শেষ পর্ব
১৫.
লিংলির তৈরি করা ক্রেনিপিউটারে ঝুলিয়ে রাখা মানুষদের একজন একজন করে নামিয়ে তাদের জ্ঞান ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। জ্ঞান ফিরিয়ে আনার আগে খুব সাবধানে তাদের মস্তিষ্ক থেকে বাই ক্রেনিয়াল খুলে নিতে হয়েছিল। কাজটি খুব সহজ ছিল না, সেটি করার সময় দুজন মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে মারা গেছে। প্রায় দশজনের মস্তিষ্কের কম-বেশি ক্ষতি হয়েছে–অন্যেরা বেশ ভালোভাবেই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেছে। ক্রেনিপিউটারে একটা প্রসেসর হিসেবে কাজ করার সময়টুকুর কোনো স্মৃতি তারা মনে করতে পারে না–এক দিক দিয়ে সেটি ভালো। সেই বিভীষিকার স্মৃতি দিয়ে তারা কী করবে?
শহরের অনেক মানুষের রহস্যময়ভাবে হারিয়ে যাওয়া সন্তানদের এখানে খুঁজে পাওয়া গেছে। লিরিনার কথা সত্যি। লিংলির বন্দিশালার মধ্যবয়স্ক মানুষটিও তার মেয়েকে খুঁজে পেয়েছে। আমি আর টিশা আমাদের শহরের লুক আর হুনাকেও খুঁজে পেয়েছি, সত্যি কথা বলতে কি, প্রথমে আমরা তাদের চিনতে পারিনি, মাথায় চুল নেই, বিবর্ণ চেহারা, বিভ্রান্ত দৃষ্টি। হাসপাতালের সারি সারি বিছানায় তারা শুয়ে ছিল, আমাদের দেখে তাদের দৃষ্টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। টিশা অবাক হয়ে বলল, “তোমরা লুক আর হুনা না?”
দুজনেই তখন খুবই দুর্বল, কথা বলার শক্তি নেই, তার মাঝে মাথা নাড়ল। টিশা তাদের হাত ধরে বলল, “তোমাদের আর কোনো ভয় নেই। শুধু তোমরা যে বেঁচে যাবে তাই নয়–আমাদের শহরের সব ডিটিউন করা ছেলেমেয়েও ভালো হয়ে যাবে। তাদেরকে কেমন করে ভালো করা যায় আমরা এখন জানি।”
লুক আর হুনা কোনো কথা বলল না, শুধু তাদের চোখ থেকে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল।
শহরের মানুষজন যখন বিজ্ঞানী লিংলির তৈরি করা ক্রেনিপিউটার দেখতে পেল তখন তারা বিস্ময়ে এবং আতঙ্কে একেবারে হতবাক হয়ে গেল। তাদের শহরে এত ভয়ংকর একটি ঘটনা ঘটছে অথচ তারা কিছু জানে না। এ নিয়ে শহরের মানুষজনের ভেতর তীব্র এক ধরনের অপরাধবোধের জন্ম নিয়েছিল। শহরের মানুষ দাবি করল, বিজ্ঞানী লিংলিকে প্রকাশ্যে সবার সামনে বিচার করে শাস্তি দিতে হবে।
শেষ পর্যন্ত অবশ্যি তাকে বিচার করতে হয়নি কিংবা শাস্তিও দিতে হয়নি। সে নিজেই নিজের শাস্তি দিয়েছিল। তার সেলের ভেতর ছাদ থেকে একটা কার্বন ফাইবার ঝুলিয়ে গলায় ফাঁস নিয়েছিল। সূক্ষ্ম ফাইবার তার গলার চামড়া কেটে বসে যে বীভৎস দৃশ্য তৈরি করেছিল, তার সাথে হয়তো তার নিজের তৈরি ক্রেনিপিউটারেরই শুধু মিল খুঁজে পাওয়া সম্ভব। আত্মহত্যা করার আগে আমি আর টিশা একবার তার সাথে কথা বলতে গিয়েছিলাম, সে খুব স্বাভাবিকভাবে আমাদের সাথে কথা বলেছে, ক্রেনিপিউটারের জন্য তার মনে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ক্রেনিপিউটারে মানুষগুলোকে কেন কার্বন ফাইবার দিয়ে শূন্যে ঝুলিয়ে রেখেছিল। সে খুবই স্বাভাবিক গলায় বলেছিল, অল্প জায়গায় অনেক মানুষকে রাখার সেটা সবচেয়ে সহজ উপায়। ঝুলে থাকে বলে চারদিক থেকে আলো বাতাস পায় এবং দেহটি সুস্থ থাকে, বিছানায় শুয়ে থেকে থেকে চামড়ায় পচন ধরে না। তার কথা শুনে আমি আর টিশা হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম।
আমাদের শহরের মানুষেরা আমাকে আর টিশাকে ডেকে পাঠিয়েছিল। সবকিছু শুনে তারা আমাদেরকে সেই শহরের কমান্ড্যান্টের দায়িত্ব দিতে চায়। আমরা রাজী হইনি, শুধু মাত্র ডিটিউন করা ছেলে মেয়েগুলোকে ঠিক করে দেয়ার জন্যে একটা নিউট্রাল টিউব পাঠিয়ে দিয়েছি। কুনিল ঠিক হয়ে তার মায়ের সাথে কথা বলছে, ব্যাপারটা চিন্তা করেই আমরা এক ধরনের আনন্দ পাই।
লিংলিকে ধরিয়ে দিয়ে ক্রেনিপিউটার ধ্বংস করার জন্য এই শহরের মানুষেরা আমাকে আর টিশাকে গভীর এক ধরনের ভালোবাসা দিয়ে গ্রহণ করেছিল। কমবয়সী ছেলেমেয়েদের সাথে পার্কে পানির ধারে বসে আমরা অনেক গল্প-গুজব করে নেচে গান গেয়ে সময় কাটিয়েছি। ঠিক কী কারণ জানা নেই কিন্তু এত আনন্দে থাকার পরও আমার আর টিশার ভেতরে এক ধরনের অস্থিরতার জন্ম নিল। অস্থিরতাটুকু আরো বেড়ে গেল যখন মায়ী মায়ীর দস্যুদল শহরটিতে হানা দিল।
তবে দস্যুদলের এই আক্রমণটুকু ছিল খুবই বিস্ময়কর, কারণ দস্যুদলের নেতা এখন আর মায়ী মায়ী নয়–দস্যুদলের নতুন নেতা আমাদের রিয়ানা! এই দস্যুদল এখন শহরে শহরে আক্রমণ করে লুটপাট করে না, কাছাকাছি সবাই মিলে কনসার্টের আয়োজন করে, সবাইকে গান শোনায়। তাদের মূল গায়ক হচ্ছে মায়ী মায়ী। নেচে কুদে সে যখন গান গায় দৃশ্যটি দেখার মত। এরকম একটা বিচিত্র পরিবর্তন কীভাবে সম্ভব আমি আর টিশা রিয়ানাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। রিয়ানা বলেছে তার মূলে ছিল আমাদের দিয়ে আসা নিউট্রাল ক্রেনিয়াল টিউবটি! সেটা দিয়ে সে একজন একজন দস্যুকে ভালো মানুষে তৈরি করে নিয়েছে। এখনো তাদের বিশাল অস্ত্রসম্ভার, এখনো তারা দরকার হলে অন্য দস্যুদলের সাথে যুদ্ধ করে, কিন্তু সেটি করা হয় শুধু মাত্র জোর করে তাদের ক্রেনিয়ালে নিউট্রাল টিউব ঢুকিয়ে ভালো মানুষ করে ফেলার জন্য। কী আশ্চর্য!
রিয়ানা আমাদের দুজনকে তাদের দলে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, আমরা বিনয়ের সাথে সেটি প্রত্যাখ্যান করেছি, কিন্তু আমাদের ভেতর অস্থিরতাটুকু আরো বেড়ে গেছে। বিশাল কনসার্ট করে রিয়ানার দল চলে যাবার পর একদিন আমি আর টিশা ঠিক করলাম আমরাও চলে যাব। আমরা ঠিক করেছিলাম যাযাবর হয়ে ঘুরে বেড়াব, সেটাই ছিল আমাদের জীবনের সবচেয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত।
আমাদের কেউ চলে যেতে দিতে চাইছিল না কিন্তু যখন বুঝতে পারল আমরা আসলেই চলে যাব, তখন শহরের মানুষেরা একদিন আমাদের দুজনকে বিদায় দিল।
আমি আর টিশা যখন দরকারি কিছু জিনিসপত্র নিয়ে আমাদের মোটর বাইকে বসেছি তখন হঠাৎ করে লক্ষ করলাম, সোনালি চুলের একটি মেয়ে তার বাইকে করে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মেয়েটিকে আমরা ভালোভাবে চিনি, হাসিখুশি ছটফটে মেয়ে, খুব সুন্দর গান গাইতে পারে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কোথায় যাচ্ছ?”
মেয়েটি মুখের উপর থেকে তার সোনালি চুলগুলো পেছনে সরিয়ে বলল, “তোমাদের সাথে।”
আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, “আমাদের সাথে?”
“হ্যাঁ।” মেয়েটি মাথা নাড়ল, বলল, “আমিও যাযাবর হয়ে যাব।”
“তুমিও যাযাবর হয়ে যাবে?”
মেয়েটি মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। আমি একা না। ঐ তাকিয়ে দেখো।”
আমি পেছনে তাকালাম, দেখলাম, অসংখ্য তরুণ-তরুণী মোটর বাইকে করে আসছে, এরা সবাই আমাদের সাথে যাযাবর হয়ে যেতে চায়!
.
এই কমবয়সী তরুণ-তরুণীগুলোকে নিয়ে আমরা নিজেরা একটা আনন্দময় শহর গড়ে তুলেছি। সবাইকে নিয়ে থাকতে গিয়ে আমরা আবিষ্কার করেছি প্রত্যেকটা ছেলে কিংবা মেয়ে নিজের মতন, মানুষের ভেতরকার এই বৈচিত্র্যটাই মনে হয় মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি। সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য।
ছেলেমেয়েগুলো সবাই আলাদা, কারো সঙ্গে কারো কোনো মিল নেই। শুধু একটা ব্যাপারে সবার মাঝে একটা মিল আছে।
এখানে কারো মাথায় কোনো ক্রেনিয়াল নেই!