্রং এর থাকার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। আমি জানি সেখানে নেই সে।
কিন্তু অন্য আর কি সমাধান হতে পারে? কাকেই বা সন্দেহ করা যেতে পারে?
কেন, ব্লোরকে।
ওঁ। আপনি কি সত্যিই তাই মনে করেন? শোনো ভেরা ক্লোরের কাহিনী তুমি তো শুনেছো। তোমাকে স্বীকার করতেই হবে, সেটা সত্য কাহিনী হিসাবে যদি ধরে নেওয়া হয়, তাহলে আর্মস্ট্রং এর নিরুদ্দেশ হওয়ার ব্যাপারে আমার কিছু করার নেই। তার কাহিনী আমার কাছে পরিস্কার। কিন্তু সেটা আর্মস্ট্রংকে ঠিক পরিস্কার করতে পারে না। আমার তার মুখ থেকে শুনেছি, পায়ের শব্দ শুনতে পেয়েছিল সে, সামনের দরজা দিয়ে একজন লোককে বেরিয়ে যেতে দেখেছে। সমস্ত ব্যাপারটাই মিথ্যে হতে পারে, সাজানো গল্প হতে পারে। হয়তো কয়েক ঘণ্টা আগেই আর্মস্ট্রংকে খতম করে এসেছিল সে নিজেই।
কিন্তু কেমন করে?
তা আমরা জানি না। লম্বার্ড তার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, তবে তুমি যদি আমাকে জিজ্ঞেস করো তাহলে বলবো একমাত্র বিপজ্জনক ব্যক্তি হলো ব্লোর। লোকটার সম্পর্কে আমরা কতোটুকুই বা জানি। সে তো নিজেই একজন পুলিশম্যান হিসাবে পরিচয় দিয়েছে। এ সব বানানো গল্প, হয়তো সে একজন উন্মাদ, জেদী ব্যবসায়ী, কিংবা সে রকম কিছু। যে কোনো অপরাধমূলক কাজ সে অনায়াসে করতে পারে। আর একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত, এ ধরনের অপরাধ যে কোনো লোকের সঙ্গে করতে পারে সে।
ফ্যাকাসে সাদা হয়ে গেলো ভেরার মুখ। এক নিঃশ্বাসে বললো সে ধরুন যদি সে তার নাগালের মধ্যে আমাদের পায়?
তার থেকে আমি অনেক বেশী সতর্ক, পকেটে রাখা রিভলবারের ওপর চাপড় মেরে কেমন কৌতূহলী চোখ নিয়ে ভেরার দিকে তাকালো লম্বার্ড। নরম গলায় বললো, আমার ওপর তোমার বিশ্বাস আছে, আছে না ভেরা? তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো আমি তোমাকে গুলি করবো না।
উত্তরে ভেরা বলে, একজন না একজন কাউকে বিশ্বাস তো করতেই হবে…..সত্যি কথা আর্মস্ট্রং–হঠাৎ তার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো ভেরা, আপনার কি মনে হয় না, একজন হা কেউ একজন সব সময় আমাদের উপর নজর রাখছে, খতম করার জন্য সুযোগের অপেক্ষা করছে?
ওটা তো তোমার নার্ভাসের লক্ষণ।
তাহলে আপনি সেটা অনুভব করেছেন? অনেক আগ্রহ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ভেরার গলা কেঁপে ওঠে। ঝুঁকে পড়ে লম্বার্ডের পাশে একটু ঘন হয়ে দাঁড়ালো ভেরা। বলুন, আপনি তা মনে করেন না? একবার আমি একটা গল্প পড়ি-দুই বিচারক একদিন আমেরিকায় ছোট্ট একটা শহরে এলো সুপ্রিম কোর্ট থেকে। তাদের বিচার হলো, একেবারে ন্যায্য বিচার যাকে বলে। কারণ তাদের সেই বিচারক তো এ জগতে ছিলেন না, তিনি ছিলেন……।
ভ্রু তুলে বললল লম্বার্ড, তার মানে তুমি বলতে চাইছে, বিচারক নেমে এসেছিলেন স্বর্গ থেকে এঃ? না, না ও সব আধ্যাত্মিক বা ঐশ্বরিক ক্ষমতায় আমি বিশ্বাসী নই। এ সব কাজ মানুষের পক্ষে যথেষ্ট।
নিচু গলায় বলে ভেরা জানেন এক এক সময়ে আমিও ঠিক নিশ্চিত হতে পারি না, মনে হয়……
তার দিকে চকিতে একবার তাকিয়ে তার মুখের কথাটা কেড়ে নিয়ে বললো লম্বার্ড। সেটা বিবেকের দংশন….কিছুক্ষণ নীরব থেকে শান্ত গলায় আবার বললো তার মানে আসলে তুমি সত্যিই ডুবিয়ে মেরেছিলে ছেলেটিকে?
না। না আমি তাকে হত্যা করিনি, আমি তাকে মারতে চাইনি। জোর দিয়ে বললো ভেরা, আমার এ কথা বলার কোনো অধিকার নেই।
লম্বার্ডের ঠোঁটে একটা সহজ সরল হাসি ফুটে উঠতে দেখা গেলো। হা, তুমি ঠিক তাই করেছিলে সোনামণি। তবে তার কারণ আমি জানি না। আর কল্পনাও করতে পারি না। তবে সম্ভবত এর মধ্যে একজন পুরুষ থেকে থাকবে। কে, কে সে?
হঠাৎ একটা পরিবর্তন অনুভব হলো ভেরার মধ্যে, তারা কারা মুখ ছেয়ে গেলো একটা চিন্তার ছায়া। ম্লান বিষণ্ণ গলায় বললো সে, হা, তার মধ্যে একজন পুরুষ ছিলো…
ধন্যবাদ, নরম গলায় বললো লম্বার্ড, হ্যাঁ এই কথাটাই আমি জানতে চেয়েছিলাম।
এই সময় হঠাৎ ভেরা উঠে দাঁড়িয়ে মৃদু চিৎকার করে বলে উঠলো, এ কি? ভূমিকম্প নাকি?
না, না, ভূমিকম্প টম্প নয়, উত্তরে বললো লম্বার্ড শব্দটা মনে হলো প্রাসাদের দিক থেকেই এলো। আমি ভাবলাম–আচ্ছা তুমি কোনো কান্নার শব্দ শুনতে পেয়েছো? আমি কিন্তু শুনেছি।
প্রাসাদের দিকে তাকালো তারা। হা ঐ প্রাসাদ থেকেই কান্নার আওয়াজটা যেন ভেসে এলো। চলো, প্রাসাদের দিকে যাওয়া যাক।
না, না আমি যাচ্ছি না।
তাহলে তুমি থাকো, আমি চললাম।
ভেরা তখন মরিয়া হয়ে বললো, ঠিক আছে, আমি আপনার সঙ্গে যাবো।
প্রাসাদে যাওয়ার ঢালু পথ দিয়ে এগিয়ে চললো তারা। প্রাসাদের সামনের উঠোনটা দুর থেকে বেশ শান্ত বলেই মনে হলো, দুপুরের রোদের আলো ঝলমল করছিল সেখানে। এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে একটু ইতস্তত করলো তারা। তারপর প্রাসাদে প্রবেশ না করে দেওয়ালে পিঠ দিয়ে হাঁটতে শুরু করলো।
আর তখনি তারা দেখতে পেলো ব্লোরকে। উঠানের পূর্ব দিকে হাত পা ছড়িয়ে চিত হয়ে পড়ে আছে সে, একটা ভারি সাদা মারবেল পাথরের আঘাতে থেঁতলে গেছে তার মাথাটা।
মাথা তুলে ওপরের দিকে তাকালো লম্বার্ড, তারপর জানালার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো সে, আমার ঠিক মাথার ওপরে ঘরটা কার বলো তো?
আমার, নিচু গলায় বললো ভেরা, ঘরের তাকে রাখা ঐ পাথরটা ঘড়ির খাপ……হ্যাঁ, এখন আমার মনে পড়েছে, সেটা দেখতে কতকটা ভালুকের মতো ছিলো।
ফিলিপস লম্বার্ড তার কাঁধ ঝাঁকালো। এখন বোঝা যাচ্ছে, ঐ প্রাসাদেই কোথাও লুকিয়ে আছে আর্মস্ট্রং। আমি চললাম তাকে খুঁজতে।
কিন্তু তাকে জড়িয়ে ধরলো ভেরা। প্রায় আর্তনাদ করে উঠলো সে। বোকামি করো না। তার কথায় অন্তরঙ্গতার সুর, এখন আমাদের পালা এর পর আমরা। আমরা খুঁজি, এটাই তো সে চায়। সে এখন মুহূর্ত গুনছে আমাদের জন্য। আমাদের খতম করতে পারলেই তার সব হিসেব শেষ।
থমকে দাঁড়ালো ফিলিপ। কি ভেবে বললো সে, এর মধ্যে কিছু একটা রহস্য অবশ্যই আছে।
সে যাই হোক, ভেরা বলেন, আমার অনুমান যে ঠিক, এখন তুমি নিশ্চয়ই স্বীকার করবে।
মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। হ্যাঁ, তোমারি জয়। হ্যাঁ, এ সব কাজ আর্মস্ট্রং এরই কিন্তু সেই শয়তানটা কোথায় বা নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে? আমরা তাকে চিরুণী খোঁজার মতো খুঁজেছি।
সে নিশ্চয়ই আগে থেকেই একটা গোপন আস্তানা ঠিক করে রেখেছিলো।
পুরনো প্রাসাদ হলে তবু কথা ছিলো।
তবু তারই মধ্যে যে তার লুকোবার জায়গাটা ঠিক করে নিয়ে থাকবে।
বেশ তো, লম্বার্ড বলে, সেই জায়গাটা আমি দেখতে চাই।
মৃদু চিৎকার করে উঠলো ভেরা, হ্যাঁ তা তো তুমি দেখবেই। আর কথাটা সে ও জানে বৈকি। সেখানে সে অপেক্ষা করছে তোমার জন্য।
পকেট থেকে রিভলবারটা অর্ধেক বার করে লম্বার্ড বলে, জানো, এটা এখনো আমার সঙ্গে আছে।
আর্মস্ট্রং এর থেকে ব্লোর, অনেক বেশী শক্তি ধরে, তুমিই তো বলেছিলে, দৈহিক শক্তি অবশ্যই ব্লোর এর ছিলো, অন্তত তাকে দেখে সেই রকমই তো মনে হতো। কিন্তু কেন বুঝতে চাইছে না, আসলে আর্মস্ট্রং উন্মাদ। একটা বদ্ধ পাগল। আর জানো তো পাগলরা সব সময় সুস্থ মানুষের থেকে শক্তিধর, সেটাই তাদের বাড়তি সুবিধে।
রিভলবারটা পকেটে আবার চালান করে দিয়ে লম্বার্ড বলে, তাহলে চলো।
অবশেষে বললো লম্বার্ড, রাত নামলো আমরা কি করবো। ভেবেছো কিছু?
উত্তর দেয় না ভেরা। লম্বার্ড নিজের থেকেই আবার জিজ্ঞেস করলো, সে কথা ভাবোনি তুমি?
অসহায়ার মতো বললো ভেরা, কিই বা করতে পারি আমরা? হে ঈশ্বর ভীষণ ভয় করছে আমার?
বেশি চিন্তা ভাবনা করেই বললো লম্বার্ড চমৎকার আবহাওয়া, চাঁদ উঠবে। পাহাড়ের চুড়ায় একটা নিরাপদ জায়গা খুঁজে নিতে হবে। সেখানে বসে রাতটা কাটিয়ে দিতে হবে। কেউ যদি আমাদের দিকে এগিয়ে আসে, আমি তাকে সঙ্গে সঙ্গে গুলি করবো।
থামলো সে। তারপর ভেরার দিকে ভালো করে তাকাতে গিয়ে বললো সে, ইস তোমার অমন হাল্কা পোষাকে ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে ভেরা?
ভেরার ঠোঁটে রহস্যময় হাসি। ঠাণ্ডা? মরে গেলে তো আরো বেশী ঠাণ্ডা হয়ে যাবে আমার শরীরটা।
হ্যাঁ, সে কথা সত্যি……শান্ত গলায় বললো লম্বার্ড। অস্থির ভাবে নড়েচড়ে উঠলো ভেরা।
এখানে আর বেশিক্ষণ বসে থাকলে সত্যি সত্যি আমি পাগল হয়ে যাবো। চলো এবার এগিয়ে যাওয়া যাক।
ঠিক আছে, চলো।
সমুদ্রের ধার দিয়ে উঁচু-নিচু পথ ধরে পাশাপাশি হেঁটে চললো তারা। পশ্চিম দিগন্তে সূর্য তখন ঢলে পড়তে শুরু করেছে। অপরাহ্নের সোনালী রোদটা কেমন যেন ম্লান বিষণ্ণ বলে মনে হলো।
হঠাৎ সমুদ্রের ঢেউগুলো গুণতে গিয়ে আক্ষেপ করে ভেরা বললো, দুঃখের কথা, সমুদ্রে স্নান করতে পারলাম না আমরা।
ফিলিপ তখন সমুদ্রের ধারে গভীর মনোযোগ সহকারে কি যেন নিরীক্ষণ করছিলো। হঠাৎ দ্রুত বলে উঠলো সে, ওখানে ওটা কি দ্যাখো তো? ঐ যে ঐ বড় পাথরটার কাছে?
স্থির চোখে সেদিকে তাকিয়ে বলে উঠলো ভেরা, কার যেন পোক বলে মনে হচ্ছে।
স্নানার্থী? হাসলো লম্বার্ড। মনে হয় সমুদ্রের কোনো জঞ্জাল টঞ্জাল কিছু হবে।
চলো, দেখাই যাক না জিনিসটা কি।
কাছেই যেতেই বলে উঠলো লম্বার্ড, তোমার অনুমানই ঠিক, ওগুলো কারোর পোষাকই বটে। আবার দেখছি, একজোড়া বুট জুতোও পড়ে রয়েছে। চলো, আর একটু তলিয়ে দেখা যাক।
সেই পাথরটার দিকে এগিয়ে চললো তারা। হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বললো ভেরা, আরে এ তো শুধু পোষাক নয়, পোষাকের আবরণে এ তো একজন মানুষ……
পাশাপাশি দুটি পাথরের মধ্যে পড়েছিলো লোকটা, ঢেউ-এর ধাক্কায় ভাসতে ভাসতে লোকটা বোধ হয় ঐ পাথর দুটির মাঝখানে আটকে পড়ে গিয়ে থাকবে।
এক সময় সেখানে গিয়ে হাজির হলো লম্বার্ড এবং ভেরা। হাঁটু মুড়ে ঝুঁকে পড়লো তারা। মুখে তার এক বিন্দু রক্তও ছিলো না, ফ্যাকাশে বিবর্ণ, জলে ডোবা মুখ, ফুলে ঢোল।
আর্ত চিৎকার করে উঠলো লম্বার্ড, হায় ঈশ্বর। এ যে দেখছি আর্মস্ট্রং…….।
.
১৬.
হঠাৎ সময়টা যেন থমকে দাঁড়ালো।…স্তব্দ মহাজাগতিক, সব কিছু যেন নিস্তব্দ। সময়ের চাকাটাও আর ঘুরছে না…..স্থির। অচল……যেন হাজার হাজার বছরের পথ চলার ক্লান্তিতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে পথের ধুলোয়।
না, সেটা কেবল মাত্র একটা কিংবা সেরকম কিছু…..
হাসি হাসি মুখ লম্বার্ডের। বললো সে, তাহলে শেষ পর্যন্ত, এই দাঁড়ালো, তাই না ভেরা?
উত্তর ভেরা বললো, এই দ্বীপে তুমি আর আমি ছাড়া আর কেউ রইলো না….।
বলাবাহুল্য। বললল লম্বার্ড, অতএব আমরা এখন জেনে গেছি, আমরা, এখন কোথায় তাই নয় কি?
তা সেই শ্বেতপাথরের ভল্লুকের কায়দাটা কি ভাবে কাজে লাগালে?
প্রিয়তমা, কায়দাটা অতি সহজ আর অত্যন্ত ভালোও বটে….
তাদের চার চোখের মিলন হলো আবার।
নিজের মনে ভাবলো ভেরা, আগে কেন আমি তার মুখটা ঠিক মতো চিনতে পারি নি? একাট নেকড়ে হা উপমাটা ঠিক তাই একটা নেকড়ে মুখ …তার সেই ভয়ঙ্কর দাঁতগুলো……।
মুখ খুললো লম্বার্ড, কর্কশ তার কণ্ঠস্বর বুঝি বা বিপজ্জনকও বটে তবে অর্থপূর্ণ।
এখানেই সব শেষ, বুঝলে।
আমরা এখন সত্যের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছি। আর এখানেই শেষ…..।
হ্যাঁ, আমিও তা বুঝেছি শান্ত ভাবে বললো ভেরা।
তারপর স্থির চোখে সমুদ্রের দিকে তাকালো সে। জেনারেল ম্যাকআর্থারও স্থির চোখে তাকিয়েছিলো সমুদ্রের দিকে। কখন, কেবল গতকালই?
কিংবা তার আগের দিন? সেও বলেছিলো, এখানেই সব শেষ…..।
কিন্তু ভেরার কাছে সেই কথাগুলো, সেই ভাবনাগুলো বিদ্রোহ জানালো তার মনে। না, এ কখনোই শেষ হতে পারে না।
নিচে সেই মৃত লোকটির দিকে তাকালো ভেরা। বললো সে বেচারা ডঃ আর্মস্ট্রং…..।
খিঁচিয়ে উঠে বললো লম্বার্ড, এ সব কি? মেয়েলী দরদ?
পাল্টা প্রশ্ন করলো ভেরা, কেন হবেনা? তোমার কোনো দয়া মায়া নেই?
উত্তরে বললল লম্বার্ড, তোমার জন্য আমার কোনো দয়া হয় না। আশাও করো না তুমি?
মৃতদেহটার দিকে আবার তাকালো ভেরা, ওর দেহটা জল থেকে আমাদের সরিয়ে দিতেই হবে। এসো, দুজনে আমরা ধরাধরি করে প্রাসাদ পর্যন্ত নিয়ে যাই।
কি দরকার? যেখানে আছে, নিশ্চিন্তে তাকে থাকতে দাও সেখানে।
যে ভাবেই হোক, তাকে তুলতেই হবে সমুদ্র থেকে।
হাসলো লম্বার্ড। ঠিক আছে, তুমি যা মনে করো–
নিচু হয়ে আর্মস্ট্রং-এর মৃতদেহে হাত দিলো সে। তাকে সাহায্য করার জন্য তার গায়ের ওপর ঝুঁকে পড়লো ভেরা। ভেরা তার সর্বশক্তি দিয়ে মৃতদেহটা তুলে ধরতে সাহায্য করলো লম্বার্ডকে।
জল থেকে ওপরে উঠাতেই হিমসিম খেয়ে গেলো লম্বার্ড। কাজটা খুব সহজ নয়।
যাই হোক, জল থেকে সমুদ্রতীরে মৃতদেহটা তুললো তারা কোনো রকমে। সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ভেরার দিকে তাকালো সে তুমি এখন সন্তুষ্ট তো?
হ্যাঁ যথেষ্ট বললো ভেরা।
ভেরার কথা বলার ধরণটা তাকে সতর্ক করে দিলো। ঘুরে দাঁড়ালো সে। এমন কি সে তার পকেটে হাত ঢোকাতেই টের পেয়ে গেলো, পকেট ফাঁকা, রিভলবার উধাও।
ভেরা তখন তার কাছে থেকে এক কিংবা দুগজ দুরে সরে গিয়ে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলো, হাতে রিভলবার।
মাথা নাড়লো ভেরা। শক্ত হাতে রিভলবারটা চেপে ধরলো সে। ফিলিপ লম্বার্ডের শিয়রে মৃত্যু। এর আগে কখনো এতো কাছে আসেনি মৃত্যু। আর এখনো পর্যন্ত হারও হয়নি তার।
হুকুম করার ভঙ্গিতে বললল লম্বার্ড, রিভলবারটা আমাকে ফেরত দাও। বলছি ফেরত দাও–
হাসলো ভেরা, তাচ্ছিল্যের হাসি।
এসো, আবার বললো লম্বার্ড, কাছে এসে রিভলবারটা আমার হাতে তুলে দাও বলছি।
ভেরাকে চুপ করে থাকতে দেখে তৎপর হলো লম্বার্ড, তার মস্তিষ্ক দ্রুত কাজ করে চলে। কথায় তাকে ভোলানো আর যাবে না, এখন কাজ, শুধু কাজ। কোন পথে, কি ভাবে এখন তার ভাবনা সেটাই। সারাটা জীবন ঝুঁকি নিয়ে এসেছে সে, সেই ঝুঁকিই নিলো সে এখানে।
শেষবারের মতো চেষ্টা করলো সে। ধীরে ধীরে শান্ত সংযত গলায় তাকে যুক্তি দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করলো, শোনো খুকী, মন দিয়ে আমার কথা শোনো–এবং তারপর হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠলো সে, কালো চিতার মতো, যেমন করে হিংস্র পশু ঝাঁপিয়ে পড়ে তার শিকারের ওপর।
আর তখনি রিভলবারের ট্রিগারটা টিপে ধরলো ভেরা যন্ত্রচালিতের মতো………।
নিশ্চল মুর্তির মতো লম্বার্ডের দেহটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কয়েক মুহূর্তের জন্যে, তারপর ভারি জিনিস পতনের মতো তার দেহটা পড়ে গেলো মাটির ওপর।
অতি সন্তর্পণে এগিয়ে গেলো ভেরা, হাতে তখনো তার সেই রিভলবারটা, সাবধানের মার নেই। কিন্তু অতো সাবধান হওয়ার প্রয়োজন ছিলো না।
ফিলিপ লম্বার্ড এখন মৃত। গুলিটা গিয়ে বিদ্ধ হয়েছিলো তার ঠিক হৃৎপিণ্ডে।
বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো ভেরা–এখন সে মুক্ত, স্বস্তি পেতে পারে, এখন মৃত্যু তাড়া করে ফিরবে না। অবশেষে সব ভয় কেটে গেলো।
আর ভয় নেই–তার নার্ভ ফেল করার কোনো কারণ আর রইলো না..।
দ্বীপে সে এখন একা, নিঃসঙ্গ, আর সঙ্গে আছে নয়টি মৃতদেহ। কিন্তু তাতেই বা কি এসে যায়? সে তত বেঁচে আছে…
বসলো সেখানে সে অত্যন্ত সুখে, অপার শান্তি বিরাজ করছে এখন তার সামনে…….কোনো ভয় নেই আর…..
সূর্য তখন অস্ত যেতে শুরু করেছে। লাল আভায় রাঙ্গায়িত পশ্চিম দিগন্ত। ভেরা তখন চলতে শুরু করলো। একটু আগের সেই ঘটনার আকস্মিকতায় চলার শক্তিটুকু যেন হারিয়ে ফেলেছিলো সে। তবে এখন সে অনেকটা নিশ্চিন্ত, নিজের নিরাপত্তা নিজে অর্জন করার আনন্দে বুঝি বা উজ্জীবিত।
এখন তার মনে হলো, খুব ক্ষুধার্ত, ঘুমও পাচ্ছে। সে এখন চায়, প্রাসাদে ফিরে গিয়ে ক্লান্ত শরীরটাকে তার বিছানায় এলিয়ে দেয়, তারপর শুধু ঘুম আর ঘুম……।
সম্ভবত আগামীকাল তারা আসবে এবং তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, এখানে থাকার জন্য তার কোন চিন্তাই নেই। এখন তার আর এই নিঃসঙ্গতা খারাপ লাগছে না। ওঃ এই নিবিড় একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতার মধ্যেই শান্তির পরশ অনুভব করতে পারছে। এটাই বোধহয় ঈশ্বরের আশীর্বাদ, একান্ত কাম্য ছিলো তার। চলতে চলতে এক সময় প্রাসাদের সামনে এসে ভালো করে তাকালো। এখানে এখন আর কোনো ভয় নেই, মৃত্যুর আশঙ্কা নেই। কোনো আততায়ী তার জন্য ওঁৎ পেতে বসে নেই এখানে। এখন নির্ভয়ে প্রাসাদের দিকে তাকিয়ে দেখতে পারে সে। অথচ একটু আগেও দিবালোকে এই প্রাসাদের দিকে ভালো করে তাকাতে পারেনি এক অজানা আশঙ্কায়, অজানা ভয়ে।
ভয়-ভয় জিনিসটা কেমন যেন অদ্ভুত…..।
যাইহোক, ভয়ের পর্ব এখন শেষ। ভয়টাকে সে জয় করেছে, মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে। উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে তার থেকে দ্বিগুণ শক্তিধর একজন পুরুষকে ঘায়েল যে সে করতে পেরেছে, এ জয়ের আনন্দ এখন তার কাছে সব চেয়ে বেশী বলে মনে হলো।
প্রাসাদের ভেতরে এগিয়ে চললো সে। অস্তগামী পাকা টমাটোর মতো লাল সূর্যটা তখন পশ্চিমের আকাশটাকে লাল ও কমলা রঙে রাঙ্গিয়ে তুলেছিলো। তার মধ্যে একটা সুন্দর শান্তির স্পর্শ অনুভব করলো সে।
সমস্ত জিনিসটাই হয়তো একটা স্বপ্ন ভাবলো ভেরা।
ক্লান্ত ভয়ঙ্কার ক্লান্ত সে এখন। শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে প্রচণ্ড ব্যথা যন্ত্রণা, চোখের পাতাগুলো বুজে আসছে। এখন আর ভয়ের কোনো চিন্তা নেই, নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারে সে।
নিজের মনে হাসলো সে। প্রাসাদের মধ্যেও যেন একটা অদ্ভুত শান্তি বিরাজ করছিলো।
সাধারণত, ভাবলো ভেরা, যেখানে প্রতিটি ঘরে মৃতদেহ পড়ে রয়েছে, প্রাসাদে সে ছাড়া অন্য কোনো জীবিত প্রাণীর অস্তিত্ব নেই, সেখানে কেউ ঘুমোতে চায় না, যদি মৃত্যু এসে বলে এবার তোমার পালা……।
রান্নাঘরের দরজার সামনে এসে থমকে দাঁড়ালো সে। টেবিলের মাঝখানে তখনো তিনটি পুতুল পড়েছিলো। হাসলো সে। নিজের মনেই বললো সে, মহাকালের সময় থেকে অনেক পিছিয়ে পড়েছে তোমরা।
টেবিলের ওপর থেকে দুটি পুতুল তুলে নিয়ে জানালা গলিয়ে বাইরে ফেলে দিলো সে। উঠানের পাথরের মেঝের ওপর শব্দ হতে শুনলো।
আমার সঙ্গে তোমরা আসতে পারো। প্রিয়, আমরা জিতে গেছি। আমরা জয়ী। বিড়বিড় করে নিজের মনে বললো সে।
দিনের আলো নিভে আসছে একটা আবছায়া অন্ধকারে ডুবেছিলো ঘরটা।
ভেরা, খুদে নিগারটা তার হাতে তালি দিলো তারপর সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করলো সে ধীরে ধীরে, কারণ হঠাৎ তার পা দুটো ভীষণ ক্লান্ত বলে মনে হলো।
একটা খুদে নিগার ছেলে একা থেকে গিয়েছিলো। কি করে শেষ হলো সেটা? ওহো, হা বিয়ে করে সে আর তারপর কেউ আর সেখানে ছিলো না…….।
বিবাহিত…মজার ব্যাপার, আশ্চর্য, হুগো যে সেই প্রাসাদে ছিলো, এ অনুভূতি কি করেই বা তার হলো……..?
অত্যন্ত বলিষ্ঠ তার সেই অনুভূতিটা। হা ওপর তলায় তার জন্য অপেক্ষা করছে হুগো। নিজেই নিজেকে বললো ভেরা, বোকামো করো না। তুমি এখন এমনি এতোই ক্লান্ত যে, যতো সব উদ্ভট চিন্তা এখন তোমার মনে জাগছে। এ সবই তোমার কল্পনা, এতটুকু মিল নেই বাস্তবের সঙ্গে।
ধীরে ধীরে উপরে উঠে চলে সে। সিঁড়ির একেবারে শেষ ধাপে উঠে আসার পর তার হাত থেকে কি যেন একটা পড়ে গেলো। রিভলবারটা যে তার হাত থেকে পড়ে গেলো নজরেই পড়লো না তার। তার লক্ষ্য এখন কেবল তার হাতের পুতুলটা, সেটাই এখন তার একমাত্র সঙ্গী, তার একাকীত্ব ঘোচানোর প্রতিকী।
প্রাসাদটা কি ভীষণ শান্ত। তবু, একেবারে ফাঁকা প্রাসাদ বলেও মনে হলো না….।
উপর তলায় তার জন্য অপেক্ষা করছে হুগো…।
একটা ছোট্ট, কালোমানিক এখনো অবশিষ্ট। সেই কবিতার শেষ লাইনটা কি যেন ছিলো? বিবাহিত হওয়া কিংবা সেই রকম কিছু একটা ব্যাপারে, তাই কি?
অবশেষে তার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো সে। ঘরের ভেতরে তার জন্য হুগো যে অপেক্ষা করছে। এ ব্যাপারে একেবারে নিশ্চিত সে। দরজা খুললো সে। হাঁপাচ্ছে সে। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো ভেরা….।
ওটা কি ঘরের ছাদ থেকে কি যেন ওটা ঝুলছে? দড়ির শেষ প্রান্তে একাট ফাস আগে থেকেই তৈরী? এবং নিচে একটা চেয়ার? উঠে দাঁড়াবার জন্য। চেয়ারটা লাথি মেরে সরিয়ে দেওয়া যাক।….. আর সেটাই তো চেয়েছিলো হুগো…হ্যাঁ, এবার মনে পড়েছে সেটাই তো কবিতার শেষ তিনটি লাইন….
শেষ কালো মাণিক, শেষ প্রাণের কোনো,
মনের দুঃখে দিল গলায় দড়ি,
বাকী রইলো না আর কেউ……।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে তার হাত থেকে পড়ে গেলো পুতুলটা। মাটিতে পড়ে গড়াতে গড়াতে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো। যন্ত্রচালিতের মতো সামনের দিকে এগিয়ে চললো ভেরা। এখানেই শেষ ঠাণ্ড, ভিজে হাতটা অবশ্যই সিরিলের, তার কণ্ঠনালী স্পর্শ করলো।
তুমি এখন ঐ পাহাড়টার কাছে যেতে পারো সিরিল।…..
এইভাবেই খুনটা সংগঠিত হয়েছিলো, কতোই না সহজ ছিলো সেই খুন। কিন্তু তারপর থেকেই স্মরণ করতে চেষ্টা করলো সেদিনের সেই ঘটনাটা…
আর নয়। সামনেই মৃত্যুর হাতছানি….
বিন্দুমাত্র বিলম্ব না করে চেয়ারের ওপরে উঠে দাঁড়ালো সে। ঘুমের ঘোরে, হাঁটার মত আধবোজা চোখে ছাদের দিকে তাকালো সে।…আশ্চর্য, তার হাত একটুও কাঁপলো না দড়ির ফাঁসটা নিজের গলায় পরিয়ে দিতে গিয়ে।
ঐ তো হুগো ওখানে দাঁড়িয়ে দেখলো, সে কি করলো, তাকে কি করতে হলো।
তারপর লাথি মেরে সে তার পায়ের তলা থেকে চেয়ারটা সরিয়ে দিলো……
স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার স্যার টমাস লেগ উত্তেজিত হয়ে বললেন সমস্ত ব্যাপরটাই অবিশ্বাস্য।
জানি স্যার, শ্রদ্ধার সঙ্গে বললো ইন্সপেক্টর মেইন।
অ্যাসিসট্যান্ট কমিশনার বলে চলেন, একটা দ্বীপে দশ দশটা মানুষ মারা গেলো, আর একজনও কেউ জীবিত রইলো না, আমার মাথায় কিছুই আসছে না।
অবিশ্বাস্য হলে, জোর দিয়ে বললো ইন্সপেক্টর মেইন, এটাই ঘটনা স্যার।
ও সব কথা রাখো। তেমনি উত্তেজিত হয়ে বললেন স্যার টমাস, কেউ না কেউ নিশ্চয়ই তাদের খুন করেছে।
সেটাই তো আমাদের সমস্যা স্যার।
ডাক্তারের রিপোর্ট থেকে কোনো হদিশ পাওনি?
না স্যার। ওয়ারগ্রেভ আর লম্বাৰ্ড গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। মিস ব্লেন্ট ও মার্স্টান মারা গেছে সায়নাইডের তীব্র বিষক্রিয়ায়। আর মিসেস রগার্স মারা গেছে অতিরিক্ত ঘুমের পিল খেয়ে, রগার্সের মাথাটা তার ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন। ব্লোরের মাথাটা কোনো ভারী জিনিসের আঘাতে থেতলে গেছে। জলে ডুবে মারা গেছে আর্মস্ট্রং। পিছন থেকে কোনো ভারী জিনিসের আঘাতে ম্যাকআর্থারের মাথার খুলি ভেঙ্গে যায়। আর তাতেই তার মৃত্যু হয়। আর সব শেষে গলায় দড়ির ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে থাকবে ভেরা ক্লেথর্ন।
যতো সব নোংরা ব্যাপার। মিনিট দুই চুপ করে থেকে উত্তেজিত স্বরে আবার বলে উঠলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার, তার মানে তুমি বলতে চাও, স্টিকলহ্যাভেনের লোকজনেদের কাছ থেকে কোনো সাহায্যই পাওনি তুমি? খোঁজ নিয়ে দ্যাখো, তারা নিশ্চয়ই কিছু না কিছু জানে।
সাধারণ মানুষ তারা, কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে ইন্সপেক্টর মেইন, সমুদ্রে বেড়াতে ভালোবাসে। তারা শুধু জানে, ওয়েন নামে একজন লোক ঐ দ্বীপটা কিনে ছিলো, এর বেশী কিছু নয়।
তা ঐ দ্বীপটা কে দেখাশোনা করে, আর কেই বা এ সব ব্যবস্থা করে থাকে?
মরিস, আইজ্যাক মরিস নামে একজন লোক।
এ ব্যাপারে তার কি অভিমত?
কিছুই সে বলতে পারবে না স্যার, কারণ সে তখন মৃত।
ভ্রু কুচকে উঠলো অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারের, এই মরিস লোকটা সম্পর্কে তুমি কিছু জানো?
হ্যাঁ স্যার, তাকে আমরা জানি। খুব একটা ভদ্র নয় সে। বছর তিনেক আগে সেই বেনিটোজের শেয়ার কেলেঙ্কারীর ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে সে, আমরা নিশ্চিত জানতাম, সে জড়িত ছিলো, কিন্তু আমরা সেটা প্রমাণ করতে পারিনি। তারপর ডোপের কারবারে মিশে যায় সে। সেক্ষেত্রেও তার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ আমরা খাড়া করতে পারিনি। জানেন স্যার, মরিস খুবই সাবধানী লোক।
আর এখানেও এই দ্বীপটা সংক্রান্ত ব্যাপারেও মরিস জড়িত ছিলো?
হ্যাঁ সার, এই দ্বীপটা বিক্রীর সঙ্গে সেও জড়িত, যদিও তৃতীয় পক্ষের হয়ে নিগার দ্বীপটা সে কিনেছে, সেটা পরিস্কার করে দিলেও ক্রেতার নাম সে প্রকাশ করেনি।
আর্থিক দিক থেকে সে কতো বেশী বলীয়ান সেটা আগে জানতে হবে, বুঝলে?
হাসলো ইন্সপেক্টর মেইন। আপনি মরিসকে চেনেন না স্যার। দেশের সব থেকে ভালো একজন চাটার্ড এ্যাকাউন্টেন্ডকে দিয়ে তার হিসাবের খাতাপত্র পরীক্ষা না করে দেখলে তার আর্থিক অবস্থাটা সঠিক জানা যাবে না। বেনিটোজ কারবারের তদন্ত করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, তার কর্মচারীরা তাদের মালিকের মতোই চতুর ও ধুরন্ধর।
ইন্সপেক্টর মেইন বলে চলে, স্টিকলহ্যাভেনের সব ব্যবস্থাই করে এই মরিস লোকটা তাদের বলে, এই নির্জন দ্বীপে মানুষ বসবাসের পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতে যাচ্ছে তারা এক সপ্তাহের জন্য। আর সে তাদের এও বলে সেখান থেকে কোনো সাহায্যের আবেদন এলে তারা যেন নজর না দেয়।
অস্বস্তিবোধ করলেন স্যার টমাস লেগ, তার মানে তুমি বলেত চাইছো সেই সব লোকগুলো তার ঐ ধরনের কথায় একটুও সন্দেহ প্রকাশ করেন নি। তার সবকথা তার এক কথায় বিশ্বাস করে নিলো?
ভুলে যাচ্ছেন স্যার, আগে এই নিগার দ্বীপের মালিক ছিলেন একজন আমেরিকান যুবক এলমার বোরসন। সেখানে তিনি প্রায়ই একটা না একটা পার্টি দিতেন। সেই সব পার্টি দেখতে দেখতে তাদের গা সওয়া হয়ে গিয়েছিলো। তাই তারা ধরে নিয়েছিলো, বিত্তবানের ব্যাপারে তাদের মাথা না ঘামানোই উচিৎ। আর এই কারণেই বোধহয় মরিসের সেই উপদেশ শুনে কোনো সন্দেহ জাগেনি তাদের মনে। এদিকটার কথাও আপনাকে ভেবে দেখতে হবে স্যার।
তার যুক্তিটা মেনে নিলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার।
মেইন আরো বলে, ফ্রেড নারাকট তার লঞ্চে করে এই দশজন লোককে সেই দ্বীপে পৌঁছে দিয়ে যান। সেই নারাকট একটু অদ্ভুত কথা শুনিয়েছে। সে বলেছে, সেই লোকগুলোকে দেখে একটু আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলো সে। মিঃ বোরসনের পার্টির লোকদের মতো ঠিক নয়। লোকগুলো কেমন সরল ও সাধারণ মানুষের মতো, মনে হয়েছিল তার, সেই সঙ্গে একটা চিন্তাও জেগেছিলো, তার মনে। আর বোধহয় সেই কারণেই বোধ হয় এস. ও. এস সিগনাল পাওয়ার পরেই মরিসের সব উপদেশ উপেক্ষা করে একটুও দেরী না করে সে তার লঞ নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলো নিগার দ্বীপের দিকে।
সে আর অন্য লোকে কবে সেখানে গিয়েছিলো?
এগারো তারিখ সকালে স্টিকলহ্যাভেন একদল স্কাউটের চোখে পড়ে সেই সংকেত। সেইদিন যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিলো না। তাই বারো তারিখের আগে সেই দ্বীপে যাওয়া সম্ভব হয়নি।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার জিজ্ঞেস করলেন, প্রাসাদে যে গ্রামোফোন রেকর্ডটা তুমি পেয়েছিলে, সেটার কি খবর? ওটা থেকে কোনো ক্লু কিংবা সাহায্য পেলে না?
উত্তরে ইন্সপেক্টর মেইন বলে ওটা নিয়েও আমি মাথা ঘামিয়েছি। সেই রেকর্ডটা যে কোম্পানি সরবরাহ করেছিলো, তারা সিনেমা ও থিয়েটারের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম তৈরী করে থাকে। রেকর্ডটা আইজ্যাক মরিসের ঠিকানায় মিঃ ইউ. এন. ওয়েনের কাছে পাঠিয়ে দেয় তারা। তাদের বলা হয়েছিলো সখের থিয়েটারে সেই রেকর্ডটা নাকি ব্যবহার করা হবে। টাইপ করা স্ক্রিপটা রেকর্ডের সঙ্গেই ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
লেগ জিজ্ঞেস করলেন, তা সেই রেকর্ডটার বিষয়বস্তুই বা কি ছিলো?
সেই প্রসঙ্গে আম আসছি স্যার, গম্ভীর হয়ে বললো ইন্সপেক্টর মেইন। গলা পরিস্কার করে আবার বলতে শুরু করলো সে, সমস্ত অভিযোগের ব্যাপারে যতদূর সম্ভব আমি খোঁজখবর নিয়েছি। প্রথমে রগার্স দম্পতিদের কথা দিয়েই শুরু করা যাক। ওরাই সর্ব প্রথম সেই দ্বীপে এসে পৌঁছায়। আগে ওরা মিস ব্র্যান্ডির বাড়িতে কাজ করে? মিস্ ব্র্যান্ডি হঠাৎ মারা যান। তার চিকিৎসকের কাছ থেকে তেমন কিছুই জানা যায়নি। সে বলে, রগার্স দম্পতি অবশ্যই তাকে বিষ খাওয়ায়নি। কিংবা সেরকম কিছু করেনি, কিন্তু তার ব্যক্তিগত বিশ্বাস হলো, মিস্ ব্র্যান্ডির হঠাৎ মৃত্যুটা কেমন যেন একটু গোলমেলে হয়তো তাদের তরফ থেকে অবহেলা করার দরুণই তার অসময়ে মৃত্যু ঘটে। সে আরো বলে, তবে এই অভিযোগ প্রমাণ করা অসম্ভব ব্যাপার।
এরপর বিচারপতি ওয়ারগ্রেভের প্রসঙ্গে আসা যাক। তিনি ছিলেন বিচারপতি, ঠিক আছে। তার এই বিচারপতিই সিটনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন। প্রসঙ্গক্রমে বলা যেতে পারে, সিটন ছিলেন প্রকৃত অপরাধী, তাকে অপরাধী সাব্যস্ত করার মধ্যে কোনো ভুল নেই। ফাঁসির পরে অবশ্য সেটা নিয়ে কথা ওঠে, কিন্তু তার আগে সাক্ষ্য প্রমাণ থেকে দেখা যায়, তার অপরাধ ছিলো সন্দেহাতীত। তখনকার সময়ে দশজন লোকের মধ্যে নজনেরই ধারনা ছিলো, সিটন ছিলো নিরপরাধ। এবং বিচারপতির রায়টা ছিলো প্রতিহিংসা নেওয়ার জন্য।
ক্লেথর্ন মেয়েটির খোঁজখবর নিতে গিয়ে আমি দেখেছি। সে ছিলো একটি পরিবারের গভর্নের্স, আর সেই পরিবারের একজন জলে ডুবে মারা যায়। সেই শিশুটিকে স্নান করাতে নিয়ে যায় সে সমুদ্রে। যাই হোক, এর জন্য তাকে অবশ্য দোষ দেওয়া যায় না। সত্যি কথা বলতে কি ভালো আচরণই করেছিলো সে শিশুটির সঙ্গে তাকে উদ্ধার করার জন্য সাঁতার কেটে এগিয়েও গিয়েছিলো সে। কিন্তু তার দুর্ভাগ্য সমুদ্রের ভয়ঙ্কর স্রোতের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে নি সে, ভেসে গিয়েছিলো শিশুটি।
বলে যাও, দীর্ঘশ্বাস ফেললেন অ্যাসিসট্যান্ট কমিশনার।
হাঁপিয়ে উঠেছিলো মেইন বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে সেই আবার বলতে শুরু করলো, এবার ডঃ আর্মস্ট্রং এর কথা বলি। বহু পরিচিত লোক তিনি। হারলে স্ট্রীটের চেম্বারে তার ভালো পসার ছিলো। তিনি তার পেশায় কোনো অবৈধ কাজকর্ম যে করেছিলেন, সে রকম কোনো রেকর্ড নেই। তবে এ কথা সত্যি যে, ১৯২৫ সালে লেইথামার হাসপাতালে ক্লিজ নামে একটি মেয়েকে অপারেশন করেছিলেন তিনি, অপারেশন টেবিলেই মারা যায় সে। হয়তো তার খুব বেশী অভিজ্ঞতা না থাকার দরুণ অপারেশনে তেমন দক্ষ ছিলেন না তিনি প্রথম জীবনে, তবে এর জন্য কখনোই তাকে অপরাধী হিসাবে সাব্যস্ত করা যায় না। আর অবশ্যই এই মৃত্যুর পিছনে তার কোনো মোটিভ খুঁজে পাওয়া যায় না।
তারপরে মিস্ এমিলি ব্লেন্টের প্রসঙ্গে আসা যাক। বেট্রিস টেইলর নামে এক যুবতী কাজ করতো তার বাড়ীতে। গর্ভবতী হয়ে পড়ে মেয়েটি অবৈধ প্রণয়ে। তাকে বাড়ি থেকে বিতাড়িত করলেন মিস্ ব্লেন্ট, সে তখন জলে ডুবে আত্মহত্যা করলো। ব্যাপারটা ভালো না হলেও মেয়েটির মৃত্যুর জন্য কোন ক্রমেই অভিযুক্ত করা যায় না তাকে।
মেইন তার তালিকা দেখে পড়তে শুরু করলো, তরুণ মার্স্টান ছিলো বেপরোয়া গাড়ি চালক। দু-দুবার ড্রাইভিং লাইসেন্স বাতিল করে দেওয়া হয়েছে, আমার মতে তার গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ করে দেওয়া উচিৎ। তার শাস্তি এ রকমই হওয়া প্রয়োজন। কেম্রিজের রাস্তায় দুটি বাচ্চা ছেলে জন কোম্ব ও লুসি কোম্বাসকে চাপা দেয় সে। তার স্বপক্ষে তার কয়েকজন বন্ধু বান্ধব সাক্ষ্য দেয় আদালতে, আর তাতেই জরিমানার হাত থেকে রেহাই পেয়ে যায় সে।
ওদিকে তদন্ত করে জেনারেল ম্যাকআর্থারের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পাওয়া যায় নি। চমৎকার তার সার্ভিস রেকর্ড। আর্থার রিচমন্ড তার অধীনে কাজ করতো, যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যায় সে। জেনারেলের সঙ্গে তার কোনো বিরোধ ছিলো না। সত্যি কথা বলতে কি তারা দুজন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলো।
তা হতে পারে, বললেন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার।
এখন ফিলিপস লম্বার্ডের কথায় আসি। বিদেশে সন্দেহভাজন লোকদের সঙ্গে তার মেলামেশা ছিলো। জেলও খেটেছে বার দুয়েক। ভয়ঙ্কর ছিলো না, একটু বেপরোয়া স্বভাবের লোক ছিলো সে। সেই সঙ্গে তার একটু অহঙ্কারও ছিলো। তার পক্ষে খুন জখম করাটা অস্বাভাবিক নয়।
তারপর ব্লোর-এর কথা বলি, একটু ইতস্ততঃ করে মেইন বলে দশজনের একমাত্র সেই বাকী থাকে।
ব্লোর। জোর দিয়ে বললেন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার, সেই শয়তানটা না?
আপনিও কি তাই মনে করেন স্যার?
সব সময়েই আমি তাই মনে করি, বললেন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার, লোকটা দারুন ধুরন্ধর। ধরা ছোঁয়ার বাইরে। আমার ধারণা ল্যান্ডরের মামলায় তার কোনো কারচুপি ছিল নিশ্চয়ই। সেই সময় খুব একটা খুশি হতে পারিনি আমি। আবার আমার কিছু করারও ছিলো না। হ্যারিসকে কাজে লাগালাম। কিন্তু সেও কোনো কাজ করতে পারলো না। কিন্তু তখনো আমার বিশ্বাস, তাকে ধরার মতো ঠিক মতো ফঁদ পাততে পারলে, ও ভাবে সে আমাদের কলা দেখিয়ে পার পেয়ে যেতে পারতো না। সহজ প্রকৃতির লোক ছিলো না সে। একটু থেমে জিজ্ঞেস করলেন স্যার টমাস লেগ, তুমি বলছো আইজ্যাক মরিসও মারা গেছে? তা সে কবে মারা গেলো?
ভেবেছিলাম, আপনি নিশ্চয়ই এ প্রসঙ্গে আসবেন স্যার। হ্যাঁ ৮ই আগস্ট রাতে মারা যায় সে। অতিরিক্ত ঘুমের পিল খাওয়ার দরুনই তার মৃত্যু ঘটে। তার সেই মৃত্যুটা আত্মহত্যা, নাকি দুর্ঘটনা ঠিক বোঝা যায় না।
আমার কি ধারণা জানো মেইন?
সম্ভবত আন্দাজ করতে পারি স্যার।
আর যাই হোক, দারুন উত্তেজিত হয়ে বললেন লেগ, মরিসের মৃত্যুতে একজনের খুব সুবিধে হয়েছে।
মাথা নেড়ে তার কথায় সার দিয়ে বললো ইন্সপেক্টর মেইন, আমি জানতাম স্যার, আপনি ঠিক এই কথাই বলবেন।
টেবিলের ওপর ঘুষি মেরে অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার বলে উঠলেন উত্তেজিত হয়ে সমস্ত ব্যাপারটাই অদ্ভুত অবিশ্বাস্য। পাহাড়ে ঘেরা একটা ছোট্ট দ্বীপে দশজন লোক মারা গেলো, অথচ আমরা জানতেও পারলাম না, এর জন্য দায়ী কে, কিংবা কেনই বা হত্যা করা হলো, আর কি ভাবেই বা।
কেশো গলা পরিস্কার করে বললো মেইন, ভালো কথা স্যার, ব্যাপারটা আসলে ঠিক সেই রকম নয়। একজন বিকারগ্রস্ত লোক নিজের হাতে বিচারের ভার তুলে নিলো। আইনের চোখে ধরা ছোঁয়ার বাইরে এমনি দশজন লোককে সংগ্রহ করে সে তারা প্রকৃত অপরাধী নাকি নিরপরাধ, তাতে কিছু এসে যায় না।
স্থির চোখে তাকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বললেন লেগ, তাই নয় কি? আমারো তাই মনে হয়–
চুপ করে গেলো মেইন। সম্মান দেখানোর জন্য তামাশা করতে থাকলো সে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়লেন লেগ।
বলে যাও বললেন তিনি এক মিনিট, ভাবলাম বুঝি বা কোনো ক্ল পেয়ে গেলাম। হারিয়ে গেলো সেটা, বলল, কি যেন বলেছিলে তুমি?
মেইন আবার বলতে শুরু করলো, ধরে নেওয়া যাক, দশজন লোকের বিচার হওয়ার কথা ছিলো। ইউ. এন. ওয়েন তার কাজ শেষ করে যে ভাবেই তোক সেই দ্বীপ থেকে হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়ে থাকবে।
এ যে দেখছি চমৎকার ভোজবাজির খেলা। কিন্তু তুমি তো জানো মেইন, এর একটা ব্যাখ্যা থাকা চাই, যুক্তি থাকা চাই।
স্যার আপনি হয়তো ভাবছেন, লোকটা যদি দ্বীপে না গিয়েই থাকে তাহলে তার সেই দ্বীপ থেকে তার উধাও হয়ে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। অথচ সেখানকার স্থানীয় অধিবাসীদের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেই দ্বীপে আদৌ সে যায় নি। অতএব এর একমাত্র ব্যাখ্যা হলো, খুনী ঐ দশজনের মধ্যেই একজন।
মাথা নাড়লেন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার। আন্তরিক ভাবে বলতে থাকে মেইন
হ্যাঁ, সে কথাও আমরা ভেবেছি স্যার। আমরা এর গভীরে প্রবেশ করার চেষ্টা করেছি। শুরুতেই বলে রাখি, নিগার দ্বীপে ঠিক কি ঘটেছিল, এ ব্যাপারে আমরা একেবারে অন্ধকারে পড়ে নেই। ভেরা ক্লেথর্ন ডায়েরী লিখতো এবং এমিলি ব্লেন্টও। বৃদ্ধ ওয়ারগ্রেভ কিছু নোট লিখে যায়-রসক ঘীন, আইন মাফিক, রহস্যজনক, তবে যথেষ্ট সহজবোধ্য। এবং ব্লোরও কিছু নোট লিখে ছিলো। তবে এই সব ডায়েরী ও নোটের অথ্যগুলোর মধ্যে মোটামুটি ভাবে মিল আছে একটার সঙ্গে একটার। মৃত্যুগুলো হয়েছিলো এই ভাবে, মার্স্টান, মিসেস রগার্স, ম্যাকআর্থার, রগার্স, মিস ব্লেন্ট, ওয়ারগ্রেভ। ভেরা ক্লেথনের ডায়েরী থেকে আমরা জানতে পারি, রাতের অন্ধকারে প্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে যায় আর্মস্ট্রং তারপর তাকে অনুসরণ করে ব্লোর ও লম্বার্ড তার খোঁজে। ব্লোরের নোটবইতে একটা নোট লেখা ছিলো, স্রেফ দুটি অক্ষরে-আর্মস্ট্রং নিরুদ্দেশ।
স্যার, এখন সব দিক বিবেচনা করে এর থেকে মনে হয়, এখানে আমরা একটা ভালো সমাধান খুঁজে পেতে পারি। আপনার মনে আছে, জলে ডুবে মারা যায় আর্মস্ট্রং। ধরে নিলাম, আর্মস্ট্রং তখন পাগল হয়ে যায়–হওয়ারই তো কথা, সবাইকে অমন নৃশংস ভাবে খুন করলেও কারোরই বা মাথার ঠিক থাকে বলুন। আর আর্মস্ট্রং খুনী হলেও সেও তো রক্ত মাংসে গড়া মানুষ। তাই মাথা ঠিক না থাকার ফলে বিবেকের দংশনে পাহাড়ের চুড়া থেকে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে থাকবে, কিংবা সমুদ্রে সাঁতার কেটে সে তার দেশে পালিয়ে আসতে গিয়ে গভীর জলে তলিয়ে গিয়ে থাকবে। আর তাতেই তার মৃত্যু ঘনিয়ে এসে থাকবে।
সমাধানের সূত্রটা ভালো, কিন্তু ধোপে টিকবে না। না, স্যার তা হয় না। প্রথমেই পুলিশ সার্জেন্টের সাক্ষ্য দেখুন। ১৩ই আগস্টের সকালে সেই দ্বীপে গিয়ে হাজির হয় সে। আমাদের সাহায্যে লাগাতে পারে এমন বিশেষ কোনো তথ্য আমরা দেখতে পাই না। তার রিপোর্টে তার বলার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো তাদের সবার মৃত্যু ঘটে কম করেও অন্তত ছত্রিশ ঘণ্টার মধ্যে। তবে আর্মস্ট্রং সম্পর্কে একেবারে নিশ্চিত সে। সে বলেছে, আর্মস্ট্রং এর দেহ জলে ভেসে যাওয়ার আগে আট দশঘণ্টা জলের মধ্যে ছিলো সে। এর থেকে এখন ধরে নেওয়া যেতে পারে রাত দশটা এগারোটার সময় প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে গিয়ে থাকবে আর্মস্ট্রং, কেন এমন হলো। দেহটা যেখানে ভেসে যায়, সেই জায়গাটা আমরা দেখেছি দুটো পাথরের মাঝখানে মৃতদেহটা আটকে গিয়ে থাকবে, সেখানে তার পোষাকের কিছু অংশ, চুল ইত্যাদি ছড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। ১১ তারিখের রাত এগারোটা নাগাদ মৃতদেহটা নিশ্চয়ই সেখানে ভেসে এসে থাকবে সামুদ্রিক ঝড়ের টানে। তারপর ঝড় থেমে যায়, সমুদ্রের উত্তাল ঢেউও তখন শান্ত স্তিমিত, আর জলও তখন সমুদ্র তীর থেকে অনেক নিচে নেমে গিয়ে থাকবে।
আপনি হয়তো বলতে পারেন, এটা আমার ধারণা, সমুদ্রে যাওয়ার আগে তিনজনকে শেষ করে গিয়ে থাকবে আর্মস্ট্রং। কিন্তু তা নয় এই যুক্তিতে যে, সমুদ্রের ধার থেকে আর্মস্ট্রং এর মৃতদেহ অশান্ত সমুদ্র থেকে টেনে তুলে নিয়ে আসা হয় ওপরে। নরম বালির ওপর তার মৃতদেহ টানাটানির স্পষ্ট দাগ আমরা দেখেছি বালির ওপর। অতএব একটা ব্যাপারে আমি একেবারেই নিশ্চিত, আর্মস্ট্রং এর মৃত্যুর পর একজন কিংবা দুজন অবশ্যই জীবিত ছিলো তখন।
একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলো সে; আর এর থেকে ঠিক কি মনে হয় জানেন স্যার ১১ তারিখের সকালের অবস্থা এইরকম–আর্মস্ট্রং নিরুদ্দেশ (জেলে ডুবে যায়)। তখনও তিনজন লোক বেঁচে ছিলো; লম্বার্ড, ব্লোর এবং ভেরা ক্লেথর্ন। লম্বাৰ্ড গুলিবিদ্ধ, তার মৃতদেহ আর্মস্ট্রং এর কাছে সমুদ্রের ধারে পড়ে ছিল। ভেরা ক্লেথর্নকে তার শয়নকক্ষে গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলতে দেখা যায়। ব্লোর এর মৃতদেহ উঠানে পড়ে থাকত দেখা যায়, তার মাথাটা থেঁতলানো ভারী পাথরের আঘাতে হবে হয়তো, আর পাথরটা যে ওপরের জানালা গলিয়ে ফেলা হছেছিল সেটা অনুমান করে নেওয়ার স্বপক্ষে যথেষ্ট যুক্তি আছে।
তা সেটা কার ঘরের জানালা? সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার।
ভেরা ক্লেথর্নের। এখন স্যার, তাদের প্রত্যেকের ব্যাপারটা আলাদা আলাদা ভাবে বিশ্লেষণ করা যাক। প্রথমে ফিলিপ লম্বার্ড থেকে শুরু করছি। ধার নেওয়া যাক মিস ক্লেথনের ঘরের জানালা গলিয়ে পাথর ফেলে ব্লোরকে হত্যা করেছে লম্বার্ড। তারপর ভেরাকে ঘুমের পিল খাইয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন করে তার গলায় ফাঁস লাগিয়ে দেয়। সবশেষে সমুদ্রতীরে গিয়ে নিজেই নিজেকে গুলিবিদ্ধ করে থাকবে।
কিন্তু তাই যদি হয়, তার কাছ থেকে রিভলবারটাই বা কে নিয়ে গেলো? কারণ প্রাসাদের দোতলায় ওয়ারগ্রেভের ঘরের ভেতরে রিভলবারটা পড়ে থাকতে দেখা যায়।
রিভলবারের ওপর কার হাতের ছাপ ছিলো?
হ্যাঁ, স্যার ভেরা ক্লেথর্নের।
কিন্তু লম্বার্ড তখনো জীবিত ছিলো–
স্যার, আপনি কি বলতে চাইছেন জানি, ভেরা ক্লেথই খুনী এই তো। লম্বার্ডকে গুলিবিদ্ধ করার পর রিভলবারটা হাতে নিয়ে প্রাসাদে ফিরে যায় সে, মার্বেল পাথরটা ব্লোর এর ওপর নিক্ষেপ করার পর নিজে সে তার গলায় ফাঁস লাগায়।
এই পর্যন্ত সব ঠিক আছে। তার শয়নকক্ষে একটা চেয়ারের ওপর শ্যাওলার ছাপ পাওয়া যায়, এবং তার জুতোতেও দেখে মনে হয়, সে তার গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়ার জন্য সেই চেয়ারটা ব্যবহার করে থাকবে। চেয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে গলায় ফাঁস লাগানোর কাজ শেষ হওয়ার পরেই পা দিয়েই চেয়ারটা সরিয়ে দেয় এবং ঝুলে পড়ে সে।
কিন্তু চেয়ারটা ছুঁড়ে ফেলার মতো অবস্থায় ছিলো না। অন্য সব চেয়ারগুলোর মতো সেই চেয়ারটাও সযত্নে দেওয়ালের পাশে হেলান দিয়ে রাখা ছিলো। ভেরা ক্লেথনের মৃত্যুর পরে সেই কাজটা অন্য কেউ করে থাকবে।
এরপর স্বভাবতই আমাদের সব সন্দেহ গিয়ে পড়ে ক্লোরের ওপর। তবে এর মধ্যেই একটা কিন্তু থেকে যায়, আপনি যদি বলেন, লম্বার্ডকে গুলি বিদ্ধ করে ভেরা ক্লেথর্নকে আত্মহত্যা করতে প্ররোচিত করার পর প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে যায় সে, তারপর উঠোনে নেমে একটা ভারী মার্বেল পাথরের আঘাতে নিজেই নিজেকে হত্যা করেছে সে। সেক্ষেত্রে আপনার কথা আমি বিশ্বাস করবো না। আপনার এ যুক্তি আমি মেনে নিতে পারি না। কারণ পুরুষরা এভাবে কখনো আত্মহত্যা করতে পারে না। তাছাড়া সে ধরনের মানুষই ছিলেন না ব্লোর। ব্লোরকে আমরা বেশ ভালো করে জানি ন্যায় বিচার নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো লোক সে কোনদিনও ছিলো না।
এ ব্যাপারে, বললেন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার, আমি তোমার সঙ্গে একমত।
ইন্সপেক্টর মেইন তখন বলে, তাহলে স্যার, এর থেকে ধরে নেওয়া যেতে পারে, ঐ দ্বীপে নিঃশ্চয়ই অন্য আর কেউ তখন জীবিত ছিলো। সমস্ত ব্যাপারটা শেষ হয়ে যাওয়ার পর যে কিনা সব কিছু ভালো করে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখে গেছে। কিন্তু এখন কথা হচ্ছে, এতো সব ঘটনা ঘটে যাওয়ার সময় কোথায় ছিলো সে, আর কোথায়ই বা যেতে পারে সে? অথচ স্টিকলহ্যাভেনের লোকেরা সম্পূর্ণ নিশ্চিত যে, উদ্ধারকারী দল সেই দ্বীপে পৌঁছানোর আগে সেখানে থেকে কেউই চলে যেতে পারে না। কিন্তু সে ক্ষেত্রে আবার থামলে সে এখানে।
সেক্ষেত্রে, জিজ্ঞেস করলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার, কি হতে পারে?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা দোলালো সে। তারপর সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বললো, কিন্তু সে ক্ষেত্রে কে, কে তাদের খুন করলো?
এমমা জেন জেলে ডিঙির মালিক স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে যে মূল্যবান নথিটি পাঠিয়েছিল সেটা এখানে তুলে ধরা হলো।
যৌবনের শুরু থেকেই আমি বুঝে গেছি, আমার প্রকৃতি রাশি রাশি বিতর্কে ভরা। তাহলে প্রথম থেকেই শুরু করি, সংশোধনের অসাধ্য একটা রোমান্টিক ভাবপ্রবণতা। এই যে বোতলবন্দী করে একটা অতি প্রয়োজনীয় নথি সমুদ্রে ফেলে দেওয়া, এর মধ্যে একটা অদ্ভুত রোমাঞ ছিলো, ভেতরের অভিযানের কাহিনী গুলো, যখন কেউ পড়বে তার সেই শিশুসুলভ মনোভাবটা কল্পনা করার মধ্যে একটা অন্য মাদকতা আমি অনুভব করতে পারছি। আমার মনে রোমাঞ জাগায় আর সেই কারণেই আমি অবলম্বন করি এই পন্থাটা স্বীকারোক্তি লেখা, সেটা বোতলবন্দী করা, পরে বোতলের মুখটা সীল করে সমুদ্রের ঢেউতে ভাসিয়ে দেওয়া। আমার ধারণা আমার এই স্বীকারোক্তি কারোর না কারোর হাতে গিয়ে পড়বে। (আবার নাও পড়তে পারে) এবং তারপর (কিংবা আমি কি নিজেই নিজের ঢাক পেটাচ্ছি?) মানুষ নিগার দ্বীরে সেই অনির্ণীত হত্যা রহস্যের ব্যাখ্যা খুঁজে পাবে।
রোমান্টিকতার সঙ্গে আরো একটি বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমি জন্মাই। মৃত্যু দৃশ্য দেখা কিংবা মৃত্যু ঘটানোর মধ্যে অবশ্যই আমার একটা পাশব প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার প্রবণতা ছিলো, সেই নিষ্ঠুরতার মধ্যে একটা অদ্ভুত রোমা অনুভব করতাম আমি তখন। মনে আছে ছেলেবেলায় বাগানের পোকা মাকড় মেরে দারুণ মজা পেতাম। সেই ছেলেবেলা থেকেই খুনের নেশায় পেয়ে বসলো আমাকে।
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একটা বৈপরীত্যও এসে ভর করলো আমার সেই খুনের নেশার মধ্যে। ন্যায় বিচারের একটা বলিষ্ঠ প্রবণতা দেখা দিলো। নিরপরাধ ব্যক্তি আমার হাতে প্রাণ হারাবে, এ যেন ভাবাই যায় না। সব সময় আমার চিন্তা ছিলো সত্যিকারের দোষী ব্যক্তির যেন শাস্তি হয়।
আমার মনে হয়, একজন মনস্তত্ববিদ ঠিক বুঝতে পারবে, আমার মানসিকতা ঠিক কিরকম ছিলো সেই সময়। আর সেই মানসিকতাই কি পরবর্তী কালে আইনকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করতে সাহায্য করেছিল আমাকে। নিজেকে একজন পেশাদার আইনজ্ঞ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরে সহজাত প্রবৃত্তির দিক থেকে যথেষ্ট সন্তুষ্ট হলাম।
কোনো অপরাধ আর সেই অপরাধের শাস্তি সব সময় আমাকে মুগ্ধ করতো। সব রকমের গোয়েন্দা ও থ্রীলার গল্প পড়ে আমি উপভোগ করি। অবসর সময়ে নিজের ঘরে বসে একা একা বিচিত্র সব খুনের পরিকল্পনা করতাম।
তারপর যখন আদালতের আইন কার্যকর করার মহান দায়িত্ব আমার ওপর ন্যস্ত হলো, তখন আমার মনের সেই সুপ্ত পাশব প্রবৃত্তির আরো বেশী করে চরিতার্থ করার প্রেরণা পেলাম। বেচারা অপরাধী আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মৃত্যু ভয়ে কাঁপছে, বিচারকের মুখ থেকে তার আসন্ন মৃত্যুর পরোয়ানা শোনার জন্য বিচারকের মুখের দিকে গভীর আগ্রহ নিয়ে প্রতীক্ষা করে থাকার দৃশ্যটা দেখে আমি খুব মজা পেতাম। তবে মনে রাখবেন নিরপরাধ কোনো ব্যক্তিকে আসামীর কাঠগড়ায় দেখলে আমি কখনোই খুশী হতে পারতাম না। অন্তত এ ধরনের দুটি মামলার শুনানী মুলতুবি রেখে জুরিদের আমি বলেছি, আজ কোনো কেস নেই। যাই হোক, পুলিশের সততা এবং দক্ষতার জন্য আমি তাদের ধন্যবাদ জানাই বেশীর ভাগ অপরাধী যাদের বিচারের জন্য আমার সামনে হাজির করা হতো, তারা সবাই দোষী সাব্যস্ত হয়।
এই রকমই একটা কে ছিলো এডওয়ার্ড সিটনের। লোকটার সুন্দর চেহারা এবং সুন্দর ভদ্র আচরণ জুরিদের ভুল পথে চালিত করে এবং প্রভাব ফেলে তাদের মনে। কিন্তু কেবল মাত্র সাক্ষ্য প্রমাণেই নয়, অপরাধ জগতে আমার দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, লোকটা সত্যি সত্যি অপরাধ করেছে, খুনী না হয়ে যেতে পারে না সে। তার বিরুদ্ধে আনা খুনের অভিযোগ মিথ্যে নয়, একজন বয়স্ক মহিলাকে খুন করে সে, যিনি বিশ্বাস করতেন তাকে।
ফাঁসুড়ে বিচারক হিসাবে আমার খ্যাতি বা দুর্নাম ছিলো একটা সে যাই হোক, মামলার সব দিক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিচার করে তবেই আমি আমার শেষ রায় জানালাম, আমার বিচার ছিলো অত্যন্ত কঠোর, কোনো অপরাধীকেই আমি রেহাই দিতাম না। আমাদের অনুভূতিপ্রবণ, উকিল ব্যারিস্টারদের সওয়াল জবাবে জুরিরা যাতে বাধিক্যে কাতর না হয়ে পড়ে, কিংবা আসামী পক্ষের উকিল যাতে তাদের প্রভাবিত করতে না পারে, তার জন্য সব রকম চেষ্টা চালিয়ে যেতাম। এর জন্য আমি তখন প্রকৃত ঘটনা ও সাক্ষ্য প্রমাণের প্রতি জুরিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতাম, তাতে কাজ হতো, ওরা তখন আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠতো, তাদের স্বাভাবিক মতামত ব্যক্ত করতে, অপরাধীর মতামত ব্যক্ত করতো, অপরাধীর সম্পর্কে আইনের সুবিচার করতো।
বেশ কয়েক বছর থেকে নিজের মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করি, নিজের প্রতি আস্থা, নিয়ন্ত্রণ সব যেন হারিয়ে ফেলছিলাম, তখন আমার কেবলি ইচ্ছা হতো, বিচারের প্রহসন ছেড়ে দিয়ে নিজের হাতে আইন তুলে নিতে, নিজের খুশিমত অপরাধীকে শাস্তি দিতে।
আজ আমি অকপটে স্বীকার করছি, আমি চেয়েছিলাম, নিজেই একটা খুন করি। এ যেন নিজেকে প্রকাশ করার জন্য, স্বীকৃতি লাভের জন্য শিল্পীর সেই চিরন্তন চাওয়া, চেস্টা করলে অপরাধ জগতে আমিও একজন শিল্পী হতে পারি। কিন্তু আমার সব জল্পনা কল্পনা অনুমান প্রচণ্ড ভাবে ধাক্কা খেলো আমার বিবেকের কাছে, আমার পেশার কাছে। বিচারকের কি খুনী হওয়া সাজে?
তবু মন মানে না। কেবলি তাগিদ খুন, হা খুন আমাকে করতেই হবে। তার থেকেও বড় কথা হলো, সে খুন যেন সাধারণ না হয়। সে খুন অবশ্যই যেন অদ্ভুত হয় একটু বিচিত্র ধরনের, সাধারণের থেকে একটু আলাদা রকমের। কিন্তু আমার বিবেক আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়, ন্যায়বিচার যেন হয়। নিরপরাধ কেউ যেন অযথা শাস্তি না পায়।
তারপর হঠাৎ, হা হঠাৎই একদিন সেই খুনের পরিকল্পনাটা আমার মাথায় এলো। একজন চিকিৎসের সঙ্গে কথা হচ্ছিল আমার, একজন অনামী ডাক্তার কথায় কথায় বললো সে, এমন এক একটা খুন আছে, কোনো আইনই স্পর্শ করতে পারে না খুনীকে।
তার জানা একটা উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বললেন, হঠাৎ তার এক রোগিনী মারা গেলেন। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হতো তার। নিশ্বাসকার্য স্বাভাবিক করার ওষুধ নাকে শোঁকাতে গিয়ে একটু অবহেলা করার দরুনই এই মৃত্যু। ওষুধ দিয়েছিল এক দম্পতি, তারই দেখাশোনা করতো সেই বৃদ্ধা মহিলাটিকে। বৃদ্ধা মারা যাওয়ায় কিছু টাকা তারা পেয়েছে। কেবল মাত্র এই মোটিভকে কেন্দ্র করে তাদের দোষী হিসাবে চিহ্নিত করা যায় না। হয়তো অভিযোগ উঠতে পারে, ওষুধ শোঁকাতে গিয়ে একটু অবহেলা হয়ে গেছে, তা এমনতো হতেও পারতো তিনি নিজে খুঁকতে গিয়েও। এই অজুহাতেই রেহাই পেয়ে গেলো দম্পতিটি। আইনের ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেলেন তারা।
সেটাই হলো সমস্ত ব্যাপারটার সূত্রপাত। সহসা দেখতে পেলাম, আমার পথ পরিস্কার। আমি তখন বদ্ধপরিকর একটা খুন নয়, এক সঙ্গে অনেক অনেকগুলো খুন। ছেলেবেলায় সেই কবিতাটির কথা আমার মনে পড়ে গেল দশটি কালো নিগার ছেলের কবিতা।
শুরু হলো গোপনে অপরাধীদের সংগ্রহ করা…..
কি ভাবে সংগ্রহ করা হলো, সেই বিস্তারিত বলে অস্থা সময় নষ্ট করবো না। কারোর সঙ্গে দেখা হলে একটা নির্দিষ্ট রুটিন মাফিক কথাবার্তা বলার রেওয়াজ ছিলো আমার। এভাবে একটা বিস্ময়কর ফল পেয়ে গেলাম। নার্সিং হোমে থাকার সময় ডঃ আর্মস্ট্রং এর কেসটা পেয়ে গেলাম। যে নার্সাট আমার দেখাশোনা করতো, তার সঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে সে আমায় খবর দিলো, ডঃ আর্মস্ট্রং ছিলো মাতাল, মদ্যপ। একদিন মাতাল অবস্থায় একজন রুগীকে অপারেশন করতে গিয়ে মেরে ফেলে সে। ব্যস পেয়ে গেলাম আর একজন অপরাধীর নাম।
ক্লাবে একদিন পুরনো মিলিটারির খোশগল্প শুনতে গিয়ে জেনারেল ম্যাকআর্থারের অপরাধ কাহিনী শুনলাম। সম্প্রতি আমাজন ফেরত একজন নোক লম্বার্ডের অপরাধ কাহিনী শোনাল। ম্যাজোরকায় এক রাগী মেমসাহেবের মুখ থেকে পিউরিটান এমিলির কাহিনী শুনলাম। আর আন্টনি মার্স্টান হলো আমার নিজের আবিস্কার, যেমন করে আর পাঁচজন অপরাধীকে খুঁজে বার করা হয়। জীবন সম্পর্কে তার কোনো দায়িত্ববোধ ছিলো না, সে ছিলো সম্পূর্ণ অপদার্থ। এ ধরনের লোককে আমি সমাজে অত্যন্ত বিপজ্জনক বলে মনে করি, এর বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। প্রাক্তন ইন্সপেক্টর ব্লোর স্বাভাবিকভাবেই এসে যায় আমার অন্বেষণ পথে। ল্যান্ডর কেসের মামলার ব্যাপারে আইনের পেশায় নিযুক্ত আমার কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে আলোচনার ফাঁকে ব্লোর-এর নামটা ওঠে। পুলিশ হচ্ছে আইন ও শৃঙ্খলার বাহক, পেশাগত মর্যাদায় পুলিশের কথাই শেষ কথা এবং সত্য বলে ধরে নেওয়া হবে। কিন্তু পুলিশের লোক হয়েও ব্লোর ছিলো মিথ্যা ভাষণের প্রতিভূ। তাকে ক্ষমা করা যায় না।
অবশেষে পাওয়া গেলোলা ভেরা ক্লেথনের কেস। আমি তখন আটলান্টিক পাড়ি দিচ্ছি। একদিন গভীর রাতে ধূমপান করে আমি ও হুগো হ্যামিল্টন নামে একটি সুদর্শন যুবক বসে আছি। পরিচয় হলো যুবকটির সঙ্গে। যুবকটির জীবন মোটেই সুখের নয়। সে তার দুঃখ ভুলতে মাত্রাতিরিক্ত মদ গিলেছিল। ফলের খুব একটা আশা না করেই শুরু করলাম কথাবার্তা। তার সঙ্গে তার কথা শুনে আমি তো অবাক। এখনো মনে আছে তার সেদিনের সেই কথাগুলো। সে বলেছিলো, আপনি ঠিকই বলেছেন। খুন মানেই বেশীর ভাগ লোকে যা ভাবে ঠিক তা নয়, খাবারে আর্সেনিক মিশিয়ে দেওয়া কিংবা উঁচু পাহাড় থেকে কাউকে ঠেলা মেরে ফেলে দেওয়া। সামনের দিকে ঈষৎ ঝুঁকে পড়ে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আরো সে বলে, আমি একজন নারী খুনীকে চিনি, আমি আপনাকে বলছি? তাকে আমি বেশ ভাল করেই জানি। আরো কি জানেন, এক সময় তাকে পাওয়ার জন্য আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। ঈশ্বর আমাকে সাহায্য করুন। বলছি বড় দুর্ভাগ্যই বটে। জানেন, কম বেশী আমার জন্যই অমন নিষ্ঠুর কাজ সে করেছিল…তবে তাই বলে এই নয় যে, আমি কখনো সে রকম স্বপ্ন দেখেছিলাম নারী মাত্রই শয়তান দানবী পুরোপুরি দানবী একজন চমৎকার, সাদাসিধে হাসিখুশীতে ভরা মেয়েকে আপনি দানবী হিসেবে চিন্তাই করতে পারেন না, পারেন কি? সেই নারী একদিন এক দুধের শিশুকে স্নান করাতে নিয়ে গেলো এবং আমাকে পাওয়ার জন্য তাকে জলে ডুবিয়ে হত্যা করলো একজন নারী যে এমন একটা নিষ্ঠুর কাজ করতে পারে, আপনি চিন্তা করতে পারেন?
আমি তাকে বললাম, আপনি নিশ্চিত, এ কাজ সে করেছে?
হ্যাঁ আমি একেবারে নিশ্চিত, উত্তরে সে দৃঢ়স্বরে বলে কেউ তা ভাবেওনি। কিন্তু আমি জানি ফিরে এসে আমি যখন তার দিকে তাকালাম……সে তখন বুঝে গেছে, আমি তার সব ছলাকলা বুঝে গেছি …….তবে সে কথা উপলব্ধি করতে পারেনি তা হলো সেই নিষ্পাপ শিশুটিকে আমি ভালবাসতাম…..।
তারপর সে আর কিছু বলেনি, তবে যেটুকু সে বলেছিল, তাতেই যথেষ্ট, এ পর্যন্ত যে সব তথ্য সংগ্রহ করেছি আমার পরিকল্পনার রূপরেখা টানা তখন আটকায় কে।
তখন দরকার আমার দশম শিকার। পেলাম তাকে, নাম তার মরিস। কুখ্যাত লোক সে। আফিম কোকেনের ঢালাও, চোরাই ব্যবসা তার। আমার এক বন্ধুর মেয়েকে আফিম কোকেনের নেশায় আসক্ত করে ফেলে সে। মাত্র একুশ বছর বয়সে আত্মহত্যা করে মেয়েটি।
আমার এই পরিকল্পনার ব্যাপারে অন্বেষণ চালানোর সময় ধীরে ধীরে সেটা আমার মনের মধ্যে গেঁথে যায় পাকাপাকি ভাবে। আমার প্ল্যান তখন সম্পূর্ণ। বাস্তবে সেটা রূপায়িত করার আগে গেলাম একদিন হারলে স্ট্রীটে এক ডাক্তারের কাছে চেক আপ করানোর জন্য। আমি তাকে বললাম, আগেই আমার একটা অপারেশন হয়ে গেছে। শুনে সেই ডাক্তার বলে তাহলে আপনার দ্বিতীয়বার অপারেশন অর্থহীন। আমার চিকিৎসক খোলাখুলি ভাবে আমাকে জানিয়ে দিলেন একটা অপ্রিয় সত্য কথা হা, এই রকমই একটা সত্য ভাষণ শুনতে অভ্যস্ত আমি।
আমার সিদ্ধান্তের কথা আমি ডাক্তারকে বলিনি যে, আমার মৃত্যু যেন ধীরে ধীরে বিলম্বিত না হয়, আমি চাই স্বাভাবিক মৃত্যু। না আমার মৃত্যু হওয়া উচিত কোনো এক উত্তেজনা মুহূর্তে। মৃত্যুর আগে আমি বাঁচতে চাই।
এখন আসল কাজ হলো নিগার দ্বীপে অপরাধ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা। সেই দ্বীপটা সংগ্রহ করার কাজে মরিসকে ব্যবহার করা খুবই সহজ ব্যাপার। এ সব ব্যাপারে একজন বিশেষজ্ঞ সে। আমার সাম্ভাব্য যে কজন শিকারের খবর সংগ্রহ করেছিলাম তাদের প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা টেপে ফেললাম। আমার কোনো প্ল্যানই ভেস্তে যায় নি। আমার সব অতিথিরাই আটই আগস্ট এসে হাজির হলো নিগার দ্বীপে। আমিও মিশে গেলাম তাদের দলে।
এখানে আসার আগেই মরিসের সব হিসেব নিকেশ হয়ে গিয়েছিল। পেটের অসুখে ভুগছিল সে। লণ্ডন ত্যাগ করে আসার আগে আমি তাকে একটা ক্যাপসুল দিয়ে বলি, আমার নিজের গ্যাস্টিক পেনে যথেষ্ট উপকার পেয়েছি এই ক্যাপসুল ব্যবহার করে। দ্বিধাহীন চিত্তে যে সেটা গ্রহণ করে নেয়। একটু স্নায়ুবিক রোগাগ্রস্ত লোক সে। লোকটা যে এ ব্যাপারে কোনো নথীপত্র রেখে যেতে পারে, সে রকম ভয় আমার ছিলো না। সে ধরনের লোকই নয় সে।
নিগার দ্বীপে কার বিরুদ্ধে কি রকম মৃত্যুর পরোয়ানা জারি করা হবে, এ নিয়ে আমি বিশেষ চিন্তা ভাবনা করেছিলাম। আমার অতিথিদের অপরাধের তারতম্য বিচার করে আমি ঠিক করে ফেলি, যার অপরাধ সব থেকে কম, তাকে আগে মরে যেতে হবে, কারণ আমি চাই না মৃত্যু ভয়ে অহেতুক বেশী মাথা ঘামাক সে, আর একটা ঠাণ্ডা মাথায় খুনের জন্য আতঙ্কে সিটকে উঠুক সে।
অ্যান্টনি মাস্টার্ন এবং মিসেস রগার্সকে সবার আগে মরতে হলো, একজন সঙ্গে সঙ্গে আর একজন ঘুমের মধ্যে শান্তিতে। মাস্টার্নকে আমি জানি, নৈতিক দায়িত্ববোধ বলতে তার কিছু ছিলো না। যা আমাদের সবারই আছে। মিসেস রগার্স, আমার কোনো সন্দেহ নেই, তার স্বামীর প্ররোচনায় অভিনয় করতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি।
তারা দুজন কি ভাবে মৃত্যুর মুখোমুখি হলো, বিস্তারিত আলোচনা করতে চাই না এখানে। এ কাজ পুলিশের, সহজেই অবিষ্কার করতে পারবে তারা। বাড়ির পোকা মাকড় মারার জন্য অতি সহজেই পটাশিয়াম সায়ানাইড সংগ্রহ করা যায়। সংগ্রহের কিছু অবশিষ্ট ছিলো আমার সঙ্গে। গ্রামাফোনে সেই সব ভয়ঙ্কর উক্তিগুলো উচ্চারিত হওয়ার পর অতিথিদের মনে যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়, সেই ফাঁকে প্রায় একটা খালি গ্লাসে একটু পটাসিয়াম সায়ানাইড ফেলে রাখি।
সেই সময় আমি আমার প্রতিটি মুখের দিকে তাকিয়ে নিরীক্ষণ করেছিলাম। এবং আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে আমার কোনো সন্দেহ ছিলো না, প্রত্যেকেই অপরাধী।
ইদানীং আমার মাথার যন্ত্রণার দরুণ ঘুমের ওষুধ ক্লোরাল হাইড্রেট খেতে হতো আমাকে, আর সেই ট্যাবলেট আমার কাছেই ছিল। রগার্স যখন তার অসুস্থ স্ত্রীর জন্য ব্র্যান্ডি নিয়ে এসে টেবিলের ওপর রাখে। সেখান দিয়ে যেতে গিয়ে ব্র্যান্ডির গ্লাসে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিই, তাতেই কাজ হয়ে গেলো। রগার্সের স্ত্রীর ঘুম আর ভাঙলো না। ব্যাপারটা খুব সহজেই মিটে গেলো, সেই সময় কারোর মনে কোনো রকম সন্দেহই জাগলো না।
নিঃশব্দে মৃত্যু এসে বললো জেনারেল ম্যাকআর্থারকে এবার তোমার পালা। না, কোনো জ্বালা যন্ত্রণা ছিলো না সেই মৃত্যুতে। তবে টেরেস ছেড়ে চলে যাওয়ার সময়টা খুব সাবধানে বেছে নিতে হয়েছিল আমাকে, কিন্তু সব কিছুই সফল হয়েছিল।
আমার অনুমান মতো খুনীর সন্ধানে সারাটা দ্বীপ তন্ন তন্ন করে খোঁজা হলো, এবং আবিষ্কার করা হলো, আমরা সাতজন ছাড়া অন্য আর কেউ ছিলো না। সঙ্গে সঙ্গে একটা সন্দেহের আবহাওয়া সৃষ্টি হলো নিগার দ্বীপে। আমার প্ল্যান মাফিক তখন আমার একজন সহকারীর প্রয়োজন হয়ে পড়লো। ডঃ আর্মস্ট্রংকেই বেছে নিলাম। ফাঁদে পড়ার মতো লোকই বটে সে। আমার নাম যশ এবং একবার চোখের দেখায় আমার চিনতো সে। আমার মতো লোক যে খুনী হতে পারে সেটা ছিলো তার ধারণার অতীত। তার সব সন্দেহ গিয়ে পড়েছিল লম্বার্ডের ওপর। এবং তার এরকম একটা ধারণার প্রতি আমার যে সমর্থন ছিলো সেই রকম ভান করতে থাকি। আমি তাকে আভাষে জানালাম, খুনীকে হাতেনাতে ধরার একটা মতলব আমার মাথায় এসেছে।
প্রত্যেকের ঘরে তল্লাসি চালানো হলেও তাদের কারোরই দেহ তল্লাসি হয়নি তখনো পর্যন্ত।
দশই আগস্ট সকালে খুন করলাম রগার্সকে। উনুন জ্বালাবার কাঠ কাঠছিলো সে তখন পিছন ফিরে, তাই সেখানে আমার উপস্থিতি একেবারেই টের পায়নি, তার পকেটে খাবার ঘরের চাবির সন্ধান পেলাম।
রগার্সের দেখা না পেয়ে বিভ্রান্ত সবাই তার খোঁজে বেরিয়ে পড়তেই সেই সুযোগে অতি সন্তপণে লম্বার্ডের ঘরে ঢুকে তার রিভলবারটা হস্তগত করলাম। তার কাছে সেটা যে থাকার কথা আমি জানতাম। সত্যি কথা বলতে কি মরিসের সঙ্গে তার সাক্ষাতকারের সময় সে যেন এ ব্যাপারে সেরকম পরামর্শই দেয় তাকে।
ব্রেকফাস্টের সময় মিস্ ব্লেন্টের কফির কাপে কফি ঢালতে গিয়ে ঘুমের ওষুধ ক্লোরালের শেষ ডোজটুকু মিশিয়ে দিলাম। খাবারঘরে তাকে রেখে আমরা বেরিয়ে এলাম। একটু পরেই সেখানে ফিরে গেলাম সে তখন প্রায় অচৈতন্য, এর ফলে তাকে সায়ানাইড ইনজেকশন দেওয়াটা খুব সহজ হয়ে গেলো। মৌমাছি ওড়ানোর ব্যাপারটা নিছক একটা ছেলেমানুষী ছাড়া আর কিছু নয়। তবু আগেই বলেছি, ছেলেবেলায় পড়া সেই কবিতা দেখছেন না খুনগুলো আগাগোড়া কেমন কবিতার ছন্দ ও নিয়ম মেনে হয়ে আসছে। তা এক্ষেত্রেই বা তার ব্যতিক্রম হতে যাবে কেন?
ঠিক এর পরেই, কি ঘটবে আমি আগেই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম। আমি নিজেই সেরকম একটা প্রস্তাব দিয়েছিলাম, আমরা সবাই কঠোর অনুসন্ধান চালানোর কথা বললাম। আগেই আমি সেই রিভলবারটা লুকিয়ে রেখেছিলাম নিরাপদ জায়গায়। সায়ানাইড কিংবা ঘুমের ওষুধ কোনো কিছুই আমার কাছে আর ছিলো না।
এরপর আমি নিজে উদ্যোগ নিয়ে বলালম আর্মস্ট্রংকে, এখুনি আমরা আমাদের মতলবটা কার্যকর করতে চাই। ব্যাপারটা খুবই সহজ, আমি নিজেই হবো পরবর্তী শিকার। সম্ভবত তাতে খুনীর ওপর নজর রাখবো।
আর্মস্ট্রং খুব আগ্রহ দেখালো আমার সেই মতলবে। সেদিন সন্ধ্যায় অভিনীত হলো সেই অভিনব নাটক। কপালে সামান্য একটু লাল মাটির প্লাস্টার, একটা লাল পর্দা, এবং উলের একটা পোলো, তাতেই নাটক মঞ্চস্থ হলো। মোমবাতির মৃদু আলো বড় বেশী কাঁপছিল, এবং অনিশ্চিতও বটে, খুব কাছ থেকে যে আমাকে পরীক্ষা করবে, সে হলো ডঃ আর্মস্ট্রং।
অতি নিখুঁত ভাবে কাজটা করে গেলো, মিস্ ক্লেথন তার ঘরের ঝুলন্ত শ্যাওলা দেখে চিৎকার করে বাড়ি মাত করে তুললো, অনেক চিন্তা ভাবনা করে তার ঘরে শ্যাওলা ঝুলিয়ে রেখে এসেছিলাম আগেই। তার চিৎকার শুনেই সবাই দোতলায় তার ঘরের উদ্দেশ্যে ছুটলো। এই সুযোগে রং টং মেখে খুনীর পোজ দিয়ে ফেললাম।
কাল্পনিক মৃত অবস্থায় আমাকে দেখে তাদের মনে যে প্রতিক্রিয়া হলে সেটা ছিলো একান্ত কাম্য। পেশাদার অভিনেতার মতো অভিনয় করলো ডঃ আর্মস্ট্রং। তারা আমাকে ধরাধরি করে নিয়ে গেলো ওপর তলায়। আগেই আর্মস্ট্রং আমাকে পরীক্ষা করে তাদের জানিয়ে দিয়েছিল, আমি মৃত। তারা আমার মৃতদেহ আমার বিছানায় শুইয়ে দিলো। আমার ব্যাপারে কাউকেই চিন্তিত বলে মনে হলো না, তারা নিজেরা সবাই মৃত্যু ভয়ে আতঙ্কিত এবং সবাই এ ওর ভয়ে শঙ্কিত। ব্যবস্থা মতো রাত সোয়া দুটোর সময় আমি ও আর্মস্ট্রং মিলিত হলাম বাড়ির বাইরে। আমি তাকে কাছেই একটা পাহাড় চূড়ায় নিয়ে গেলাম। আমি তাকে বললাম, কেউ বাড়িতে প্রবেশ করলে আমরা এখান থেকে স্পষ্ট দেখতে পাবো, তবে বাড়ি থেকে কেউ আমাদের দেখতেও পাবে না। তবু তা সত্বেও স্মরণ করিয়ে দিতে হবে তাকে, ছেলেবেলার সেই কবিতাটা যদি সে মনে রেখে থাকে। সিন্ধু পাখী হজম করলো একজনকে…..।
ব্যাপারটা ছিলো খুব সহজ। পাহাড়ের চূড়ার ধারে গিয়ে হঠাৎ আমি চিৎকার করে উঠে তাকাতে বললাম তাকে ঐ দেখ, ওটা একটা গুহা না? সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকে পড়লো সে। কাজটা দ্রুত সারাতে হলো। ভয়ঙ্কর একটা ধাক্কা দিলাম তাকে, সঙ্গে সঙ্গে ভারসাম্য হারিয়ে ফেললো সে এবং নিমেষে পাহাড়ের চূড়া থেকে তার ভারি দেহটা পড়লো নিচে। বাড়ি ফিরে এলাম। আমার শব্দ নিশ্চয়ই শুনে থাকবে ব্লোর। আর্মস্ট্রং এর ঘরে ফিরে আসার কয়েক মিনিট পরে আবার ফিরে চললাম, তার আগে বেশ কয়েবার পায়ের শব্দ করলাম যাতে কেউ না কেউ শুনতে পায়। সিঁড়িতে নামার পথে দরজা খোলার শব্দ হলো। সামনের দরজা দিয়ে বাড়ির বাইরে যাওয়ার সময় পিছন থেকে তারা নিশ্চয়ই অন্ধকারে আমার ছায়ামূর্তিটা দেখে থাকবে আমাকে আর্মস্ট্রং ভেবে।
তারা আমাকে অনুসরণ করছে দেখে তখন দেওয়াল ঘেঁষে পা টিপে টিপে বাড়ির পিছন দিকে এসে সাবধানে পাঁচিল টপকে খাবার ঘরের কাছে এলাম। জানালা আগে থেকে খুলে রেখেছিলাম। জানালা বন্ধ করে শার্সির কাঁচ ভেঙ্গে খাবার ঘরে ঢুকে পড়লাম। তারপর ওপরতলায় গিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে যথারীতি আবার আমার বিছানায় শুয়ে পড়লাম মরার মতোন।
অনুমান করে নিলাম তারা আবার তল্লাসি চালাবে সারা বাড়িটায়, তবে আমার মনে হয় না, মৃতদেহগুলো খুব কাছ থেকে পরীক্ষা করে দেখবে। তবে হয়তো নিঃসন্দেহ হওয়ার জন্য তারা মৃতের চাদর সরিয়ে দেখতে চাইবে, চাদরের আড়ালে আর্মস্ট্রং তার দেহটা ঢেকে রেখেছে কি না। আর ঠিক সেই রকমটিই ঘটতে দেখা গেলো।
হ্যাঁ, ভাল কথা, লম্বার্ডের ঘরে রিভলবারটা আবার রেখে দেওয়ার কথাটা বলতে একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম। কারোর হয়তো জানার আগ্রহ হবে, সেটা কোথায় আমি লুকিয়ে রেখেছিলাম। বিস্কুটের টিনে ভর্তি ছিলো ভাড়ার ঘর। একেবারে নিচের একটা বিস্কুটের টিনের ঢাকনা খুলে রেখে দিই রিভলবারটা এবং ঢাকনা লাগিয়ে তাতে অ্যাডহেসিভ টেপ লাগিয়ে দিই।
লাল পর্দাটা লুকিয়ে রাখি ড্রইংরুমের একটা চেয়ারের আবরণের নিচে আর উলের গোলাটা লুকিয়ে রাখি চেয়ারের জর্দা কাটা ছোট একটা গর্তে।
এরপর আমার ছকে বাঁধা পরিকল্পনা মাফিক দেখলাম তারা তিনজনে প্রত্যেকে প্রত্যেকের ভয়ে দারুণ ভীত, সবাই সবাইকে সন্দেহ করেছে মনে মনে, কিন্তু কেউ কাউকে অপরাধী সাব্যস্ত করতে পারছে না, প্রমাণের অভাবে। তাদের মধ্যে একজনের হাতে আবার একটা রিভলবার। ঘরের জানালা দিয়ে আমি তাদের লক্ষ্য করলাম। ব্লোর যখন একা এদিক এগিয়ে এলো, আমি তখন একটা বড় সাইজের মার্বেল পাথরের টেবিল ক্লথ হাতে নিয়ে প্রস্তুত হলাম। এবার ওর যাওয়ার পালা, ওর আর বেঁচে থেকে কোনো লাভ নেই। একেবারে জানালার নিচে আসতেই ওকে লক্ষ্য করে মার্বেল পাথরের ঘড়িটা সজোরে নিক্ষেপ করলাম। অব্যর্থ লক্ষ্য, বিদায় নিলো ব্লোর, চির দিনের মতো…।
তারপর আমার জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থেকেই দেখলাম, লম্বার্ডকে গুলি করলো ভেরা ক্লেথ, দক্ষ, তৎপর এবং দুঃসাহসী যুবতী। লম্বার্ড ও ক্লেথর্নকে একসঙ্গে দুজনকে মেলামেশা করতে দেখে সব সময় আমার মনে হতো, মেয়েটি যেন লম্বার্ডের বেশ মানানসই। তবু সেই অপ্রিয় ঘটনাটা ঘটে যাওয়ার পরই আমার নাট্য মরে শেষ অভিনয়ের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য তৎপর হলাম। মঞ্চ সাজালাম ভেরার ঘরে।
এটা একটা মনস্তাত্বিক পরীক্ষা নিরীক্ষা। অবচেতন মনে ভেরার নিজের অপরাধের জন্য টেনশন ও নাভাসের ফলস্বরুপ হঠাৎ একজনকে গুলি বিদ্ধ করা তার আত্মহননের জন্য সম্মোহিত করার পক্ষে এ দুটি কারণই যথেষ্ট নয় কি? আমার ধারণা এমনটি হওয়া উচিত। এবং হলোও তাই, আমরা অনুমানই ঠিক ওয়ার ড্রোবের পাশে ছায়া ঘন আঁধারের সামনে দাঁড়িয়ে আমার চোখের সামনে ভেরা ক্লেথর্নকে গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়তে দেখলাম।
তখন বাকী রইলো মঞ্চের দৃশ্য। এগিয়ে গেলাম। ভেরার পায়ের তলা থেকে চেয়ারটা সরিয়ে দেওয়াল ঘেঁষে রেখে দিলাম। রিভলবারটার খোঁজ করলাম বাইরে এসে সিঁড়ির একেবারে ওপর ধাপের উপর, সন্ধান পেলাম সেটার। সেখানে রেখে দিয়েছিল ভেরা। রিভলবারের ওপর তার হাতের ছাপ রাখার জন্য সব রকম সর্তকতা অবলম্বন করলাম।
অতঃ কিম।
এই লেখাটা শেষ করবো। লেখাটা বোতলবন্দী করে সীমোহর আঁটতে হবে বোতলের মুখে, এবং তারপর বোতলটা সমুদ্রে নিক্ষেপ করতে হবে।
আমার যতদূর ধারণা নিগার দ্বীপের রহস্যের সমাধান কখনো হবে না, রহস্যই থেকে যাবে চিরদিনের মতো, অবশ্য আমি জানি, পুলিশ আমার থেকেও চালাক, যাইহোক, এই সব খুনের তিনটি কু রয়েছে। একঃ পুলিশ বেশ ভাল করেই জানে, এডওয়ার্ড সিটন অপরাধী। অতএব তারা জানে, কোনো কারণেই দ্বীপের দশজন লোকের মধ্যে একজনও খুনী হতে পারে না এবং এর পরেই ধরে নিতে হয় যে, প্রচলিত মত বিরোধ থাকলেও অথচ যা সত্য তা হলো যুক্তিগ্রাহ্য হিসাবে সেই লোকটিই খুনী। দ্বিতীয় ক্ল নিহীত রয়েছে ছেলেবেলায় সেই কবিতার সপ্তম পংক্তিতে। আর্মস্ট্রং এর মৃত্যুর কারণ জলে ডুবে, সে ছিলো ভাল সাঁতারু, তবে মনে হতে পারে লাল সিন্ধু পাখীর আক্রমণের টাল সামলাতে না পেরে জলে ডুবে তার মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু এটা কি একটা ভোজবাজী বা প্রতারণা নয় কি? হ্যাঁ, সে রকমই একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় তার মৃত্যুর মধ্যে-আর্মস্ট্রং প্রতারিত এবং মৃত্যুর কোলে ঠেলে দেওয়া হয় তাকে। আর এই কুকে কেন্দ্র করেই পুলিশী তদন্ত শুরু করা যেতে পারে। সেই সময় দ্বীপে মাত্র চারজন জীবিত ছিলো, আর সেই চারজনের মধ্যে একমাত্র আমিই সেই সম্ভাব্য ব্যক্তি যে কিনা আস্থার সঙ্গে তাকে গভীরে অশান্ত সমুদ্রে সাঁতার কাটার জন্য অনুপ্রাণিত করে থাকতে পারে। আর তৃতীয় সূত্রটা নিছকই সাংকেতিক। আমার কপালে মৃত্যুর পরওয়ানা আঁকা ছিলো। বুলেটের চিহ্ন। আমার কাল্পনিক চিহ্ন। আমার কাল্পনিক মৃত্যুটা কতটা বিশ্বাসযোগ্য পুলিশ একটু ভাল করে তদন্ত করলেই হয়তো প্রকৃত সত্য উদঘাটন করতে পারবে।
আমার মনে হয়, আরো একটু বলার আছে।
বোতলবন্দী আমার এই স্বীকারোক্তিটা সমুদ্রে নিক্ষেপ করার পর ফিরে যাবো আমার ঘরে এবং বিছানায় বিছিয়ে দেবো আমার দেহটা। আমরা চশমার ফ্রেমে সরু কালো ইল্যাস্টিক সুতো লাগানো থাকবে। সেই চশমার ওপর আমার দেহের সম্পূর্ণ ভার পড়ে থাকবে। সুতোর এক প্রান্ত দরজার হাতলে করে জড়িয়ে রাখবো রিভলবারে। এতে কি ঘটবে আমি কি ভাবছি জানেন।
রুমালে হাত জড়িয়ে নিয়ে আমি আমার কপালে তাক করে রিভলবারের ট্রিগার টিপবো। হাতটা আমার দেহের পাশে এলিয়ে পড়বে। ইল্যাস্টিকের পাশে এলিয়ে পড়বে। ইল্যাস্টিকের সুতোয় টান পড়বে, এর ফলে সুতোয় বেঁধে রাখা রিভলবারটা ছিটকে গিয়ে দরজার হাতলে আছড়ে পড়বে এবং সঙ্গে সঙ্গে সুতো বন্ধন মুক্ত হয়ে ছিটকে পড়ে যাবে। ইল্যাস্টিক সুতোটা তখন রিভলবার মুক্ত হয়ে নিরীহ হয়ে ঝুলতে থাকবে আমার চশমার ফ্রেমে। আর রুমালটা পড়ে থাকবে ঘরের মেঝের ওপর, কোনো মন্তব্য ব্যতিরেকেই।
আমার বিছানায় আমি আবিষ্কৃত হবো, আমার সহ শিকারদের মতো আমার মৃত্যুর কারণ নথীভুক্ত হবে কপালে গুলিবিদ্ধ হয়ে। আমার মৃতদেহ যখন পরীক্ষা করা হবে তখন মৃত্যুর সঠিক সময় নির্ধারিত হবে না।
ঝড় যখন থেমে যাবে তখন ওপারের মূল ভূখণ্ড থেকে নৌকো আসবে। আসবে লোকেরা এই দ্বীপে, এবং তারা আবিষ্কার করবে দশটি মৃতদেহ এবং নিগার দ্বীপের সমাধানের অযোগ্য একটি সমস্যা।
স্বাক্ষর :
লরেন্স ওয়ারগ্রেভ।